ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সাক্ষাৎকার: সুনেত্রা গুপ্ত


    মালবিকা ব্যানার্জি (Malavika Banerjee) (March 27, 2021)
     
    অধ্যাপক সুনেত্রা গুপ্ত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা (zoology) বিভাগের অধ্যাপক। যে বিশেষজ্ঞরা একদম প্রথমেই লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁদের অন্যতম। এক বছর পরে, আমরা বুঝতে পেরেছি, ধারাবাহিক লকডাউন খুব একটা কোভিড সংক্রমণ কমাতে পারেনি। যেসব দেশ খুব কড়াকড়ি করেছে, আর যেসব দেশ তেমন কড়াকড়ি করেনি— তাদের কোভিড-ফলাফলে বিশেষ তফাত হয়নি। কোভিড অতিমারী-র এক বছর পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষে অধ্যাপক গুপ্ত-র সাক্ষাৎকার। 

    অধ্যাপক সুনেত্রা গুপ্ত

    ভারতে লকডাউন শুরুর ঠিক এক বছর হয়ে গেল। তখন কি ভেবেছিলেন ২০২১-এর মার্চে অবস্থটা এরকম হবে?

    সত্যি কথা বলতে কী, আমি যেটা একেবারেই ভাবিনি, তা হল এই দীর্ঘ লকডাউনের মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হবে। এত অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের কাছে একটা ভ্যাকসিন এসে গেছে, যা বেশ বড় রকমের বিপন্ন একটা জনসংখ্যাকে কোভিডের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে এটা কিন্তু আমার কাছে একেবারেই আশ্চর্যের বিষয় নয়। আমি তো বলেইছিলাম, গত সেপ্টেম্বরের মধ্যেই  ভ্যাকসিন এসে যাবে। 

    তবে আমি ভাবতেই পারিনি, এতগুলো দেশ দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনের পথ বেছে নেবে। কারণ লকডাউন একটা নিতান্ত সাময়িক ব্যবস্থা, তাও আবার শুধু সেই দেশগুলোর ক্ষেত্রে উপযুক্ত, যাদের যথেষ্ট রসদ আছে, যা এই সময়টায় নাগরিকদের খাইয়ে-পরিয়ে রাখতে পারবে। সোজা কথায়, ভারত বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে লকডাউন হওয়া উচিতই ছিল না। 

    কিন্তু আস্তে আস্তে বহু দেশই লকডাউনের পথ বেছে নিল, এমনকী আপনি যেখানে থাকেন, সেই ইংল্যান্ড-ও। আপনার মতে, কী করা উচিত ছিল? 

    লকডাউনের পথ বেছে নেওয়া কোনও সভ্য দেশের কাজ হতে পারে না, বিশেষ করে দেশটা যদি তার গরিব এবং কমবয়সি নাগরিকদের কথা সহানুভূতি নিয়ে ভাবে। হ্যাঁ, যদি মাত্র সপ্তাহ দুয়েকের জন্য লকডাউন হয়, যে-সময়টায় সরকার ভেবে নিচ্ছে তার হাতে কী কী রসদ আছে, আর তা দিয়ে কী করে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করবে সে-কথা আলাদা। ব্রিটেন সরকার তো দাবি করছে, তারা নাকি এমনটাই করছিল। কিন্তু সংক্রমণ কমানোর জন্য লকডাউনকে হাতিয়ার করাটা একটা ভুল যুক্তি, অনেকগুলো কারণে।  

    অনেকদিন ধরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে, অনন্তকাল লকডাউন চালিয়ে যেতে হয় যেটা উদ্ভট ব্যাপার। একটু অন্যভাবে বোঝাই। ধরে নেওয়া যাক, লকডাউন খুব কার্যকরী। কিন্তু সেই লকডাউনেও লাভটা কী হচ্ছে? সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার গতিটাকে কম রাখা যাচ্ছে। কাজেই, লকডাউন একটা চমৎকার উপায় একমাত্র তখনই, যদি একেবারে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত লকডাউন চালিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে, আমরা তো আর কেউ জানতাম না, কবে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে, কবেই বা তা দেওয়া শুরু হবে। তাই অনেকদিন ধরে লকডাউন চালিয়ে যাওয়া একটা অবাস্তব পদ্ধতি। যে কোনও লকডাউন দীর্ঘ সময় ধরে চললে, তার জন্য দেশকে বিরাট মাশুল দিতে হয়। খুব বড় মাশুল।  

    আমরা বরং বলেছিলাম, দেশগুলোর যে জিনিসটার ওপর জোর দেওয়া উচিত ছিল, তা হল, ‘সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা’। যখন সংক্রমণ হু-হু করে বাড়ছে (সে সময়টাও বড়জোর তিন থেকে ছ’মাস)তখন, যাঁরা শারীরিক ভাবে বিপন্ন এবং খুব তাড়াতাড়ি সংক্রমণের ফলে কাবু হতে পারেন, এমন মানুষকে সুরক্ষিত রাখার ওপর জোর দেওয়া। ওই সময়টার পর কিন্তু করোনা-আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি, আর অন্যান্য জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একই। তাও তো যক্ষ্মা, এইচআইভি-র মতো ভয়ানক অসুখগুলোর কথা বললামই না। আসলে পুরো ব্যাপারটাকে একটা বড় পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন ছিল, যা হয়নি। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে এই ‘সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা’র উপর জোর দেওয়া উচিত ছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে, যেখানে মানুষ কাছাকাছি, ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকেন, এমনকী একটা আলাদা ঘরও নেই, সেখানে এই সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা দেওয়া কীভাবে সম্ভব? আশ্চর্যের ব্যাপার, যে-দেশগুলোয় লকডাউন হয়েছে, তার তুলনায় এইসব দেশগুলো, যেখানে মানুষ কাছাকাছি থাকে সেখানে বরং আক্রান্তদের অনেক বেশি সুরক্ষা দেওয়া গিয়েছে।  

    সত্যিটা হল, লকডাউন বিপন্নদের আরও বেশি করে সংক্রমণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ইংল্যান্ডে জরুরি পরিষেবায় যাঁরা কর্মরত, তাঁদের কাজে বেরোতে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই ডায়াবিটিস-এর মতো রোগ ছিল, যা তাঁদের আরও বিপন্ন করে তুলেছে। যাঁদের এই ধরনের কো-মর্বিডিটি রয়েছে, তাঁদের তো আরও বেশি করে ঘরে থাকতে বলা উচিত ছিল, স-বেতন ঘরবন্দি থাকার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। তার বদলে, যাঁদের মাইনে সমেত ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে আমার বন্ধু মার্টিন কুলড্রফ (বিখ্যাত বায়ো-স্ট্যাটিস্টিশিয়ান) তাঁদের নাম দিয়েছেন ‘ল্যাপটপ ক্লাসেস’ সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরাই লকডাউনের জন্য সুরক্ষিত থেকেছেন, নিম্নবিত্তরা নয়। শিশুরা এবং পড়ুয়ারা, তরুণ প্রজন্ম সবাই অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই লকডাউনের জন্যে। 

    আমরা ‘গোষ্ঠী প্রতিরোধ-ক্ষমতা’ বা ‘হার্ড ইমিউনিটি’-র কথা খুব শুনছি। এর সঙ্গে টিকাকরণের সম্পর্ক কী? গোষ্ঠী প্রতিরোধ-ক্ষমতা গড়ে তুলতে কত শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে?

    খুব দুভার্গ্যজনক যে, এই ধরনের প্রশ্নগুলি বহু বিজ্ঞানী খুব ভুল বুঝেছেন। গোষ্ঠী প্রতিরোধ-ক্ষমতা যে কোনও অতিমারীর সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে থাকে যেখানে বেশির ভাগ মানুষ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন, কিন্তু সবাই যে ভাইরাসের প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন, তা নয়। এই সব মানুষের প্রতিরোধ-ক্ষমতা গড়ে ওঠে, ওটাই মানুষের শরীরের ধর্ম, আমাদের সাধারণভাবেই এই ক্ষমতা গড়ে ওঠে। যেই অনেক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন, অনেকের মধ্যে প্রতিরোধ-ক্ষমতা গড়ে উঠবে এবং ভাইরাসটা আর খুব বেশি ছড়াতে পারবে না। প্রত্যেকটা মানুষের এই ক্ষমতা গড়ে উঠবেতা নয়, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের উঠবে। তাহলে ভাইরাস-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আর ভাইরাস-সংক্রমণ একটা নিয়ন্ত্রণসীমার মধ্যে আসবে।  

    যদি এমন কোনও ভ্যাকসিন থাকে, যা সংক্রমণকে প্রতিরোধ করতে পারে, তাহলে সংক্রমণের মাত্রাকে একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে বেঁধে রাখা যায়, যা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এমনও হতে পারে, ভ্যাকসিন দিতে দিতে রোগটা নির্মূলই করে ফেলা গেল, কিন্তু সেটা এখনও পর্যন্ত কেবল স্মলপক্স-এর ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়েছে। 

    কিছু ভ্যাকসিন অত্যন্ত কার্যকর, যেমন হাম বা মিসল্‌স-এর টিকা বাচ্চাদের এমন একটি অসুখ থেকে রক্ষা করে, যা থেকে মৃত্যু অবধি হতে পারে। করোনাভাইরাসের টিকা তেমন নয়, কারণ কোভিড-১৯ অসুখটাই হামের মতো নয়। এখানে সংক্রমণ হল, তা থেকে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠল, কিন্তু প্রতিরোধ-ক্ষমতা যেই চলে গেল, তখনই ফের সংক্রমণের সম্ভাবনা গড়ে উঠল। তবে দ্বিতীয়বার সংক্রমণে, অসুখটা খুব মারাত্মক হয় না।

    ভ্যাকসিন মানুষকে অসুস্থতা ও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। কিন্তু ভ্যাকসিন সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে না, অন্তত দীর্ঘ সময়ের জন্য করে না। যেসব মানুষের অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাঁদের ভ্যাকসিন দিয়ে আমরা সুরক্ষিত করতে পারি। সবচেয়ে ভাল ব্যাপার হল, যাঁরা একা থাকার মতো জায়গা পান না, তাঁদেরও এই পদ্ধতিতে সুরক্ষা দেওয়া যাবে। 

    যদি আমরা আশা করি যে ভ্যাকসিন থেকে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে, তা ভুল। গোষ্ঠী-প্রতিরোধক্ষমতা শুধু সংক্রমণের মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে। ভারতে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠেছে কি? আমার মনে হয়, হ্যাঁ। ইংল্যান্ড ও ভারতের কিছু কিছু জায়গায় গোষ্ঠী-প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠেছে। যে কোনও কারণেই হোক, ইংল্যান্ডে এ কথাটা বিশ্বাস করা হচ্ছে না, বোধহয় লকডাউন চললে কিছু মানুষের স্বার্থ সিদ্ধ হওয়ার ব্যাপার আছে। 

    ভ্যাকসিন আসার আনন্দটা কিছুটা কোভিড ভাইরাসের নতুন-নতুন ‘স্ট্রেন’ আসার কারণে দমে গিয়েছিল। এখন যে ভ্যাকসিন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো কি আমাদের এই নতুন স্ট্রেনগুলোর বিরুদ্ধে যথেষ্ট সুরক্ষা দেবে?

    ভাইরাসের সব স্ট্রেন-এর বিরুদ্ধে সুরক্ষার ক্ষেত্রেই এই ভ্যাকসিনটা যথেষ্ট। ভাইরাসের বদল বা মিউটেশন হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। লোকের ধারণা, একটা ভাইরাস এল, তার অনেক বদল হল আর সেটা দিনকে দিন শক্তিশালী হল। সেভাবে আসলে ব্যাপারটা ঘটে না। 

    আমি ভাবিনি করোনাভাইরাসের এতগুলো বদল হবে আর তা আমাদের প্রতিরোধ-ক্ষমতাকে এড়িয়ে যেতে পারবে। কিন্তু কলকাতায় পার্থ মজুমদার এবং অন্যান্য কয়েকজন যে গবেষণা করেন, তাতে দেখা যায়, গোড়াতেই এই ভাইরাসের বদল ঘটেছে, যাতে এটা বেশি ছড়াতে পেরেছে। চিনে যা ছড়াচ্ছিল আর ইতালিতে যা ছড়াচ্ছিল, তা আলাদা। তবে তখন তা নিয়ে এতটা হইচই হয়নি। 

    ব্রিটেনের ‘স্ট্র্যান্ড’টা অন্যগুলোর তুলনায় বেশি ঝঞ্ঝাটের, কিন্তু ভ্যাকসিন এটার বিরুদ্ধেও সুরক্ষা গড়ে তুলবে। তাছাড়া ভ্যাকসিনগুলোকেও দরকার হলে কিছুটা বদলে নেওয়া যাবে। যদি দুর্বলদের সুরক্ষার খাতিরে আর এক দফা ভ্যাকসিনেশন হয়, সেক্ষেত্রে ভ্যাকসিনটাকে নতুন স্ট্রেন-এর বিরুদ্ধে কার্যকরী করে তোলা সম্ভব।  

    ‘আমার ভ্যাকসিন তোমারটার চেয়ে ভাল’ এই অহঙ্কারের খেলা শুরু হয়েছে। বৈজ্ঞানিক হিসাবে, এই জাতীয়তাবাদ এবং রাজনীতিকে কী চোখে দেখেন?   

    ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতির আশঙ্কা অনেকে করেছিলেন, কিন্তু যেটা এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা পুঁজিবাদের একদম নগ্ন রূপ। আমার মতে ভ্যাকসিন স্পনসর করা এবং বিতরণ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। ভ্যাকসিনেশন, বা কোনও চিকিৎসা-পদ্ধতিতেই, কোনওভাবেই মুনাফা তোলার জায়গা থাকতে পারে না। তবে যা ঘটছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিছু দেশ আন্তর্জাতিকতা থেকে সরে গিয়ে আত্মসর্বস্ব কিছু নীতি তৈরি করেছে, আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিরাট বিরাট ওষুধ কোম্পানি, যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হল মুনাফা লোটা এ একটা বিষাক্ত জুটি। আমাকে যা সত্যি আশ্চর্য করেছে তা হল, ভ্যাকসিন বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভাইরাসকে আটকানোর কিছু উপায় এখনও কী ভীষণভাবে আত্মসর্বস্ব এবং জাতীয়তাবাদী। 

    খুব প্রশংসা হয়ে চলেছে নিউজিল্যান্ডের, এমনকী ইংল্যান্ডের, যেখানে যতটা পারা যায় প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে যা কিনা আন্তর্জাতিকতার সব মতাদর্শের বিরুদ্ধে। আমি কখনও কল্পনা করতে পারিনি যে এটা ঘটতে পারে।

    অতিমারীর ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)-এর ভূমিকা সম্বন্ধে আপনার কী মতামত?

    আমি ইম্প্রেসড নই। ওদের বক্তব্যে কোনও ধারাবাহিক পরিকল্পনা বা যুক্তি দেখতে পাইনি। এই একবার লকডাউন সুপারিশ করছে, পরমুহূর্তেই তা নাকচ করছে; নিজেদের ওয়েবসাইটে ‘হার্ড ইমিউনিটি’-র সংজ্ঞা বদলে দিল কী অদ্ভুত! অতিমারীর সময় বিভিন্ন মতামত শোনা, এবং তার উত্তর দেওয়ার কাজটা অবধি ওরা ভালভাবে করতে পারেনি। ওদের আন্তরিকতা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু হাবভাব হচ্ছে এলোপাথাড়ি সমাধান হাতড়ে বেড়ানো একটা সংস্থার মতো। কী করা যেতে পারে তা নিয়ে কোনও সুসংবদ্ধ আলোচনা, বা পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশে লকডাউনের দরুন ভয়াবহ ক্ষতির স্বীকৃতি কিছুই তো ওদের মধ্যে দেখলাম না। 

    এর ফলাফল যে ইতিমধ্যেই বিধ্বংসী, তা আমরা বুঝেছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজ ছিল এটা স্পষ্ট বলা যে, যদি কোনও দেশ লকডাউনে যেতে চায়, সবাইকে বুঝতে হবে, সিদ্ধান্তটার কারণ কী। যে-দেশগুলোয় লকডাউন করলে তক্ষুনি মৃত্যু বাড়বে, সেখানে যে এটা হতে পারে না, তা তো নিশ্চিত করার দরকার ছিল।  

    অতিমারীর লড়াইয়ে বিভিন্ন দেশের ভূমিকা সম্বন্ধে আপনার কী মতামত?

    নিউজিল্যান্ড: অত্যন্ত আত্মসর্বস্ব এবং জাতীয়তাবাদী। একটা ভাইরাসকে চিরকালের জন্য আটকে রাখা যায় না। ওদের স্ট্র্যাটেজিটা ভবিষ্যতের কোনও এক সময়ের একটা টিকার দিকে তাকিয়ে নেওয়া হয়েছিল; এমন একটা ভ্যাকসিন যা নিউজিল্যান্ড বানাতে পারবে না, কেননা তা অসম্ভব। তারা বাকি দুনিয়ার ওপর নির্ভর করে ছিল একটা ভ্যাকসিনের জন্য যা নিউজিল্যান্ডবাসীকে সুরক্ষিত রাখবে, এবং একই সঙ্গে বাকি দুনিয়াকে নিউজিল্যান্ডের থেকে দূরে রাখতে ছিল বদ্ধপরিকর। কেউ অবশ্য বলতেই পারে, অতশত বুঝি না, আমার দেশবাসীকে আমি আগে বাঁচাব। কিন্তু তা বললে, অত গর্ব করার কিছু নেই, বরং সেই স্বার্থসর্বস্বতার জন্য লজ্জা পাওয়া উচিত। ওদের দেশের সীমানা খোলামাত্র ওখানে সংক্রমণ হবে, সক্কলে যদি ভ্যাকসিন নিয়ে থাকে, তা-ও।  

    আমেরিকা: আমি ২০২০-র অক্টোবরে আমেরিকা যাই এবং ওই দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে এটা বুঝি, বিভিন্ন আমেরিকান রাজ্য তাদের নিজেদের মতো করে অবস্থা সামলেছে। 

    মাস্ক, নির্দেশাবলি, বন্দোবস্তসবকিছুর ক্ষেত্রেই তাই এক এক জায়গায় এক এক রকম নির্দেশ, কোনও সম-পরিকল্পনা নেই। এগিয়ে ছিল ফ্লোরিডা। সেখানে প্রবীণদের জন্য নির্দিষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। তারা কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার তুলনায় যেখানে কিছু কঠোর, পুরনোপন্থী ব্যবস্থা নেওয়া হয় কিছু খারাপ ফল করেনি।

    সুইডেন বনাম ইংল্যান্ড: সুইডেন আর ইংল্যান্ডকে পাশাপাশি রেখে দেখা যেতে পারে। অতিমারীকে যুঝতে সুইডেন কোনও কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি, কিন্তু কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল: নিজেকে দুর্বল মনে করলে ভিড় থেকে দূরে থাকুন, নিয়মিত হাত ধুয়ে ফেলুন, মুখ ছুঁয়ে ফেলবেন না। নিজেদের স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা যে ওরা খুব ভালভাবে করতে পারেনি, সে-কথা নিজেরাই স্বীকার করবে। কিন্তু সব মিলিয়ে সঙ্কটটা যথেষ্ট ভাল সামলেছে।

    ইংল্যান্ডে লকডাউনের ফলে দেশের সমস্ত হোটেল-রেস্তরাঁ এবং শিল্পকেন্দ্র বন্ধ হয়ে বসে আছে; পরিবারের সদস্যেরা অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না, তা বেআইনি হবে! ব্যাপারটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর। বাচ্চাদের এই সবে স্কুলে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এত কিছু সুইডেনে হয়নি ওঁদের ব্যবস্থা আমাদের তুলনায় অনেক শিথিল ছিল, কিন্তু তাও ব্রিটেন কোনও পরিমাপেই সুইডেনের চেয়ে ভাল ফল দেখাতে পারেনি।             

    সুইডিশ মডেলটা ভাল; আমাকে যদি কোনও একটা মডেল বেছে নিতে বলা হয়, আমি সুইডেন-কেই বেছে নেব।

    সুইডেন লকডাউনের পরিবর্তে কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল

    ভারত: কোভিডের সমস্যা হচ্ছে, অতিমারীটা আঞ্চলিক স্তরে ছড়িয়ে পড়ে।মহারাষ্ট্রে ছড়িয়েছে এবং আমি আশা করছি পশ্চিমবঙ্গে চরম সময়টা পার হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকটা অঞ্চলে, ঠিক যেমনটা ভাবা হয়েছিল, সেভাবেই রোগটা হয়েছে: এসেছে, দ্রুত ছড়িয়েছে, যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ ‘ইমিউন’ হয়ে যাওয়ার পর, চলে গেছে। রোগটা হয়তো আবার পরের শীতে ফেরত আসবে, কিন্তু আশা করা যায় সেটা খুব বড় একটা সমস্যা হিসাবে দেখা দেবে না। ভারতের কিছু জায়গায় ‘হার্ড ইমিউনিটি’ দেখা যাচ্ছে। আবার কিছু জায়গা এমন আছে যেখানে সংক্রমণ এখনও পৌঁছয়নি, সেখানেও এক সময় পৌঁছবে। ভারতের অধিকতর জনসংখ্যা ‘হার্ড ইমিউনিটি’ পেয়ে গেছে, এটা বলা বোকামি হবে।  

    ভারতবর্ষে লকডাউন চলাকালীন পরিযায়ী শ্রমিকেরা, মার্চ ২০২০

    বিশ্ব জুড়ে, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এই রোগ শীতকালে আসে এবং গরমকালে চলে যায়।কিন্তু ভারতের মতো আবহাওয়ার দেশে এটা খুব পরিষ্কার নয়। আমাদের বর্ষাকালে হয়তো এটা ফেরত আসবে; গত বছরও, বর্ষাতেই সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়েছিল। আমি ভাবিনি, অতিমারী দক্ষিণ আফ্রিকায় এভাবে ফেরত আসবে, কিন্তু ওখানকারও আবহাওয়া স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠার দরুন হয়তো তা হল। তাছাড়া, একটা বিশাল অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় হয়তো রোগ ছড়াতে পারে। অতএব, ধারাভি-তে ৫০ শতাংশ ‘সেরো-পজিটিভিটি’ আছে মানেই রোগটা মালাবার হিল-এ ছড়াবে না, এমন কোনও কথা নেই।

    ইংল্যান্ড: এই মুহূর্তে আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম। অনেকটা ‘হার্ড ইমিউনিটি’ হয়েছে বলা যেতে পারে। সরকারের উপদেষ্টারা অবশ্য বলবেন, এটা লকডাউনের সুফল। সত্যি কথাটা হল, যাঁরা দুর্বল, তাঁদের সবাইকেই আমরা ভ্যাকসিন দিয়ে দিয়েছি। এবং বহুদিন আগেই আমাদের সবকিছু খুলে দেওয়া উচিত ছিল। শিক্ষাবিদেরা দিব্যি আছেন, বাড়ি থেকে ল্যাপটপে বসে কাজ করছেন। যাঁদের আমরা সর্বনাশ করেছি, তাঁরা হলেন দরিদ্র, এবং তরুণ। এটা ভীষণই দুঃখের যে বাচ্চাদের স্কুলে যেতে দেওয়া হয়নি এবং এখনও তাদের মাস্ক পরতে হচ্ছে এবং নাক সোয়াব করাতে হচ্ছে, যা খুবই অস্বস্তিকর। শিশুদের খেসারত দিতে হচ্ছে এমন একটা সমস্যার, যেটা তাদের নয়ই। আমি খুব হতাশ। 

    ইংল্যান্ডে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিশু উদ্যান

    ব্যক্তিগত ভাবে, এই অতিমারীর সময়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? 

    এর অনেকগুলি স্তর আছে। একদিকে আমার অভিজ্ঞতাটা সুখকর নয়, কারণ আমার মতামতগুলো ছিল সরকার ও তার উপদেষ্টাদের মতামতের একেবারে উল্টো। আমার মতের প্রচণ্ড বিরোধিতা করা হয়, এবং তা সরাসরি ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আমাদের কথা যাতে কোনওভাবেই শোনা না হয়, সেজন্য রীতিমতো প্রচার চালানো হয়। বেশ কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ নিয়ে কুৎসিত আক্রমণ করেন।

    কিন্তু বিজ্ঞান তো তর্কাতীত নয়, তাকে তো চ্যালেঞ্জ করা যায়, বিজ্ঞান নিয়ে তর্ক করা যায়, নীতি প্রবর্তন নিয়ে তর্ক করা চলে। কিন্তু আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি (লকডাউনের বদলে সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা) জানানোর জন্য হিংস্র ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হলাম। 

    কিন্তু একই সঙ্গে, সমমনস্ক মানুষদের সান্নিধ্যে এলাম, যাঁরা আমার মতো একই মতে বিশ্বাস করেন। আমার মতোই তাঁরাও কেবল ইংল্যান্ডে নয়, সারা বিশ্বে গরিবদের উপর লকডাউনের প্রভাব নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী ছিলেন। আমরা একত্রিত হয়ে চেষ্টা করেছিলাম বোঝাতে, লকডাউনের প্রভাবে কী কী ক্ষতি হতে পারে এবং এই ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ রোধ করার ক্ষেত্রে কী কী অন্য উপায় অবলম্বন করা যায়। 

    ইংল্যান্ড ৩৭০০ কোটি পাউন্ড খরচ করেছে শুধু track-test-tag করার জন্য, মানে, ভাইরাস সংক্রমণ খুঁজে বার করা, পরীক্ষা করা, রোগীকে চিহ্নিত করাএই প্রক্রিয়ার জন্য। এতে কাজ হওয়ার খুব সম্ভাবনা ছিল না। এই টাকার অঙ্কটা তো খরচ হলই, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হল বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলির সঙ্গে একত্রে কাজ করার জন্য যে ফান্ড দেওয়া হয়, সেগুলোও। যেমন, আমার নিজের একটি গবেষণা, পোলট্রি হেলথ-এর  জন্য যে অনুদান পাওয়ার কথা ছিল, তা-ও বন্ধ হয়েছে। এ তো সবে শুরু, আরও অনেক অনুদান বন্ধ হবে।  

    আপনি তো একজন পুরস্কার-বিজয়ী লেখক। এই অতিমারী সাহিত্যে কীভাবে স্থান পাবে বলে আপনার মনে হয়? 

    আমি অন্তত এই নিয়ে কিছুই লিখব না। এমন কয়েকটা অতিমারী হয়েছে আগে, যেগুলো আমাদের ভাবনায় একটা গভীর স্থান করে নিয়েছে। যেমন ধরা যাক প্লেগ। এই অসুখ নিয়ে বাস্তব এবং কাল্পনিক, দু’ধরনের লেখাই হয়েছে। স্বয়ং অ্যালবার্ট কামু এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আশ্চর্য ব্যাপার হল, ১৯১৮ সালের অতিমারী স্প্যানিশ ফ্লু কিন্তু সাহিত্যে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি। যদিও ক্যাথরিন অ্যান পোর্টার এ বিষয়ে একটি দারুণ ছোট্ট নভেল লিখেছেন, ‘পেল হর্স, পেল রাইডার’।

    তিনটে গল্পের সংকলন। একটা গল্প ১৯১৮-র স্প্যানিশ ফ্লু’র প্রেক্ষাপটে।

    স্প্যানিশ ফ্লু-তে পাঁচ কোটি মানুষ মারা গেলেও বিশ্বসাহিত্যে কখনই কোনও কেন্দ্রীয় স্থান পায়নি এই অতিমারী। কেউ কেউ হয়তো এই কোভিডের সময়টাকে ব্যবহার করে কিছু লিখবেন। আমি মনে করি, সাহিত্য কিছু লেখার আগে একটা বিষয় নিয়ে বেশ কিছুটা সময় ধরে গভীর ভাবে ভাবা উচিত।  

    ছবি এঁকেছেন উপল সেনগুপ্ত

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook