অতিমারী যে আমাদের আরও কত কী নতুন নতুন ব্যাপারস্যাপার দেখাবে কে জানে! ক্রিকেট ধারাবিবরণীর একটা চেনা বাক্য ছিল আগে— ঝলমলে দিন, দর্শকভর্তি মাঠ। প্রথমটা থাকলেও গত দু’বছর ধরে ক্রিকেট মাঠের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই— দর্শকভর্তি মাঠ, ব্যাপারটা একেবারে গায়েব হয়ে গেছে, অন্তত ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানে। এখন একটি দর্শক চোখের কোণ দিয়ে দৃষ্টিগোচর হলে বুক থরহরিকম্প। এই রে! কোভিড ধেয়ে এল বুঝি। শান্ত, নিস্তব্ধ মাঠে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। দর্শকদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার চিৎকারও নেই, ব্যর্থ হলে গালিগালাজও নেই। এমনকী ভিডিয়ো গেমেও দর্শকের নকল চিৎকার বসিয়ে দেয়। এখন আমাদের সেটুকুও নেই।
শুধু কি তাই? এ বছর আইপিএল খেলার সময় থাকলাম তো বায়োবাবল-এ। ব্যাপারখানা কী? খুব সহজকথায় বলতে গেলে বাকি পৃথিবী থেকে আলাদা। খানিকটা বিলাসবহুল জেলের মতো। আমরা যে হোটেলে থাকছিলাম, তার একটা দিক প্লেয়ারদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। অর্থাৎ আলাদা ঘর তো বটেই, তার সঙ্গে সংরক্ষিত রেস্তোরাঁ, সুইমিং পুল, জিম— কেবল আমাদের জন্য। যেসব হোটেলকর্মীরা আমাদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরাও বাকি হোটেলের কর্মীদের থেকে আলাদা। তাঁদের বাড়ির লোকেদের থেকে আলাদা। অন্যান্য টিমের প্লেয়ারদের সঙ্গে দেখাও সেই মাঠে। যেদিন যে দলের সঙ্গে খেলা। কিন্তু নতুন শক্তিশালী শত্রু আমাদের। তার রোয়াব কম হবে কেন? এত করেও শেষ রক্ষা হল না। কেকেআর-এই প্রথম কোভিড সংক্রমণ হল। আর করোনার রক্তচক্ষু দেখে আমরা যে যার বাড়ি ফিরলাম। ফিরে অন্তত ১৪ দিন নিভৃতবাসে। বাড়ির শহরে হোটেলঘরে বন্দি।
কষ্টটা কোথায়? আমি ঢাকা শহরে অথচ ঈদের আনন্দে সামিল নই। মাঠে থাকলে এই সব কষ্ট এত বেশি বোধ হয় না। তখন আমি কাজের মধ্যে থাকি, এটাই প্রাপ্তি। এবার তো মন আরওই খারাপ। এক তো আইপিএল বন্ধ হয়ে গেল, আর দুই, কেকেআর যেমন খেলবে ভেবেছিল, তার কিছুই হল না। প্রথম ম্যাচ জেতার পরেও আমরা পিছিয়ে পরেছিলাম। ভেবেছিলাম, পরের চারটে ম্যাচে ফিরে আসবে ফের লড়াইয়ে। কিন্তু মাঝপথে খেলা বন্ধ। আর এরকম মাঝপথে খেলা বন্ধ হয়ে যাওয়াটাও একটা মানসিক ধাক্কা।
তবে মানুষ যে কত রকম পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে, এইরকম বেকায়দায় না পড়লে বুঝতে পারতাম না। কখনও কি ভেবেছিলাম এরকম ভাবে ধীরে ধীরে ক্রিকেটের এক-একটা পালক কেড়ে নেওয়া হবে, কিন্তু তবুও কেবল ক্লিনিক্যালি ক্রিকেট খেলাটা চলতে পারে? কিন্তু হল তো। গত বছর দর্শকশূন্য মাঠ, এ বছর বায়োবাবলে আটকে থেকে নিজেদের প্রস্তুত করা। খেলা শেষে একা মাইক ধরে ইন্টারভিউ দেওয়া, ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলন। সায়েন্স ফিকশনের চেয়ে কম কী! কে বলতে পারে, এর পর কী নতুন ধরন আসতে চলেছে। প্রথমটা ভয় করবে, কিন্তু আবার নিশ্চয়ই নতুন কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেব। নিজেকে হয়তো বলব, এটাই তো এখন জীবন। আমরা হয়তো জুনিয়রদের বলব, আরে! একটা সময় মাঠে ভর্তি দর্শক থাকত, আমরা খেলেছি সেই সময়!
অবশ্য বদলই তো জীবন। আর বদলই কন্সট্যান্ট।