ইচ্ছেউড়ান

Representative Image

সেপ্টেম্বর মাস পড়লেই আমরা চাঁদার বই হাতে তোমার বাড়ি যাব। আমরা মানে আমি, রুম্পা, মিমি, তুতুল, ঝিলিক আর ওর বোন। এই ধরো দুপুর-দুপুর, মেসোমশাই যখন আপিসে। যেমন সুযোগ বুঝে প্রতিবছর আসো তুমি; সঙ্গে থাকে রণিদা, তাতাই, বুড়ো, তুহিনদা আর গোগোল, ঠিক তেমনি। আর তুমিও আমারই মতন কীভাবে যেন আগে থেকে জেনে যাবে আমরা সোসাইটির চাঁদা কালেকশনে বেরিয়েছি। গেল দু’দিন গোধূলি বিকেলে অপেক্ষা করেছ তাই, যেমনটা আমি তোমার জন্য করি, প্রতিবছর।

আমার জানো তো, সেই ছোট্টবেলা থেকে তোমাদের মতো বাড়ি-বাড়ি চাঁদা তুলতে যাওয়ার সাধ। ঝিলিকের বোনেরও। সত্যি। ও নিজে বলেছে আমায়— দুর্গাপুজোর চাঁদা তুলতে আমরা মেয়েরা দলবল নিয়ে সোসাইটির বাড়ি-বাড়ি যাব। কলিং বেল বাজিয়ে দরজা খোলার ওয়েট করব, তারপর খসখস করে চিরকুট কেটে দেব— ‘অমুক নম্বর ফ্ল্যাট থেকে অমুক পরিমাণ মূল্য দুর্গাপুজোর চাঁদা বাবদ ধন্যবাদপূর্বক গৃহীত হল।’ মাসিমা পেছন থেকে বলবেন, ‘ওরে দাঁড়া তোরা, দুটো জল-মিষ্টি খেয়ে যা’। আমরা গম্ভীরভাবে বলব, ‘অসম্ভব মাসিমা, এখনও গোটা ডি ব্লক কভার করা বাকি।’

কী দারুণ ব্যাপার বলো তো! কিন্তু ওই, ঝিলিকের বোনেরও আমারই মতো কপাল। ওর মা-ও ওকে এসবের জন্য ছাড়ে না বাড়ি থেকে। অবশ্য ছাড়লেই বা লাভ কী? পুজো কমিটির কাকুরা তো কখনও তোমাদের মত আমাদের ডেকে বলে না- ‘চাঁদার বই এসে গেছে। পরের সপ্তাহে স্লিপ দিয়ে দিস বাড়ি-বাড়ি।’

আরও পড়ুন: কেবলই বিপ্লবীর প্রেমিকা! প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে মর্যাদা দেয়নি প্রগতিশীল ভারতীয়রাই! লিখছেন সম্প্রীতি চক্রবর্তী…

আমার আরও কতশত ইচ্ছে হয় জানো? ইচ্ছে হয় চতুর্থীর দিন রাত্রিবেলা খাওয়াদাওয়ার পর লরি করে তোমাদের মত দলবেঁধে দুর্গাঠাকুর আনতে যাই। তোমরা রাত্রিবেলা ঠাকুর আনার সময়ে বন্ধুরা মিলে খুব মজা করো, না? কী করো? আড্ডা মারো, গান করো, ইয়ার্কি মারো… আমি আসলে কখনও অত রাতে বাড়ির বাইরে থাকিনি তো, তাই জানিনা। তুতুল, ঝিলিকরাও থাকেনি; তাই ওদের থেকেও জানা হয় না। জানো তো, আমাদের মেয়েদের কোনওদিন জানাই হয় না যে, রাতের খোলা আকাশের নীচে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাটা কেমন হয়। কিন্তু আমাদেরও খুব জানতে ইচ্ছে হয়। বলি না, কেউ সে-ইচ্ছের দাম দেবে না তাই।

আমি একটুও চাই না সপ্তমীর সকালে মায়ের সঙ্গে ত্রিপত্র ছাড়াতে; ঘটের গায়ে স্বস্তিক আঁকতে কিংবা প্রসাদের কুচোফল কাটা শিখতে। আমি চাই তোমার মতো মই বেয়ে উঠে প্যান্ডেলের বাঁশ সিধে করতে। আমি চাই ঢিলে সামিয়ানার কোণ ঠিক করে দিলে পুরুত মশাই আমার দিকে তাকিয়েও হেসে বলুক, ‘এতক্ষণে কেউ একটা কাজের কাজ করল।’

কাজের কাজ! তাই বটে। শুধু তোমাদের কাজগুলোই কেমন কাজের কাজ দেখো। অথচ তোমার, আমার, ঝিলিক, তুতুল, বুড়োদা— কারও মায়ের পুজোর সকাল-বিকেল নিঃশব্দে ফল কাটা, ভোগ রাঁধা, প্রসাদ বাড়া, সলতে পাকানো, নৈবেদ্য সাজানোর মতো কাজগুলো কোনও কাজই নয়। কাউকে কখনও দেখেছ ওগুলোকে গুরুত্ব দিতে? বলতে যে, বাহ্‌, কী সুন্দর ফল কেটেছ তুমি! দেখোনি। কারণ আমরা ধরে নিই যে, ওগুলো এমনিই হয়, এমনিই হয়ে যাবে…

জানো তো, আমার মনে হয় দুর্গাপুজোর মহাযজ্ঞে মেয়েদের ভূমিকা অনেকটা মল্লিকা সেনগুপ্তের ভাষায় বিপ্লবের ময়দানে সেবাদাসীর কাজের মত। তারা আছে, সর্বত্র আছে; তবু নেই, সর্বত্র নিশ্চিহ্ন। কিন্তু আমি তো তা হতে চাই না। আমি চাই অষ্টমী পুজোর বিকেল গড়ালে আমাকেও পাড়া থেকে নিভে যাওয়া প্যান্ডেলের আলো সারাতে ডাকা হোক। মা-মাসিরা বারণ করবে না কেউ; বলবে না— সেকি! এসব মেয়েদের কাজ না কি? আমি বেরিয়ে যাব ঘরের জামা পরেই। আয়না দেখব না, চুল আঁচড়াব না, মাপব না জামার ঝুল। তারপর ঠিক তোমার মতোই প্যান্ডেলে গিয়ে দাঁত দিয়ে তারের প্লাস্টিক কোটিং ছিঁড়ে ভোল্টমিটারে ডগা স্পার্ক করে খুঁজে নেব ‘ফল্ট’। বাবা এসে পাশে দাঁড়িয়ে মেকি অসন্তোষ দেখিয়ে প্রশ্রয়ের সুরে বলবে, ‘সাবধান। আর্থিং-এ গন্ডগোল আছে কিন্তু। ‘আর তক্ষুনি, ঠিক তক্ষুনি তোমার মতন আমিও জেনে যাব যে, বাবা আজ আমার মধ্যে নিজের অতীতের শক্তি আর ভবিষ্যতের নির্ভরতা একসঙ্গে খুঁজে পেলেন। নিজের মা-বউ-মেয়েদের মধ্যে কোনওদিন যা দেখেন না তারা।

জানো আমার একটা গভীর, গোপন সাধ জাগে মাঝে-মাঝে। ইচ্ছে করে, নবমীপুজোর দিন সন্ধেবেলা তুমি যেখানে বসবে, আমি তার একটু দূরেই চেয়ার টেনে বসব মুখোমুখি।  হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঝারি মারব তোমায়। লুকিয়ে নয়; তোমার মতন করে আমিও সটান চোখে চোখ রাখব তোমার। তারপর ঝারা তিন মিনিট তাকিয়ে থাকব স্থির। তখন শুধু ঢাকের আওয়াজ, ধুনোর গন্ধ আর নবমীপুজোর সন্ধ্যারতির তাপটুকু ছাড়া সব নিভে যাবে আশপাশে। আর আমি আরও, আরও অনেক গভীরে দেখব তোমায়। যেভাবে তোমায় কেউ কোনওদিন দেখতে পায়নি, দেখবে পাবে না কোনদিনও; সেইখানে তোমার প্রশ্বাস আমি ভরে নেব বুক জুড়ে। তোমার বিন্দু-বিন্দু ঘাম দিঘি ভরে বয়ে এনে ফুটিয়ে দেব পারিজাত ফুল।

কী বললে, দেখে ফেলবে সবাই? তা দেখুক। তুমি তো জানো, তোমার মতো আমারও প্রেমে বীর হওয়ার সাধ জাগে বড়। তুমি যখন পুজোর সময়ে আমায় শাড়িতে দেখে ওপেনলি ফ্লার্ট করো, তোমায় কি কেউ নষ্ট ছেলে বলে? আমাকেই-বা কেন বলবে বলো তাহলে?

দশমীর দিন বুঝলে, আমার বড় দায়িত্ব থাকবে। সিঁদুরে অ্যালার্জি, আমি বরণের বদলে বরং তোমার মতই মাচা বেঁধে ভাসানের গাড়িতে ঠাকুর তোলার দায়িত্বটা নেব। না, না একা তো পারব না, ঝিলিক, মিমিদেরও সঙ্গে নিতে হবে। ওদেরও খুব ইচ্ছে, জানো? কেউ করতে দেয়নি কখনও, তাই করেনি আরকি। কী বললে, গায়ের জোর কম? সে তুমি জানো না তাই বলছ। বিকেলে ‘ভারী’ জল দিতে না এলে, আমরা প্রত্যেকেই যে কতবার দু-হাতে দশ লিটারের বালতি চাগিয়ে ওপর নীচ করি, সেসব কি ছাই জানো!

বাবুঘাটে ঠাকুর ভাসানের সময়, তোমার মতই গঙ্গায় নামব আমি। ঘাট পেছল, আমি নামছিও প্রথমবার। তবু কেউ বারণ করবে না জানো। সবাই যেন জেনে গেছে ততক্ষণে, যে সবই আসলে তোমার, আমার, সবার মিলিত কাজ। ফারাক নেই কোত্থাও। ঘটে করে গঙ্গাজল তুলে ফেরার সময় তাই তোমার মতোই লরির ছাদে বসব আমি। প্রতিবারের মতো গাড়িতে ফিরব না কাকিমাদের সঙ্গে। আমার কতদিনের সাধ; ভাসান থেকে ফেরার পথে লরির মাথায় শুয়ে তোমার মত আমিও খোলা আকাশের নীচে মেলে দেব উৎসব শূন্য বুক। রাতের অন্ধকারর তারা দিয়ে শুষে নেবে আমার অপ্রাপ্তিগুলো।

জানো একবার একটা সিনেমা দেখেছিলাম। বেজিং শহরের এক বুড়ো ভদ্রলোক, শহর থেকে প্যাকার্স অ্যান্ড মুভার্সের টিম এনেছেন গ্রামে। আর তারপর একটা ধূ-ধূ মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের বলছেন, এটাই আমার বাড়ি, তোমরা জিনিসপত্র সব ঘর থেকে বার করে গাড়িতে তোলো। কোম্পানির লোকজন তো অবাক, খানিক বিরক্তও। ভাবছে আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল। এদিকে ভদ্রলোক বলেই চলেছেন— আরে কী হল, শুরু করো?

‘হান্ড্রেড ফ্লাওয়ার্স হিডেন ডিপ’ সিনেমাতে ক্রমশ আমরা দেখতে পাই যে গল্পের প্রোটাগনিস্ট বুড়ো লোকটার অতীত কল্পনার বাড়িটির সঙ্গে প্যাকার্স অ্যান্ড মুভার্স কোম্পানির লোকজনও ধীরে-ধীরে মিশে যাচ্ছেন ক্রমশ। শূন্যে হাত মেলে সত্যি-সত্যিই তারা সেই নির্মাণটিকে ছুঁতে পারছেন। তুলতে পারছেন, সরাতে পারছেন অদৃশ্য সব জিনিসপত্র।

আমিও ঠিক এমনটাই বলতে চাইছি জানো? শুধু পার্থক্য এই যে, সিনেমায় নির্মাণটা অতীতে ছিল, প্রোটাগনিস্ট তা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছিলেন। আর আমার ক্ষেত্রে নির্মাণটা ভবিষ্যতে হবে, যা আমি বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি।