১৯৯২, ৬ ডিসেম্বর। বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়ে গিয়েছে। মানে, আরও অজস্র দশকজুড়ে ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বিষয়টিকে চিরতরে নষ্ট, ধ্বংস করে দেওয়ার ভিত্তিটি রচিত হয়ে গিয়েছে। এর ঠিক ৩ মাস পর, ১২ মার্চ, ১৯৯৩। শুক্রবারের দুপুর। বেলা ১.৩০টা থেকে ৩.৪০-এর মধ্যে ১২টি বিস্ফোরণ। ভারতের বাণিজ্যনগরী, বিনোদন-নগরীকে এক কখনও-না-ভুলতে-পারা দিন তোফা দিয়ে গিয়েছিল ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’। মুম্বই, বা তৎকালীন বম্বে জুড়ে আক্ষরিক অর্থেই যেন দুই ঘণ্টা দশ মিনিটের এক হাড়কাঁপানো চিত্রনাট্য! হিন্দু চরমপন্থীদের হাতে মসজিদ ভাঙার পর দিকে দিকে যে সাম্প্রদায়িক হিংসা শুরু হয়েছিল, তার তৎক্ষণাৎ আঁচ এসে পড়েছিল বম্বেতেও। কিন্তু ধর্ম রাজনীতির জন্য ভাল মশলা হলেও, বাণিজ্যের লক্ষ্মীর সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায়। হিন্দু ও মুসলিম ব্যবসায়ীদের একাংশ কিন্তু অচিরেই বুঝে গিয়েছিলেন, এই হানাহানিতে আসলে ব্যবসারই মন্দা। শহরজুড়ে অজস্র শান্তি কমিটিও সক্রিয় ছিল সেই সময়। ফলে বাবরি-পরবর্তী হানাহানিতে মুম্বই প্রাথমিকভাবে উত্তপ্ত হয়েও আখেরে শান্ত হয়ে যায়— প্রবল তুফানের আগে যেমন চারপাশ খুব বেশিই শান্ত লাগে! বিদ্বেষের রক্তবীজ তো মরে না। তাই বম্বের শিকড়, ঐতিহ্য, সহাবস্থান নাড়িয়ে দিতে পেরেছিল ১২টি বোমা হামলা, ২৫৭টি মৃত্যু।
নয়ের দশকের শুরুতে বম্বের ধমনি কাঁপিয়ে দেওয়া পথেই পরবর্তী বহু বছর ভারতের বহু স্থানে এমনই বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে। ২০০৩ সালের ২৫ অগাস্ট বিস্ফোরণে বম্বের গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া এবং জুয়েলারি হাব জাভেরি বাজার ধ্বংস হয়ে যায়। ২০০৬ সালের ১১ জুলাই, ব্যস্ততম সময়ে শহরজুড়ে লোকাল ট্রেনে সাতটি ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটে, ১৮০ জনেরও বেশি লোক নিহত হন। ২০০৮ সালে মুম্বইয়ের রেল স্টেশন, বিলাসবহুল হোটেল এবং একটি ইহুদি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বোমা হামলায় ১৬৬ জন নিহত হন। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ভিড়ে ঠাসা বাণিজ্য-কেন্দ্রগুলিতে প্রায় একসঙ্গে তিনটি বিস্ফোরণ ঘটে, যেখানে ২৬ জনের প্রাণ যায়। ভারত তো বটেই, শুধু মুম্বইয়েই ১৯৯৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে অজস্র বিস্ফোরণ হয়েছে। তবে উদারীকরণের হাওয়ামাখা সেই দশকে ভারতে সন্ত্রাসবাদের নতুন চেহারা জন্ম নেয় বাবরির হাত ধরে, একথা অত্যুক্তি নয়। অজস্র সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, শিশু— যারা কখনও কল্পনাও করতে পারেননি এমন ঘটবে— এই নতুন ভারত তাঁদের জমিন-আশমান দুই-ই কেড়ে নিয়েছিল।

আরও পড়ুন: পার্টিতন্ত্রর সঙ্গে কীভাবে জুড়ে গেল পেটোতন্ত্র?
লিখছেন অমিতাভ মালাকার…
৯ মার্চ, ১৯৯৩। মানে ১২ মার্চের সেই কুখ্যাত বোমা হামলার তিনদিন আগে, বম্বের বহরমপাড়া বস্তির একজন পাতি দুষ্কৃতী গুল নূর মহম্মদ শেখ, ওরফে গুল্লুকে নাগ পাড়া পুলিশ স্টেশনে আটক করা হয়। সেই সময়জুড়ে রুপোর চোরাকারবারি টাইগার মেমন দল পাকাচ্ছে। অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত ১৯ জনের মধ্যে গুল্লু ছিল একজন। এখানে মনে রাখতেই হবে, বাবরি-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক হিংসায় কিন্তু টাইগারের অফিস পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তারপরেই বম্বে বোমা হামলার মূল মাস্টারমাইন্ড হয়ে ওঠার রাস্তা খুঁড়তে থাকে টাইগার। ১৯৯৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩ সালে গুল্লুকে দুবাই হয়ে পাকিস্তানে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ৪ মার্চ গুল্লু বম্বেতে ফিরে আসে। কিন্তু এর মাঝে গুল্লুর অনুপস্থিতিতে পুলিশ তার ভাইদের আটক করে ফেলেছিল। ফলে গুল্লু আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। আশ্চর্য মজার বিষয় হল, ধরা পড়েই কিন্তু গুল্লু পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া, বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ, সাহার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং শিবসেনার দপ্তর-সহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বোমা হামলার ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা যে হচ্ছে, তা গড়গড়িয়ে স্বীকার করে নেয়। বম্বে পুলিশ ভাবে, মশকরা করছে গুল্লু। ভাবে, তাঁদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে গুল্লু। বলে খারিজ করে দেয়। আর সন্ত্রাসীরা পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে গোটা পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে এসে এপ্রিলের বদলে মার্চেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়।
আরও মজার বিষয়, টাডা আদালত যে ১০০ জনকে এই বীভৎস ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করেছিল, তাদের অনেকেই হেফাজত থেকে পালিয়ে যায়, যার মধ্যে ছিল হামলার মূল পরিকল্পনাকারী টাইগার মেমনও। পরবর্তীতে, ফাঁসি হয়েছিল মেমন পরিবারেরই ইয়াকুব মেমনের। ইয়াকুবের ভাই ঈসা এবং ইউসুফ মেমনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ইউসুফ ২০২০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।


এই বোমা হামলার পরে দাউদ ইব্রাহিমের নেতৃত্বে বম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী অপরাধী সংগঠন ডি-কোম্পানির মধ্যেও ফাটল ধরে। বোমা হামলায় ক্ষুব্ধ হয়ে ইব্রাহিমের ডানহাত ছোটা রাজন সংগঠন থেকে আলাদা হয়ে যায়। সঙ্গে নেয় সাধু, জসপাল সিং এবং মোহন কোটিয়ান-সহ বেশিরভাগ হিন্দু সহযোগীদের। রাজনের স্পষ্ট ধর্মীয়ভাবে আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে বম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ড সেই প্রথম সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে— ছোট রাজনের হিন্দু গ্যাং আর দাউদ ইব্রাহিমের মুসলিম ডি-কোম্পানি।
মুম্বইয়ের ১৯৯৩ সালের বিস্ফোরণের মূল অস্ত্র ছিল গাড়ি বোমা, স্কুটার বোমা, স্যুটকেস বোমা, জিপ বোমা — প্রায় ৩০০০ কেজি আরডিএক্স! সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই তো বিশ্ব হাড়ে হাড়ে বুঝেছিল, এই বিস্ফোরক উপাদানের ক্ষমতা। ১৯৯১ সালে এই আরডিএক্স দিয়েই হত্যা করা হয়েছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে। ১৯৯৩ সালের পর আবার মুম্বইতেই ২০০৬ সালে ট্রেনে ধারাবাহিক বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হয় আরডিএক্স। ২০০৬ সালের ১১ জুলাই, ব্যস্ত সময়ে ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে ঘটে সেই সাতটি বিস্ফোরণ, যা ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলাগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৩ সালে ছিল মূলত গাড়ি বোমা। ২০০৬ সালে বোমা রাখতে ব্যবহৃত হয় প্রেশার কুকার। মাতুঙ্গা, খার, মাহিম, যোগেশ্বরী, বোরিভালি এবং মীরা রোড এলাকায় বিস্ফোরণগুলি ঘটে, বেশিরভাগই চলন্ত ট্রেনে এবং দু’টি বিস্ফোরণ ঘটে স্টেশনে। এই হামলার পরে লশকর-ই-তৈবার সঙ্গে যুক্ত লশকর-ই-কাহার দায় স্বীকার করে। মেল করে জানায়, মূল উদ্দেশ্য গুজরাত এবং কাশ্মীর অঞ্চলের পরিস্থিতির প্রতিশোধ নেওয়া। ২০০৬ সালের ১১ জুলাই, ১১ মিনিটের মধ্যে বদলে গেছিল সাধারণ মানুষের জীবন। সাধারণ, গড়পড়তা মানুষ, যারা খেটে-খেয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। ২০৯ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু আবারও বুঝিয়ে দিয়েছিল, জীবন কী মারাত্মক রকমের অসহায়!

এখানেও মজার বিষয় হল, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাতিল সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, কর্তৃপক্ষের কাছে সামান্য কিছু তথ্য ছিল যে, একটি আক্রমণ হতে চলেছে, ‘কিন্তু স্থান এবং সময় জানা যায়নি।’ তাই নিশ্চিন্তে ছিলেন সকলে। বিপ্লব, হামলা, মৃত্যু কেন যে সরকারকে আগাম জানিয়ে ঘটে না!
তদন্তে জানা গেছিল, ‘স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’-র মদতে লশকর-ই-তৈবার কর্মী আজম চিমা ছিল এই হামলার মাস্টারমাইন্ড। নেপাল সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তান থেকে বেশ কয়েকজন লশকর-ই-তৈবার সন্ত্রাসী ভারতে ঢোকে, সমস্ত নিরাপত্তা-প্রতিরক্ষার মুখে ছাই দিয়ে। সম্ভবত, প্রতিরক্ষা-প্রশাসনের অপারগতা আর ঢিলেমির বিরুদ্ধে মোক্ষমতম থাপ্পড়টি ছিল ‘আ ওয়েডনেসডে’। ২০০৮ সালে নীরজ পাণ্ডে পরিচালিত এই সিনেমায় নাসিরুদ্দিন শাহ-অভিনীত একজন ‘কমন ম্যান’ সাধারণ মানুষের এই অনিশ্চিত জীবন, সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ, বিচারের নামে অনন্তকালের ঢিলেমি, সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তি— সবটার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন অত্যাশ্চর্য উপায়ে। ২০০৬ সালে দলা পাকিয়ে পড়ে থাকা শতাধিক ‘কমন ম্যান’-দের হয়ে সওয়াল করেছিল সেই চলচ্চিত্র। তার আগে, ২০০৪ সালেই হুসেইন জাইদির বিখ্যাত বই ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে: দ্য ট্রু স্টোরি অফ বম্বে বম্ব ব্লাস্টস’ অবলম্বনে তৈরি হয়ে গিয়েছে অনুরাগ কাশ্যপের বিখ্যাত সিনেমা ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’।


কেন এই বাবরি-পরবর্তী সময়টি এবং বিশেষ করে বম্বের বোমা হামলার উল্লেখ দরকার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আর-এক সম্প্রদায়ের বদলা নেওয়া, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়া— সবকিছুতেই তখন বড় হাতিয়ার বোমা-ই। ১৯৯৩ সালে, মুম্বইয়ে এই হামলার ঠিক চারদিন পরে বউবাজারে বোমা হামলায় ৬৯ জনের প্রাণ যায়। এই হামলার শিকড়েও ছিল সেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস! বউবাজার এলাকায় জুয়ার আসর চালাত মহম্মদ রশিদ খান। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং তার পরবর্তী দাঙ্গার পর হিন্দুদের ওপর প্রতিশোধ নিতেই কলকাতার একাধিক অংশে বোমা হামলার পরিকল্পনা করেছিল রশিদ। বিস্ফোরক মজুত করতে শুরু করেছিল। দুর্ঘটনাক্রমে যেখানে বিস্ফোরক মজুত করা হচ্ছিল, সেখানেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়।
বাবরি ছাড়াও তখন উত্তুঙ্গে খালিস্তান ইস্যু। ১৯৯১ সালেই উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপুরে বোমা হামলায় ৪০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন। বিএসটিকে এবং খালিস্তান ন্যাশনাল আর্মি এই বোমা হামলার দায় স্বীকার করেছিল। সেই সময়েই মাথাচাড়া দিচ্ছে উত্তর-পূর্বের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংকটও! ১৯৯৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর, বড়দিনে নাগা-মাওবাদী সংগঠন, এনএসসিএন-আইএম নাগাল্যান্ডের দিমাপুরের আরা মাইল এলাকায় রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে এক শক্তিশালী গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। মূল উদ্দেশ্য ছিল, নাগাল্যান্ডের তৎকালীন শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী কিহোতো হলোহোনকে হত্যা। তবে হলোহোন গাড়িতে ছিলেন না। বেঁচে যান তিনি, বিস্ফোরণে মারা যান তাঁর স্ত্রী, কন্যা, নাতি-নাতনি-সহ আরও একজন।
১৯৯৬ সালের ২১ মে দিল্লির লাজপত নগর বাজারে বোমা বিস্ফোরণে ১৩ জন সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছিল। বিস্ফোরণের ঠিক একদিন পরেই দৌসা বিস্ফোরণ ঘটে। জম্মু-কাশ্মীর ইসলামিক ফ্রন্টের ছয় সদস্যকে এই বিস্ফোরণের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ১৩ ডিসেম্বর, ২০০১। ভারতের সংসদে সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ। কমান্ডোদের পোশাকে সন্ত্রাসীরা সংসদে ঢোকে খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের স্টিকার দেখিয়ে। বিশাল গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে। ২৯ অক্টোবর, ২০০৫। দিল্লিতে তিনটি বিস্ফোরণে ৬২ জন নিহত হন। পাকিস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লশকর-ই-তৈবা ইসলামিক ইনকিলাব মাহাজ ছদ্মনামে হামলার দায় স্বীকার করে।
২০০০ সালে দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক, গোয়া এবং অন্ধ্রপ্রদেশে ইসলামপন্থী চরমপন্থী গোষ্ঠী দীনদার আঞ্জুমান বিভিন্ন গির্জায় ধারাবাহিক বোমা হামলা চালায়। ২০০০ সালের ২১ মে প্রথম অন্ধ্রপ্রদেশের মছলিপত্তনমে এক খ্রিস্টান ধর্মসভায় বোমা হামলা চালে। ৮ জুলাই, অন্ধ্রপ্রদেশে ওঙ্গোলের গেওয়েট মেমোরিয়াল ব্যাপটিস্ট চার্চ এবং তাদেপল্লিগুদেম শহরের মাদার ভান্নিনি ক্যাথলিক চার্চে বিস্ফোরণ হয়।
২০০৮ সালের ২৬ জুলাই। আহমেদাবাদে ৭০ মিনিটের ব্যবধানে ২১টি বোমা হামলা ঘটে। মারা যান ৫৬ জন। নেপথ্যে পাকিস্তানের হরকাত-উল-জিহাদ আল-ইসলামি।
কেন এই বাবরি-পরবর্তী সময়টি এবং বিশেষ করে বম্বের বোমা হামলার উল্লেখ দরকার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আর-এক সম্প্রদায়ের বদলা নেওয়া, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়া— সবকিছুতেই তখন বড় হাতিয়ার বোমা-ই। ১৯৯৩ সালে, মুম্বইয়ে এই হামলার ঠিক চারদিন পরে বউবাজারে বোমা হামলায় ৬৯ জনের প্রাণ যায়। এই হামলার শিকড়েও ছিল সেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস! বউবাজার এলাকায় জুয়ার আসর চালাত মহম্মদ রশিদ খান। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং তার পরবর্তী দাঙ্গার পর হিন্দুদের ওপর প্রতিশোধ নিতেই কলকাতার একাধিক অংশে বোমা হামলার পরিকল্পনা করেছিল রশিদ। বিস্ফোরক মজুত করতে শুরু করেছিল। দুর্ঘটনাক্রমে যেখানে বিস্ফোরক মজুত করা হচ্ছিল, সেখানেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়।
২০০৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সমঝোতা এক্সপ্রেসে বোমা হামলা হয় মধ্যরাতে। ভারত-পাকিস্তান সংযোগকারী ওই যাত্রীবোঝাই ট্রেনের দু’টি বগিতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ৭০ জন নিহত হন। এক্ষেত্রে স্যুটকেস বোমাই মূলত ব্যবহৃত হয়। এনআইএ তদন্তে জানায়, এই সন্ত্রাসী হামলায় আটজন অভিযুক্তর মধ্যে ছিলেন স্বামী অসীমানন্দ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে আগে যুক্ত ছিলেন তিনি। অবশ্য তিনি জামিনে মুক্তি পান। ২০০৭ সালে অভিযুক্ত মূল পরিকল্পনাকারী সুনীল যোশী নিহত হয় আর ২০১৯ সালে, নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় তখন, এক এনআইএ আদালত সব অভিযুক্তকে মুক্ত করে দেয়।
নব্বই ও নব্বই-পরবর্তী ভারতের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের নেপথ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে হিন্দু উগ্রপন্থীদের হাতে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের পতন। মসজিদ ধ্বংসের পর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে বঞ্চনার যে নতুন স্ফুলিঙ্গের জন্ম হয়, তা জঙ্গিদের জন্য নতুন চারণভূমি গড়ে তোলে। দেশের মধ্যে বিভেদ ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠীও নতুন করে এদেশে খাল কাটতে শুরু করে। তার সবচেয়ে দগদগে ঘা-টিই ১৯৯৩-এর বম্বে বিস্ফোরণ। দাউদ ইব্রাহিমের ডি-কোম্পানি ১৯৯৩-এর বোমা বিস্ফোরণের জন্য ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) ডিরেক্টরেটের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে। ১৯৯৪ সালে, ভারতের অন্য দুই গ্যাংস্টার, আফতাব আনসারি এবং আসিফ রাজা খান আহমেদ ওমর সাঈদ শেখের সঙ্গে তিহার জেলে বন্দি হয়। ওমর সাঈদ শেখ পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল-মুজাহিদিনের এক ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত সদস্য। জানা যায়, ওমর সাঈদই আফতাব আনসারি এবং আসিফ খানকে ভারতের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’-এ উদ্বুদ্ধ করে। বাবরির ঠিক দশ বছর পরে, ২০০২ সালের গোড়ার দিকে, গুজরাতের সাম্প্রদায়িক হিংসা ছিল আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা এই দেশে সন্ত্রাসীদের হামলায় নয়া ইন্ধন জোগায়।
১৯৯০ থেকে ২০১০ সময়পর্বে ভারতে অজস্র বোমা বিস্ফোরণ, সন্ত্রাসীদের দাপট একটিই বিষয় স্পষ্ট করে দেয় কেবল। মহাত্মা গান্ধীর একটি কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল অনুরাগের ব্ল্যাক ফ্রাইডে— an eye for an eye makes the world blind। আমরা আসলে অন্ধ হলাম, হতে চাইলাম, আর চাইলাম বলেই পারলাম।