ফিল্মফিরিস্তি: ৬

Representative Image

জীবনের সন্ধান


বিজ্ঞাপন

আমরা কীসের আশায় বাঁচি? আচ্ছা, আমাদের কথা ছাড়ুন, আমরা না হয় স্বস্তিতে আছি। যারা স্বস্তিতে নেই, ভবিষ্যৎ যাদের অনিশ্চিত, এই যেমন সাহারা মরুভূমির দক্ষিণভাগের দেশগুলো ছেড়ে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা করা মানুষগুলোর কথাই ধরা যাক, তারা কীসের আশায় বাঁচে? মালি, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, সেনেগাল ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ থেকে এই যে অজস্র অভিবাসী— মূলত উত্তর আফ্রিকার তিউনিশিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছে, সে-দেশে গিয়ে অভিবাসন নীতির চক্করে, কেউ-কেউ আইনি জটিলতায় আটকা পড়ছে, আবার কেউ-কেউ প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে, তিউনিশিয়ার উপকূল থেকে রাতের অন্ধকারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, নৌকাযাত্রা করে ইউরোপে ঢুকতে চাইছে, তারা জীবন থেকে ঠিক কী চায়? সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ? নির্ভয়ে বাঁচতে পারার স্বাধীনতা? গাত্রবর্ণ, স্বভাব, আচরণ ও কথা বলার ধরন নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা বৈষম্য থেকে মুক্তি?

এসব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের ইতিহাসে; যে ধ্রুব ইতিহাস, চিরসত্যের নামান্তর।

তিউনিশিয়া, মিশর, আলজিরিয়া, লিবিয়া, সুদান বা মরোক্কোর মতো উত্তর আফ্রিকার কয়েকটি দেশ আরব-অধ্যুষিত। অনেককাল আগে, আরবিরা এইসব অঞ্চলে এসে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং বিস্তার ঘটিয়েছিল ইসলামের। এখানকার আদি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ক্রমশ পিছিয়ে গিয়ে, প্রাধান্য পেল ইসলামি সংস্কৃতি। ফলে, উত্তর আফ্রিকার এই দেশগুলিতে, বর্তমানে আরবিদেরই প্রতিপত্তি।

প্রশাসনই ভক্ষক? ফিলিপিন্সের কড়া বাস্তব উঠে আসে ব্রিলিয়ান্তে মেন্দোজার ছবিতে! পড়ুন: ফিল্মফিরিস্তি পর্ব ৫…

তাদের গায়ের চামড়া সাদা। এই দেশগুলোর দক্ষিণ ভাগে রয়েছে সাহারা মরুভূমি এবং সাহারার দক্ষিণে থাকা অগুন্তি আফ্রিকান দেশে রয়েছে, মূলত কালো চামড়ার লোকজন। গোটা আফ্রিকাতে এই যে দুটো ভাগ, একদিকে সাদা চামড়ার আরব আধিপত্য, অন্যদিকে কালো চামড়ার পুরনো আফ্রিকান নাগরিক, এদের দ্বৈরথ হালফিলে সংবাদমাধ্যমের নজরে এসেছে।

সাহারার দক্ষিণের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ জটিল রাজনীতি, আর্থিক বৈষম্য, চাকরির সুযোগ না থাকা, ঝাপসা ভবিষ্যৎ এবং হঠাৎ-হঠাৎ লেগে যাওয়া গৃহযুদ্ধ, বা কট্টর প্রশাসনিক চাপের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে, অনেকেই ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে।

আফ্রিকার ঠিক পাশেই, ইউরোপ এবং তিউনিশিয়ার একদম কাছে থাকা সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ, ইতালিতে ঢোকার প্রবেশপথ। ইউরোপ কেন? কারণ ইউরোপে আছে উদার অর্থনীতি এবং আশা জাগানো আগামীকাল। এই লোকগুলোর কাছে তিউনিশিয়া ট্রানসিট পয়েন্ট; কারণ তিউনিশিয়া হয়ে সমুদ্রপথে ইউরোপে যাওয়া, তুলনামূলকভাবে সহজ ও কম সময়সাপেক্ষ।

এভাবেই অগুন্তি মানুষ— সাহারার ওপাশ থেকে এসে, তিউনিশিয়ায় প্রবেশ করেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। তবে অনেকেই আর বের হতে পারেনি। নানা গোলকধাঁধায় সূক্ষ সুতোয় ঝুলে রয়েছে। এই সূক্ষ সুতোয় ঝুলে থাকা কয়েকজনের গল্প বলে এরিজে সেহিরির ‘প্রমিসড স্কাই’ (‘Promis le ciel’) ছবিটি। এ-ছবিতে দেখা ও দেখানোর চোখ একান্তই আন্তরিক।

আইভরি কোস্ট থেকে বছর দশেক আগে, তিউনিশিয়ায় অভিবাসী হয়ে আসা মারি, তার কাছে ভাড়ায় থাকা আরও এক অভিবাসী জোলি, যে তিউনিশিয়ায় এসেছে পড়াশোনা করতে এবং অন্য আরেক অভিবাসী নানি, যে চাইছে পাকাপাকিভাবে ইউরোপে চলে যেতে, এই তিনজনকে নিয়ে ছবিটি এগিয়েছে। আর রয়েছে একটি বাচ্চা মেয়ে, যাকে পাওয়া গেছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে। হয়তো মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে, তার মা-বাবা কিংবা কোনও প্রিয়জন আফ্রিকা ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল।

এই মেয়েটি তাদের তিনজনের জীবনে আসার পর থেকে, নানা রকমের দোলাচল শুরু হয়। সময়টা ভুলে গেলে চলবে না, ২০২৪-এর তিউনিশিয়া, যে-সময়ে প্রেসিডেন্ট কায়েস সঈদের অঙ্গুলিহেলনে, দেশজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসীদের ধরপাকড় চলছে, রাস্তাঘাট থেকে তুলে নিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে, যে-দেশ থেকে এসেছে, সেই দেশেই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা হিংসা ও বৈষম্য তো রয়েছেই।

তারপরেও, এত অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মাঝে, জীবন গান গাওয়া থামায় না। মারি একটি ছোটখাটো কমিউনিটি তৈরি করে, প্রত্যেককে বলে সাহসী হতে, নির্ভয়ে বাঁচাতে। নিজের মেয়েকে পেছনে ফেলে আসা নানির তিউনিশিয়ায় থাকার কোনও বৈধ কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও, সে নিজের আত্মপরিচয় লুকিয়ে রাখতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

জোলি এদের থেকে বয়সে অনেকটাই কম, উঠতি যুবতী, সে ছবির শুরুতে, খুব একটা চিন্তিত নয় বাকিদের মতো, কারণ সে মনে করে, তার কাছে এদেশে থাকার বৈধ কাগজপত্র যখন আছে, তাকে বাকিদের মতো হেনস্থার শিকার হতে হবে না। জোলির ভুল ভাঙতে খুব একটা দেরি হয় না। তিউনিসের মতো বড় শহরেও, কৃষ্ণাঙ্গদের বাড়ি ভাড়া দিতে অনেকের বাধোবাধো ঠেকে, তাদের এক জায়গায় জমায়েত হয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে দেখলে, শ্বেতাঙ্গ মুসলমানদের মনে আতঙ্ক ছড়ায় এই ভেবে যে, এই বুঝি তারা গোপনে কোনও শলাপরামর্শ করবে বলে একত্রিত হয়েছে। তবে এরিজে সেহিরির দেখানোর চোখ, একপাক্ষিক নয় মোটেই।

মারি যে বাড়িতে ভাড়া থাকে, সেই বাড়ির মালিক শ্বেতাঙ্গ-তিউনিশিয়ান ইসমাইল; মহল্লার লোকজনের আপত্তি থাকলেও, যখন তখন পুলিশের ধরপাকড় হতে পারে জেনেও, সে মারিকে বাড়ি খালি করতে বলে না। নানির শ্বেতাঙ্গ বন্ধু ফুয়াদ, নানিকে যে-কোনও বিপদ থেকে রক্ষা করে চলেছে নানি এদেশে আসা ইস্তক। এ-রকম ভালমানুষের সংখ্যা যদিও প্রায় নগণ্য, সে-কথা অপ্রকাশ্য থাকে না ছবিতে।


এরিজে সেহিরির এটি দ্বিতীয় ফিচার ফিকশন। এর আগে ২০২২-এ বানিয়েছিলেন প্রথম ফিচার ফিকশন ‘আন্ডার দ্য ফিগ ট্রিজ’। উত্তর-পশ্চিম তিউনিশিয়ার গ্রামাঞ্চলে একদল খেতমজুরের এক সাদামাটা দিনযাপনের গল্প ছিল সে’টি। যেহেতু সেহিরির শুরুটা তথ্যচিত্র বানানো দিয়ে (২০১৯-এ বানান পূর্ণদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র ‘রেলওয়ে মেন’, তিউনিশিয়ার রেলকর্মীদের নিয়ে), তাই ‘আন্ডার দ্য ফিগ ট্রিজ’-এ ন্যারেটিভের মধ্যে মিশে ছিল একজন তথ্যচিত্র নির্মাতার নিজস্ব ছাপ। তুলনায় ‘প্রমিসড স্কাই’ ছবিটি অনেকাংশেই ফিকশন-নির্ভর, দেখানোর ভঙ্গীতেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। ‘আন্ডার দ্য ফিগ ট্রিজ’-এ যেমন হলদেটে সূর্যালোকসমৃদ্ধ কালার প্যালেট ছবিটিকে স্বকীয় করেছিল, তেমনই ‘প্রমিসড স্কাই’-তে রয়েছে, নীল-সাদা-হালকা গোলাপী কালার প্যালেট, যা ছবির বিষয়কে করে তুলেছে আরও পরিণত।

পোড়খাওয়া আফ্রিকান পরিচালক, আব্দেরহমানে সিসাকোর ‘টিমবাকটু’ (২০১৪) ছবির সম্পাদক, নাদিয়া বেন রাচিড, এই ছবিরও সম্পাদনার দায়িত্ব সামলেছেন; ফলে ছবিটি হয়ে উঠেছে আঁটসাঁট ও গতিশীল।

অভিবাসন বর্তমান তিউনিশিয়ার এক জ্বলন্ত সমস্যা। কিন্তু এই বিষয়টি ছবিতে দেখাতে গিয়ে, সেহিরি যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ স্বর বজায় রাখতে পেরেছেন। গতিময় কাহিনি বুনন, চরিত্রভিত্তিক ক্যামেরার কৌশল, গতিময় সম্পাদনা, সংগীতের পরিমিত ব্যবহার এবং এক দোলাচলে ভরা পরিণতির কারণে ‘প্রমিসড স্কাই’ এই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি হয়ে থেকে যাবে।

তিউনিসের মতো বড় শহরেও, কৃষ্ণাঙ্গদের বাড়ি ভাড়া দিতে অনেকের বাধোবাধো ঠেকে, তাদের এক জায়গায় জমায়েত হয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে দেখলে, শ্বেতাঙ্গ মুসলমানদের মনে আতঙ্ক ছড়ায় এই ভেবে যে, এই বুঝি তারা গোপনে কোনও শলাপরামর্শ করবে বলে একত্রিত হয়েছে।

তিউনিশিয়া থেকে আমরা ইতিমধ্যেই কাউথের বেন হেনিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ নারী চিত্রপরিচালককে পেয়েছি, যার ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য ডগস’ (২০১৭), ‘দ্য ম্যান হু সোল্ড হিজ স্কিন’ (২০২০), ‘ফোর ডটারস’ (২০২৩) ও সাম্প্রতিক ‘দ্য ভয়েজ অফ হিন্দ রজব’ (২০২৫)-এর মতো ছবিগুলো সমসাময়িক বিশ্ব-চলচ্চিত্রের সম্পদ। তিউনিশিয়ার নারী চলচ্চিত্রকার তথা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একজন তিউনিশিয়ান চলচ্চিত্রকার হিসাবে এরিজে সেহিরির নামও ‘প্রমিসড স্কাই’-এর দরুণ ইতিহাসে উঠে গেল।

ছবি: প্রমিসড স্কাই (Promis le ciel)
পরিচালক: এরিজে সেহিরি
দেশ: তিউনিশিয়া
ভাষা: আরবি ও ফারসি