ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • দেওয়ালে ও কার ছায়া?


    রাস্‌কিন বন্ড (Ruskin Bond) (May 22, 2021)
     

    বয়স তখন কত হবে আমার, ২৪-২৫! লিখে তখনও নাম বিশেষ হয়নি। ফ্রিলান্স লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। দেরাদুনে একটা দোকানের উপর দুটো ছোট্ট কামরার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। সাহিত্য-জগতে বিরাট নাম করব, এমন একটা আশা অন্তত আমি করছিলাম তখন। 

    বাড়িওয়ালা (যিনি দোকানের মালিকও ছিলেন) বেশ কিছু বছর ধরেই ইলেকট্রিক বিল না দিয়ে উঠতে পারায় ঘর দুটোতে বিদ্যুৎ ছিল না, কিন্তু এতে আমার কোনও অসুবিধা হয়নি। তখনও দেরাদুনে এত গরম পড়ত না, এবং আমি সিলিং ফ্যান-এর প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি। একটা তেলের বাতিই আমার কাছে যথেষ্ট ছিল, এবং উহা রোম্যান্টিকও বটে। বিখ্যাত সাহিত্যিকরা তো তাঁদের মাস্টারপিসগুলো এমন সব বাতির আলোতেই লিখেছেন, তাই না? একাকী বাতির আলোয় ‘ফাউস্ট’ নিয়ে লড়ে চলেছেন গ্যেটে, ‘সনেটস’ নিয়ে শেক্সপিয়র, ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ নিয়ে দস্তয়েভস্কি (সম্ভবত তাঁর জেলের ঘরে)— এঁদের যেন আমি দেখতে পেতাম। যেমন দেখতে পেতাম, ঘরে বসে, কাঁপা-কাঁপা বাতির আলোয় এমিলি ব্রন্টে লিখে চলেছেন ‘উদারিং হাইটস’ আর বাইরে তাঁর পাদ্রি পিতার সাধের সম্পত্তি, বিস্তীর্ণ জলাভূমির উপর বয়ে চলেছে ঘোর তুষার ঝড় । 

    শুধু এঁরা নন, তেলের বাতির আলোয় বহু জিনিয়াসই নিশ্চয়ই লিখেছেন— প্রেমচন্দ তাঁর গ্রামে, কিটস তাঁর চিলেকোঠায়, পাগলা-গারদে বেচারা জন ক্লেয়ার… আমি অবশ্য কোনও জিনিয়াস ছিলাম না আর পাগলা-গারদে ঢোকারও কোনও ইচ্ছা আমার ছিল না, কিন্তু বাতির আলোয় লেখার আইডিয়াটা আমার বেশ ভাল লেগেছিল। তাই, একটা ভাল তেলের বাতি আর এক বোতল কেরোসিন কিনে ফেললাম। বাতিটাকে একটা পুরনো, বিবর্ণ টেবিলের উপর বসিয়ে (খাওয়া-দাওয়া আমি রাস্তার শেষে একটা ধাবায় সেরে আসতাম), আলোটাকে সুন্দর একটা আভায় নিয়ে এসে, তার আশীর্বাদে আমার প্রথম গল্পটা লিখে ফেললাম। 

    গল্পটার বিষয়বস্তু কী ছিল, সেটা আর মনে নেই, কিন্তু এটা মনে আছে খুব খারাপ হয়নি, এবং আমি কোনও এক রবিবারের পত্রিকায় সেটা বিক্রিও করে দিই।

    ধাবায় রাতের খাবার খেয়ে ফিরে এসে রোজ সন্ধ্যায় আমি বাতিটা জ্বালাতাম, টেবিলে বসতাম এবং একের পর এক গল্প বা প্রবন্ধ লিখে ফেলতাম। লিখি বা না-ই লিখি, বাতিটার আলোটা আমি উপভোগ করতাম; ওই নরম আভাটা বেশ আরামের ছিল আমার কাছে। আলোটা টেবিলের উল্টো দিকের দেওয়ালে আমার ছায়া ফেলত, আর যখনই আমি টেবিল থেকে উঠে ঘরে পায়চারি করতাম (যা আমি লেখার সময় করেই থাকি), আমার ছায়াও উঠে আসত, ঘরের দেওয়ালে পায়চারি করত— যেন নিজস্ব একটা অস্তিত্ব নিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠত।  

    দেরাদুনের সেই বাড়ি

    ছায়াটাকে সব সময়ই একটু লার্জার দ্যান লাইফ দেখাত; বাতিটা আমার ছায়ামূর্তিকে একটু বেশি বড় করে দেখাত। এর কারণ ছিল সম্ভবত বাতিটার কাঁচ, বা বাতিটার অবস্থান। 

    একদিন, একটু বেশিই রাতে, একটা গল্প লেখার মাঝে, হঠাৎ মুখ তুলে তাকাতেই আমি দেখলাম— আমার ছায়ার পাশে আরও একটা ছায়া। 

    অন্য ছায়াটা যার, সে একদম আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। 

    ঘরে তবে অন্য কেউ ছিল যে আমার ঘাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে আমার লেখা পড়ছিল। 

    কাজ করার সময় কেউ খুঁটিয়ে দেখতে থাকলে আমার বিরক্ত লাগে। পরীক্ষার হলেও, প্রবন্ধ বা উত্তর লেখার সময় পাশে সুপারভাইজার এসে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি মোটেই এগোতে পারতাম না; সরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম, যাতে আমি মনোযোগ দিয়ে লেখায় ফিরতে পারি।  

    তাই খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে ঘুরে দেখার চেষ্টা করলাম কে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিল।  

    আমার পিছনে কেউ ছিল না, ঘরে কেউ ছিল না। 

    ভয় পাইনি ঠিকই কিন্তু ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। দেওয়ালে যে ছায়াটা পড়েছিল, আমায় দেখছিল— আমি কি তবে তাকে সম্পূর্ণ কল্পনা করলাম? ফের দেখলাম। কিন্তু ছায়াটাকে আর দেখতে পেলাম না।  

    লেখায় ফিরলাম, কিন্তু অস্বস্তিটা রয়েই গেল। আমি যে ঘরে একা নই, এই ভাবনাটা কিছুতেই থামাতে পারছিলাম না। আর আরও অস্বস্তি লাগছিল যে আমি লিখছি, এই অবস্থায় কেউ আমার পাণ্ডুলিপি পড়ে নিচ্ছে।   

    লেখক কি পাঠক চান না? এতে অভিযোগ জানানোর কী আছে? যদি গোস্ট রাইটার থাকতে পারে, গোস্ট রিডারও থাকুক না।    

    এর পরে আবার মুখ তুলে তাকাতেই দেখি ছায়া উপস্থিত, আমার বসে থাকা অবস্থার যে ছায়াটা পড়েছে, ঠিক তার পাশে দাঁড়িয়ে, নিশ্চল; আমার লেখা পাতাটা খুঁটিয়ে পড়েছে, পড়ছে আমার শব্দগুলোকে, জেনে নিচ্ছে আমার চিন্তার স্রোত। 

    ছায়াটি যে কোনও একজন নারীর, সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। তার চুল এলোমেলো হয়ে ঘাড়ের উপর ফেলা, ছায়ারেখায় স্পষ্ট তার শরীরের মেয়েলি গঠন, পরনে একটা গাউন, যা তার পিছনে মেঝেয় লুটোচ্ছিল। এই সব বিবরণ, ছায়াটাই আমাকে বলল, কিন্তু এর বেশি কিছু নয়।   

    পেনটা রেখে, পাণ্ডুলিপিটা একটা পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দিয়ে বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। অন্ধকারে কোনও ছায়া থাকে না। 

    অন্ধকারে আমার কখনওই অসুবিধে হয় না। আমার দুর্বল দৃষ্টিশক্তির দৌলতে আমি আলোকিত, ঝলমলে ঘরে যা দেখতে পাই, অন্ধকারেও প্রায় তা-ই দেখি। এই কারণেই বাতির আলো আমার পছন্দ। এই আলোটা কখনওই খুব কড়া নয় বা জীবনে নাক গলায় না। আর এর আলোকবৃত্তের বাইরে রয়েছে অন্ধকার; সেই বন্ধুত্বের আঁধার যেখানে ছোট্ট বাদুড়, ভীতু ইঁদুর এবং লাজুক মানুষদের ঘর। 

    কিন্তু বাতি ছায়া তৈরি করে। 

    এর পরের দিন সন্ধেবেলায় যখন লিখতে বসি, আমার একমাত্র পাঠকের ছায়া আশা করেছিলাম। 

    তার উপস্থিতি টের পাওয়ার আগে আমি এক-দু’পাতা লিখে ফেলেছি ততক্ষণে। মুখ তুলে দেওয়ালে তার ছায়া দেখার প্রয়োজন ছিল না, আমি জানতাম, সে এসেছে। ততক্ষণে সারা ঘরে একটা স্পষ্ট সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল— গোলাপের আতরের সুগন্ধ! সে আমার সঙ্গে কথা বলছিল তার পছন্দের ফুলের সৌরভে। 

    কিন্তু আমি তাতে আবেশিত হইনি। আমার গল্প লেখা চালু রাখলাম— ‘টাইম স্টপস অ্যাট শামলি’ (‘শামলিতে সময় থেমে যায়’)— কিছু পৃষ্ঠা লেখা শেষ করলাম, বাতি নেভালাম এবং বিছানায় শুতে চলে গেলাম।  

    আমার অতিথি যে স্পষ্টতই বিরক্ত হয়েছিলেন তা বুঝলাম যখন উপলব্ধি করলাম যখন গোলাপের তীব্র গন্ধটা উবে গেল। তার বদলে আমার ঘর ভরে গেল থেঁতলে যাওয়া গাঁদাফুলের উগ্র গন্ধে। মাথার ওপর অবধি কম্বল টেনে আমি যাবতীয় গন্ধ এবং ছায়াকে সরিয়ে রাখলাম।  

    পরের দিন সকালে আমার পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিল। জানালাটা ছিল আধ-খোলা, হয়তো বা ভোরের হাওয়া পাতাগুলোকে উড়িয়ে মেঝেতে ফেলেছিল। এতে কি আমার অনাহূত আগন্তুকের কোন হাত ছিল? সে তার উপস্থিতি বোঝানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। 

    সারা ঘরময় পাণ্ডুলিপির পাতা ছড়ানো…

    রাতের বদলে দিনে কাজ করতে শুরু করলাম। বাতিটা খুব প্রয়োজন ছাড়া জ্বালাতাম না। ছায়ারা বিশ্রাম নিক। বিশ্রাম নিন আমার অবাস্তব ছায়াময়ী…

    তিনি উপেক্ষা সহ্য করতে পারলেন না।  

    একদিন গভীর রাতে— প্রায় রাত দুটোর সময়, ডাইনিদের জাগার প্রহরে (উইচেস আওয়ার)— আমার ঘুমটা হঠাৎ একটা ভয়ানক চিৎকারে ভেঙে গেল। পুরো ঘরে মহিলাকন্ঠে তীব্র চিৎকার ধাক্কা খেয়ে বেড়াচ্ছিল। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম, প্রায় হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম, কোনও মতে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা বাতিটা জ্বেলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার থেমে গেল; দেওয়ালজুড়ে লুকিয়ে পড়তে থাকল ছায়ারা।     

    প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকল। দুপুররাতে আমার ঘুম ভেঙে যেত ভয়াবহ চিৎকারে, আবার বাতিটা জ্বালিয়ে দিলেই মুহূর্তে থেমে যেত আর্তনাদ। ঘরে আর সুগন্ধ ম-ম করত না, বাতাসে ভাসত পোড়া তেলের এবং পুড়ে যাওয়া কিছু একটা জিনিসের গন্ধ।    

    ঘটনাটার কথা আমি ধাবার মালিক মেলারামকে বললাম। বিজ্ঞভাবে তাঁর তেল-চুকচুকে গোঁফে তাড়ি দিতে-দিতে মেলারাম বললেন, ‘মনে হচ্ছে তোমার বাড়িওয়ালা তোমার কিছু লুকিয়েছে। পাঁচ-ছ’বছর আগে তোমার ফ্ল্যাটে এক মহিলা মারা গিয়েছিলেন। ফ্ল্যাটটায় এক নিঃসন্তান দম্পতি বাস করতেন। ওই মহিলা আর তাঁর চিকিৎসক স্বামী। ঝগড়াঝাঁটি সারাক্ষণ লেগেই থাকত ওঁদের মধ্যে। একদিন রান্নাঘরে খাবার করতে গিয়ে পেট্রোম্যাক্স স্টোভটা ফেটে যায়, মহিলার পোশাকে ফুটন্ত তেল পড়ে এবং তাঁর সারা গায়ে আগুন লেগে যায়। চিৎকার করতে-করতে উনি বারান্দায় ছুটে আসেন, সাহায্যের জন্য চেঁচাতে থাকেন, কিন্তু আমরা যতক্ষণে ওঁকে সাহায্য করতে পারি, ততক্ষণে ওঁর ভয়ানক অবস্থা হয়েছিল।’ 

    ‘ওঁর স্বামী কোথায় ছিলেন?’   

    ‘বাইরে, পেশেন্ট দেখতে গিয়েছিলেন। আমাদের পিছন-পিছন উনি হাসপাতাল পৌঁছোন, কিন্তু মহিলা ততক্ষণে মারা যান। সত্যি বলতে কী, ওঁর শরীর বলতে আর কিছু ছিল না।’  

    ‘তার মানে এটা দুর্ঘটনা ছিল?’ 

    ‘পুলিশ তাই বলে। কিন্তু গুজব শোনা যায়— এই ধরনের ঘটনায় সব সময়েই কানাঘুষো শোনা যায়। ডাক্তার যখন এখানের পাট চুকিয়ে চলে যান এবং দিল্লিতে প্র্যাক্টিস শুরু করেন, গুজব আরও ফুলেফেঁপে ওঠে। উনি অবশ্য আবার বিয়ে করেছিলেন…’   

    ‘সবই অনুমান আসলে,’ আমি বলে উঠি। ‘কিন্তু ঢের হয়েছে, আমি আর ওই মহিলার উপস্থিতি সহ্য করতে পারছি না। ওঁর ছায়াটা যথেষ্ট আসল বলে এমনিতেই মনে হয়, তার ওপর এখন আবার এই চিৎকার! আমি আপাতত স্টেশন হোটেলে গিয়ে উঠছি। তার পর আপনি যদি আমাকে আর একটা ফ্ল্যাট খুঁজতে সাহায্য করেন।’   

    কিন্তু তৎক্ষণাৎ ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়া সম্ভব হল না। আমার নিজের জিনিসপত্র মানে জামা-কাপড় ইত্যাদি দুটো সুটকেসে ধরে যেত, কিন্তু এ-ছাড়াও আমার ছিল এক আলমারি-ভর্তি বই। আমার নোটবুক আর পাণ্ডুলিপির সঙ্গে বইগুলোকেও খুবই যত্ন সহকারে প্যাক করা দরকার ছিল। যার মানে দাঁড়াল আমার ভুতুড়ে ঘরে আরও একটা রাত। 

    সে দিন রাতে যত দেরি করে সম্ভব ঘুমাতে গেলাম, অন্ধকার করে ঘুমাতে গেলাম। সেই রাতটাকে অবশ্য ঠিক অন্ধকার বলা যাবে না, কেননা বারান্দায় জুড়ে উপতে পড়ছিল পূর্ণিমার চাঁদের আলো। ঠিকই করেছিলাম বাতিটা আর জ্বালাব না। অনেক হয়েছে ছায়ার কারবার।

    একটা স্বপ্নে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলাম, এই সময়ে কাঁধে ঠিক সেই নরম হাতের ছোঁয়া পেলাম। এর পর, তার অন্য হাতটাও আমাকে ছুঁল। ভয়ে এবং তার উপস্থিতির উত্তেজনায় আমি কেঁপে উঠলাম। দুটো হাতই আমার বুকের উপর এবং আমার হাতের উপর ঘোরাফেরা করল। কোনওভাবেই হাত দুটোকে বিদেহী বলে মনে হল না। আমি নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকলাম।       

    মেলারামের সহকারী বাচ্চা ছেলেটাকে ভোরবেলায় চা দিয়ে যেতে বলেছিলাম। কোনও আর্তনাদ বা চিৎকার ছাড়া কিছুক্ষণ দিব্যি ঘুম হল সে-রাতে। কিন্তু কোনও এক সময়ে, আমার বাঁ কাঁধে একটা ঠেলা পড়ায় ঘুমটা ভেঙেও গেল। চা নিয়ে আসা ছেলেটা ধাক্কা দিচ্ছে ভেবে ধড়মড় করে উঠে বসে বললাম, ‘কী হল, এত তাড়াতাড়ি কেন এসেছ?’ ততক্ষণে চাঁদের আলো নিভে এসে চারিদিকে শুধু অন্ধকার।  

    জবাব পেলাম না। বরং আরও একটা ঠেলা খেলাম। 

    বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম, ‘এই ছেলেটা, কথা বলছ না কেন? কোনও অসুবিধা হয়েছে নাকি?’

    কোনও উত্তর না পেয়ে আরও একটু উঠে বসতে যাচ্ছি, এই সময়ে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম একটা মানুষের হাত; উষ্ণ, ফোলাফোলা, নরম, আমার হাতে মিশে যেতে চাইছে।    
    ঘুমের ঘোরে তখনও হাতটা চা-ওয়ালা ছেলেটার ভেবে আমি খপ করে হাতটা ধরলাম। আমার অন্য হাতে একটা কব্জি আর একটা লম্বা, আস্তিন-বিহীন হাত অনুভব করতে-করতে যেই না কনুই অবধি পৌঁছেছি, দেখি হাত শেষ! আমি একটা শূন্যে ভেসে থাকা হাত ধরে আছি! 

    আমার অবস্থাটা বুঝুন। হাতটা ছেড়ে দিয়ে, কোনওক্রমে বিছানা থেকে হাঁচড়ে নেমে ছুটে বারান্দায় গেলাম এবং তারস্বরে চিৎকার করে সাহায্য চাইলাম। ততক্ষণে মেলারাম উঠে পড়েছে, এবং সে আর তার ছেলে টর্চ আর একটা পুরনো বন্দুক নিয়ে দৌড়ে এল। কিন্তু ঘরে কেউ ছিল না, কোনও জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়া শরীরের কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চিহ্নমাত্র দেখা গেল না। এর কিছু পরেই আলো ফুটে গেল।      

                                                                         ***

    স্টেশন হোটেলে কিছু রাত কাটানোর পর আমি ওডিওন সিনেমার ঠিক পিছনে একটা উজ্জ্বল, ঝলমলে ফ্ল্যাট পেয়ে গেলাম। সেখানে ইলেক্ট্রিসিটিও ছিল। লম্বা লোডশেডিং সত্ত্বেও (যা আজ অবধি দেরাদুনে চলছে) আমি আর ওই তেলের বাতিটার ভরসায় ছিলাম না। কিন্তু বাতি আমার কাছেই রেখেই দিয়েছিলাম এই ভেবে, যে কখনও যদি বিদ্যুতের বিল দিতে না পারি!

    কিন্তু ওই বাতিটার নরম আলোটা খুবই মিস করতাম। কেন জানিনা আমার মনে হত আমি দিনের আলোয় বা কড়া বৈদ্যুতিক আলোর বদলে ওই বাতির আলোয় অনেক ভাল লিখতাম। বাতিটার আলোটাই যেন আমার লেখার জন্য একটা ঠিকঠাক পরিবেশ তৈরি করত; একটা মেজাজ, একটু জাদুর ছোঁয়া, একটু বিষাদ, একটা তাড়াহীন গতি…

    তাই এক সন্ধ্যায় আমি বাতিটা জ্বেলে ফেললাম, এবং একটা আরামকেদারায় বসে দেওয়াল জুড়ে ছায়ার খেলা দেখতে থাকলাম।  

    কিন্তু দেওয়ালে আমার ছাড়া আর কারও ছায়া দেখা গেল না, আমার পেছনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম না। পুরনো সেই গানের কথায়, ‘আমার প্রতিধ্বনি, আমার ছায়া এবং আমি’… কিন্তু আমরা একে অপরের ঠিক সঙ্গী ছিলাম না। 

    বাতিটা ড্রেসিং টেবিলে রাখা থাকল। শহরের অন্য প্রান্তে এক বন্ধুর বাড়ি ঘুরে আমি দেরি করে বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন। ক্লান্ত ছিলাম তাই কাজ করার আর ইচ্ছে বা শক্তি কোনওটাই ছিল না। বাতিটা জ্বেলেই শুতে চলে যাই। বাইরে, রাস্তায়, কোনও ঘড়িতে রাত বারোটা বাজল। 

    একটা স্বপ্নে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলাম, এই সময়ে কাঁধে ঠিক সেই নরম হাতের ছোঁয়া পেলাম। এর পর, তার অন্য হাতটাও আমাকে ছুঁল। ভয়ে এবং তার উপস্থিতির উত্তেজনায় আমি কেঁপে উঠলাম। দুটো হাতই আমার বুকের উপর এবং আমার হাতের উপর ঘোরাফেরা করল। কোনওভাবেই হাত দুটোকে বিদেহী বলে মনে হল না। আমি নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকলাম।      

    নরম, উষ্ণ, ফোলাফোলা হাতটা আমার গাল ছুঁয়ে গেল। আমি নিজের হাত বাড়িয়ে তার মুখটা ছুঁতে চাইলাম, কিন্তু ছোঁয়ার মতো কিছু ছিল না। অশরীরী মস্তকহীন!

    যখন উঠে বসার চেষ্টা করলাম, তাঁর অন্য হাত বেড়ে উঠতে থাকল, লম্বা হয়ে বেড়ে গিয়ে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে গেল, আর বাতিটা নিভিয়ে দিল।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook