আমার নেশার জন্যে ফেলুদা আর বাসুদেব মাস্টারমশাই দায়ী। আইসিএসই’র ও পি সিন্হালের অঙ্ক দিব্যি পারতাম, কিন্তু বাসুদেব মাস্টারমশাই একদিন ঘোষণা করলেন, শুধু এইসব অঙ্ক করলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ভবিষ্যৎ আলোকিত করতে, কেসি নাগের বই নিয়ে এসে হাজির হলেন। কী সেইসব অঙ্ক! বাঁদর বাঁশ বেয়ে ওঠে আর নামে, চৌবাচ্চা দিয়ে জল বেরিয়ে যায়, বাপের আর ছেলের বয়সের হিসেব…প্রত্যেকবার ছেলের বয়স বাবার চেয়ে বেশি হয়ে যায়! কেসি নাগ আর বাসুদেব লাহিড়ীর যুগ্ম অত্যাচারে যখন বেঁচে থাকা দুস্কর হয়ে পড়েছে, হঠাৎই মনে পড়ল, ফেলুদার ডায়লগ— ‘বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিয়ে নিই রে তোপসে’।
বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিলে, নির্ঘাত এইসব অঙ্ক সরসর করে মিলে যাবে এই আশায়, যোগীপাড়ার মোড়ে লোকনাথের দোকান থেকে একটা বিড়ি কিনে, খেয়ে— বাড়িতে এসে অঙ্ক খাতা টেনে নিলাম। অঙ্ক বেশ মিলেও যাচ্ছিল— এমন সময়ে ছোড়দি ঘরে ঢুকে নাক টেনে বলল, ‘বিড়ির গন্ধ কেন?’ বলেই ধাঁই করে আমার পিঠে একটা কিল। বেধড়ক মার খেলাম ছোড়দির কাছে। হাতেপায়ে ধরে বলেছিলাম, বাব-মাকে না বলতে। শেষে দয়া হয়েছিল বলে হয়তো বলেনি— কিন্তু ধোঁয়ার প্রতি আমার বিশ্বাস আর ভরসা সেদিন থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন: তামাকের বিজ্ঞাপনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত যে-সমস্ত ইঙ্গিত! লিখছেন আবীর কর
ক্লাস টেন। কবিতা পড়া আর লেখা দুটোই পুরোদমে চলছে। সুনীল-শক্তির লেখাতে না থেমে, তাঁদের যাপন নিয়েও বিস্তর জ্ঞান লাভ করছি। মনে হল, এবারে একটু গাঁজা দিয়ে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়া দরকার। মানিকতলা বাজারের পেছনে দাদুর ঠেকের কথা শুনেছিলাম— এক মামাতো দাদার সঙ্গে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। সিগারেটের মধ্যে গোঁজার প্রচুর চেষ্টা করে, সামান্যই ঢোকাতে পেরেছিলাম, তাই গাঁজার ওপরে ভক্তি চলে গিয়েছিল।
এইসময়ে, গোদের ওপরে বিষফোঁড়া এক স্বপ্ন— ‘খোল নলিচা বদলে যাবে বিপ্লবে বিপ্লবে।’ শ্রীদীপ এন্টালি মার্কেট অঞ্চলে দেখে-দেখে, ইতিমধ্যে গাঁজার সিগারেটের কৌশল শিখে নিয়েছে। ক্লাস টেনের পরীক্ষার পরে দেশের বাড়িতে গিয়ে, গাঁজার সিগারেট বানানো হল। দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত নিল, একসঙ্গে চারজনের মরে যাওয়াটা রিস্ক হবে, তাই তারা খাবে না— বিপদ দেখলে লোক ডাকবে। শ্রীদীপ আর আমি টান দিলাম। অহো! কী নেশা! চোখের সামনে ক্যালাইডোস্কোপ দেখছি, মাথা ঝাঁকাচ্ছি আর ডিজাইন বদলে যাচ্ছে! মনের আনন্দে ডিজাইন দেখছি, হঠাৎ দেখি গায়ে মশারি লাগছে। চেয়ে দেখি শ্রীদীপ মুঠো করে চেপে ধরেছে মশারি । কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে চোখ বন্ধ করেই বলল, ‘আমি উড়ে যাচ্ছি। চেপে ধর।’ এক নতুন যাত্রা শুরু হল।

ইলেভেনে মিশনে চলে গিয়ে যখন ফেরত এলাম, তখন দেখি শ্রীদীপ অনেক এগিয়ে গিয়েছে। ব্যাকলগ ক্লিয়ার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ইতিমধ্যে তুষার রায়ের লেখার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে— মাথার মধ্যে শুধুই তুষার ঝরছে আর আত্মহননের গান। সঙ্গী হল। পুরুলিয়ার কৃতী ছাত্র প্রবীর। শ্রীদীপ খবর আনল, জোড়াগির্জার পাশে মেথর পট্টিতে রোজ সন্ধ্যায় ভাল গাঁজার ঠেক বসে। সেখানে গিয়ে প্রথম পঞ্চমুখী গাঁজার কল্কে দেখলাম। আর পরিচয় হল চরসের সঙ্গে। যমুনা সিনেমার সামনে, ববির ঠেকের সন্ধান পেলাম; যেখানে গাঁজা আর চরস সহজেই পাওয়া যায়। জানলাম, পাহাড়ি চরস আর মনিপুরী গাঁজার বিশেষত্ব। দেশলাই কাঠির মাথায় চরস গেঁথে, আগুনে সেটাকে নরম করে খৈনির মতো ডলে সেটা দিয়ে হয় সিগারেট বানাও, নয়তো কল্কেতে দিয়ে দাও। আর যদি পঞ্চমুখী কল্কেতে দিয়ে টান দাও? গাঁজা আর চরসের ধোঁয়া মিশে মাথায় ধাক্কা দিয়ে, ‘ওঁ ফট স্বাহা!’
বেশ চলছিল যাপন। তুষার রায়ের রতন বাবু রোডের বাড়ি থেকে রতন বাবু ঘাটের শ্বশানের দূরত্ব যতটা, ভেতরে ধোঁয়া থাকলে মানিকতলা মোড় থেকে নিমতলার দূরত্ব উনিশ-বিশ। দুটো ঘটনা সে-সময়ে বেধড়ক ধাক্কা দিল। ক্রিক লেনে বাবুনদের বাড়িতে, ওর ঘরটা ছিল পেটের মধ্যে অ্যাপেন্ডিক্সের মতো; লম্বা বারান্দার মাঝে একটা ছোট্টো টাল। বাবুন নেশা করবেই আর করলেই কাঁদুনি গাইত, ‘আজকে সকালে নুচি খেয়েছি, একটু অম্বল হয়ে গিয়েছে’— বমি করার প্রিলিউড।
সেদিন ববির ঠেক থেকে চরস কিনে, মেথরপট্টিতে চূড়ান্ত নেশা করে সাম্যবাদ আর বিপ্লবের অদৃশ্য ফেস্টুন টাঙিয়ে, আমি প্রবীরের হোস্টেলে এসে শুয়ে পড়েছি, আর বাবুন নিজের বাড়ি ফেরত গিয়েছে। বাবুন আবার শুকনো নেশাও খালি পেটে করতো না, তাই গুচ্ছের বাদাম খেয়েছিল। বাবুনের ওই অ্যাপেন্ডিক্স ঘরে সে আর তার দাদা শুতো। সেদিন বাড়িতে ওর পিসি আর পিসোমশাই আসায়, ওই ঘরে পিসোমশাই শুয়েছিলেন, গৌতমদা অন্য ঘরে শুয়েছিল। শীতকাল। পিসোমশাই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। বাবুনকে স্খলিত পায়ে ঘরে ঢুকতে দেখে পিসোমশাই প্রমাদ গুনেছিলেন। ঘরে ঢুকে রোজকার মতো নিজের দাদা গৌতমদার নিতম্বতে এক লাথি মেরে সরিয়ে, বাবুন শুয়ে পড়েছিল— এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙেছিল যখন, বাবুনের বমি পেয়েছে। ততক্ষণে ঘুমন্ত পিসোমশাইয়ের মাথা থেকে কাঁথা সরে গিয়েছে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় পিসোমশাইয়ের মাথার সুবিশাল টাককে, বাবুন একটা বাটি মনে করে, সেখানে বমি করেছিল। মাঝরাতে চিৎকার চেঁচামেচি— পিসোমশাইয়ের টাক দিয়ে বাদাম ঝরে-ঝরে পড়ছে। বাবুনের মা আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন, তাই পরের দিন সকালে আমার বাড়িতে হাজির। মাসিমাকে কোনওমতে বিশ্বাস করিয়েছিলাম সেদিন, যে বাবুনের বমি নেশাজনিত ছিল না, অম্বলজনিত ছিল।
সেদিন অবস্থা সামাল দিলেও, আমার শ্বশুরমশাই (তখন মেসোমশাই) যখন মাতৃহারা হলেন। নিমতলা শ্মশানে তখন ঠাকুমা পুড়ছেন। মেসোমশাই নিমতলার গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসলেন আর উদাস দৃষ্টিতে গঙ্গার দিকে চেয়ে আছেন। আমি একসময়ে ওঁর পাশে গিয়ে বসলাম। একদিকে সদ্য মাতৃহারাকে সঙ্গ দেওয়া, অন্যদিকে একটা সাঁকো নির্মাণ— দুটোই যাতে হয়। ওঁর হাতটা ধরতে উনি আমার হাতটা চেপে ধরলেন। এমন সময়ে একটা কণ্ঠস্বর ঘাড়ের পেছনে— ‘নে ভাই!’ দেখলাম কল্কে বাড়িয়ে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তুষার রায়ের কল্যাণে তখন যে শ্বশানে আমার সহাবস্থান, ভুলে গিয়েছিলাম। মেসোমশাইকে অগ্রাহ্য করেই সে বলল— ‘পরে আবার গাল দিবি, তাই বানিয়েই তোর কাছে নিয়ে এলাম’। তাকাচ্ছি না দেখে একটা লাথি মেরে বলল, ‘কী রে! সতী হলি নাকি!’ মেসোমশাই উঠে হাঁটা লাগালেন। আমি বেশ কিছু গালাগালি করাতে সে জিভ কেটে বলল, ‘আরে, কী কেস! আমি গিয়ে সাল্টাচ্ছি’। ওকে সেই সাল্টানো থেকে বিরত করে, টুক করে দুটো টান মেরে যখন মেসোমশাইকে গিয়ে একটা ভুল হয়েছে বোঝাতে গেলাম, উনি উদাস চোখে আমায় দেখে বললেন, ‘তুমি এখানে রেগুলার আসো বুঝতে পেরেছি।’
পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় পিসোমশাইয়ের মাথার সুবিশাল টাককে, বাবুন একটা বাটি মনে করে, সেখানে বমি করেছিল। মাঝরাতে চিৎকার চেঁচামেচি— পিসোমশাইয়ের টাক দিয়ে বাদাম ঝরে-ঝরে পড়ছে।
আমার নেশার জগৎ অভিযান এখানেই থামিয়েছিলাম। তমাল বলে, এভারেস্ট সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হতে পারে, কিন্তু কে ২, অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে ওঠা আরও বেশি কঠিন। আমি অপেক্ষাকৃত ছোট পাহাড়ে চড়ায় মন দিলাম এবারে। সিদ্ধি বা ভাঙ নিয়ে একটা আধ্যাত্মিক পরিমন্ডল আছে, তাই এটা খেলে ঝামেলা কম। মানিকতলার অদূরেই কপিলাশ্রম; এইসব জায়গায়, ‘আজকাল কী বানাচ্ছ, নেশাই হয় না!’ গোছের সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিলেই হল, তেড়েফুঁড়ে এমন এক গ্লাস শরবত দেবে যে বারো ঘন্টার জন্যে নিশ্চিন্ত। গন্ধ নেই, চোখ লাল হয় না— কিন্তু মাথার মধ্যে নাগরদোলা, বাড়ি এসে শুয়ে পড়লেই হল। তারপরে ব্যোম-পথ। এইসব কঠিন পাহাড়ে ওঠার অভিযাত্রীদের দিকে মন দিলাম। আমাদের যেখানে শুকনো নেশার দৌড় ছিল, উল্টোডাঙার লেংরি, শ্যামবাজারে ভূতো, বৌবাজারে ভগবান, ধর্মতলায় ববির ঠেক আর গাঁজা পার্ক অবধি, ততদিনে নেশা অনেক এগিয়ে ওষুধের দোকানে ঢুকে গিয়েছে।
হিমালয়েও যেমন অনেক অনামী শিখর ছিল বা আছে, নেশার জগতেও নিত্য তখন নতুন শিখর আবিষ্কৃত হচ্ছে। প্রবীর ডাফ হোস্টেলে থাকত আর সেখানে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে পড়তে আসা ছাত্ররা অনেকেই থাকত। তাদের কলকাতা শেখালে, বিনিময়ে তারা নেশা শেখাত। ফেনসিডিল, আদর করে যাকে ‘ডাইল’ ডাইল বলা হত, ওদের কাছ থেকেই শেখা। একটা ছোট ফাইলের ডাইল দামে মদের ২৫%, কিন্তু নেশা হবে ৪০০%। হোস্টেলের ঘরে-ঘরে ডাইল। এর সঙ্গে শুরু হল পাউরুটি বা বিস্কুটে মাখনের বদলে আয়োডেক্স মাখিয়ে খাওয়া। ডাইল একবার খেয়ে দেখলেও আয়োডেক্স খেয়ে দেখার সাহস পাইনি— শূন্যপথ থেকে জলপথে বিচরণ করাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করেছি ততদিনে।

রাস্তা দিয়ে যেতে-যেতে এদিক-ওদিক দেখা আমার পুরোনো অভ্যেস। একদিন সদর স্ট্রিটে শুনশান দুপুরবেলা একটা দোকানে দাঁড়িয়ে কোল্ড ড্রিংক খাচ্ছি, দেখি সামনের ল্যাম্পপোস্টের পাশে একটা লোক এক অদ্ভুত-দর্শন বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক কাবারিওয়ালা তার কাছে গিয়ে কিছু বলে, হাতে টাকা গুঁজে দিল। লোকটা বাক্সের ওপরে ঢাকনাটা সরাল, তাতে বেশ কয়েকটা ফুটো। একটা ফুটোর মধ্যে কাবারিওয়ালাটা নিজের জিভ গুঁজে দিল। অন্য ফুটোগুলোতে একটা কাঠি ঢুকিয়ে, অন্য লোকটা খোঁচাতে লাগল। খানিকবাদে দেখলাম কাবারিওয়ালাটা কেঁপে উঠে, নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। অবাক হয়ে দোকানদারটার দিকে তাকাতে সে বলল, ‘সাপের ছোবল নিল। কালকে সকালের আগে আর উঠবে না’। তার কাছে শুনলাম ওই বাক্সের মধ্যে সাপ আছে। মালিক সেটাকে খোঁচায় আর বিরক্ত হয়ে সাপ ছোবল মারে। সেই ছোবল খাওয়ার জন্যেই, কাবারিওয়ালা জিভ ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। শিয়ালদা অঞ্চলে দেখেছি নিস্তেজ হয়ে কিছু কিশোর রেললাইনের কিছু দূরে শুয়ে আছে। খবর নিয়ে জেনেছি, তারা ডেনড্রাইট জাতীয় আঠা শুঁকে নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছে।
বাংলাদেশে যখন পড়াতে গেলাম, অতিমারীর পরে ফ্লাইট সবে চালু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বলল, ঢাকায় আমাকে সাতদিন কোরেন্টাইনে থাকতে হবে। আমি পড়লাম মহা গেরোয়। পরাগ বাঁচালো আমাকে— রাজীবের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। পরাগের সঙ্গে বহুবার ফোনে কথা হলেও চোখে দেখিনি, রাজীবকে চিনিও না— আমি মালপত্তর নিয়ে ধানমন্ডির টালি রোডে তার ফ্ল্যাটে উপস্থিত হলাম। রাজীব তখন ঢাকায় নেই, কিন্তু আমি যাচ্ছি খবর দিয়ে রেখেছিল। এক মস্ত ফ্ল্যাট, সেখানে ওর ভাগ্নে আর তার এক বন্ধু থেকে পড়াশোনা করে। অচিরেই এরা আমার ভাগ্নে হয়ে গেল। বিস্তর ভাট বকি, ওরা অবাক হয়ে শোনে। কিন্তু ঝামেলা একটাই, বেলা একটা থেকে সন্ধ্যা আটটা অবধি এদের দেখা যায়, বাকি সময়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। বাংলাদেশে সুরা নিষিদ্ধ, বিদেশিদের এক বোতল আনতে দেওয়া হয়, তাই বোতলের দিকে তাকিয়ে বসে থেকে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করি, তাতে যদি একটু নেশা হয়। একদিন মরিয়া হয়ে ওদের জিজ্ঞাসা করতে জানলাম ক্যারু কোম্পানির শুধু লাইসেন্স আছে উৎপাদনের। বাকি যা পাওয়া যায়, সব বেআইনি আর গোলমেলে পদ্ধতিতে বানানো। ওদের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা নেশা করো না আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?’ লাজুক হেসে বলল, ‘স্যার, আমরা শুকনো খাই’। মনক্ষুণ্ণ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পাতা?’ আরও লজ্জা পেয়ে বলল, ‘বড়ো তামাক’। মনের মধ্যে শান্তির ঢেউ ধাক্কা দিল। ‘কল্কে না রিফার?’ ‘স্যার, রিফার’। স্যার লাইনের জেনে ওরা উত্তেজিত, তৃষ্ণা মেটার আনন্দে স্যার উদ্বেলিত। সেদিন সন্ধ্যায় বসার পরিকল্পনা হল। প্রথমবার ওদের ঘরে ঢুকে দেখলাম, খাটের পাশে একটা বালতি, আর সেখানে জলের মধ্যে একটা ফাঁকা কোল্ড ড্রিংকের দুই লিটারের বোতল— ইঁটের সাহায্যে দাঁড় করানো রয়েছে। বড়ো তামাক সেবন পর্ব শুরু হতেই, খানিকবাদে শিফাৎ বোতলটা হাতে তুলে নিল। গাঁজার ধোঁয়া বাইরে না ছেড়ে এই বোতলের মধ্যে ছেড়ে বোতলের মুখ বন্ধ করে দিতে থাকল। ‘এটা কি করছ?’ ‘স্যার, গ্রাভিটি বানাচ্ছি’। শুনলাম এইভাবে বোতলে ধোঁয়া ছেড়ে-ছেড়ে ধোঁয়া ভর্তি বোতল জলে ডুবিয়ে রাখা আর দুই-তিন ঘন্টা বাদে সেই বোতলের মুখ খুলে, সেই ধোঁয়া টানাকে ‘গ্রাভিটি’ বলে। ওই ঘন জমা গাঁজার ধোঁয়া এক টান ভালভাবে নিলে পুরো ‘ঢিস’। ওদের কেন সকালে দেখা যায় না, কিছুটা বুঝলাম। কিছুটা কৌতূহল বশত আমিও সেই বোতলে মুখ লাগিয়ে টেনে, যখন পরের দিন দুপুরে চোখ মেললাম, তখন মাধ্যকর্ষণ কী জিনিস পুরোটা বুঝলাম।
নেশার ধরন সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বদলেছে। ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা সবাই দৌড়ে চলেছে— তাদের এক নম্বরে থাকতেই হবে। আমাদের সময়ে কোচিং সেন্টার— কেবল পড়াশুনার মধ্যে আটকে ছিল, এখন ক্রিকেট থেকে দাবা— সবকিছুরই কোচিং সেন্টার। সকালে দেখি মা ছেলেকে নিয়ে ফিরছে— ‘কভার ড্রাইভটা এখনও ভাল করে শিখতে পারলি না!’ কিংবা ‘ব্যাকফুটে গেলেই তুই এল-বি-ডাবলু হয়ে যাচ্ছিস কেন?’ ঘর্মাক্ত সাদা জামা পরে, ছেলে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরছে, মাটির দিকে তাকিয়ে। ওপরে তাকালে এক শূন্য দৃষ্টি। ছেলেমেয়েরা এই চাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে এক অদ্ভুত নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। ইস্কুলে লুকিয়ে চলে আসছে এক ট্যাবলেট-হ্যাপি পিল। খেলে মন তুরীয়ানন্দ আর চাপমুক্ত। সেই ট্যাবলেটের রেশ কমে যেতেই এক হতাশাবোধ, যুদ্ধে হারের গ্লানি। মা-বাবারা দৌড়ে যাচ্ছে মনস্বত্ববিদের কাছে— ‘আমার ছেলেকে ঠিক করে দিন প্লিজ!’ বাবা-মার নেশা সন্তানকে কেউকেটা করার, সন্তানের নেশা হ্যাপি পিল। আর-এক নেশা মোবাইল ফোন। যখন কলেজে যাই, দেখি ক্লাসের চার সহপাঠী চলেছে কলেজে। দেখা হলে একটু পরিচিতের হাসি, তারপরে চারজনই মোবাইল ফোনে ব্যস্ত। তাদের মধ্যে কোনও কথা নেই। কলেজে পৌঁছে মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে, ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে বাস্তব দুনিয়ায় প্রবেশ, আবার কলেজ থেকে বেরনো মাত্র অ্যাকচুউয়াল ওয়ার্ল্ড থেকে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ। বাড়িতে বসার ঘরে বাবা-মা-সন্তান বসে, তিনজনের হাতে তিনটে ফোন, তিনজন তিনটে আলাদা দুনিয়ায় বাস করে। কোনও কথা নেই— পরিচিতরাও অপরিচিত আর অপাংক্তেয় এই নতুন দুনিয়ার নেশায়। একা থাকার আর একাকীত্বের নেশা। মাঝেমাঝে মনে হয়, গাঁজা-চরস-ভাঙ কি এই নেশার চেয়েও বাজে ছিল?
বিঃদ্রঃ এই লেখায় আমি মানে শুধু আমি না, এখানে আমি মানে আমরা— অমল, বিমল, কমল, তমাল, এবং ইন্দ্রজিৎ।