আশির দশকের প্রথম দিক। তখন ম্যাক্সমুলার ভবনে থিয়েটার করি, নাচ করি। অঞ্জন ও ছন্দা দত্ত-ও থিয়েটার করে ম্যাক্সমুলার-এ। ক্যান্টিনও চালায়। অঞ্জন ততদিনে মৃণাল সেনের ছবি ‘চালচিত্র’ এবং ‘খারিজ’ করে ফেলেছে। ‘খারিজ’ মুক্তির পথে। এই সময় আমাদের সবার মধ্যেই ছিল একটা সুপ্ত বাসনা, যদি কোনও পরিচালকের নজরে পড়ে যাই! মঞ্চাভিনয়ের মাধ্যমে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়, যাঁরা সাংস্কৃতিক জগতের ধারক-বাহক। ১৯৮২ সালে সেই সুবাদে আমন্ত্রণ পাই কলকাতায় অনুষ্ঠিত ফিল্মোৎসবে। তখনও এম.এ পড়ছি। থিয়েটার, গান, রাজনীতি, সিনেমা, সাহিত্য নিয়ে কফির পেয়ালায় ঝড় তুলছি। মৃণাল সেন ও সত্যজিৎ রায় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। তাঁদের চাক্ষুষ করার ইচ্ছে মনে মনে। সুযোগও এসে গেল এই কলকাতা ফিল্মোৎসবে। এম এস সথ্যু-র ছবি ‘বারা’ দেখানো হবে, আমার পরিচিত এক সরকারি আমলার দৌলতে পাস পেয়েছি। তিনিই বলেছেন ইনফরমেশন সেন্টারে আসতে, ঠিক বিকেল চারটেয়। নিয়ে যাবেন চ্যাপলিনে ছবি দেখতে। সঙ্গে থাকবেন সথ্যু সাহেব নিজে। ওঁর তৈরি ‘গরম হাওয়া’ দেখে উত্তেজিত হয়ে ছিলাম। তাই ওঁর সঙ্গে দেখা হবে ভেবে কিছু কমেন্ট মনে মনে ঝালিয়ে নিলাম। ইনফরমেশন সেন্টারে পৌঁছে দেখি, সেই আমলা, যিনি একটি তথ্যচিত্রও পরিচালনা করেছিলেন, ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে কী যেন খুঁজছেন। কাছে যেতেই বললেন, ‘ওদিকে অপেক্ষা করো, আমি ব্যস্ত আছি।’ বলেই চলে গেলেন কোথায় যেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি। এই সময় দেখি বেশ কিছু হোমরা-চোমরা মানুষের মধ্যে, তাঁদের সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে আসছেন সত্যজিৎ রায়। কতদিন স্বপ্ন দেখেছি, ওঁকে সামনাসামনি দেখব। ওঁর অধিকাংশ ছবিই দেখেছি। ‘সীমাবদ্ধ’ দেখে খুব মনে হয়েছিল, আমার চেনাজানা জগতের মানুষদের উনি এমন সুন্দর ভাবে দেখালেন কী করে? সামনে থেকে ওঁকে দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আমি। আমার বাইশ বছরের হৃদয় তখন এত জোরে আওয়াজ করছিল যে নিজেরই লজ্জা করছিল, মনে হচ্ছিল কেউ যদি শুনে ফেলে! আমার পরিচিত আমলা ফিরে এলেন, সত্যজিৎ রায়ের দিকে এগিয়ে গেলেন, ওঁর সঙ্গে কথা শুরু হয়ে গেল। আমি যতটা পারি বুকে বল সংগ্রহ করে ওই জটলার মধ্যে ঢুকে গেলাম। আমার পরিচিত তখন সত্যজিৎ রায়কে বোঝাচ্ছেন, গাড়িটা এইখানেই আছে, কেবল চালক উধাও। তখন তো আর মোবাইল ফোন নেই। বুঝলাম সত্যজিৎ রায়কে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব ওঁর। হঠাৎ দেখতে পেলাম ওঁর চালককে। পরিচিত আমলার শার্ট ধরে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। উনি ভাবলেন আমি পরিচালকের সঙ্গে পরিচিত হতে চাই। তাই মুখে একটু বিরক্তি নিয়েই বললেন, ‘এখন নয়’। আমি এবার বলেই ফেললাম, ‘ওই যে তোমার গাড়ির চালক।’ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। বেশ খানিকটা দূরে রাস্তার ওপারে চা খাচ্ছে চালক। আমলা চালকের নাম ধরে ডাকতে গিয়ে থেমে গেলেন। তারপর ‘এই, এই, এই যে…’ বলে ডাকতে থাকলেন। কিন্তু কাকে ডাকছেন, কেউ বুঝতে পারছে না। আমার গলা বেশ জোরদার চিরকাল। আমি আর থাকতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘এই যে মানিকদা, মানিকদা, তাড়াতাড়ি এসো!’ সবাই চুপ। আমার দিকে তাকিয়ে। কী অন্যায় করলাম রে বাবা! চালক আধ-খাওয়া চায়ের ভাঁড় ফেলে দৌড়ে এল। অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য ভেঙে গমগমে গলায় সত্যজিৎবাবু বললেন, ‘ওঃ! এইজন্য ওকে নাম ধরে ডাকতে পারছিলে না? বাঙালি পরিবারে তো মানিকের ছড়াছড়ি।’ সেদিন ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়নি বটে, তবে আমি খুব খুশি ছিলাম ভেবে, বেশি না হলেও একটু তো নজর কেড়েছি।
এরপর এল ১৯৮২ সালের জুলাই মাস। ‘আজকাল’ পত্রিকায় চাকরি। কিছুদিনের মধ্যেই নিউজ ডেস্ক-এর কাজ করতে করতে আমি সাক্ষাৎকার নেওয়া শুরু করি। এবং এই সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে গুরু ছিলেন রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়। তিনি একদিন ঠিক করলেন সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার নেবেন, এবং যেহেতু উনি জানতেন আমার অভিনয় করার সুপ্ত বাসনার কথা, নিয়ে গেলেন আমাকে সঙ্গে করে। ওঁর বাড়িতে তখন লিফট নেই। আমরা হেঁটেই উঠলাম। ল্যান্ডিংয়ের ওপর দুটো দরজা। একটা পেছনের বারান্দার, আর অন্যটি একেবারে বই-ঠাসা বৈঠকখানার। রঞ্জনদা পেছনের দরজায় টোকা দিলেন। দরজা খুললেন বাড়ির কর্মী। রঞ্জনদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৌদি আছেন?’ আমরা বৌদির সঙ্গে দেখা করতে ঢুকলাম। একটি ঘরে বসলাম। যিনি দরজা খুলেছিলেন, তিনি চলে যেতেই আমি রঞ্জনদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বৌদি মানে বিজয়া রায়? আপনি কি ওঁকে ইন্টারভিউ করবেন?’ রঞ্জনদা বললেন, ‘না, ওঁর সাক্ষাৎকার তুমি নেবে… আর আমি সত্যজিৎ রায়ের।’ এরই মধ্যে ঢুকে এলেন বিজয়াদি। অসাধারণ আন্তরিক এক মহিলা। এসেই চা, বাড়িতে তৈরি কচুরি, মিষ্টি আনতে বললেন। এরপর ঘরে ঢুকলেন সত্যজিৎ রায়। কেন জানি না উঠে দাঁড়ালাম, যেন স্কুলে পড়ি। উনি বসতে বললেন ও জানালেন, উনি কাজ করছেন, আধঘণ্টা সময় লাগবে। ততক্ষণ ‘কচুরি খাও, এ-বাড়িতে কচুরি বেশ সুস্বাদু।’ সত্যিই তাই। আর কচুরি, মিষ্টি, চা খেতে খেতে বিজয়াদির সঙ্গে কত গল্প চলল। সত্যজিৎবাবু কী খেতে ভালবাসেন, কেমন খুঁটিনাটি নিয়ে বাড়িতেও চিন্তা করেন। এছাড়া ওঁর রুচির ভূয়সী প্রশংসা করলেন সত্যজিৎ-জায়া। আধঘণ্টা ধরে সাক্ষাৎকার হল স্বামী সত্যজিৎ রায়কে নিয়েই।
এরপর আমরা চলে গেলাম পরিচালকের ঘরে। যেমন ছবিতে দেখা যায়, তেমনই বই-ঠাসা ঘর। চেয়ার-টেবিল বইভর্তি। আমি আর রঞ্জনদা একটা করে মোড়ায় বসলাম। কিছুক্ষণ পরেই সত্যজিৎবাবু ঘরে ঢুকলেন। দুজনে উঠে দাঁড়ালাম। আমার হৃৎপিণ্ড আবার বাজতে শুরু করেছে। উনি বসতে বলামাত্র ভয়ে ভয়ে এবার আমি বসলাম একটা চেয়ারে। রঞ্জনদা তাঁর মোড়ায় বসার সময়ে বোধহয় ভুল করে ভেবেছিলেন চেয়ারে বসছেন। তাই বসতে গিয়ে পড়েই গেলেন। তাতে সত্যজিৎবাবু বললেন, ‘আহা, ওই মোড়ায় বসছ কেন রঞ্জন, ওই চেয়ার থেকে বই সরিয়ে বোসো।’ ইতিমধ্যে আমার বুকের ধড়ফড়ানি কমে গেছে। এত স্বাভাবিক একজন মানুষ, এত নার্ভাস হওয়ার কী আছে? আসলে বিজয়াদির সঙ্গে গল্প করে অনেকটা আশ্বস্ত লাগছিল মানুষটির ব্যাপারে। তবে ওঁর ব্যবহার যতই স্বাভাবিক হোক, উনি কথা বললে কেমন যেন রোমাঞ্চিত লাগছিল, একটু ভয়-ভয়ও করছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, ভাগ্যিস আমি সাক্ষাৎকার নিচ্ছি না, শুধু রঞ্জনদার ছোট টেপ রেকর্ডারটা চালাচ্ছি।
‘হ্যাঁ, বলো কী নিয়ে সাক্ষাৎকার?’
রঞ্জনদা বললেন, ‘আসলে আপনার সাম্প্রতিক ছবিতে স্মিতা পাতিল অভিনয় করেছে…’
‘ওঃ! She is a natural! খুব instinctive অভিনেত্রী।’
এবার রঞ্জনদা হঠাৎ বলে ফেললেন, ‘মানে ‘আকালের সন্ধানে’-র স্মিতা আর…’ শেষ করার আগেই সত্যজিৎ রায় বললেন, ‘ওটা মৃণালের ছবি, ওই ছবিতে স্মিতার মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্নটা মৃণালকেই করা ভাল, আমার ছবি ‘সদ্গতি’, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বলো।’
রঞ্জনদা ভুল বলে ফেলেছেন ভেবে এতটাই ঘাবড়ে গেলেন যে, পরবর্তী প্রশ্নের জন্য নড়েচড়ে বসতে গিয়ে, নোটবই ঠিক করতে গিয়ে, আবার মোড়াটা উল্টে ফেললেন। মাটিতে পড়ে যেতেই সত্যজিৎবাবু উঠে হাত বাড়িয়ে দিলেন, রঞ্জনদা ওঠামাত্র, উনিই বই সরিয়ে চেয়ারে বসতে বললেন। ‘আসলে কী জানো রঞ্জন, মোড়ায় বসার আলাদা আর্ট আছে। তুমি এখনও সেটা রপ্ত করে উঠতে পারোনি। মহিলারা পারে।’