ভূতগ্রস্তর মতো রাত নামছিল। কুচি কুচি বরফের মতো ফায়ারিং। পিছনে একাধিক ইজরায়েলি ট্যাংক। তাড়া করছে। সামনে একজন ফিলিস্তিনি নারী। গর্ভবতী। যেন সেই শীতরাতের ধারাবাহিক আর প্রলম্বিত অন্ধকারে, আরও দু’মাস পেরিয়ে, একজন শিশু জন্ম নিয়েছে। চোখ খোলামাত্র আলো দেখতে পায়নি। কারেন্ট নেই। ওম বলতে পেয়েছে বিস্ফোরণের তাপ। প্রথম যে শব্দ প্রবেশ করেছে কর্ণকুহরে, তা ঝাঁঝরা করে দেয় অপাপবিদ্ধ ঘুম অথবা একশো হাজার মানুষ। গাজার মৃত কোনও রাস্তায়, নিমাহ কাঁদছে দারুণ। সদ্যোজাতর কান্না। প্রতিরোধের মতো। নিমাহ— অর্থ হয়, খোদার উপহার; ছ’মাস, খুশবুদার কোনও মলম লেপেছে সভ্যতার আত্মায়!
এ যেন সমগ্র একটি ভূখণ্ডের ট্রমা! যুদ্ধের। গণহত্যার। গৃহহীনতার। ইনফাইনাইট লুপের মতো। এক প্রজন্ম থেকে আর-এক প্রজন্মে। ব্যক্তি থেকে সম্মিলিত চেতনায়। স্তরে স্তরে সঞ্চারিত। যে লুপের ভেতরে জল নেই। পুষ্টি নেই। ওষুধ নেই। কেবল মাংসপোড়া গন্ধ। পনেরো বছরের হুসেম যখন যুদ্ধধ্বস্ত রাফা শহরের পথে পথে হাঁটে, একাকী, সে বলছে, নিজেকে তার মনে হয়— প্রেত! জন্মাবধি পেশি এবং স্নায়ুতে যেন বহন করছে এক গভীরতর আঘাত। আমরা জানি, সেই আঘাত অদৃশ্য অথচ থলথলে জোঁকের মতো আটকে থাকবে ছেলেটার চেতনায়। বাৎসল্য কী, সে বোধ করেনি কখনও। শুধু জানে সারভাইভ করতে হবে। প্যারাসুটে উড়তে উড়তে ত্রাণসামগ্রী আসবে। ছিনিয়ে নিতে হবে। অনন্তকাল ধরে। একা।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন-এর একটি মেডিক্যাল টিম পৌঁছেছিল গাজায়। সঙ্গে আইভি ফ্লুইডস, স্যালাইন, আইভি অ্যান্টিবায়োটিক। মূলত ট্রমা থেকে সাময়িক স্বস্তি দেয়। যেহেতু পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পোস্ট-ট্রমাটিক ডিজঅর্ডারে ভুগছেন ৬৯% গাজাবাসী। যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্রনিক। একজন কর্মী বলছিলেন, নিরন্তর অসহায়তা, অনিশ্চয়তার উদ্বেগ আর মৃত্যুভয়— একেবারে হাঁ-মুখে গিলে খেয়েছে তরুণ প্রজন্মের সম্পূর্ণটা। তারা গুলিবিদ্ধ দেওয়ালে অথবা আঁকার খাতায় যে ছবি আঁকে, সেখানে ভাঙা দোলনা। পুড়ে ছাই বাড়ি। কালো কালো ধোঁয়া। কাছেই কোথাও বম্বিং হয়। আত্মা কেঁপে গিয়ে তবু সে জগৎ-জুড়োনো হাসি হাসে। ঘুমোতে যায় দু-হাতে কান চেপে। শক্ত করে। সেই কর্মী বলছিলেন, কোনও কোনও নারী এসেছিলেন, খাদ্য নয়, মানসিক সুস্থতার প্রত্যাশায়!
আরও পড়ুন : কম্পিউটারের জনক কি প্রথম কম্পিউটারটি সফলভাবে বানিয়েছিলেন?
লিখছেন অতনু বিশ্বাস…

আসলে রক্তের অন্তর্গত বোধ অথবা বিস্ময়ের পুরোটাই ভয়। শোক। মনে পড়ছিল, বাদল সরকারের নাটক— ‘ত্রিংশ শতাব্দী’। হিরোশিমা ইউনিভার্সিটির এমিরেটাস অধ্যাপক এবং এক্স প্রেসিডেন্ট, ডক্টর ওসাদা আশ্চর্য একটি কাজ করেছিলেন। হিরোশিমার অভিজ্ঞতা কেমন? লিখিত আকারে সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। প্রায় ৩২টি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের থেকে। ২০০০ রচনা। ‘ত্রিংশ শতাব্দী’-তে যখন চরিত্র হয়ে উঠেছেন ওসাদা, পড়ে শোনাচ্ছেন এইকো মাৎসুনাগার কথা। ক্লাস ফাইভ। সে খেতে বসে দেখেছিল কমলা রঙের উজ্জ্বল একটা আলো। তারপর মাৎসুনাগা লিখছে: ‘যখন চোখ খুললাম, দেখি চারিদিক সাদা ধোঁয়ায় ঢাকা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেলাম। দেখলাম ডান পা-টা মাটিতে পুঁতে আছে…দাদা ততক্ষণে আমার বোনকে টেনে বের করছে। চুলগুলো একেবারে সাদা, মুখের পাশটা কেটে ফাঁক হয়ে আছে, মাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে, আর টকটকে লাল রক্ত বেরিয়ে আসছে সেখান দিয়ে…’
মাৎসুনাগা হাঁটতে পেরেছিল। দেখেছিল আগুনে পুড়ে যাচ্ছে তার আস্ত পরিবার। বারো বছরের ফিলিস্তিনি কিশোর সামিরের বাঁ পা নেই হয়ে গেছে। একটি ইজরায়েলি সুইসাইড ড্রোনের হামলায়। যেমন নেই হয়ে গেছে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন! সে দেখেছে তারই প্রতিবেশে, কারও হাত নেই। পিঠ থেকে একখাবলা মাংস উঠে গেছে। মা আর বাবাকে হারিয়ে থ মেরে গেছে কেউ আর কোলের ওপর ঘুমচ্ছে ছোট বোন। এই যে ক্রমাগত উপড়ে ফেলা, ঘর কিংবা পরিবারের আশ্রয় থেকে, পাশবিকভাবে, ফলস্বরূপ সে নিজেকে মনে করে জগৎ-বিচ্ছিন্ন। সোশ্যাল সিস্টেম ভেঙে যাচ্ছে তার। মনোবিদরা বলছেন, যেহেতু কোনও ইমোশনাল সংযোগ তৈরি হচ্ছে না, তাই আরও দশ-বারো বছর পেরিয়ে, সে উন্মাদ হয়ে যেতে পারে। দুনিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পারে অস্বাভাবিক কোনও ভাষায়। ভাবতে শুরু করে, সে যেন অপ্রেসড। সর্বক্ষণ একটা খাঁচায় বন্দি। এ আসল কলোনাইজড ট্রমা।

ফ্রানৎজ ফাঁনো লিখেছিলেন কমিউনিটি সাইকোলজির কথা। তিনি বলছেন, উপযুক্ত ত্রাণসামগ্রী পেয়েও বহু ট্রমাটিক রোগী সুস্থ হতে পারেনি উত্তর আফ্রিকায়। তবে যে বিষয়টি আশ্চর্যের—সেইসব রোগীদের যদি আপন পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, তবে সে সুস্থ হয়ে ওঠে দ্রুত। পাশাপাশি ফাঁনো বলেন, ‘ডিকলোনাইজ দ্য মাইন্ড’। দেখুন মানসিক এবং শারীরিক ট্রমা কী ভীষণ রাজনৈতিক! গাজা ভূখণ্ডে এমন মানুষ অসংখ্য, যাদের মস্তিষ্ক জুড়ে আছে এক স্বাধীনতার ধারণা। মুক্তির আস্বাদ। সেইটুকু পেলে যেন সুস্থ হবে সে। মুছে যাবে এ-জন্মের যত ট্রমা।
শোনা যায়, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরে আমেরিকান সৈন্যবাহিনীর অধিকাংশের মধ্যেই মানসিক বিকলনের আভাস পাওয়া গেছিল। যুদ্ধ-পরিস্থিতির ট্রমা। সেই সময় আমেরিকার পক্ষ থেকে প্রচুর চেষ্টা করা হয়েছিল, জনগণের সিমপ্যাথি অর্জনের। অপরদিকে স্ট্যানলি কুব্রিক তৈরি করেছিলেন ‘ফুল মেটাল জ্যাকেট’। মনে পড়ছে, যে, সৈন্যদল যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, রাতে ঘুমতে যেতে যেতে বলে, রাইফেল আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। রাইফেল ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন। অথচ প্রাইভেট পাইল একটু নরম মনের। হোঁচট খায়। খিস্তি খায়। যুদ্ধের সঙ্গে যুঝতে পারে না কিছুতেই। মস্তিষ্কে জমতে শুরু করে যুদ্ধ, রাইফেল, হত্যা— সমস্তটা মিলিয়েই এক ট্রমা। তারপর একদিন প্রাইভেট পাইল উন্মাদ হয়ে যায়। একা একা বাথরুমে গিয়ে বসে একদিন। রাইফেল হাতে। সার্জেন্ট বাথরুমে ঢুকলে সে তাকে গুলি করে মেরে দেয়। পরমুহূর্তে নিজেকেও। স্ট্যানলি কুব্রিকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লোজ-আপ শটে, প্রাইভেট পাইলের যে না-মানুষের মতো মুখের ওপর আলো এসে পড়েছিল, ওই আসলে ট্রমা। যুদ্ধের। গণহত্যার… যারা সহ্য করতে পারে, ফিরে আসে। গাজা ভূখণ্ডে। স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন দেখে। যাবতীয় ট্রমা তুচ্ছ করেই।