তলপেটে যাতনা

আমাদের ছোট থেকে চেনানো হয়েছে একটা আলাদা ঘর। শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, বেগতিক দেখলে মুখে বলবে ‘অ্যাঁ’ বা ‘উঁ’। ইচ্ছেমতো করতে বলার পরিবর্তে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘হাগিস’। একটু বড় হলে বলা হয়েছে, ‘তলপেটে যাতনা’ অনুভবমাত্রই ছুটে যাবে নির্দিষ্ট ঘরে। ওই ঘরের বাইরে কক্ষনও না। লোকে বলবে ‘ন্যাস্টি’। স্কুলে পেলে হাত তুলবে। টিচার বিচার করলে, ভাল। নাহলে কাজে লাগাবে সহ্যশক্তি। চেপে থাকবে। ফার্স্ট পিরিয়ডে যাওয়ার পর, থার্ড পিরিয়ডে যেতে চাইলে দিদিমণি বা স্যার যদি অ্যালাউ না করেন, খবরদার প্রশ্ন করবে না, ‘বাথরুমটা কি তোর বাবার?’ এই বলে।

মোদ্দা কথা, ত্যাগের মোড সবসময়ে কমোডের মধ্যেই হবে। বেচাল চলবে না। কার পেটে-পেটে কত, তা না বোঝালেও চলবে! হিসি কিংবা পটি, চাপায় যে যত পটিয়সী, তার কদর তত বেশি। নইলে যে বিপদ! সুলভ যদি দুর্লভ হয়, পেটের ভেতর মল যদি ঝলমল করে বেরিয়ে আসতে চায় এবং কাছেপিঠে নিদেনপক্ষে না-পাওয়া যায় কোনও শপিং মল, তখন? ওই ‘এমারজেন্সি’তে, ‘জিন্স’-ই কি হয়ে উঠবে আমার একমাত্র বন্ধু?

নিশির ডাক এবং হিসির ডাক, কখন কীভাবে যে জীবনে এসে পড়বে, আগে থেকে কেউ-ই বলতে পারে না। বাচ্চা হলে ছাড় আছে, বুড়ো হলে মার। সুতরাং, আপনাকে খুঁজতে হবে নিরালা ঝোপঝাড়। ‘এখানে প্রসব করিবেন না’ দেওয়ালও যদি সাবালকের ঝরনাধারায় ধুয়ে যায়, এবং কুচুটে কেউ দেখে ফেলে, ব্যাস, রক্ষে নেই! বা ধরা যাক, দু-তিন বোতল বিয়ার খেয়ে বাড়ি ফিরছেন, এমন সময়ে টের পেলেন, হিয়ার মাঝে যা লুকিয়ে ছিল, তা জানান দিচ্ছে জোর। বেগের আবেগ সামলাতে পারছেন না। বাড়ি অনেকদূর। সময় কাটছে, পেটও ফাটছে। তখনও কি অপেক্ষা করবেন ওই চার দেওয়ালের? মাথায় রাখবেন হাইজিন? না কি ইউটিআই ভুলে গিয়ে বিউটি আই দিয়ে খুঁজে বের করবেন আপনার শান্তিনিকেতন? মনে রাখবেন, বসে বা দাঁড়িয়ে, যেভাবেই হোক, সংস্কার ছাড়িয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অপর নামই ‘আত্মোন্নতি’!

আরও পড়ুন: ফোন না থাকলেই এমারজেন্সি, থাকলেও কি নয়? লিখছেন প্রিয়ক মিত্র…

গোপাল ভাঁড়ের সেই নৌকাবিহারের গল্পটা মনে আছে তো, যেখানে গোপাল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে শিক্ষা দিয়েছিল ভোরের প্রাতঃকৃত্য নিয়ে? রাজা ‘এমারজেন্সি’-র মুখে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, গু-গুরুত্বর আদি তত্ত্ব। এও যেমন সত্য, সত্য এ-ও, যৌনইচ্ছা কখনও-কখনও গৌণ ইচ্ছায় পরিণত হয় চাপের মুখে। বাসুদেব দাশগুপ্ত এই বিষয় ধরে চমৎকার একটা গল্প লিখেছিলেন। নাম: ‘রিপুতাড়িত’। গল্প শুরু হয় এইভাবে, ‘তরলাকে আমার চাই। যে করেই হোক যেভাবেই হোক ওকে আমার চাই-ই চাই। আমি পাগল হয়ে গেছি ওকে দেখে। ওর প্রতি এক বর্বর কামনা আমাকে অন্ধ করে ফেলেছে, আচ্ছন্ন করে ফেলেছে আমার মন, প্রাণ, শরীর… সবকিছু। কিন্তু কিভাবে পাবো? কেমন করে পাবো ওকে?’ অর্থাৎ, কামনার দাবিতে গল্পের নায়কের পথচলা শুরু হয়, কিন্তু শেষে গিয়ে দেখা যায়, করুণ পরিণতি। তরলাকে নিয়ে আমাদের নায়ক সিনেমা যায়। রেস্তোরাঁয় বসে শুনিয়েও ফেলে নিজের ছড়ানো-ছেটানো দুঃখগান। তরলা সিম্প্যাথেটিক হয়ে আসে। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে মুখ ফুটে বলেও ফেলে, ‘আপনার মুখে আপনার ঘরের কথা শুনে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে!’ কিন্তু পরিস্থিতি যে অমন প্যাথেটিক হবে কে জানত! নায়ক যখন ভাবতে শুরু করে, ঘরে ঢুকে কীভাবে আদরের নৌকো ভাসাবে, ঠিক তখনই তার তলপেটে শুরু হয় একটা ‘পেইন’। তরলাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে সে খুঁজতে বেরোয় পেচ্ছাপখানা। এবং তা না পেতে-পেতে, ‘তলপেটের যন্ত্রণা আরও বাড়ে। সমস্ত শরীর টাটিয়ে ওঠে যেন। আমি ছুটতে থাকি প্রাণপণে।… তলপেটের নিচে মাংসের থলিটা বুঝি ফেটে যাবে এইবার। প্যান্টের পকেটে হাত চালিয়ে ওটাকে চেপে ধরি ভাল করে। কোন দিকে না তাকিয়ে পাঁই পাঁই করে ছুটে চলি আমি। সর্বাঙ্গ বেয়ে ঘাম ঝরে। গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে যায়।’ এবং সবশেষে যখন এক পার্কের ভেতরে কোনওমতে একটা জায়গা পাওয়া যায়, দেখা যায় তার ঠিক পাশেই দুটো ছেলেমেয়ে প্রেমালাপ করছে— ‘পেচ্ছাপ করতে করতে আমি ওদের চুমু খাবার শব্দ শুনি। ছেলেটা মেয়েটিকে প্রায় শুইয়ে ফেলে ঘাসের উপরে। চাপা গলায় হাসাহাসি করে। আমায় ওরা কিছু বলবে না বুঝেই নিশ্চিত আরামে আমি এদিকে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করি চোখ বুজে। শরীরের সব ভার, সব বোঝা নেমে যেতে থাকে…। পরিপূর্ণ শান্তি আর আনন্দে ভরে ওঠে মন— আ-া-া–াঃ, কি আরাম!’ গল্প এখানেই শেষ। তরলার সঙ্গে যা হতে পারত, তা আবহসংগীতের মতো ঘিরে ধরে নায়ককে। তরলা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হয়তো ততক্ষণে ফিরে গেছে। আর আমরা, পাঠকরা বুঝতে পারি, শেষ মুহূর্তে তরলার প্রতি চাপকে এক গোলে হারিয়ে দিয়েছে তরলের চাপ!

প্রশ্ন একটা থাকে অবিশ্যি। এই যে রাস্তাঘাটে বেরলে ‘প্যান্টে হয়ে যাবে’-মার্কা টেনশন কিংবা ‘আশেপাশে করার জায়গা নেই’-মার্কা অস্বস্তি, এই ‘এমারজেন্সি’-পরিস্থিতি কি আমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর চাপিয়ে দিইনি? দার্শনিক-জিজ্ঞাসায়, যাঁরা সকালে হেগেল না হতে পেরে কান্ট হয়ে বাড়ি থেকে বেরন, অর্থাৎ যাঁদের ঠিকমতো হয় না, তাঁদের কেন অপরাধীর মতো আড়ষ্ট হয়ে ঘুরতে হবে ক্ষেত্রবিশেষে? কাক-পায়রা-বেড়াল-কুকুর-ছাগল, কই এদের তো কোনও ‘এমারজেন্সি’ নেই! গোটা পৃথিবীই এদের কাছে শৌচালয়। খাটের তলা, মানুষের মাথা, গাড়ির টায়ার হয়ে রাস্তা-মাঠ-জঙ্গল-নদী— কোথাও এতটুকু সংকোচ নেই! কী সাবলীল, সহজ! এই নির্দিষ্ট ঘরের পরিবর্তে, আমাদেরও যদি বিশ্বনিখিল লিখে দেওয়া হত, পেট-গুড়গুড়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারতাম না কি? রাতের বাস কখন রাতের বাঁশ হয়ে পিছনে সেঁধিয়ে যায়, এই ভাবনার সত্যিই কি কোনও প্রয়োজনীয়তা থাকত তখন? 

গোপাল ভাঁড়ের সেই নৌকাবিহারের গল্পটা মনে আছে তো, যেখানে গোপাল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে শিক্ষা দিয়েছিল ভোরের প্রাতঃকৃত্য নিয়ে? রাজা ‘এমারজেন্সি’-র মুখে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, গু-গুরুত্বর আদি তত্ত্ব। এও যেমন সত্য, সত্য এ-ও, যৌনইচ্ছা কখনও-কখনও গৌণ ইচ্ছায় পরিণত হয় চাপের মুখে।

সাঁতার শিখতাম যখন, একজন সহ-সাঁতারু প্রায় রোজই মাঝে মাঝে হাত তুলে আমাদের ট্রেনারকে বলত, ‘স্যর, একটু এমারজেন্সি, ঘুরে আসি?’ ট্রেনার সৌরভদা, অনেকদিন বাদে একদিন তার দিকে ছুড়ে দিয়েছিল সেই অমোঘ প্রশ্ন, ‘যখন গঙ্গার বুকে এক-দেড় কিলোমিটার সাঁতার কাটবি, তখনও কি হাত তুলবি এমারজেন্সি বলে?’ ছেলেটি তারপর থেকে আর কোনওদিন কিছু বলেনি। জল আমাদের ব্যথা বোঝে, কিন্তু স্থল? নিজেকে প্রশ্ন করি, সামতাবেড়ে আলাপ হওয়া হরিদাস পাড়ুইয়ের মতো আমি কি কোনওদিন অত সহজে কাউকে বলে উঠতে পারব, ‘খাড়ায়েন কত্তা, মোরা ময়দানের খেলোয়াড়, যাব আর আইব’? জানি, পারব না। ঘাসের জঙ্গলে বড়জোর খুলতে পারি আমাদের জুতো, কাপড়জামায় লজ্জা লাগে না?

১৯০৯ সালে শান্তিনিকেতনে পড়তে গেছিলেন মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত। তাঁর ‘শান্তিনিকেতনের স্মৃতি’ থেকে সেকালের আশ্রমের জীবনধারার একটা পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, ‘তখন ছিল তিনটি পায়খানা, একশো ছেলে এবং শিক্ষকের পক্ষে তাহা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না, তার উপর ছিল দুর্গন্ধ। আমরা যাইতাম মাঠে। বিদ্যালয়ের চতুর্দিকে ছিল ঝোপ এবং লোকালয়হীন মাঠ।’ অর্থাৎ মাঠ-পুকুরে যে-মনুষ্যকুল অভ্যস্ত ছিল এতদিন, তারাই ক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে। ছুচুন্দর-কাব্যে অবধারিত হয়েছে ‘সোপ পেপার’ বা ‘টিস্যু’। হে ঈশ্বর, এই ‘কষ্ট’কাঠিন্য আর ভাল লাগে না! যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও। গুমুতবাহন হয়ে চাপ আর বহন করতে পারি না। আমরা যা পারি, তা-ই পাড়ি। কিন্তু যত্রতত্র পাড়ি না, কীরকম দ্বিধায় ভুগি। কেননা, আমাদের ছোট থেকে চেনানো হয়েছে একটা আলাদা ঘর। বলা হয়েছে, ‘তলপেটে যাতনা’ অনুভবমাত্রই ছুটে যাবে নির্দিষ্ট ঘরে। ওই ঘরের বাইরে কক্ষনও না। লোকে বলবে ‘ন্যাস্টি’…