রামধনু, প্রতিরোধ

Representative Image

প্রাইড মান্থের শিকড় রয়েছে , ১৯৬৯ সালের স্টোনওয়ালের দাঙ্গার সময়ে। নিউ ইয়র্কের গ্রিনউইচ ভিলেজে অবস্থিত ‘স্টোনওয়াল ইন’ নামে একটা গে-বারে, পুলিশের বর্বর হানার প্রতিবাদে শুরু হয় এই আন্দোলন। সে-বছরই ২৮ জুন, একাধিক কুইয়ার এবং ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা রাস্তায় নামেন, পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। বারের ঘটনার প্রতিবাদ থেকে, জন্ম নেয় এক সংগঠিত ক্যুইয়ারে আন্দোলন, যার সূত্র ধরে ১৯৭০ সালে প্রথম প্রাইড মার্চ দেখে আমেরিকা।

এরপর থেকে প্রতি বছর জুন মাস হয়ে ওঠে, LGBTQIA+ সম্প্রদায়ের দৃশ্যমানতা, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতার প্রতীক — জুন মাস হয়ে ওঠে গর্বের মাস। এই সময়ে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, রামধনু পতাকা উড়িয়ে, বিভিন্ন যৌনতার মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব উদযাপন করেন, সমাজে নিজের স্থান দাবি করেন।

আরও পড়ুন: সাধনার জন্য লিঙ্গান্তরের যে ইতিহাস আজও আড়ালে! লিখছেন আত্মজিৎ মুখোপাধ্যায়

ভারতে ‘প্রাইড ওয়াক’ শুরু হয় ১৯৯৯ সালে, কলকাতায়। ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ‘প্রাইড ওয়াক’। তার নাম দেওয়া হয়েছিল, ‘Friendship Walk’। সরাসরি ‘প্রাইড ওয়াক’ নাম না রাখার কারণ— প্রথমবার বলে, এই হাঁটার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে, মানুষের কাছে একটু ভিন্ন আবেদনে পৌঁছে যাওয়া, যা আদপে যৌন পরিচয়, লিঙ্গ পরিচয়, প্রেমের অধিকারের দাবি এবং ‘৩৭৭ ধারা’-র বিরোধিতা।

১৯৯৯ সালে, শহরের এই প্রথম প্রাইড ওয়াকে মাত্র ১৫-২০ জন অংশ নিয়েছিলেন। ওই স্বল্প কয়েকজনই, সে-সময়ে রাস্তায় পা রেখে, ভয় না পেয়ে সমাজের বদ্ধ মানসিকতা ভেঙে, ইতিহাস গড়লেন। প্রথম প্রাইড ওয়াক তাই সম্যকভাবে রাজনৈতিক, কারণ তখনও ভারতীয় সমাজে LGBTQIA+ বিষয়টি আলোচনার বাইরে ছিল।

১৯৯৯-এ শুরু হওয়া এই ‘প্রাইড ওয়াক’ সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে রূপ বদলায় নিজের। পরবর্তীকালে ২০০৩ এবং তারপর প্রতি বছর নিয়মিতভাবে কলকাতায় প্রাইড ওয়াক হতে থাকে। পরে এর নাম হয়, ‘Rainbow Pride Walk’।

প্রথমদিকে এই ওয়াক হত, নিতান্ত ছোট পরিসরে। মূলত অ্যাক্টিভিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এবং কিছু সাহসী মানুষই অংশ নিতেন। কিন্তু ধীরে-ধীরে রাজপথে ‘প্রাইড ওয়াক’ ওঠে, শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইভেন্ট।

বর্তমানে প্রাইড ওয়াকে শামিল হয় বিভিন্ন সংগঠন, কলেজ ইউনিয়ন এমনকী মানবাধিকার সংস্থাও। যৌন বা লিঙ্গ পরিচয়ে, অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে, বৃহত্তর ক্ষেত্রে— সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন তুলতে থাকে আজকের ‘প্রাইড ওয়াক’। সমালোচনা করে জাতপাত, শ্রমের অধিকার, দারিদ্র্য, এবং পিতৃতান্ত্রিক নির্মাণেরও।

ভারতে ক্যুইয়ার ইতিহাসে, ২০০৯ সালের ২ জুলাই একটা মাইলফলক। নাজ ফাউন্ডেশন বনাম দিল্লি সরকার মামলায়, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা আংশিকভাবে অবৈধ ঘোষণা করে, ওই দিন দিল্লি হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায় দেয়।

৩৭৭ ধারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের একটি আইন, যা ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌন সম্পর্ক’- কে অপরাধ বলে মান্যতা দিত। এই ধারা মূলত সমলিঙ্গে যৌন সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে দেখত, যার ফলে বহু LGBTQIA+ মানুষ বছরের পর বছর বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছেন, শিকার হয়েছেন পুলিশি হেনস্থার, সহ্য করেছেন বৈষম্য এবং মানসিক যন্ত্রণা।

এই দিন দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে বলা হল, কোনও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির পারস্পরিক সম্মতিতে হওয়া ব্যক্তিগত যৌন সম্পর্ককে অপরাধ বলা, সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে। ক্যুইয়ার ব্যক্তিদের মানবাধিকারের পক্ষে, এই প্রথমবার আইনি স্বীকৃতি পাওয়া। এই রায় জানায় যে, তাঁরা রাষ্ট্রের চোখে অবৈধ নন। এই রায় LGBTQIA+ সম্প্রদায়ের মধ্যে এক নতুন আলো দেখায়— প্রথমবার তাঁরা স্বাধীনভাবে ভাবতে পারেন, ‘আমাদের অস্তিত্ব স্বীকৃত, আমাদের ভালবাসা অপরাধ নয়’।

দিল্লি হাইকোর্টে এই রায়ের পরে, পশ্চিমবঙ্গসহ সমস্ত দেশ জুড়ে ‘প্রাইড ওয়াক’ এবং ক্যুইয়ার আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। এখানে বিশেষ ভাবে দ্রষ্টব্য যে, এই রায়ের পর অনেকেই প্রথমবার নিজেদের পরিচয় নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে শুরু করেন বা সাহস পান কথা বলার। সংবাদমাধ্যমে ক্যুইয়ার ব্যক্তিদের গল্প এবং সাক্ষাৎকার দেখা যেতে শুরু করে, কিছু প্রগতিশীল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুইয়ার-সমর্থক নীতিও গ্রহণ করে।

কিন্তু এর সঙ্গে-সঙ্গে বিপরীত প্রতিক্রিয়াও তীব্রতর হয়। গোঁড়া ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং রক্ষণশীল মহল— এই রায়ের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা চালায়। তবে ক্যুইয়ার সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যে সংহতি, প্রতিবাদ, এবং দৃঢ়তা তৈরি হয়, তা বাংলার সমাজকে ধীরে-ধীরে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলে।

আজকের ‘প্রাইড মান্থ’ শুধুমাত্র LGBTQIA+ সম্প্রদায়ের উৎসব নয়, বরং এক স্মরণিকাও — ক্যুইয়ার আন্দোলনের ইতিহাসে যতটা পথ পেরিয়ে এসেছে এই আন্দোলন, তার গল্প এবং কতটা পথ এখনও বাকি তার দিকচিহ্ন।

আশার আলোতে জল ঢেলে, ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট, দিল্লি হাইকোর্টের রায় খারিজ করে, ৩৭৭ ধারা আবার পুনর্বহাল করে দেয়। বলাই বাহুল্য যে, ভারতের LGBTQIA+ সম্প্রদায়ের জন্য এই রায় ভয়াবহ। দেশ, মনন যেন আবার পিছিয়ে গেল কয়েক দশক। কিন্তু এবার আর থেমে থাকেনি ক্যুইয়ার আন্দোলন। দেশজুড়ে উঠেছিল আন্দোলনের নতুন ঢেউ— একাধিক মানবাধিকার সংগঠন, ক্যুইয়ার মানুষ, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ এবং সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে, সোচ্চার হয়ে উঠলেন এই আইনের বিরুদ্ধে, জমা পড়ল একাধিক পিটিশন। সেই সমস্ত পিটিশন সমর্থন পেল হাজার-হাজার মানুষের।

শেষমেশ, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮— সুপ্রিম কোর্ট এক ঐক্যমত রায়ে জানায়, ‘প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মতিপূর্ণ সমলিঙ্গ যৌন সম্পর্ক অপরাধ নয়; এবং ৩৭৭ ধারার সেই অংশ অসাংবিধানিক’। এই রায় শুধু একটি আইনের বাতিল হয়ে যাওয়া নয়— এই রায় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, যা LGBTQIA+ সম্প্রদায়ের মানুষকে, এই দেশের অন্য নাগরিকের সঙ্গে সমানাধিকারে বাঁচার প্রতিশ্রুতি দিল। তাঁদের ভালবাসাকে অপরাধ নয় বলে স্বীকৃতি দিল এবং বলল, যে তাঁদের সম্মান, গোপনীয়তা ও স্ব-পরিচয়, সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার।

তাই আজকের ‘প্রাইড মান্থ’ শুধুমাত্র LGBTQIA+ সম্প্রদায়ের উৎসব নয়, বরং এক স্মরণিকাও — ক্যুইয়ার আন্দোলনের ইতিহাসে যতটা পথ পেরিয়ে এসেছে এই আন্দোলন, তার গল্প এবং কতটা পথ এখনও বাকি তার দিকচিহ্ন। পশ্চিমবঙ্গে, এমনকী খোদ কলকাতায় এখনও বহু উদাহরণ আছে, যেখানে ক্যুইয়ার মানুষেরা পরিবারে, স্কুলে, কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার হন অহরহ।

অনেক শহরাঞ্চলে এখনও LGBTQIA+ কেন্দ্রিক মনোচিকিৎসা পরিষেবা, হেল্পলাইন, বা সুরক্ষিত আশ্রয়স্থান অনুপস্থিত। তাই বর্তমানের ‘প্রাইড ওয়াক’ কেবল দৃশ্যমানতার জায়গা নয়, বরং দাবির জায়গা— যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, এবং ন্যায়বিচার নিয়ে বাস্তব জীবনে পরিবর্তনের দাবি তোলা হয়।

২ জুলাই ২০০৯ আমাদের বলেছিল— রাষ্ট্রের চোখেও ভালবাসা অন্যায় নয়। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শিখিয়েছিল— মর্যাদা, সামঞ্জস্য ও অধিকার সবার। কিন্তু এই রায়ের বাইরে বাস্তব জীবনের রায় এখনও প্রতিদিন লেখা হচ্ছে, এবং তা অধিকাংশ সময়েই হিংসার এবং বিপরীতধর্মী।

পারিবারিক নির্যাতন, ধর্মীয় অস্বীকৃতি, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, অথবা চিকিৎসাক্ষেত্রে অজ্ঞতা— এই সমস্তই প্রমাণ যে ‘প্রাইড মান্থ’ বা ‘প্রাইড ওয়াক’ এখনও প্রাসঙ্গিক। কারণ নীতি বদল মানেই রীতি বদল নয়; তাই প্রাইড মান্থের উদ্দেশ্য শুধু রং নয়, বরং গ্রহণযোগ্যতার আলো ছড়িয়ে দেওয়া প্রতিটি মনে ও মননে।

প্রাইড উদযাপন হোক জীবন জুড়ে ও যাপন জুড়েও; কারণ প্রাইড শুধু জুন মাসের নয়, রংধনু কেবল রঙ নয় — প্রাইড মানে বাঁচার, ভালবেসে বাঁচার, ভালবেসে বদল আনার উদ্‌যাপন।