মশগুল : পর্ব ১৬

‘অনুষ্টুপ’-এর আড্ডা…

এই ২০২৫ সালে অনুষ্টুপ-এর সূত্রপাত ভাবতে গেলে গত শতাব্দীর আড্ডার তৎকালীন মহিমার কথা ভাবতে হবে। আর সেই ১৯৬৪-’৬৫ সালে প্রেসিডেন্সি-স্কটিশের ছাত্র-ছাত্রীরা এক জায়গায় হলেই যে আড্ডা হত, তার বিষয়বস্তু ছিল অনিবার্যভাবে ‘সাহিত্য’। আর সেই বয়সে সাহিত্য বলতে মূলত কবিতার কথাই ভাবা হত। কী করে যে ‘নিরালা’ রেস্টুরেন্টে রিসেস-পিরিয়ডে নিছক টিফিন, চা ও ধূমপান সহযোগে আড্ডা, এবং সেই আড্ডা থেকে জন্মাচ্ছে তিন-তিনটি লিট্‌ল ম্যাগাজিন, এখন ভাবতেও অবাক লাগে। আর সেই আড্ডা ক্রমশ লেখালিখি এবং সেই লেখা, পড়ার আনন্দে মশগুল হওয়ার ক্রমবিবর্তন। সাহিত্যের সেই আড্ডায় রাজনীতি ছিল না এমনটি নয়, কিন্তু বামপন্থা ও দক্ষিণপন্থায় তেমন রেষারেষি ছিল না। সেসব নিয়ে কখনও কখনও তুমুল বিতর্ক হত, কিন্তু তাতে মনোমালিন্য ছিল না। ছিল এক বৌদ্ধিক চর্চার ক্ষেত্র।

সেই সময় ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার রমরমা। শক্তি-সুনীল-শংকর-তারাপদ রায়, সন্দীপনদের কবিতা তরুণদের অবশ্যপাঠ্য। এই কবিতাপ্রেমীদের মধ্যে তখন এসএফআই ও সিপির ভেদাভেদ ছিল না। কেবল কবিতার গুণাগুণ বিচার করা হত। সেই সময় আমাদের আড্ডার বন্ধুরা দু-দু’টি পত্রিকা করলেন। একটি ‘অনন্যা’, অন্যটি ‘অত্বর’। প্রথমটি কবিতা, গল্প, ইত্যাদি সবই। আর অত্বর-পত্রিকাটি কেবল কবিতা ও কবিতার আলোচনার জন্য। ‘অত্বর’-এ শুভঙ্কর ঘোষ উদার বামপন্থী, কিন্তু কবিতার গুণাগুণ বিশ্লেষণে তাত্ত্বিক। শ্যামসুন্দর তখন প্রেমিকার জন্য মশারি টাঙাচ্ছেন কবিতায়। এসব দেখেশুনে এবং এই আড্ডাসমূহে অংশগ্রহণ করে আমরাও ঠিক করলাম, একটি পত্রিকা করব।

আরও পড়ুন: বাদল সরকারের সঙ্গে আড্ডা ‘পথসেনা’-কে অন্য দিশা দেখিয়েছিল! অতনু মজুমদারের কলমে ‘মশগুল’ পর্ব ১৫…

প্রায় ত্রিশজন কিশোর এক হলাম। নিয়মিত কফি হাউসে দল বেঁধে বসা, আড্ডা, ভাগ করে কফি খাওয়া। কফি হাউসে ঢুকে ডানদিকের অংশে বিকেলে শক্তি-সুনীল-শংকর প্রভৃতিরা, মাঝে মাঝে ‘এক্ষণ’-এর নির্মাল্য আচার্য, ইন্দ্রনাথ মজুমদারদের দেখা যেত। রবিবারে সৌমিত্র সহ ‘এক্ষণ’-এর পুরো টিম। অবশ্য সকালের দিকে। আমরা বের করে ফেললাম ‘কল্লোল’ (নবপর্যায়)। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন— ‘এক দশকে সংঘ ভেঙে যায়’। আমরা মাত্র একটি সংখ্যার পরেই বিভক্ত হয়ে গেলাম। সাতজন মিলে তৈরি হল ‘অনুষ্টুপ’— সাল ১৯৬৬, রোগা-পাতলা একটি সংখ্যা। তখন শরৎকাল। সেই যাত্রা হল শুরু ‘অনুষ্টুপ’-এর। সম্পাদক— অনিল আচার্য, সহযোগী সম্পাদক রঞ্জিৎ সাহা, অন্য পঞ্চজন সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য। কমলেশ্বর গুপ্ত, সাহানা ভদ্র, মৃণাল সেন (চিত্র-পরিচালক নয়) ছিলেন মুখ্য। আড্ডাস্থল ছিল কফি হাউস। কার্যালয় ছিল কমলেশ্বর গুপ্ত-র পার্ক স্ট্রিটের ঠিকানা। তারপর সেই সাতজনের চারজন ছিটকে গেল জীবন-জীবিকার তাড়নায়। রইল বাকি তিন।

এবার এল সাতের দশকের অভিঘাত। এল বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ। ‘অনুষ্টুপ’-এর নতুন সাপ্তাহিক আড্ডাস্থল হল পাইকপাড়া, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তরুণ অধ্যাপক দীপেন্দু চক্রবর্তীর বাড়ি রানি হর্ষমুখী রোড। প্রায় সাত-আটজনের এই আড্ডায় সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির আলোচনা ছাড়াও দপ্তরে আসা লেখাগুলি পাঠ করা হত। সাতের দশকের শেষ ভাগে সেই সংঘ-ও ভেঙে গেল। অনুষ্টুপ ভেঙে বেরিয়ে গেলেন কয়েকজন। বন্ধ হয়ে গেল সেই আড্ডা। কিন্তু দীপেন্দু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে প্রকাশিত হল নতুন একটি পত্রিকা ‘প্রস্তুতি’, যেটা পরে ‘প্রস্ততিপর্ব’ নামে কিছুদিন বেরিয়েছিল।

‘অনুষ্টুপ’-এর নিজস্ব কার্যালয় হল ’৮০-’৮১ সালে। ২-ই নবীন কুণ্ডু লেন। সেখানে বসত নিয়মিত আড্ডা। গল্পকার ও কবিরা নিয়মিত আড্ডা বসাতেন। ছিলেন প্রয়াত তপোবিজয় ঘোষ, পানিহাটি থেকে আসতেন সাধন চট্টোপাধ্যায়, ছিলেন ভগীরথ মিশ্র, অসিত চক্রবর্তী, জয়ন্ত, শংকর, রঞ্জিৎ। তরুণরা আসতেন অন্য দিনগুলিতে আসতেন অরূপ, কুণাল, হিমাদ্রি, মধু-সহ অন্যান্য অনেকে। ‘অনুষ্টুপ’ তখন একেবারে চাঁদের হাট।

শনিবার সন্ধেয় আসতেন সোমেশ্বর ভৌমিক, সোমেশ চট্টোপাধ্যায়, কল্যাণ সান্যাল। একটু সিরিয়াস আলোচনা হত। সংগীত, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব ছিল সেইসব আলোচনার বিষয়।

এখন আর আড্ডা হয় না। তবু আমরা শনিবারে অনেকে আড্ডা দিই। সেখানে মূল বক্তা অনিরুদ্ধ রাহা। আমরা মূলত শ্রোতা। আসেন সৌমেন পাল ও রাজকুমার চক্রবর্তী, সঞ্জীব, সৌমিক, সন্দীপন সেন। ‘অনুষ্টুপ’-এর ষাট বছর হয়ে গেল। এখন সময় বদলেছে। আড্ডা আর তেমন জমে না। হাহুতাশই বেশি। তবু আমরা সুসময়ের অপেক্ষায়। আবার তখন জমে উঠবে আড্ডা, যেমন ছিল গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে।