প্রতিবাদ বা আন্দোলনের গানের কথা লিখতে গেলে বিখ্যাত জ্যাজ ট্রাম্পেটবাদক-কম্পোজার-গায়ক লুই আর্মস্ট্রং-এর একটা উক্তি মনে পড়ে যায়: ‘অল মিউজিক ইজ ফোক মিউজিক’, ‘সব সঙ্গীতই লোকসঙ্গীত’। ‘লোক’ ব্যতিরেকে সঙ্গীত সৃষ্টি হয় না। লোকসঙ্গীতের আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রচারিত; তার মিউজিক ভিডিও বড় একটা তৈরি হয় না।
পৃথিবী জুড়ে লোকসঙ্গীতের উৎস নিপীড়িত মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। শোষণ-নির্যাতন-যন্ত্রণার ইতিহাস। আমেরিকায় ব্লুজ মিউজিকের আবির্ভাব হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি। আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের ‘কাজের গান’ (work songs), ভক্তিগান (spirituals), ‘চান্ট’ (chant) বা জপ এবং ব্যালাডস-এর সংমিশ্রণে তৈরি হয়ে ওঠে ব্লুজ। কৃষ্ণাঙ্গ লোককথা-উপকথার মৌখিক ধারায় যে গল্প-আখ্যান চলে এসেছে, তার ভিত্তিতে তৈরি লোকগীতি থেকে উপাদান টেনে সৃষ্টি আমেরিকার এই গান। বন্দি ক্রীতদাসদের গানের কথায় বারবার ফুটে ওঠে নিপীড়নের জীবন থেকে মুক্তিলাভের উদগ্র চেষ্টার এক লৌকিক আধ্যাত্মিকতার দর্শন, যা পরবর্তীকালে কৃষ্ণাঙ্গ চার্চের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়:
I don’t do nobody nothin’, Jesus,
But they hates me just the same,
(O Lordy) I don’t do nobody nothin’, Jesus,
But they hates me just the same.
(আমি কারও ক্ষতি করিনি, প্রভু যিশু,
কিন্তু ওরা আমাকে তবুও ঘৃণা করে
হে প্রভু, আমি কারও ক্ষতি করিনি, যিশু,
তবুও সবাই ঘৃণা করে চলে।)
— ‘আই ডোন্ট ডু নোবডি নাথিং’, প্রচলিত ব্লুজ
তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে, কিছু নির্দিষ্ট সপ্তকের (scale) ব্যবহারে ব্লুজ হয়ে ওঠে অনন্য; মন-খারাপের, মন-কেমনের গানের সমার্থক। প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে মনে রাখা উচিত, সামাজিক অবদমন সত্ত্বেও ব্লুজ ধারার গান তথাকথিত পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীতের সঙ্গে মিশে যায়নি। বরং স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে পরবর্তীকালে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দশকগুলোতে জন্ম দিয়েছিল জ্যাজ ধারার, যা ১৯৫০-এর মধ্যে হয়ে দাঁড়ায় কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবাদ এবং সভ্যতার বিবর্তনের এক নজিরবিহীন সাংস্কৃতিক প্রতীক। সারা পৃথিবীতে এর রেশ টেনে কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবাদের কন্ঠস্বরগুলো ভেসে ওঠে নানা দেশে, বিভিন্ন ফর্মে, ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে— আমেরিকায় হিপ-হপ, জামাইকায় স্কা এবং রেগে; মালি এবং মধ্য-আফ্রিকার কিছু দেশ, যেমন নাইজিরিয়া ও কেনিয়াতে আফ্রো-পপ; পশ্চিম আফ্রিকায় সোউকৌস, সেনেগালে এম্বালাহ। এই সব ফর্মের ভিত আদতে লোকসঙ্গীত।
কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের বহু শতাব্দী আগে ভারতের ইতিহাসে রয়ে গিয়েছে সমাজের প্রান্তিক মানুষের মৌখিক-আখ্যানের ঐতিহ্য। এদেশে ‘প্রতিবাদ’ শব্দটার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে আছে সামাজিক, ধর্মীয় প্রথা; এখনও নিরক্ষর জনজাতি-আদিবাসী-দলিত-নিম্নবর্গের মানুষের জীবনকাহিনির একমাত্র সম্ভার রয়েছে লোকগীতির মধ্যে। এই ‘প্রতিবাদ’ কোনও বিশেষ ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে নয়; দৈনন্দিন জীবনের ছবি তুলে ধরা এইসব গানে এক বৈষম্যপূর্ণ অবস্থার সূক্ষ্ম সমালোচনা থাকে। বাংলায় আজও পট-পালাগান-ঝুমুর-ছৌ-গম্ভীরা, বাউল-ফকিরি, বিস্তীর্ণ উপকূল জুড়ে ভাটিয়ালি লোকগীতিতে বেঁচে আছে এই ঐতিহ্য।
কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের গানের সমান্তরাল ধারায় দেখা যায় জোটচাষি বা শেয়ার-ক্রপারদের ‘কল-অ্যান্ড-রেস্পন্স’, ‘ফিল্ড হলার’ বা ক্ষেতে কথোপকথনের গান, রংপুর এবং গোয়ালপাড়ার দিনমজুরদের ভাওয়াইয়া গান; চা-বাগান, কয়লাখনি এবং মিলের গান, যা তুলে ধরে শহুরে জীবনের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর এক ছবি। শুধু দারিদ্র, শ্রম বা অবসাদের কথা নয়, ফুটে ওঠে পরিযায়ী শ্রমিকের দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যাকুলতা; ভিনদেশে কাজের খোঁজে আসা মজুরের ঘরে ফেরার স্বপ্ন:
‘চল মিনি আসাম যাব,
দ্যাশে বড় দুখ রে,
আসাম দ্যাশে রে মিনি চা-বাগান ভরিয়া,
কুড়ল মারা যেমন তেমন
পাতা তুলা কাম গো,
হায় যদুরাম
ফাঁকি দিয়া পঠাইলি আসাম…’
— ‘চল মিনি আসাম যাব’, উৎস সম্ভাব্য ছোটনাগপুর।
এই গানের স্তবকে-স্তবকে লেখা প্রতিবাদ। ফার্স্ট ফ্লাশ উপভোগ করার প্রয়োজনের মাঝে বাগানের দিনমজুরের দুর্দশা, তাদের অন্ধকার বর্তমান এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের স্থিরচিত্র যেন ঠান্ডাঘরের প্রেক্ষাপটে মাথা কুটে যায়।
আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ছাড়াও, সামাজিক বিভেদের বিরুদ্ধে বাংলার লোকগীতি সোচ্চার হয়েছে বারবার। ‘বাউল-ফকির’— এই বাক্যাংশের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই চারণদলের বিভেদের ঊর্ধ্বে জীবনযাপনের মূলমন্ত্র। বাউল সমাজে কোনও বাউল আসেন হিন্দু পরিবার থেকে, কেউ বা মুসলমান পরিবার থেকে, কিন্তু বাউল-জীবন সাধনের পরিচিতি এই যুগ্ম নামেই। বিশেষজ্ঞ শক্তিনাথ ঝা-এর মতে, ‘যে কোনও বর্ণ, ধর্ম বা লিঙ্গের মানুষ গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে বাউল হতে পারে। এখানে প্রত্যেকের অবারিত অধিকার।’ বাউল-ফকিরদলের আরাধ্য ঈশ্বর দৃষ্ট; যাঁকে চোখে দেখা যায় না, তাঁর উপাসনা বাউল-ফকিরি আধ্যাত্মিকতায় নেই। এই আধ্যাত্মিকতার ধারা ভারতবর্ষে সনাতন হিন্দুধর্মের বিপরীতধর্মী। সনাতন ধর্ম তুলে ধরে পরলোক, পূর্বজন্ম, কর্মফল, কল্পিত ঈশ্বরের মধ্য দিয়ে লিঙ্গভেদ, অর্থনৈতিক বিভেদ, জাত-পাত-বর্ণ সাম্প্রদায়িক বিভেদ; অন্যদিকে সমস্ত বিভেদকেই অস্বীকার করা বাউল-ফকিরি ধারায় দেখা যায় শুধুমাত্র মানুষ নামের এক জাতির উপাসনা।
‘ছুনৎ দিলে হয় মুসলমান
নারী জাতির কি হয় বিধান?
আমি বামুন চিনি পৈতার প্রমাণ
বামনি চিনব কেমনে?
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
সব লোকে কয় লালন কী জাত, এই সংসারে’
— লালন ফকির
ইতিহাস বলে, ষোড়শ শতাব্দী থেকে, শ্রীচৈতন্যের বাংলায় ইহবাদী, দেহবাদী, বর্তমানপন্থী একটা বাস্তবিক আন্দোলনের অগ্রভাগে বাউল-ফকিরেরা দাঁড়িয়েছিলেন। গোঁড়া সনাতন ধর্মের অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাঁদের এই প্রতিবাদের সুর হয়তো কোমল ছিল, কিন্তু বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। বিশ্বাস রয়ে গেছে; ধর্মান্ধ রাজনীতির চোখ-রাঙানিতেও বাংলায় লোকগীতির সাধনা এখনও অটুট।
২০২১-এ কি বাংলায় লোকগীতির চর্চা নিম্নমুখী? না, বরং এর উল্টোটাই সত্যি। শহুরে আমোদের চাহিদা এই ঐতিহ্যময় লোকসংস্কৃতির একটা বড় অংশে ভাগ বসাতে খুবই তৎপর হয়ে উঠেছে। তাহলে এখন, এনআরসি/ সিএএ আন্দোলন, শাহিন বাগ, পার্ক সার্কাস, কৃষক অবরোধের পরিপ্রেক্ষিতে, নতুন, প্রতিবাদী লোকসঙ্গীত উঠে আসছে না কেন? তা খুব প্রকট ভাবে প্রতিবাদী না হোক, অন্তত প্রচ্ছন্ন বিরোধিতা নিয়েও তো তা আমাদের সামনে আসতে পারে? এক-আধটা প্রতিবাদের গান যা-ও বা আনাচে-কানাচে শোনা যাচ্ছে, তা নাগরিক, নগরকেন্দ্রিক গান। মনে রাখতে হবে, বাংলায় গণসঙ্গীতের ঐতিহ্য দীর্ঘ, এবং এই গানের শিকড়ও দৃঢ়ভাবে লোকগীতিতে প্রোথিত। ১৯৪০-এর আইপিটিএ অ্যান্থেম ‘সুনো হিন্দ কে রেহনেওয়ালো’; ১৯৪২-এর বাংলার মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘ভুখা হ্যায় বেঙ্গল’; কেরালায় কায়ূর চাষিদের ফাঁসির প্রতিবাদে লেখা ‘ফিরায়ে দে দে’— প্রতিটি গান লোকগীতির ধারায় লেখা আন্দোলনের গান (যেগুলো এই মুহুর্তে বাঁচিয়ে রেখেছেন শিক্ষাবিদ, গীতিকার ও গায়িকা সুমঙ্গলা দামোদরণ)। এই গানের ঐতিহ্যে, মৌলবাদ বিরোধী, গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলা, অত্যাচারের রাজনীতির সমালোচনা করা লোকসঙ্গীত আজ আমরা বড় একটা শুনতে পাচ্ছি না। গণ-আন্দোলনে গণসঙ্গীতের এই অনুপস্থিতি ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু আশা রাখি, আন্দোলন যেন শহর পেরিয়ে যায়, নগর-মফস্সল-গ্রামাঞ্চল যেন এক হয়ে ওঠে প্রতিবাদে, গেয়ে ওঠে, ‘হম দেখেঙ্গে’।