এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে বাঙালিদের মধ্যে ঝড় আসা এবং ঝড়ের আশার একটা আনন্দ জেগে ওঠে। ভরসা রাখি কালবৈশাখীর উপর, ক্ষমাহীন উত্তাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু এই বছরটা একটু আলাদা হয়ে উঠেছে— রাজনীতি এবং অতিমারীর ক্রমাগত আক্রমণে গ্রীষ্মের বৃষ্টি এবং এর সংযুক্ত সব রোম্যান্টিসিজমই কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছে।
এইবারের পয়লা বৈশাখ নিয়ে এসেছে মৃত্যু এবং অবসাদের বিরামহীন মিছিল। কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভ যেন প্রতিহিংসাপরায়ণ। এই ভয়ানক খবরের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা আমার পক্ষে খুবই কঠিন। আমরা একেবারে প্রথম দফায় ফেরত চলে গিয়েছি; ঘরবন্দি, বন্ধুবর্গ বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। দুনিয়া জুড়ে অতিমারীর সঙ্গে যুঝতে হয়তো এখন আমরা একটু বেশি তৈরি। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের উদ্বেগ আরও অনেক বেড়ে গিয়েছে। প্রশ্ন হল, এই অবিরাম প্যারানোইয়া-সৃষ্টিকারী অবস্থার মোকাবিলা করে মানসিক ভাবে সুস্থ থাকার উপায় কী? আমার মনে হয় সকলের একটা ছোট, নিজস্ব পালিয়ে যাওয়ার জায়গা থাকা উচিত। আমার ক্ষেত্রে, এই নিজস্ব এস্কেপ-টা জুগিয়ে দেয়— ফ্যান্টাসি ফিকশন।
ছোটবেলার অনেকটা সময় আমি একা একা, বা আমার দাদু-দিদার সঙ্গে আমাদের দক্ষিণ কলকাতার বিশাল বাড়িতে কাটিয়েছি। সময় কাটানোর জন্য দাদুকে গল্প বলতে বিরক্ত করা আমার প্রিয় কাজ ছিল— এবং এই আবদার তাঁকে রাখতেই হত, হয় দুপুরের ঘুমের আগে, নয়তো রাতে। দাদুর কাছেই আমি প্রথম বাগদাদের খলিফা হারুণ অল-রশিদের কথা শুনি, এবং আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাতের অসামান্য গল্পও তাঁর কাছেই আমার প্রথম শোনা। সেই সময় থেকেই কল্পনার জগৎ নিয়ে আমার অবসেশন শুরু— মনগড়া, মায়াবী জায়গাগুলো, যেখানে মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও পালিয়ে আনন্দ! ওই বয়স থেকেই আমি নিজের খেয়ালে, নিজের মাথার ভিতরে বেঁচে থাকতে শুরু করেছিলাম, হয়তো একটু বেশিই— কী করা যায়, মাথায় তো অ্যাডভেঞ্চার ঠাসা! এই কথাগুলো বলছি, কারণ এখন আমরা সকলেই যেন একটা প্রলয়ের পৃথিবীতে বন্দি হয়ে বাঁচছি।
তাই এই সঙ্কটমুহূর্তে, আরও বেশি করে আমরা কয়েদখানায় একটি খোলা জানলা চাইছি। একটা পালাবার ফাঁক, যার মধ্যে দিয়ে একটা জাদু-দুনিয়ায় উড়ে যেতে পারি। আজ আমি গর্ব করে নিজেকে ‘ফ্যান্টাসি নার্ড’— রূপকথা ও কল্পকাহিনির পোকা হিসাবে পরিচয় দিতে পারি। এই বিস্তৃত সাহিত্যসম্ভারে একটা বিশেষ কাহিনি আমার শৈশবের সঙ্গে আমার প্রাপ্তবয়সের সংযোগ ঘটায়। নীল গাইম্যানের বিশ্ববিখ্যাত গ্রাফিক নভেলের সিরিজ ‘দ্য স্যান্ডম্যান’-এর ষষ্ঠ সংগ্রহ ‘ফেবলস অ্যান্ড রিফ্লেকশন্স’-এর শেষ গল্প ‘রামাদান’-এ আমার সঙ্গে খলিফা হারুণ অল-রশিদ এবং তাঁর জাদুনগরী বাগদাদের আবার দেখা হয়ে যায়।
গাইম্যানের স্বপ্নের নায়ক মর্ফিউস (যাঁকে সিরিজে ‘ড্রিম’ নামেও ডাকা হয়) এবং খলিফা হারুণ একটা চুক্তি করেন। এটা হচ্ছে গল্পের মূল ব্যাপার, কিন্তু গল্পটা জুড়ে আমরা রাজকীয় বাগদাদের আশ্চর্য অলিগলিতে ঘুরে বেড়াই। আমি গাইম্যানের বিশাল ফ্যান, কিন্তু সমান কৃতিত্ব প্রাপ্য শিল্পী পি. ক্রেগ রাসেলের। তাঁর তুলির ছোঁয়ায় গাইম্যানের চমৎকার কাহিনি-নির্মাণ, তাঁর কিছুটা বিচ্ছিন্ন অথচ অবিশ্বাস্যভাবে আকর্ষণীয় লেখার স্টাইল একটা অন্য মাত্রা পায়। গল্পটা একটা স্বপ্নের মতো বয়ে চলে, এবং শেষে মনে হয় যে এটাই বোধহয় গল্পটার আসল মজা। খলিফা হারুণ উপলব্ধি করেন যে স্বপ্নটাকে চিরস্থায়ী করা অসম্ভব। তাঁর স্বপ্নের শহরে ততক্ষণে নৈতিক অবনতি শুরু হয়ে গেছে। তিনি বোঝেন যে এই অসুখটাকে ছড়িয়ে পড়া থেকে আটকানো যাবে না; এবং তাঁর মরিয়া ভাব ও হতাশার যে রূপায়ণ করা হয়েছে, তা খুব সুন্দর, আবার মন ভেঙে দেয়। অনেক ভেবে খলিফা হারুণ এক উপায় বার করেন, এবং এখানেই ড্রিম-এর সঙ্গে তাঁর চুক্তির শর্ত আমরা জানতে পারি। স্বপ্নের রাজাকে হারুণ অনুরোধ করেন তাঁর প্রিয় নগরীকে তার রাজকীয় মহিমায় চিরতরে সাজিয়ে রেখে দিতে— যার মানে অতুলনীয় বাগদাদের অস্তিত্ব থেকে যায় শুধুমাত্র স্বপ্নের রাজ্যেই। খলিফার এই ইচ্ছাপূরণের পরেই দেখা যায়, ছেঁড়া, মলিন একটা কাপড়ের উপরে ঘুম ভেঙে ওঠা এক পথবাসীকে; যে-কাপড় একদিন ম্যাজিক কার্পেট বা উড়ন্ত গালিচা ছিল।
গল্পের শেষ পাতায় দেখা যায়, একটা বাচ্চা ছেলে এক মুদ্রার বিনিময়ে মায়াবী বাগদাদ নগরী সম্পর্কে লেখা একটা গল্প কিনছে। এই শেষ ছবিটা আমাকে প্রতিবার, অনিবার্য ভাবে, আমার দাদুর কাছে গল্প শোনার সময়টায় ফেরত নিয়ে যায়।
ফ্যান্টাসি-ধারায় নীল গাইম্যান সত্যিই রাজত্ব করছেন বহুদিন। ওঁর লেখায় আমি আমার অনেক চেনা ভাবনার দেখা পাই, আবার ওঁর লেখায় আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারি কোনও অপরাধবোধ ছাড়াই, প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও, বা বলা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক বলেই। তবে ওঁর লেখা সব বয়সের জন্য। ওঁর লেখার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসাবে আমি তুলে ধরব ‘স্যান্ডম্যান’-কেই, কিন্তু ওঁর নভেল ‘আমেরিকান গডস’-কেও সুপারিশ করব। এই উপন্যাসে পৃথিবীটাকে একটা কাল্পনিক আতশকাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখা হলেও, বাস্তবের সঙ্গে এর সংযোগ গভীর এবং মর্মস্পর্শী।
এই ভয়ানক সময়ে, মন ভাল করা স্বপ্ন দেখার অভ্যাস একইসঙ্গে একটা বর এবং অভিশাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু স্বপ্নটা একেবারে না-দেখার চেয়ে, আমার কাছে দেখাটাই আসল, তার জন্য যদি দাম দিতে হয়, তবুও। একদম হারুণ অল-রশিদের মতোই।