ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং: পর্ব ৫


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (April 17, 2021)
     
    শীতল হাতে কুচিয়ে দেব

    বাংলার নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনী চারজনকে গুলি করার পর এক পার্টির ক-নেতা বলছেন, দিকে দিকে শীতলকুচি হবে, খ-নেতা বলছেন ইস চারজনকে মারল কেন আটজনকে মারা উচিত ছিল, গ-নেতা বলছেন বেশি খেলতে যেও না শীতলকুচির খেলা খেলে দেব। সোজা কথায়, খুন হয়েছে বেশ হয়েছে, লোককে সবক শেখাতে এবার থেকে খুনই করা হবে। মানুষ মরলে— এমনকী শত্রু মরলেও— উল্লাস প্রকাশ ভয়াবহ অসভ্যতা, কিন্তু সংস্কৃতিমান বাংলায় এখন অশিক্ষা ও অভদ্রতার বাজার সাংঘাতিক, এবং ভোট-সম্ভাবনাও প্রকাণ্ড, অন্তত দলগুলোর তা-ই আন্দাজ, নইলে সমস্ত পার্টি তাদের পুরোভাগে মস্তানির দানবিক তর্জনী ডিসপ্লে করত না। খুনোখুনি বাংলার নির্বাচনে চিরকালই চলে, এবং কোনওদিনই রাজনৈতিক দলের নিহত কর্মীদের মানুষ ধরা হয় না, সংখ্যা ধরা হয়। এ যদি বলে আমাদের সাতজন মরেছে, ও বলে তোরা তো আমাদের আটজনকে মেরেছিস। এক চিন্তক টিভি-বিতর্কে বলেছিলেন, দোহাই, বুঝুন, এগুলো মানুষের প্রাণ, ওয়ান-ডে খেলার স্কোর নয়। চিন্তক হাততালি পান, কিন্তু নেতারা দেশ চালান। তাঁরা যদি ঠিক করেন খুনের রানে নিয়ত টপকে যেতে হবে বিরোধীকে, তবে সেই থিমেই বাংলার নির্বাচনী পাঁচালির পয়ার ছমছম করবে। আর বাংলার সাধারণ মানুষ রবীন্দ্রসঙ্গীত (আসলে কেকেআর) নিয়ে এতটা নিমগ্ন থাকবে যে বুঝতেই পারবে না, কখন পরনের কল্কাপাড়ের গামছাটা খুলে নিয়ে চলে গেছে সেই নেতারা, যাদের একজন চেঁচায় তোর বাপকে গিয়ে বল বাড়ির পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, আর একজন শান্ত গলায় হুমকি দেয়, শিল্পীরা রাজনীতি করতে এলে রগড়ে দেব। 

    বাজে বকে লাভ নেই, মানুষ প্রেমের চেয়ে ঘৃণা বেশি ভালবাসে। প্রতিবেশীকে ভালবাসো— এ কথা বললে একপিসও স্বতঃস্ফূর্ত হাততালি উঠবে কি না সন্দেহ। কিন্তু প্রতিবেশীকে ঘৃণা করো— ও তোমার প্রাপ্য চাল-ডাল সাপটে মেরে দিল, এই বলে ক্রাউড-কে তড়াং চাগিয়ে তোলা যায়। আসলে মানুষ এমনিতেই সারাদিন রাগে ঘেন্নায় ভাজা-ভাজা হচ্ছে, নিজের তাবৎ দুর্দশার জন্য অন্য কাউকে ভিলেন খাড়া করছে, কারণ নিজেকে আংশিক দায়ী করতে গেলেও স্ব-তদন্ত ও আত্ম-বকুনির অভ্যাস আয়ত্ত করতে হয়— তা সাধারণ লোকের প্রবণতা-বিরোধী। আমজনতার আর একটি কোমল ক্রীড়াভ্যাস: যে তার মতো দেখতে নয়, তার মতো পোশাক পরে না, তার মতো খাবার খায় না— এমন লোক সম্পর্কে অস্বস্তি, ভয়, সন্দেহ লালন। এবার তাকে যদি জপানো যায়, তোমার চাকরি নেই কারণ ওই আলাদা-মতন লোকটা তোমার চাকরিটা নিয়ে নিয়েছে, তোমার চিকিৎসা নেই কারণ ও তোমার ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে বসে আছে, তুমি সিরিয়াল দেখতে পাচ্ছ না আর ওকে রাষ্ট্র ফ্রি টিভি দিয়েছে, তাহলে কোঁৎ করে সেই বিশ্বাসের দেড়মণ্ড আড়াইমণ্ড গিলে জাবর ওথলানোই স্বাভাবিক, কারণ সে হুবহু এই গুজগুজটাই ক্লাবঘরে গুলছিল। এই প্রচারে নেতাদের সাংঘাতিক সুবিধে হল, কেন খাবার নেই হাসপাতাল নেই পিচরাস্তা নেই, জবাবদিহি করতে হয় না। শুধু আঙুল দেখাতে হয়, গরগরে গরল ওগরাতে হয়, খেপিয়ে তুলতে হয়। সে-কাজ ভীষণ সোজা, আর তাতে মজাও বেশি। 

    কিন্তু এসব কথা তো বহুদিন ধরেই সত্যি। আগেও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটে টানার জন্য তাকে বিশেষ সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার কথা (এবং উল্টো-গোষ্ঠীর সুবিধে কেড়ে নেওয়ার কথা) বলা হয়েছে, অমুক ধর্মগুরু আর তমুক বড়বাবার পায়ে মাথা ঠুকে চেষ্টা হয়েছে তাঁর অধীনস্থ ও আজ্ঞাবহ সমষ্টিকে নিজের পার্টির দিকে হেলাবার। কিন্তু তখন এই মেরুকরণ, সাম্প্রদায়িক ক্যারম খেলা হত গোপনে, মুখে ভজা হত সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যের সনেট। সে-ভণ্ডামি যে ঘুচে গেল, মঞ্চ থেকে বাখোয়াজ সরাসরিই চেল্লাতে লাগল অমুককে মারো, তমুকের ঘর জ্বালিয়ে দাও, আর মানুষ আকুল হল সমর্থনে উল্লাসে, এই পরিবর্তন কী করে ঘটল? সম্ভবত, লোকে অভদ্রতা অশালীনতা অমানবিকতাকে আলিঙ্গন করার জন্য আগাগোড়া প্রস্তুতই ছিল, নেতারা শুধু এত্তাবড়া গুড-লাক বিশ্বাস করতে পারেননি। আসলে, একটা উদ্ভট কুসংস্কার প্রচলিত— যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবী নাকি অধিক সভ্যতার দিকে গড়াচ্ছে। এই ধারণার কোনও ভিত্তি নেই, একটা গামবাট আশাবাদ ছাড়া। পৃথিবী এক জায়গাতেই থেমে থাকে, ঘুরপাক খায়, কখনও চার পা এগোয়, পরক্ষণেই পাঁচ পা পিছিয়ে আসে। হরেদরে চেঙ্গিস খাঁ-র যুগ আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুগ একই থাকে। নেতারা (এবং পাবলিক) তবু এতদিন অ্যাসেম্বলি হল-এর প্রার্থনাসঙ্গীতের ঠাটে দাঁড়িয়ে ‘কামড়ে দেওয়া কি ভাল দেখাবে?’ মর্মে নখ খুঁটছিলেন, ‘ধুত্তোর দেখনশোভা ধুতির গিঁট!’ বলে অনৌচিত্যের ডাঙায় নামতে পারছিলেন না, একটা এমন ন্যায্য-কুমিরের ন্যাজ-ঝাপটার ভয়ে আড়ষ্ট ছিলেন, যার আসলে অস্তিত্ব নেই। 

    কিন্তু গোকুলে (গো-কুলে?) বাড়ছিল গর্বগুন্ডা। কম বুদ্ধি, কম ভাবনা, কম নীতিবোধ— এগুলোর বিরাট সুবিধে হল, বহু সময় এরা অতিসাহসের জন্ম দেয়, ধাঁ করে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়, পাহাড়ের গায়েও লাথি চালিয়ে দেওয়া যায়। ‘শিক্ষিত হতে হয়’ (বা অন্তত ‘শিক্ষিত হাবভাব করতে হয়’), ‘প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিও সৌজন্য বজায় রেখে কথা বলতে হয়’, ‘অন্য রঙের মানুষকে যদি সহ্য না-ও করতে পারি, প্রকাশ্যে তা বলতে নেই’, ‘যে হত্যা বা ধর্ষণ করে, তার গলায় মালা দিতে নেই’, ‘খাপ পঞ্চায়েতের আদিম বিচারকে স্যালুট জানাতে নেই’— এগুলো অ্যাদ্দিন চলছিল, কারণ এগুলো চলছিল। এগুলোকে অন্তর থেকে গ্রহণ করা হচ্ছিল বলে নয়, শ্রদ্ধা করা হচ্ছিল বলে নয়, ভাল লাগছিল বলে নয়, স্রেফ চলছিল বলেই, অনেকে ভেবেছিল এগুলো চালিয়ে যেতে হয়। এবার, যেই না (হাঙ্গেরি বা রাশিয়া বা উরুগুয়ে বা তুরস্ক বা অন্য কোথাও) কোনও তেজি কালাপাহাড় (বা কানাপাহাড়— যার দৃষ্টি কুশিক্ষায় ঝাপসা) এসব ধাঁ তুবড়ে দিয়ে লাফিয়ে স্বনির্মিত বেদীতে উঠে হাঁকতে লাগল, ‘মার শালাদের!’, অমনি গুচ্ছ লোক চমকে উঠে ভাবল, এ-ই প্রকৃত মসিহা, বাঘের বাচ্চা। যে সোজা কথা সোজাভাবে বলতে ডরায় না, যে মিনমিনে পণ্ডিতদের মতো ধোঁয়াটে বাক্য রচে না। যেই দৃপ্ত ঘোষণা হল: মেয়েদের ঘোমটা দিতে হবে জিন্‌স পরা চলবে না, বা সমকামীরা প্রকৃতিবিরোধী ও সুতরাং প্রহারযোগ্য, বা ভিনধর্মীরা হোলসেল হাড়বজ্জাত— পাবলিক হাঁপ ছেড়ে বাঁচল: এই তো স্বাভাবিক সুবোধ্য নিকট-বুদ্ধি সন্দেশ, ইহাই সাচ্চা মম মনের বাত, ধরতে হবে এদের হাত। আর যে ড্যাকরারা বিতরণ করে নারীর সমানাধিকারের তত্ত্ব, সমকামীর সমানাধিকারের বুলেটিন, দলিতের সমানাধিকারের লিফলেট, যারা বলে পৃথিবী দেখতে চ্যাপ্টা লাগলেও আসলে গোল— তাদের বার্তা চণ্ডীমণ্ডপের চক্করের সঙ্গে মেলে না, নিজেকে অনেকটা ভেঙে, সিঁড়ি ডিঙ মারার খাটনি খেটে, তাদের মতের কাছে যেতে হয়। কিন্তু হুররে, আর মস্তিষ্কব্যায়ামের প্রয়োজন নেই, আসি গেলা সুবিধেজনক সম্রাট, যে জলের মতো বুঝিয়ে দেয়: পাকিস্তানকে ঘৃণা করো আর যে তোমার উল্টোকথা বলে তাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দাও, তাইলেই ভাবনাচিন্তার বখেড়া রইল না।

    সঙ্গে হয়তো এ-ও সত্যি, আমরা আসলে গণতন্ত্র চাই না। আমরা সিংহাসনে চাই একজন হিংস্র সিংহপুরুষ (বা সিংহীনারী), যে অন্য দেশকে মারতে মারতে ভূত ভাগিয়ে দেবে, তাদের জমি কেড়ে নেবে জল কেড়ে নেবে, আর দেশের মধ্যেও বিরোধীকে কান পেঁচিয়ে তুরন্ত জেলে ভরবে বা বাড়িতে সপাটে ঢুকিয়ে দেবে ইনকাম ট্যাক্সের রেড। সেই ধমকিবাজ রাজার হাতে হিরণ্যখচিত মুগুর দেখে আমরা ভয়ে সিঁটিয়ে মুগ্ধ হৃদয়ে ভাবি: কী বেধড়ক দাপট, ঝাপট! এরে করিব সাপোর্ট। রাজা যত হ্যারাস করেন, রাতারাতি লাইনে ঠায় দাঁড় করিয়ে দেন কাশ্মীর টু কন্যাকুমারী, নিজের খেয়ালে একবার বলেন গ্যাসের দাম কমলে ভাল আর একবার বলেন গ্যাসের দাম বাড়লেই তো বোঝা যাবে দেশের জন্য কার কত আত্মত্যাগ— আমরা ন্যাজ নাচিয়ে হাঁকি: আরও আরও প্রভু আরও আরও, লাইন দিয়ে বসিয়ে কীটনাশক ঝাড়ো। কারণ আমাদের মূল টান ধনুকের মতো বেঁকে প্রবলের পায়ে মাথা ঠেকাবার, ডান্ডাপ্রভুর থানে মাথা ঠোকার, আমরা চিরকাল রাজার কাছে চাবুক খেলে অহংকারে ফুটিফাটা হয়ে পাছায় সেই শাসন-দাগ নাতিকে ডেকে দেখিয়েছি। আজ দেশে দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত নেতারা যখন গণতন্ত্রের টুঁটি নিংড়ে দিব্যি স্বৈরতন্ত্র ঢালছেন, জনগণ একটু ফোঁসফোঁস আফশোস করছে বটে, কিন্তু সমঝদার মুণ্ড নেড়ে বলছেও, বজ্র-আঁটন জিন্দাবাদ, ব্ল্যাকের টাকা আদায় হচ্ছে, বেশি ট্যাক্সো জমা পড়ছে, ফিলিমে সেক্স দেখাচ্ছে না। বাসের ঝাঁকুনিতে পরস্পরের কানে ঝুঁকে ফিসোচ্ছে; ডিক্টেটর চাই, বুইলেন না? নইলে এ-দেশের পাবলিক ঢিট হবে নে কো। 

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook