হাহাকার আর চিৎকার। ২০২১ সালের রাজধানীর প্রতিবাদের শব্দ এই দুটো। প্রতিবাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যার দরুন স্ত্রী স্বামী কন্যা পুত্র মাতা পিতা বন্ধুস্বজন আত্মীয়, সবাইকে হারাতে হচ্ছে দিল্লির মানুষকে। এ কাহিনি অবশ্যই শুধু দিল্লির নয়, সারা দেশের। তবে দুঃখের এবং রাগের বিষয়, অনেকেরই মৃত্যু কিন্তু কোভিডের কারণে হচ্ছে না, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ হাসপাতালে বেড না পাওয়া আর অক্সিজেন না পাওয়া। পেলে এদের অনেকেরই জীবন রক্ষা করা যেত। তাই প্রতিবাদের কণ্ঠ নয়, প্রতিবাদের কান্না চতুর্দিকে— প্রশাসনের বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক চাপান-উতোরের বিরুদ্ধে। এই প্রতিবাদে গান নেই, শিল্পকলা নেই, আবৃত্তি নেই, রাস্তার কোনও ভাষণ নেই, আছে শুধু রাগের প্রকাশ— টিভি সাংবাদিকদের সামনে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, ধারালো কার্টুনে, এমনকী মিমেও। লেখার মধ্যেও দিল্লির প্রতিবাদের একটাই ভাষা— ক্রোধ। এক রকমই আবহসংগীত, চিতার আগুনের চড়চড়ানি, জানাজার মৌন, ধর্মযাজকের প্রার্থনা।
তবে অন্য এক ধরনের প্রতিবাদ-শিল্প দেখা যাচ্ছে দিল্লির পথেঘাটে, অলিগলিতে। কর্মপ্রতিবাদ। কাজ করে দেখিয়ে প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের একটাই বক্তব্য যে, সরকারে-সরকারে ঝগড়া চলুক, আমরা কাজ করে ওদের দেখাব, আসলে সাধারণ মানুষের জন্য কী করা উচিত। তাই শহরের নানা জায়গায় প্রায় মাটি ফুঁড়ে গজিয়েছে অক্সিজেন লঙ্গর, রাস্তার ধারে রাশি রাশি অক্সিজেন সিলিন্ডার বসানো, করোনার রুগি গাড়ি করে এসে অক্সিজেন নিচ্ছেন। স্বাস্থ্যের দায়িত্ব সরকারের অথবা ফেলো কড়ি মাখো তেল— এই দুই মনোভাবকেই ভুল প্রতিপন্ন করে কিছু স্বার্থহীন মানুষ ডাক্তারি ডিগ্রি ছাড়াই, হাসপাতাল ছাড়াই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন করোনা আক্রান্তদের বাঁচিয়ে রাখতে।
কেউ অক্সিজেনের আয়োজন করছেন, কেউ বাড়িতে রান্না করে রুগিদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসছেন, কেউ দিনরাত ক্লান্তিহীন ভাবে ফোন করে চলেছেন হাসপাতালে, যদি বেড খালি থাকে কোনও মুমূর্ষু রুগীকে খবর দেবেন। এসব প্রতিবাদেই, বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে— আমাদের আর প্রশাসন দরকার নেই, নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেব।
আর এক ধরনের প্রতিবাদও চলছে দিল্লি-গুরগাওঁ-নয়ডার আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটবাড়িগুলোয়, কিন্তু শোনার কেউ নেই। কিশোর বয়েসের কোভিড আক্রান্ত ছেলেমেয়েরা বাড়িতে একা বসে কাঁদছে। ক’দিন আগেও মা বাবা সন্তানদের সুখী পরিবার ছিল, এখন বাবা চলে গেছেন, মা আই সি ইউতে যুঝছেন (সেও উচ্চবিত্ত বলে হাসপাতালে ঠাঁই পেয়েছেন)।
মৃত্যুপুরী হয়ে যাওয়ার আগে দিল্লির সবচেয়ে নিঃসঙ্গ স্থান সম্ভবত ছিল যন্তরমন্তরের কাছের রাস্তাগুলো। এখানেই সারা দেশ থেকে মানুষ আসতেন প্রতিবাদ করতে, তাঁদের নিজস্ব সমস্যা বা দুঃখের কথা জানাতে। সরকারের কাছ থেকে সাড়া বা সান্ত্বনা পাওয়ার আশায় ততটা নয়, যতটা পাঁচজনকে— আক্ষরিক অর্থেই পাঁচজন— নিজের দুঃখের কথা, দাবির কথা, শোনাতে। একলা গলায় কিছু হত না ঠিকই, কিন্তু বহু প্রতিবাদী একত্র হওয়ায় একটা মেজাজ ছিল জায়গাটার।
করোনাময় রাজধানী কোনও কালেই করুণাময় ছিল না, কিন্তু বর্তমান সরকার সমাজকে প্রতিবাদের যথেচ্ছ কারণ দেওয়ার ফলে, দিল্লির অধিবাসীদের মধ্যেও এক ধরনের লড়াকু মনোভাব গড়ে ওঠে। তারও আগে, ২০১২ সালে, কিছু যুবক জ্যোতি সিংকে ধর্ষণ আর খুন করার পর, শহরের লোকেরা রাগে ফেটে পড়ে রাস্তায় নেমেছিল, তখনকার সরকার পুলিশ ব্যারিকেড জলকামান সবই ব্যবহার করার চমৎকার নিদর্শন তৈরি করেছিল, ফলে পরবর্তীতে এসবের পুনর্প্রয়োগে কোনও বাধা আসেনি। তাও বিশেষ করে যন্তরমন্তর এবং মান্ডি হাউজ এলাকায় প্রতিবাদের জন্য জনসাধারণ জমায়েত হতেই থাকে।
সিএএ ও এনআরসির বিরুদ্ধে বিরাট ভিড়, রাস্তা জুড়ে মিছিল, পুলিশের নিজেদের অভ্যাস অনুযায়ী ঠ্যাঙানি আর এলোপাথাড়ি গ্রেফতার, এসব উপেক্ষা করে ঝাঁকে ঝাঁকে টাটকা তরুণ বয়সের (এবং সব লিঙ্গের) ছাত্র নেমে পড়ে রাস্তায়, এগিয়ে দেয় গোলাপফুল, গেয়ে ওঠে ‘দিল্লি পুলিশ কথা বলো, আমাদের সঙ্গে তোমরাও চলো’। মোড়ে মোড়ে ‘হম দেখেঙ্গে’, পথনাটক। শাহিন বাগে যখন ষাটোর্ধ্ব মহিলারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাস্তা অবরোধের, ছবি-আঁকিয়ে ছেলেমেয়েরা বাড়ির দেওয়ালের গায়ে বিশাল ম্যুরাল বানাচ্ছে বিপ্লবের দৃশ্যের, বাসস্টপে গ্রন্থাগার তৈরি হচ্ছে, শ’য়ে শ’য়ে বই আসছে দান হিসেবে, কিছু লোক নীরবে বই পড়ছেন— তখন এসবই হয়ে ওঠে প্রতিবাদ, শিল্পের মাধ্যমে প্রতিবাদ, প্রতিবাদের শিল্প।
কিন্তু প্রথমবার কোভিডের প্রকোপে সব থেমে গেল, সরকার সুযোগ বুঝে শাহিন বাগ সাফ করে দিলেন, লকডাউনে লোকে যাবেই বা কোথায়, প্রতিবাদই বা করবে কী করে। কিন্তু মিছিল থেমে থাকেনি, সে অন্য আকার নিয়েছে, পরিযায়ী শ্রমিকরা পরিবার জিনিসপত্র নিয়ে হেঁটে চলেছেন দিল্লি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে নিজেদের গ্রামে, বিহারে, উত্তর প্রদেশে, পশ্চিমবঙ্গে। তাঁদের পদযাত্রায় শুধু বাঁচার আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু সেও তো প্রতিবাদ, এক-একটা সময় আসে যখন বেঁচে থাকাটাই প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়ায়।
লকডাউন না-হয় শেষ হল, কিন্তু তারপরেই এল দিল্লির সীমান্তে দেখা এখন পর্যন্ত সবেচেয়ে বিপুল প্রতিবাদ, এবং এই প্রতিবাদ কিন্তু মৌন নয়, দুর্বলের নয়। পঞ্জাব থেকে শুরু করে হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, এমনকী আরও সুদূর প্রদেশের কৃষকরাও কাতারে কাতারে জমায়েত হলেন সরকারের নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে তাঁদের মতামত জানাতে। আন্তঃশহর সড়কে মাইলের পর মাইল ধরে তাঁদের অবস্থান, সঙ্গে ট্র্যাক্টর তাঁবু লরি গাড়ি ট্যাঙ্কার, রাস্তার ওপরেই শোওয়ার বসার রান্নার পড়ার ঘর। তাঁরা যাবেন না, যতক্ষণ না তাঁদের দাবি মিটিয়ে নতুন আইন প্রত্যাহার করা হয়। এখানেও অস্তিত্ব দিয়ে প্রতিবাদ, সভা সমিতি আছে, স্লোগান আছে, বক্তৃতা আছে, গান আছে নাচ আছে রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া আড্ডা সব আছে, কিন্তু সবার ওপর আছে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা, যতদিন প্রয়োজন। ছ’মাস হয়ে গেছে দিল্লির সীমান্তে সিঙ্গু থেকে তাঁরা এক চুল নড়েননি, নড়বেনও না। প্রতিবাদী মানুষ জমে জমে গড়ে উঠেছে এক জীবন্ত ভাস্কর্য, সেটাই এখানে শিল্প।
এরপর কী হবে? নটেগাছটি কিন্তু মুড়োয়নি, অন্যান্য শহরের মতো রাজধানীও তাদের মৃতদের ভুলবে না, এই অহেতুক প্রাণ হারানোর লীলা সবাই মনে রাখবে। তখন নতুন করে মানুষের ঢল নামবে রাস্তায়। নতুন কবিতা লেখা হবে, নতুন গান বাঁধা হবে, নতুন গলা শোনা যাবে। হয়তো কোভিড থেকে সেরা ওঠার ফলে কাঁপা কাঁপা থাকবে কণ্ঠস্বর, হয়তো অনেকেই চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়বেন দম নিতে, কিন্তু দু’দণ্ড শান্তি তাঁরা দেবেন না সেই লোকদের, যারা এই দুর্যোগের জন্য দায়ী।