ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • অঙ্কুর ও আক্রোশ


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (April 24, 2021)
     

    অঙ্কুর (১৯৭৪, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: শ্যাম বেনেগাল, সংলাপ: সত্যদেব দুবে) প্রেমের ছবি। মানে, একপক্ষ কীভাবে প্রেমের সহ-জ প্রতিজ্ঞার ভার বইতে পারল না, তা-ই নিয়ে ছবি। আবার ঈশ্বরেরও ছবি বলা যেতে পারে, কারণ ছবির একদম প্রথমে এক নারী মন্দিরে প্রার্থনা করে তার একটা সন্তান চাই, ছবির শেষে দেখা যায় তার স্বামী তাকে মন্দিরে এনেছে, সে গর্ভবতী বলে। কিন্তু সে গর্ভবতী হয়েছে স্বামীর ঔরসে নয়, আর তার ফলে বহু অপমানও তাকে সইতে হয়েছে ও হচ্ছে, তবে ওসব বোধহয় ঈশ্বরের দায়িত্ব নয়। অবশ্যই প্রতিবাদেরও ছবি, কিন্তু মনে রাখতে হবে, এখানে উঁচু জাতের লোকটিকে, অর্থাৎ অত্যাচারীকে, বেশ কিছুটা দরদের দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। সে নিষ্ঠুর খুব একটা নয়, প্রধানত ক্যালাস, ব্যক্তিত্বহীন। কিন্তু শেষ অবধি তার মেরুদণ্ডরহিত কাজকর্ম ঠিক উঁচু জাতের নৃশংসতারই হুবহু অনুসারী হয়ে দাঁড়ায়। কাহিনির এই গড়নেই ছবিটির অনন্যতা।

    উঁচু জাতের ছেলে বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারে না, কলেজের পড়া মিটতেই তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় একটি ছোট মেয়ের সঙ্গে, সে ক’দিন পর, উপযুক্ত হলে, ঘর করতে আসবে। এর মধ্যে, জমিজমা ও ক্ষেতের দেখাশোনা করতে, ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রামে। সেখানে সে নিচু জাতের পরিচারিকার হাতে চা-ও খায়, তার রাঁধা ভাতডালও খায়, জাতপাত মানে না। এতে গ্রামের লোকে অবাক হয়, একটু রাগও করে। হয়তো কর্তৃত্ব দেখানোর জন্যই, ছেলেটি প্রথমটা গ্রামে ঘুরে রাগারাগি করে হ্যানো বন্ধ করে ত্যানো চালু করে। তার বাবার এক অবৈধ সঙ্গিনী (এবং সন্তান) রয়েছে এখানেই, বাবা তাদের সেরা জমি দিয়েছেন, তাদের ওপর এই ছেলেটির রাগ। সে তাদের ক্ষেতের জল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তার ধারণা, বাবা কোনওদিনই এখানে আসবেন না, ফলে সে রাজার মতো ব্যবহার করে পার পেয়ে যাবে। পরিচারিকা লক্ষ্মী তার ঘর ঝাড়েপোঁছে, রান্না করে, সাপ হিসহিস করে তেড়ে এলে তাড়িয়ে দেয়। সেই লক্ষ্মীর স্বামী বোবা-কালা, সে খেজুরের রস চুরি করে খেলে, এই ছেলেটিরই আদেশে তার মাথা ন্যাড়া করে, উল্টো গাধায় চড়িয়ে ঘোরানো হয়। সে লজ্জায় অভিমানে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। লক্ষ্মী এখন একা, তার প্রতি ছেলেটির একটা আকর্ষণ জন্মেওছে, এক সময় সে লক্ষ্মীকে বলে, সারাজীবন তাকে রক্ষা করবে, তার ভার নেবে। লক্ষ্মীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়। অবশ্যই এক সময়ে বাবা আসেন, এক বকুনিতে সিংহ ইঁদুর হয়ে যায়। বাবা বলেন, নিচু জাতের মেয়ের সঙ্গে সে সম্পর্ক করেছে, গ্রামে ঢি-ঢি পড়ে গেছে। ইচ্ছে করলেই জুতো মেরে সেই মেয়েকে গ্রামছাড়া করার ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন। ছেলেটি তর্ক করার চেষ্টা করে, মিনমিন করে বলে, ওরাও তো মানুষ, তবে সাধারণত তার আপত্তিগুলো ‘কিন্তু বাবা…’-র বেশি এগোতে পারে না। 

    তারপরেই ছেলেটির বউ চলে আসে, বাড়ির সাজসজ্জা বদলে ফ্যালে, এবং লক্ষ্মীকে তাড়াতে সচেষ্ট হয়। ছেলেটির তরফে সামান্য আপত্তি দেখা যায়, কিন্তু যেই সে শোনে লক্ষ্মী গর্ভিণী, তক্ষুনি তার সব প্রেম ও মুক্তচিন্তা বেমালুম উবে যায়, সে আঁতকে বলে, বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দে, বা তুই কোথাও চলে যা। কাজ থেকে বহিষ্কৃত, শারীরিক শ্রমও তেমন করতে পারবে না, তাই লক্ষ্মী খেতে পায় না। একদিন খাবার চাইতে এদের বাড়িতেই আসে, তাকে যখন খাবার এনে দিচ্ছে বাড়ির কর্ত্রী, লক্ষ্মী রান্নাঘর থেকে চাল চুরি করে, কিন্তু ধরা পড়ে যায়। ছেলেটি চেঁচিয়ে ওঠে, তোকে চাবুক মারা উচিত, শুধু মেয়ে বলে ছেড়ে দিলাম। ছেলেটির বউও এই অনাবশ্যক নিষ্ঠুর উচ্চারণে অবাক হয়ে যায়, কিন্তু ছেলেটি তখন সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে আধভাজা। লক্ষ্মীকে সে সত্যি পছন্দ করেছিল, তাকে এ-বাড়িতে সর্বময়ী হিসেবেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, তাকে বারবার বলত তুই বাড়ি যাবি কেন এখানেই থেকে যা, এখন সেই মেয়ে ভিখিরির মতো নিঃস্ব ও নির্বাসিত, তা নিয়ে ছেলেটির যথেষ্ট পাপবোধ রয়েছে, তার কামড়ও সে কম খাচ্ছে না। সে লক্ষ্মীর চোখে চোখ রাখতে পারে না, শুধু চায় যে কিছু একটা মিরাক্‌ল হোক, আর লক্ষ্মী উবে যাক, যাতে কেউ না জানতে পারে সে এই মেয়েটির সঙ্গে শুয়েছিল। 

    এর মধ্যে আমরা দেখেছি, গ্রামের এক মেয়ে স্বামীকে ছেড়ে অন্য জাতের লোকের সঙ্গে চলে গেছিল বলে তার বিচার হয়েছে। সে চেঁচিয়ে বলেছে, তার স্বামী যৌনক্ষমতাহীন, তাই তার বউ হয়ে শরীরের খিদে মেটে না। কিন্তু বিচারের রায় দেওয়া হয়েছে, স্ত্রী শুধু স্বামীর নয়, তার পরিবারেরও, সমাজেরও। তাই স্বামীকে ছেড়ে যাওয়া যাবে না, ভিনজাতের লোকের কাছে তো যাওয়া যাবেই না। বিচারের পর দেখানো হয়, মেয়েটি মারা গেছে। হয়তো আত্মহত্যা। হয়তো কেউ মেরে ফেলেছে। এও দেখানো হয়, মদ খেয়ে তাসের আড্ডায় বাজি রাখতে রাখতে, ঘড়ি হেরে গিয়ে, গলার চেন হেরে গিয়ে, শেষে একটি লোক তার বউকে বাজি রাখে। সেই আড্ডায় বারবার সব পুরুষ নিজেদের ‘মরদের বাচ্চা’ বলে দৃপ্ত ঘোষণা করে, বোঝা যায় এটিই তাদের সর্বোচ্চ আস্ফালন। যদিও পরের দিন সকালে বউটিকে আনতে গিয়ে জিতে যাওয়া লোকটি সফল হয় না, বউটি তার তিরস্কারের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের নামটি স্পষ্ট করেই বলে। তার মানে, ছবিটা এই দেশে নারীর অধিকার নিয়েও। যদিও ওই বিচারসভায় উপস্থিত বড়লোকের ছেলেটিকে বিপর্যস্ত দেখিয়েছিল, যদিও ওই তাসের আড্ডায় বসে থাকা বড়লোকের ছেলেটিকে স্তম্ভিত ও বিরক্ত দেখিয়েছিল, কিন্তু পরে তার নিজের কাজেও বোঝা যায়, দলিত মেয়েকে ভোগ করে তারপর জঞ্জালের ঢিপিতে ছুড়ে দেওয়া যায়। 

    কিন্তু তা বলে এই গ্রামের মানসিকতাকে এক ছাঁচে ঢেলে দেওয়া যাবে না। যে পুলিশটা মনে করে, নিচু জাতের মেয়ের ছোঁয়া খাবার খাওয়া উচিত নয়, সে লক্ষ্মীকে ভুট্টাক্ষেতে চুরি করতে দেখে, বড়লোকের ছেলেকে এসে বলে, এ কী, আপনি লক্ষ্মীকে কিছু জমি দিন, খাবারদাবারের ব্যবস্থা করুন, সে তো আপনার কাছেই ছিল এতদিন। আপনার বাবা তো এখানকার মেয়েকে ভোগ করেছেন, তার বদলে তাকে জমি-জিরেত দিয়েছেন। ছেলেটি বলে, তুমি বেশি কথা বলতে এসো না। তারপর একদিন ছেলেটি, লক্ষ্মীর হঠাৎ-ফিরে-আসা স্বামীকে লাঠি হাতে তার দিকে দ্রুত হাঁটতে দেখে (সে চাকরি চাইতে আসছিল), ভাবে সে প্রতিশোধ নিতে আসছে, আর তাকে চাবুক দিয়ে বেধড়ক মারতে থাকে। সেই মার দ্যাখে গ্রামের কিছু লোক, সেই পুলিশ, একটি ছোট ছেলে। তাদের মুখেচোখে থাকে উঁচু জাতের লোকটার প্রতি, উঁচু জাতের প্রতি, অবিমিশ্র ঘৃণা। কিন্তু তারা প্রহার থামাতে যায় না, সাহস পায় না। লক্ষ্মী এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বামীকে বাঁচায়, চেঁচিয়ে বড়লোকের ছেলেটিকে গাল পাড়ে, অভিসম্পাত দেয়। বড়লোকের ছেলে ছুটে ঘরে গিয়ে খিল দিয়ে হাঁপাতে থাকে ও কাঁদতে থাকে। তার বউ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তাদের মাঝখানে দেওয়ালে ঝোলে তাদের বিয়ের ছবি, ফ্রেমে বাঁধানো। বউ লক্ষ্মীকে সহ্য করতে পারে না, কিন্তু এই দৃশ্যে তার নীরব তিরস্কার ও লক্ষ্মীর উচ্চ-চিৎকার এক বিন্দুতে মিলে যায়। আর বড়লোকের ছেলেও হয়তো নিজের ভীরুতা, লক্ষ্মীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, লক্ষ্মীর স্বামী বোধহয় এবার সমুচিত শাস্তি দেবে এই ভয়, সেই ভয়কে জনসমক্ষে ক্রোধে বদলে নেওয়ার পরাজয়— সব মিলিয়ে নিজেকে তেমন সহ্য করতে পারে না। শেষে ওই দর্শক বাচ্চা ছেলেটি ধীরে ধীরে কিছুটা পিছিয়ে এসে, বড়লোকের বাড়ির জানলায় ঢিল ছুড়ে কাচ ভেঙে দেয়। ছবি শেষ হয়ে যায়। 

    উঁচু জাত নিচু জাতকে যেভাবে পেষে, পুরুষ নারীকে যেভাবে পেষে, বাবা ছেলেকে যেভাবে পেষে, সব দমন নিয়েই ছবি। কিন্তু ছবিতে প্রায়ই সেতার বাজে, বাঁশিও, আর যখন লক্ষ্মীর সঙ্গে ছেলেটির অনুরাগের মুহূর্ত দেখানো হয়, তখন তা অনুরাগই, শুধু ভোগলিপ্সা নয়, চক্রান্তমূলক ভানও নয়। লক্ষ্মী একবার, শাড়ি পরতে পরতে (সম্ভবত আশ্লেষজনিত কারণে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল), ছেলেটির প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিল একটি পাখির নাম। ছেলেটির বউ এসে যখন তাকে সেই পাখির নাম জিজ্ঞেস করে, বলতে গিয়ে ছেলেটির মুখ স্মৃতিকাতরতায় ও আত্মগ্লানিতে কালো হয়ে আসে। সে আবেগের মধ্যে কোনও ফাঁকি নেই। ছোট ছেলেটি কাচ ভেঙে দিয়ে যে প্রতিবাদ করে, তা হয়তো অঙ্কুর, তা থেকে যে-বিদ্রোহের একদিন উদ্‌গম হবে তা নিশ্চয়ই কাম্য, কিন্তু এই বড়লোকের ছেলের অসহায় থতমত মুখটাও দর্শকের সামনে ভাসে। সে ক্ষমতা দেখায় অন্যের ক্ষেতে জল বন্ধ করে দিয়ে, আবার বাবার সামনে কেঁচো হয়ে বাঁচে। তার রাগ হয় বাবা অন্য মেয়ের সঙ্গে কুড়ি বছর সম্পর্ক রেখেছেন বলে, কিন্তু সে নিজেও বিয়ের বাইরে অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করে ফ্যালে। এই মেয়েটিকে সে ভালবাসে, কিন্তু বাবাকে বা বউকে সে কথা দাপিয়ে বলার সাহস সে সংগ্রহ করতে পারে না। সে জাতপাত মানে না, কিন্তু তার জাতপাত-মানা বাবা বরং একটি নিচু-জাতের মেয়ের আশ্রয় ও ভরণপোষণের বন্দোবস্ত করার সাহস দেখান, যা সে পারে না। তার গুলিয়ে ফেলা, ঘাবড়ে থাকা, লতপতে মনপিণ্ডটাও এ ছবির নায়ক। একটা প্রতিবাদী ছবি সাধারণত যে একমেটে আগুন-রঙে লেপা থাকে, এ ছবি তার চেয়ে আলাদা।

    ‘আক্রোশ’( ১৯৮০, পরিচালনা: গোবিন্দ নিহালানি, চিত্রনাট্য: বিজয় তেন্ডুলকর, সংলাপ: সত্যদেব দুবে) ছবির সপ্রতিভতা অন্য স্তরের। প্রতিবাদী ছবি বহু সময়ে প্রতিবাদ দেখায়, বা নিগৃহীতের আর্তনাদ দেখায়। এই ছবির মৌলিকতা হল, এটি সেসব কিছুই দেখায় না, বরং এমন একটা টুঁটি-মোচড়ানো পরিবেশ রচনা করে, যেখানে সকলেই নিশ্চিত, এই অন্যায় প্রতিকারহীন— যে অন্যায় করছে সে-ও, যে অন্যায়ের শিকার হচ্ছে সে-ও। এক আদিবাসী মহিলার মৃতদেহ কুয়োর মধ্যে পাওয়া যায়। তাকে খুনের অভিযোগে তার স্বামীকে জেলে ভরা হয়, বিচার হবে। আদিবাসী লোকটির পক্ষে যে উকিল— ভাস্কর— সে এই ছবির অন্যতম নায়ক। সে আদিবাসী লোকটিকে জিজ্ঞেস  করে, সে এটাই প্রথম খুন করল কি না, কেন করল, সেদিন কী ঘটেছিল। কিন্তু আদিবাসী মানুষটি একটি কথাও বলে না। কোনও অভিযোগ স্বীকার করে না, কিচ্ছু অস্বীকারও করে না, শুধু তাকিয়ে থাকে, আর তার চোখ থেকে নিরন্তর আক্রোশ নির্গত হয়ে পৃথিবীকে ঝলসাতে থাকে। তার নামে অনবরত মিথ্যা সাক্ষ্য চললেও সে কিছু বলে না, সে কিছু না বললে তার ফাঁসি নিশ্চিত— এ কথা মনে করিয়ে দিলেও কিছু বলে না। ছবির মূল নায়ক কোনও কথাই বলবে না, শুধু রগ শক্ত করে কান্না গিলবে আর তাকিয়ে থাকবে পলকহীন, এটা ঠিক করে নিলে ছবির ধরনটাই অন্যরকম হয়ে যায়। ভাস্কর সূত্র সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকে। সে যখন আদিবাসী লোকটির বাবার কাছে যায়, বাবা একটা কথাও বলতে রাজি নয়। লোকটির বোনও কোনও কথা বলে না। গ্রামের অন্য লোকও না। ওই গ্রামে রাজনীতির কাজ করতে এসেছে এক নকশাল ছেলে। তাকে উকিলটি বলে, দেখুন না, যদি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন। একটা স্থানীয় খবরকাগজে খবর বেরোয়, এক আদিবাসী মহিলার লাশ কুয়োয় পাওয়া যাওয়া সম্পর্কে, বলা হয় পরের সংখ্যায় রহস্য উদ্ঘাটন হবে। তা পড়ে সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে, তিনিও উকিলকে হাঁকিয়ে দেন। আমরা জানি, একটা ছবিতে, একটা রহস্য পরতে পরতে উন্মোচিত হবে। এই ছবিটি বলে, কীসের উন্মোচন? এই হতভাগ্য দেশে, নিপীড়িতের মনে চলিত-ব্যবস্থার প্রতি ও ভদ্রলোক শ্রেণির প্রতি অবিশ্বাস এমন বদ্ধমূল, তারা ফাঁসি থেকে বাঁচতেও এদের সাহায্য প্রার্থনা করবে না, কারণ তারা জানে এ লোকটা এখন কৌতূহলভরে সমস্যা জানতে এলেও, আজ নয় কাল অত্যাচারীর পক্ষেই দাঁড়াবে (মনে রাখতে হবে, ভাস্কর প্রথম দেখায় আদিবাসী লোকটিকে জিজ্ঞেস করেনি, তুমি আদৌ খুন করেছ কি না। জিজ্ঞেস করেছে, এটাই প্রথম খুন কি না, আর খুনের কারণ কী। অর্থাৎ, আদিবাসী তো, খুন নিশ্চয় করেছে। সে নির্দোষ হতে পারে— তার উকিলও হয়েও এ সম্ভাবনার কথা তার ভদ্রলোক-হৃদয়ে জাগেনি)। আদিবাসী লোকটির ফ্ল্যাশব্যাকে আমরা দেখি, তার সুন্দরী স্ত্রীকে ফরেস্ট কনট্র্যাক্টর বাবু বাংলোয় ডেকে পাঠাতেন, এক রাতে সে বাংলোর বাইরে থেকেই স্ত্রীর আর্ত-চিৎকার শুনতে পায়, ধর্ষণ থেকে তাকে বাঁচাতে যায়, কিন্তু তাকে পেটানো হয়। কিন্তু সে-কথা সে উকিলকে বলে না, জজসাহেবকেও না। এতটাই নিখাদ ঘৃণা তার এই সমাজ-বন্দোবস্তের প্রতি, এতটাই খাঁটি অবিশ্বাস এই সাজানো ন্যায়বিচারের খেলনাবাটির প্রতি। কোনও নেপথ্য ঘটনা কাউকে বলতে যাব কেন? সত্য জানিয়ে কী হবে? কারণ ক্ষমতাবান কিছু লোক যা চায়, তা-ই হবে, হবেই, হতেই হবে, হয়ে এসেছে, এবং অন্যথা হতে পারে না। ভাস্কর এক রাতে সাইকেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দ্যাখে, কারা কাগজের সম্পাদকটিকে মেরেছে। তিনি আহত, ত্রস্ত, খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যান, তবু ভাস্করের সঙ্গে একটাও কথা বলেন না। একটা ছবি চলতে থাকে, শুধু একথা বলতে বলতে, যে, কিছু জানা যাবে না, জানলেই বা কী এসে যায়, কোনও সমাধান হবে না। শুধু কিছু লোক অনুসরণ করবে, নজর রাখবে, মারবে। 

    ভাস্করের এক সিনিয়র উকিল আছেন, এই কেসে তিনিও প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে, এই কেসের আগে ভাস্কর এঁরই জুনিয়র ছিল, তিনি ওকে পুত্রসম দেখেন। সিনিয়র বলেন, আদিবাসী লোকগুলো এরকমই, মদ খেয়ে খুনখারাপি করবে, তারপর এমন চুপ করে যাবে, যেন জন্ম-বোবা। সিনিয়র নিজে আদিবাসী, কিন্তু তা বলে হাবিজাবি লোকগুলোকে তো আর শ্রদ্ধা করতে পারেন না। এক রাতে ভাস্করের বাড়িতে আচমকা হামলা হয়, জানলার কাচ-টাচ ঝনঝনিয়ে ভেঙে যায়, দরজা ধাক্কানো চলে। আর একদিন, বাড়ি ফেরার পথে তাকে ছুরি মারা হয়। সে রক্তাক্ত হাত নিয়ে সিনিয়রের কাছে দৌড়ে আসে। আরও একদিন হামলা হলে, সিনিয়র তাকে বাড়িতে আশ্রয় দেন, সেই রাতে এই বাড়িতেই শুতে বলেন, ফোনে তিনি হুমকি পান, উঁচু জাতের ব্রাহ্মণটাকে বাড়িতে শুতে দিয়ে বাঁচাতে পারবি না রে, নিচু জাতের কুকুর! (ফোনে তাঁকে প্রায়ই শাসানো হয়, নিচু জাত হয়েও তাঁর এই বাড়বাড়ন্ত যে বেশিদিন সওয়া হবে না, তা বোঝাতে)। কিন্তু ভাস্কর যত বলে, এই কেসে তার মানে নিশ্চয় গোপন করার কিছু আছে, তাই তাকে ভয় পাওয়াতে, কেস থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করতে, তার ওপর হামলা হচ্ছে— সিনিয়র তত বলেন, এই হামলাগুলোর সঙ্গে এই কেসের আদৌ সম্পর্ক আছে, তার নিশ্চিত প্রমাণ কী? কাগজের সম্পাদক মার খেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তা যে শুধু ওই খবরটা ছাপার জন্যই, তার প্রমাণ কী? 

    একদিন ভাস্করের বাড়িতে নকশাল ছেলেটি লুকিয়ে এসে বলে দেয়, আদিবাসী রমণীকে গণধর্ষণ করেছিল এর রাজনৈতিক নেতা, ফরেস্ট কন্ট্র্যাক্টর, এক পুলিশ, এবং এক ডাক্তার। সোজা কথায়, সমাজের চার মাথা। তারপর তারা খুন করে তাকে কুয়োয় ফেলে দেয়। এর উদ্দেশ্য, আদিবাসী লোকটিকে শিক্ষা দেওয়া। কারণ সে বড্ড রাগি, প্রায়ই সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করত। ভাস্কর এরপরে আদালতে মামলায় জেরা করতে থাকে, কোণঠাসাও করে কিছু সাক্ষীকে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিনিয়রও কখনও সামান্য পিছু হটতে থাকেন। নেতা ভাস্করকে নরমে-গরমে হুমকি দেয়, লোভও দেখায়। বড় মামলায় উকিল করা হবে, খুব সুখ্যাতি হচ্ছে, ডাক্তারবাবু স্বয়ং তার নাম সুপারিশ করেছেন। সে খুব টলে না। এর মধ্যে নকশাল ছেলেটি এক রাতে আদিবাসী লোকটির বাবা ও বোনকে বোঝাচ্ছিল, তাদের আদালতে দাঁড়িয়ে সত্যি কথা বলতে হবে, নইলে অন্য লোকেই বা তাদের হয়ে কথা বলবে কী করে, হঠাৎ কিছু লোক এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। বাবাও চুপ করে থাকে, বোনটিও, তারা চেঁচায় অবধি না, কারণ ক্ষমতাবানের গুন্ডা এসে রাত্রে একটা লোককে তুলে নিয়ে গেলে কে-ই বা কী করতে পারে? লোকটার তারপর কী হয়? জানা যায় না, নিশ্চয়ই মেরে কোথাও লাশ গুম করে দেওয়া হয়। একদম অনাটকীয় ভাবে, এতটুকু প্রতিরোধ ছাড়া (লোকটি চেঁচাতে ও হাত-পা ছুঁড়তে থাকে, কিন্তু তা ছাড়া আর কিছুই হয় না, গ্রামও ঘুমোয়, বা শ্বাস বন্ধ করে শুয়ে থাকে) একটা লোককে এই তুলে নিয়ে যাওয়া, এই নিশুত রাতের ব্যাকরণ, এই ঝিঁঝি-ডাকের নিশ্ছিদ্র চাদরে ঢাকা ভারতের অনন্ত অত্যাচারের নির্বিকার চালচিত্র, আমাদের বুঝিয়ে দেয়, এভাবেই, স্রেফ ইচ্ছে হলে, যে কোনও মেয়েকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা যেতে পারে, তাকে ঘাড় গুঁজড়িয়ে কুয়োয় ফেলে দেওয়াও যেতে পারে। কতকগুলো হতদরিদ্র লজঝড়ে কুঁড়েঘরের কাঁপতে থাকা কুপির শিখায় অন্ধকারের চাষ বহুযুগ ধরে ফলছে-ফুলছে। তাই এই লাথি-খাওয়া ধর্ষণ-খাওয়া চাবুক-খাওয়াদের সম্মিলিত নীরবতার মধ্যে অসহ্য ক্ষোভ, চূড়ান্ত অভিমান, এবং সর্বোপরি নাড়ি-ছ্যাতরানো ভয় ধকধক করছে (কিছু বললে যদি আরও ধর্ষণ, খুন, চাবুক?)। দুটো লাজুক প্রশ্ন নিক্ষেপ, তারপর ‘কী আর করা যাবে, যে চুপ করে থাকে তাকে আমি সাহায্যই বা করব কী করে?’ বিরক্তি ও হাত-ধুয়ে-ফেলা দিয়ে, এই আঁট স্তূপীকৃত নৈঃশব্দ্যকে খোঁড়া যায় না। 

    সিনিয়র উকিল এসব ব্যাপারে কিন্তু দ্বিধা-টিধার ধার ধারেন না, মানে, ধারেন, কিন্তু তা ঝেড়ে ফ্যালেন ক্রমাগত, জামা থেকে নাছোড় পিঁপড়ের মতো। তিনি নিশ্চিন্তে রোজ তাস খ্যালেন, পুলিশ, ডাক্তার, নেতা, ফরেস্ট কন্ট্র্যাক্টরের সঙ্গে। ভাস্কর যখন বলে, স্যর, এই যে হামলা হচ্ছে, তার তো নির্ঘাত কোনও কারণ আছে? সিনিয়র তখন বলেন, সেই কারণেরও তাহলে কারণ আছে। কারণের কারণেরও আবার কারণ আছে। এত কারণ খুঁজতে গেলে শেষে দেখবে মনে হবে আমাদের সমাজ, রাজনীতি সবই পচে গেছে, বিপ্লব ছাড়া গতি নেই। তদ্দিনে তোমার মক্কেল ফাঁসিতে ঝুলে ফৌত হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, আদিবাসী সমাজকে যে পায়ের তলায় দ’লে দেওয়া হচ্ছে, তা তিনি জানেন। কিন্তু তা বলে তো আর বন্দুক হাতে নিতে পারেন না। যা করার, ন্যায়ের, ঔচিত্যের, যুক্তির পথে করতে হবে। এই চারজন মিলে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুন করেছে (ভাস্কর নকশাল ছেলেটির কথা শুনে যা বলছে), এ-অনুমানের যতক্ষণ না প্রমাণ হাজির হচ্ছে, তিনি কীসের ভিত্তিতে তা বিশ্বাস করবেন? অর্থাৎ, ছবিটায় এক ব্রাহ্মণ ছেলে, উকিল, প্রথমে যথেষ্ট বিরক্ত ও অনিচ্ছুক (এ কোন কেসে সে ফেঁসে গেল), এক সময় ভাবে, এ অন্যায়ের শেষ দেখতেই হবে, যা হয় হোক, আদিবাসীদের প্রতি এই অত্যাচার মেনে নেওয়া যায় না। আর এক আদিবাসী লোক, অনেক প্রতিপত্তিশালী ও সফল— এখন যুক্তির, তথ্যের, গণিতের দুর্গ বানিয়ে তার মধ্যে বাস করেন। তাঁর তাসের আড্ডাকে, তাঁর উঁচু-লোকের সঙ্গে গা-ঘষাগষিকে, তাঁর নিরাপদ সম্মানকে আপ্রাণ চেষ্টায় বাঁচিয়ে রাখতে চান। মিথ্যে ও সাজানো সাক্ষীদের পর পর হাজির করে যান, ক্ষমতাবানের স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে।

    ‘আক্রোশ’-এর ক্লাইম্যাক্স বিখ্যাত ও ভয়ঙ্কর। আদিবাসী লোকটির বাবা মারা যায়, তার অন্ত্যেষ্টিতে এসে, হাত খোলা পেয়ে, সে একসময় একজনের কুড়ুল কেড়ে নিয়ে নিজের যৌবনবতী বোনকে কুপিয়ে খুন করে, কারণ তা নইলে একদিন সেও ধর্ষিতা হবে ক্ষমতাবানদের কুঠিতে বা এই জঙ্গলেরই পথে। তারপর, যখন তাকে পুলিশরা পাকড়ে ধরেছে, আদিবাসী লোকটি ছটফটিয়ে আর্তনাদ করে। অনবরত। এই ছবিতে তাকে কথা বলতে দেখা গেছে শুধু ফ্ল্যাশব্যাকের দুটি দৃশ্যে। এই বর্তমান সময়ে তার শুধু অসহ্য নীরবতা জেনেছে দর্শকেরা। এবার তার আক্রোশের আর অসহায়তার অনর্গল আর্তনাদ খানখান করে দেয় পর্দা। অন্য যে-কোনও পরিচালক বা চিত্রনাট্যকার হলে, এখানে ছবি শেষ হয়। কিন্তু এই ছবিতে তারপরেও একটা দৃশ্য থাকে। 

    সেখানে, ভাস্কর সিনিয়রকে বলে, আদিবাসীটির প্রতি যাতে সুবিচার হয়, আপনি সাহায্য করুন। সিনিয়র বলেন, সবার সামনে একটা লোক নিজের বোনকে খুন করেছে, এই সত্যিটা তিনি জানেন। বাকি সব অভিযোগ তো, আবারও, প্রমাণসাপেক্ষ। হয়তো আদিবাসীর বউ খুন হয়নি, তার কুয়োয় পড়ে যাওয়াটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। ভাস্কর বলে, স্যর, সেই নকশাল ছেলেটির আর কোনও খবর নেই। আমারও যদি কিছু একটা হয়ে যায়, আপনি কি সেটাকেও নিছক দুর্ঘটনা বলে মেনে নেবেন, না কি মনে করবেন তা এই চক্রান্তেরই অঙ্গ? সিনিয়র প্রথমটা বলেন, হাবিজাবি কথা বোলো না। কিন্তু ভাস্কর ফের প্রশ্নটা করে। সিনিয়র বলেন, কোনও প্রমাণ না থাকলে আমি ধরে নেব, ওটা এমনিই একটা অ্যাক্সিডেন্ট। ‘থ্যাংক ইউ স্যার’ বলে ভাস্কর চেয়ার থেকে উঠে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে স্টিল হয়ে যায়। ছবি এখানে শেষ হয়। ছবি বলে: আমরা এ ছবি দেখেও, আর খবরের কাগজের পাঁচের পাতায় সাতের পাতায় এমন একশো-একটা খবর পড়েও, চুপ করে থাকব এবং নিজেদের চারপাশে সুরম্য অজ্ঞতা ও নির্ভাবনার মহল নির্মাণ করে রাখব, কারণ নিজেদের আমরা বোঝাতে পেরেছি, নিখুঁত আইনি প্রমাণ ছাড়া সত্যের অস্তিত্ব নেই। কই, অত্যাচারের প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো নেই, অপমানের নিবিড় তথ্য তো নেই, আর সাক্ষীরাও তো, নির্যাতিতরাও তো, কেমন চুপ করে জল বয়ে দিচ্ছে বা জেলের লপ্‌সি খাচ্ছে। যেন, আমাদের নিজেদের চোখ নেই কান নেই বোধ নেই পর্যবেক্ষণ নেই, আছে শুধু অজুহাত আর সাফাই, সদরের পরিপাটি খিল, ওটিই বিশ্বনিখিল। আদিবাসী হয়েও ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠা লোক, আর ব্রাহ্মণ হয়েও আদিবাসী হয়ে ওঠা লোকের মধ্যে অন্তিম তর্কের মীমাংসা হয় না, কিন্তু শেষ দৃশ্যে তাদের দেখিয়ে অবস্থানগুলো চিনে নেওয়ার একটা চেষ্টা চলে, কারণ তা দর্শকদেরও অবস্থান চিনিয়ে দেওয়ার উপায়। গল্পটা তাই নিচুজাতের প্রতি উঁচুজাতের পরোয়াহীন মর্দন ও অপমান নিয়েও, আর সেই অপমান বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়-এড়ানোর সংস্কৃতি নিয়েও। বিবেকহীন কিন্তু বিবেকের সহস্র ভড়ংওয়ালা, গা-বাঁচানো মধ্যবিত্ত দর্শকদের প্রতি, ছবি-নির্মাতাদেরও— একটা আক্রোশ না-হোক, তীব্র তিরস্কার পর্দা থেকে ধাবিত হয়।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook