বায়রন ও ব্যাবেজ

Representative image

‘বায়রন অ্যান্ড ব্যাবেজ: আ ক্যালকুলেটিং স্টোরি’ ২০২১এর এক গুরুত্বপূর্ণ এবং চিত্তাকর্ষক তথ্যচিত্র। মার্কিন তথ্যচিত্র পরিচালক রোজমেরি রিড-এর পরিচালনায় তৈরি। এটি উনিশ শতকের এক তরুণী অভিজাত ব্রিটিশ মহিলা অ্যাডা বায়রন লাভলেস এবং একজন অভিনব গণিতবিদ, যান্ত্রিক প্রকৌশলী, দার্শনিক এবং উদ্ভাবক চার্লস ব্যাবেজের মধ্যে এক অস্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক জোটের গল্প।

কম্পিউটার ছাড়া আজকের দুনিয়ায় এক পাও চলা অসম্ভব। কিন্তু তা তৈরি খুব একটা সহজে হয়নি। উনিশ শতকের প্রথম দিকেই প্রথম যান্ত্রিক কম্পিউটারের ধারণা তৈরি করেন ব্যাবেজ, যা তিনি ঘোষণা করেন ১৮২২ সালের এক গবেষণাপত্রে। এই চার্লস ব্যাবেজ-কেই সাধারণভাবে বলা হয় কম্পিউটারের জনক। তিনি পরিকল্পনা করেন একটি ডিজটাল প্রোগ্রামেবল কম্পিউটারের। সে-প্রকল্পের ছবি দেখলে তার সঙ্গে আজকের কম্পিউটারের মিল খুঁজে পাওয়া অবশ্য কঠিন হতে পারে।

আরও পড়ুন: ‘অন্ধের স্পর্শের মতো’ আধুনিক যন্ত্র কীভাবে বদলে দিল দেখার বিজ্ঞান? লিখছেন অঙ্কন ঘোড়ই…

অত্যন্ত প্রতিভাবান, ধনী সমাজের উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যাবেজের জন্ম ১৭৯১ সালে। ব্যাবেজের জীবনী বলছে, ছোটবেলায় মূলত বাড়িতেই পড়াশোনা করেছেন তিনি। ১৮১০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময়ে গণিতে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন চার্লস ব্যাবেজ। স্নাতক হওয়ার পরে ব্যাবেজকে ক্যালকুলাস পড়ানোর জন্য নিয়োগ করে রয়্যাল ইনস্টিটিউশন। দু’বছরের মধ্যে তিনি রয়েল সোসাইটির সদস্যও নির্বাচিত হন। তাঁর কেমব্রিজের বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ১৮২০তে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেন ব্যাবেজ। এই সোসাইটিই প্রথম চ্যালেঞ্জ করে রয়্যাল সোসাইটির আধিপত্য। ১৮২৮ থেকে ১৮৩৯ পর্যন্ত কেমব্রিজে গণিতের লুকাসিয়ান অধ্যাপক ছিলেন চার্লস ব্যাবেজ।

ব্যাবেজকে আজ এবং সুদূর ভবিষ্যতেও স্মরণ করার অন্যতম কারণ হল— কম্পিউটার আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তাঁর দিকচিহ্ন নির্দেশক প্রাথমিক অবদান। সে-সময়ের প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের এক বিশেষ অপূর্ণতা বিশেষভাবে হতাশ করে ব্যাবেজকে। সেই অপূর্ণতা হল গণিত টেবিলের গণনায় ত্রুটির উচ্চ হার। গণিতের গণনার জন্য এই টেবিলগুলি তৈরি করত মানুষ। আর তাতে ভুল থাকত প্রচুর। ১৮১২ সালে অ্যানালিটিক্যাল সোসাইটিতে নিজের ঘরে বসে লগারিদমের এমনই একটি টেবিল দেখছিলেন ব্যবেজ। তিনি জানতেন যে মানুষের হাতে তৈরি এই টেবিল ভুল-ত্রুটিতে ভরা। ঠিক তখনই তার মাথায় আসে যন্ত্রের সাহায্যে সমস্ত ট্যাবুলার ফাংশন গণনা করার ধারণা।

এ-জন্য ব্যাবেজ নতুন এক পদ্ধতির পরিকল্পনা করেন, যা যান্ত্রিক গণনার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। যন্ত্রকে দিয়ে গণনা করানোর এই দুঃসাহসিক রূপকথাটা কল্পনা করার জন্যই বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর জায়গা একদম পাকা। ১৮২২ সালে তিনি পরিকল্পনা করেন ডিফারেন্স ইঞ্জিন নামে একটি বিশাল যন্ত্রর, যা হবে পলিনোমিয়াল ফাংশনের মান গণনার যন্ত্র। প্রাথমিকভাবে তৈরি করা হয় একটি ছ’চাকার মডেল, এবং তা প্রদর্শিতও হয় বেশ কিছু দর্শকের সামনে। এই যন্ত্রের নকশাটি বাস্তবায়নের জন্য ১৮২৩ সালে ব্যাবেজ নিয়ে আসেন জোসেফ ক্লিমেন্ট নামে একজন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারকে। ক্লিমেন্ট কাজ করতেন উচ্চমানের। কিন্তু ১৮৩১ সালের দিকে এই যন্ত্র নির্মাণের খরচ নিয়ে তাঁর এবং ব্যাবেজের মধ্যে দেখা দেয় মতবিরোধ।

এরপর আরও বড়, উন্নত মেশিন ডিফারেন্স ইঞ্জিন ২ তৈরির পরিকল্পনা করেন ব্যাবেজ। যদিও ডিফারেন্স ইঞ্জিন তৈরির প্রচেষ্টা অবশেষে ভেঙে পডট। ব্যাবেজ একটি ভিন্ন, আরও জটিল যন্ত্র, যাকে বলা হয় অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন ডিজাইন করতে শুরু করেন, যা পাঞ্চ কার্ড ব্যবহার করে প্রোগ্রাম করার উপযোগী। কম্পিউটারের পথিকৃৎ হিসেবে ব্যাবেজের খ্যাতি মূলত এরই জন্য। আজকের কম্পিউটারে সংখ্যা এবং অন্যান্য অনেক মৌলিক উপাদান সংরক্ষণের জন্য যে মেমরি ইউনিট থাকে, তার রূপকল্পনা ছিল এই অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের মডেলে।

সে-সময়ের প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের এক বিশেষ অপূর্ণতা বিশেষভাবে হতাশ করে ব্যাবেজকে। সেই অপূর্ণতা হল গণিত টেবিলের গণনায় ত্রুটির উচ্চ হার। গণিতের গণনার জন্য এই টেবিলগুলি তৈরি করত মানুষ। আর তাতে ভুল থাকত প্রচুর। ১৮১২ সালে অ্যানালিটিক্যাল সোসাইটিতে নিজের ঘরে বসে লগারিদমের এমনই একটি টেবিল দেখছিলেন ব্যবেজ। তিনি জানতেন যে মানুষের হাতে তৈরি এই টেবিল ভুল-ত্রুটিতে ভরা।

ব্যাবেজের বিতর্কিত উদ্যোগটি কিন্তু আগ্রহ জাগিয়ে তোলে একজন ব্রিটিশ তরুণীর। সেটা ১৮৩৪ সাল। অসাধারণ প্রতিভাময়ী এই তরুণী হলেন অ্যাডা বায়রন, যিনি অগাস্টা অ্যাডা বা কাউন্টেস অফ লাভলেস নামেও পরিচিত। রোমান্টিক কবি লর্ড বায়রনের একমাত্র বৈধ কন্যা এই অ্যাডা, যাকে মনে করা হয় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর প্রবর্তক। চার্লস ব্যাবেজের অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন-এর একটি বর্ণনাও লেখেন তিনি। অসাধারণ এই ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যাডা একটি প্রোগ্রাম লিখেছিলেন অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের জন্য। কিন্তু ব্যাবেজের জীবদ্দশায় এটি বা ডিফারেন্স ইঞ্জিন ২ কিছুই তো শেষ হয়নি।

অ্যাডা বায়রন

১৮৭১ সালের ১৮ অক্টোবর মারা যান ব্যাবেজ। চার্লস ব্যাবেজের গল্প তাই আদপে কম্পিউটারের গোড়ার কথা। ব্যাবেজ বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার আবিষ্কার করলেও, ব্যর্থ হয়েছিলেন এটি তৈরি করতে। এই সবটা মিলেই ব্যাবেজের বিস্ময়কর লেগাসি।

ব্যাবেজের যন্ত্রগুলির মৌলিক স্থাপত্য ছিল আধুনিক কম্পিউটারের মতোই। ডেটা এবং প্রোগ্রাম মেমরি ছিল পৃথক, পরিচালনা ছিল নির্দেশ-ভিত্তিক; পাশাপাশি যন্ত্রটির ইনপুট/আউটপুট ইউনিট ছিল পৃথক। তাই কম্পিউটারের আবিষ্কারকের নাম-ঠিকানা একেবারে পরিষ্কার। সে কম্পিউটার সে-সময়ে রূপ না পেলেও। এবং সেই সঙ্গে পরিষ্কার তার প্রথম প্রোগ্রামারের নামও। আসলে কম্পিউটারের যে রূপ আমরা আজ দেখি তা তো আর একদিনে আসেনি। এসেছে বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। যেমন, মস্ত আকারের মেইনফ্রেম কম্পিউটার থেকে শুরু করে ছোট্ট ডেস্কটপ কম্পিউটারের আবিষ্কারই তো একটি বহুমুখী গল্প, যাতে রয়েছে নানা ব্যক্তির অবদান। কিন্তু স্পষ্টভাবে কোনও একক ব্যক্তিকে যদি কম্পিউটারের স্রষ্টার মর্যাদা দেওয়া হয়, তিনি চার্লস ব্যাবেজ। যার সঙ্গে প্রোগ্রামিং-এর যুগলবন্দি ঘটিয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানের পথিকৃৎ হয়ে রয়েছেন অ্যাডা বায়রনও।