ট্রান্সেন্ডিং দ্য গ্লাস কেস — বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বাংলায় নারী শিল্পীরা এবং লিঙ্গায়িত দেশজ আধুনিকতা’ নামে ডক্টর অপর্ণা রায় বালিগার বইটি শিল্প ইতিহাস এবং নন্দনতত্ত্বে তাঁর ডক্টরাল থিসিসের ভিত্তিতে লেখা, নিছক শিক্ষাবিজ্ঞানের চেয়েও গভীরে রয়েছে এ বইয়ের মূল শিকড়। কলকাতায় পাঠ ভবনের স্কুল পরিবেশে বড় হয়েছেন রায় বালিগা, যেখানে শিক্ষার সঙ্গে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয় শিল্পের উপরে। এই প্রথম বয়সের শিক্ষাপদ্ধতির মধ্যে যে সত্যিকারের ‘কো-এডুকেশন’ বা সমশিক্ষার আবেশ ছিল, তার কথা তিনি বলেন; #মিটু আন্দোলনের বেশ কিছু দশক আগেই এ পরিবেশ বাঙালি সমাজের অন্তর্নিহিত লিঙ্গবৈষম্যের আখর থেকে তরুণদের যথাযথ ভাবে বেরিয়ে আসতে আগ্রহী করে তুলতে সফল হয়েছিল। অপর্ণা নিজে শিল্প-ইতিহাস চর্চার ঐতিহ্যে শোভিত পরিবারের মানুষ; তাঁর মা ডক্টর অর্চনা রায় দীর্ঘদিন ধরে কলকাতার বিড়লা একাডেমি অফ আর্ট অ্যান্ড কালচারের পরিচালিকা, যে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ যাদুঘর এবং গ্যালারি রয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যখন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে শিল্প-ইতিহাসের অধ্যয়ন করতে যান, তিনি জানতে পারেন যে ওই সুপ্রসিদ্ধ কলা সংগ্রহশালাটিতে প্রায় পঞ্চাশ বছর কোনও নারী অধ্যাপনা করেননি— জেন্ডার স্টাডিজের প্রতি তাঁর আগ্রহের জন্ম এ সূত্রেই। এর পরবর্তী দেড় দশক ধরে এই বিশেষ খামতির জায়গাটি নিয়েই তাঁর গবেষণা চলে— যে অক্লান্ত পরিশ্রম ও বিশদ অনুসন্ধানের ফসল এই ‘ট্রান্সেডিং দ্য গ্লাস কেস’।
‘ট্রান্সেন্ডিং দ্য গ্লাস কেস’ দৃশ্যতই একটি নারীবাদী পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিষয়ে তলিয়ে গবেষণা করে। এ গবেষণার বিষয় কেবল বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলায় নারীদের শিল্প চর্চা নয়, উপরন্তু সে-সমাজে নারীদের স্থান, এবং স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যেভাবে হস্তশিল্প এবং নকশার সাহায্যে দেশজ আধুনিকতার পুনরাধিকার করে নেওয়া হয়েছিল, সেই সাংস্কৃতিক আখরে নারীদের পরিবর্তমান ভূমিকা নিয়েও এ বই গভীর ভাবে অনুসন্ধান করে।
বেঙ্গল স্কুলের স্বর্ণযুগে শান্তিনিকেতন সাক্ষী থেকেছে একাধিক নারী শিক্ষিকাদের অধ্যায়নের। বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত কলাভবনে নারীরা অধ্যাপকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন; সুকুমারী দেবী, চিত্রনিভা চৌধুরী (তর্কসাপেক্ষ ভাবে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা চিত্রশিল্পী) থেকে গৌরী ভঞ্জ (নন্দলাল বসুর কন্যা) সবাই তার প্রমাণ। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী প্রতিমা দেবী বিপুলভাবে ছাত্রদের সঙ্গে কাজ করতেন, এবং ওই পরিবেশের আর একজন গুরুত্বপূর্ণ শরিক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি, খ্যাতনামা শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট বোন সুনয়নী দেবী।
অপর্ণা জানাচ্ছেন, ‘সুনয়নী দেবীর শিল্পের সঙ্গে আমার যে পরিচয় হয়েছিল, নারী শিল্পীদের নিয়ে আমার আগ্রহের জন্ম সেখানেই। কলাভবনের ছাত্রজীবনে আমরা ‘সার্চিং লাইনস’ বলে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতাম, সেখানে সুনয়নী দেবীকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখি আমি। এ প্রবন্ধ লেখার সূত্রেই আমার সঙ্গে ওঁর নাতি, বিখ্যাত শিল্প সমালোচক কিশোর চ্যাটার্জীর আলাপ হয়। সুনয়নী দেবীর কাজগুলোকে নথিবদ্ধ করতে উনি আমাকে অশেষ সাহায্য করেছেন।’ বেঙ্গল স্কুলের নারী শিল্পীদের নিয়ে তাঁর এই আগ্রহের উচ্ছ্বাস গিয়ে পৌঁছয় বরোদায় এম এস বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার সময়ে তাঁর কাজেও, যে সময়ে তিনি এ বিষয়ে তাঁর ডক্টরাল থিসিসটি লেখেন। প্রসঙ্গত, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নারী অধ্যাপক ছিলেন।’ সে সময়ের স্মৃতি ঘেঁটে অপর্ণা জানান, ‘একেবারে কোর্সের গঠন থেকে শুরু করে গোটা অভিজ্ঞতা অনেকটাই প্রভাব ফেলেছিল।’
অপর্ণার গবেষণাকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছে দুটি প্রকাশিত বই— তপতী গুহ ঠাকুরতার ‘নিউ ইন্ডিয়ান এস্থেটিক্স’ এবং আর শিবকুমারের ‘কনটেক্সচুয়াল মডার্নিজম’। রায় বালিগার মতে, ‘এই লেখাগুলো আমার ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতটাই পালটে দিয়েছে।’
তাঁর বইতে পাওয়া যায় সাংস্কৃতিক আখরে, বিশেষ করে শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক আখরে (যা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙালি সমাজের, এবং বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের, উপরে সুগভীর প্রভাব ফেলেছিল) ভারতে নারীবাদের বিষয়ে একটি কৌতূহলোদীপ্পক স্ট্রাকচারালিস্ট পরিপ্রেক্ষিত।
রায় বালিগার বক্তব্য, ‘‘ঘরে’ ও ‘বাইরে’ নারীর ভিন্ন স্থান, কর্মশ্রমের লিঙ্গভিত্তিক ভাগ-বাঁটোয়ারা— এ বিষয়গুলোই আমায় গবেষণা করার সম্ভাবনা খুঁজে দিয়েছে।’
নারীবাদী পরিপ্রেক্ষিতের পাশাপাশি, বা হয়তো তারই কারণে, আধুনিকতার স্বরূপ চেনার লক্ষ্যে নব্য রেনেসাঁস, জাতীয়তাবাদী আদর্শ এবং পাশ্চাত্যের নীতিবোধ চাপিয়ে দেওয়ার ফলে বাংলায় যে সংঘর্ষগুলোর উৎপত্তি হয়েছে, সে বিষয়েও বিশদে অনুসন্ধান করে ‘ট্রান্সেন্ডিং দ্য গ্লাস কেস’। আধুনিক বাঙালি আজও এ দ্বিধার সমাধানের সন্ধানে খানিকটা কাবু হয়ে রয়েছে। পাশাপাশি, উপনিবেশিক বা অ-উপনিবেশিক পুরুষ দৃষ্টি (male gaze) নিয়ে লেখা কয়েকটি বিভাগে বেশ কিছু মূল্যবান চিত্রও তুলে ধরতে সক্ষম বইটি। এ বইয়ের একটি কৌতূহলোদীপ্পক বৈশিষ্ট্য আছে। কলাভবনের বিষয়ে লেখা শেষের আগের বিভাগে বহু নারী শিল্পীদের বিষয়ে, এবং তাঁদের কাজ নিয়ে, আলাদা করে বিশদে নানা তথ্য দেওয়া হয়েছে পাঠকের জন্য। এঁদের মধ্যে অনেকেই স্বল্পখ্যাত বা অখ্যাত, তাঁদের বহু কাজ মানুষের দেখা হয়নি। শান্তা দেবী (প্রখ্যাত সম্পাদক ও হিন্দু মহাসভার নেতা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা), গৌরী ভঞ্জ, রানী চন্দ, ইন্দুলেখা ঘোষ, অনুকণা দাশগুপ্ত প্রভৃতি শিল্পীদের কাজ আমরা এ বইতে পাই। রায় বালিগা বলেন, ‘ভাষা খুব প্রভাবশালী একটা সাধনী (tool)। শিল্প নিয়ে লেখায় এক ধরনের গঠনভিত্তিক লিঙ্গবৈষম্য রয়েছে, যার ফলে কিরণ বড়ুয়া বা মণিপুরের মহারাজকুমারী বিনোদিনী দেবীর মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের নামও বাদ পড়ে যায়।’
রায় বালিগার নিজের লেখা নোটের ভাষায়, ‘ট্রান্সেন্ডিং দ্য গ্লাস কেস’ বইটির লক্ষ্য, ‘…স্বদেশি শিল্পধারার যে শৈল্পিক ইতিহাস লেখার পদ্ধতি, তার পুনর্দর্শন ও প্রয়োজনে পুনর্নিমাণ, এবং ভারতীয় শিল্পে নারীবাদী আঙ্গিকের মধ্যবর্ত্তিতা সাধন করা।’ এ লক্ষ্যে বইটি প্রধানত সফল হয়েছে। আধুনিক ভারতের অন্যতম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ধারার যে মূলত পুরুষকেন্দ্রিক ইতিহাস, তার একটি সমান্তরাল ইতিহাসস্থাপন আমরা ‘ট্রান্সেন্ডিং দ্য গ্লাস কেস’ বইতে পাই। দেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের এই পুনর্গঠন বেরিয়ে পড়েছে পুরুষতান্ত্রিকতার কথিত কাচের শো-কেসের গণ্ডি ছাড়িয়ে।
Transcending the Glass Case: The Women Artists of Early 20th Century Bengal and the Gendered Indigenous Modernism
Dr Aparna Roy Baliga
Art & Deal, New Delhi
Rs 2,000/-