তখন আমার ২১ বছর বয়স। নাটকের জগতে পা রেখেছি বছর দুয়েক হল। ম্যাক্সমুলার ভবন বা ‘গোয়েটে ইনস্টিটিউট’ কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত অনূদিত ‘আন্তিগোনে’ নাটকটা মঞ্চস্থ করেছিল, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে। আমি অডিশন দিয়ে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেলাম। জার্মানির ‘কোলন’ শহর থেকে এসেছিলেন পরিচালক হানসগুন্থার হাইমে। গ্রিক নাটক, বাংলায় হচ্ছে, পরিচালক জার্মান। ফলে ভালমন্দ নিয়ে কচাকচি না করেই বলা যেতে পারে, ওই নাটকের দৌলতে আমার একটু-আধটু খ্যাতি হয়। পরে আমি নাটকের জগতে ঢুকে পড়ি। সেই সময় আমার অন্যতম নাট্যগুরু হয়ে ওঠেন তমাল রায়চৌধুরী। তিনিই গোয়েটের ‘ফাউস্ট’ বাংলায় মঞ্চস্থ করেন এবং আমাকে দেওয়া হয় গ্রেচেন-এর ভূমিকা, যে ফাউস্টের কাঙ্ক্ষিত প্রেমিকা। নাটকটি পুরোটা লেখা কাব্যে। তাই সংলাপ মুখস্থ করে ঠিক ভাবে বলাটা ছিল আমার ২১ বছরের ছোটখাটো মনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আর এই বয়সে যা হয়, অনেকেই আমাকে সাহায্য করতে আসতেন, কিন্তু তাঁরা কাজের চেয়ে বেশি আড্ডা দিতেন। এমনই এক বিকেলে তমালদা নিয়ে এলেন রিঙ্কুকে। একমাথা ঝাঁকড়া-কোঁকড়া চুল, আমার মতোই রোগা প্যাঁকাটি, চোখে চশমা, আর সেই চশমা ভেদ করে দুটো মায়াময় চোখ, যা ঘিরে রয়েছে ঘন কালো লম্বা পাতা। ভারি সুন্দর সেই চোখ দুটি। সেই বয়সে চোখের প্রেমে পড়ার রোগ তো থাকেই। গভীর ভাবে তাকালাম ওর দিকে। কিন্তু কোনও প্রত্যুত্তর এল না সেভাবে। তমালদা বললেন, ‘তোমাকে লাইন মুখস্থ করাবে, কীভাবে কোথায় মডুলেশন করবে বলে দেবে, আর আমি চাই তুমি মন দিয়ে লাইনগুলো পড়ো, বোঝো। একদম কোনওভাবে ‘রাস্কেলামি’ না করে।’ রিঙ্কু বলল, ‘ওসব করে কিছু হবে না। তুমি তো আমাকে চেনো তমালদা, ও আমাকে কাজ থেকে টলাতে পারবে না, যতই ছলাকলা জানুক।’ অবাক হয়ে গেলাম। মহা ফচকে ছেলে তো! আমি নায়িকা, আমাকে চমকাচ্ছে! এমনকী চোখে চোখ রেখে, একটুও বিচলিত না হয়ে কাজ করে চলেছে। সত্যিই, আমার কোনওরকম ছলচাতুরি কাজ করেনি সেই রিঙ্কু নামের ছেলেটির উপর, যার ভালনাম ঋতুপর্ণ ঘোষ।
তখনও ঋতুপর্ণর ডাকনামের প্রতি আসক্তি ছিল, তাই কাজ শুরু করতে না করতেই জেনে নিল আমার ডাকনাম ঝুমু। ‘শোন ঝুমু, এটা খুব কঠিন নাটক, কারণ কাব্য-নাটকের একটা ছন্দ আছে, আবার যদি সেটা গানের মতো শোনায়, তাহলে আজকের দর্শক নেবে না। আমি তোকে সাহায্য করব, ছন্দ ভেঙে কীভাবে কাব্য-নাটকের এসেন্স-টা ধরে রাখবি তোর অভিনয় দিয়ে।’ ঋতু আমার থেকে বয়সে ছোটই হবে। তাই প্রথম প্রথম ওর এ-ধরনের কথাগুলোকে ডেঁপোমি মনে হয়েছিল। আমি তমালদাকে বোধহয় এ নিয়ে কমপ্লেনও করেছিলাম। কিন্তু চিঁড়ে ভেজেনি। ঋতু অসম্ভব সিরিয়াস ছিল, এবং আমাকে বকেঝকে, কখনও তোয়াজ করে, কখনও গায়ে হাত বুলিয়ে গ্রেচেন চরিত্রটা উদ্ধার করেছিল। আমার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল খুবই। এই মহলা দিতে দিতে ও আমার সত্যিকারের সখা হয়ে ওঠে। আমি বুঝতে পারি, কৃষ্ণ ও দ্রৌপদীর সম্পর্ক কী ছিল। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ভাল লাগা, খারাপ লাগা, ভালবাসা ছিল, কিন্তু কোনও কামগন্ধ ছিল না।
এই সবই ১৯৮০-র দশকের প্রথম ভাগের গল্প। যখন আমরা সবে মাত্র জীবন-চলা শুরু করেছি। আমি খুব অল্প বয়সেই বিয়ে করে ফেলেছিলাম। আর সেই বিয়ের সম্পর্কে যখন সমস্যা দেখা দেয়, তখন আমি নাটকের জগতে, যাকে বলে, পুরোপুরি নিমজ্জিত। কেউ বুঝত না আমার ভেতরের তোলপাড়ের কথা। কারণ আমি জানতাম, বিয়ে বিস্বাদ হওয়ার পেছনে ভুলটা আমার। আমি বুঝিনি আমি কী চাই। সেসময় একমাত্র ঋতুই আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছিল। বলেছিল, ‘ভুল মানুষ করতেই পারে। তবে সেই ভুলটা জিইয়ে রেখে, সারাজীবন কষ্ট পাওয়া ও কষ্ট দেওয়াটা কাজের কথা নয়।’ ওর এই কথাগুলো আবারও মনে হয়েছিল পাকামো। কিন্তু পরে আমি যখন ওই বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসি, ঋতুর কথাই সাহস জুগিয়েছিল। যদিও ততদিনে ও চাকরি করছিল, আমার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। আমিও সংবাদপত্র জগতে ঢুকে গেছি। একদিকে ঋতুপর্ণ বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করছে, অন্যদিকে আমি ‘আজকাল’, ‘টেলিগ্রাফ’, তারপর ‘সানন্দা’য় নিবেদিতপ্রাণ। মাঝেমধ্যে শুনতাম, ঋতুপর্ণ নাকি বিজ্ঞাপন জগতে বাংলা বিপ্লব নিয়ে এসেছে। ‘নিম’ সাবানের সেই বিখ্যাত ক্যাপশন, ‘দেখতে খারাপ, মাখতে ভালো!’— এটা নাকি আধুনিক বাঙালি জীবনে ঝড় তুলেছে। এসব শুনে ভালও লাগত, আবার অল্প ঈর্ষাও যে হত না, তা নয়। তবে সেই ঈর্ষা বেশিদিন থাকত না, কারণ আমিও নিজের জগতে প্রাণ ভরে কাজ করছি, এবং অপর্ণা সেন, আমার সম্পাদক, আমার বেশ প্রশংসাই করতেন। আশ্চর্য ব্যাপার, সেই ঈর্ষাই ঋতু আর আমার আবার একসঙ্গে কাজ করার সূত্র।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিক, ১৯৯২ সাল হবে, তখন সুমন চট্টোপাধ্যায় (আজকের কবীর সুমন) তাঁর প্রথম ক্যাসেট ‘তোমাকে চাই’ দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করেছেন। বাংলা গানের জগতে নতুন জোয়ার নিয়ে আমরা ‘সানন্দা’র প্রচ্ছদকাহিনি করব ঠিক হল। সবাই নিজের নিজের দায়িত্ব পেল, কিন্তু অপর্ণা সেন হঠাৎ বললেন, মূল প্রতিবেদনটা লিখবে একটি অত্যন্ত প্রতিভাবান ছেলে, যার লেখা চিত্রনাট্য পড়ে তিনি মোহিত। সেই ছেলে আর কেউ নয়, ঋতুপর্ণ ঘোষ। তখনও সে বিজ্ঞাপন জগতের কপিরাইটার ও বিজ্ঞাপনের ছবি-করিয়ে। হঠাৎ তাকে মাথায় তোলার মানেটা কী! আমি ঋতুপর্ণকে আগে থেকেই চিনি, ঋতুও সে কথা রিনাদিকে বলেছে, তাই আমার ওপর ভার পড়ল, ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার। এবার উলটপুরাণ। তমালদা ঋতুকে দিয়ে আমাকে উচ্চারণ ও অভিনয়ের তালিম দিইয়েছিলেন, এবার আমার কাজ হল সময়ের মধ্যে, সবদিক বজায় রেখে, লেখাটা ঋতুর থেকে উদ্ধার করা। শঠে শাঠ্যং। এবার বাপু বুঝবে, এক মিনিটের বিজ্ঞাপনের চিত্রনাট্য বা এক লাইনে ক্যাপশন লেখা, আর বড় প্রচ্ছদকাহিনি লেখার মধ্যে কত তফাত। যেদিন আবার দেখা হল, ঋতু এমন ভাব করল, যেন গতকালই ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছে। গত দশ বছরে যে আমাদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিল না, সেটা বোঝাই গেল না। দেখলাম ও এখনও একই রকম জেদি অথচ সিরিয়াস; যা ভাববে সেইরকম ওকে সুযোগ করে দিতে হবে, যার সঙ্গে যখন সাক্ষাৎকার ঠিক হল, তখনই গাড়ি চাই।
যাই হোক, লেখাটা হল বটে, কিন্তু যেদিন প্রচ্ছদকাহিনি প্রেস-এ যাবে, সেদিনই বাবরি মসজিদ ধ্বংস হল, কারফিউ জারি হল। সংবাদপত্র অফিস থেকে বলা হল, যাদের খুব দরকার, শুধু তাদের গাড়ি করে নিয়ে আসা হবে। আমরা জনাতিনেক— আমি, অনিরুদ্ধ ধর ও সিদ্ধার্থ সরকার আসব ঠিক হল। অপর্ণা সেন যেহেতু সম্পাদক, তিনিও আসবেন। আমরা গেলাম ওঁকে বাড়ি থেকে তুলতে, দেখি ওখানে ঋতুপর্ণ রয়েছে। ও বাড়ি যেতে পারেনি, চিত্রনাট্য পড়তে এসে। পরের বছর এই চিত্রনাট্যই হয় ওঠে ‘উনিশে এপ্রিল’ ছবি। ততদিনে ঋতুপর্ণ ‘হীরের আংটি’ও করে ফেলেছে, যদিও সেটার মুক্তি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। এ ব্যাপারে ঋতুর মনে মনে দুঃখ হলেও ও থেমে থাকার পাত্র ছিল না। আবার একটা নতুন চিত্রনাট্য লিখে অপর্ণা সেনকে ধরে, তাঁকে এতটাই মোহিত করে তুলেছে যে তিনি প্রযোজক জোগাড় করতে শুরু করেছেন! সে যাক, ফিরে আসি সেই দিনে আবার। রিনাদির আলিপুরের বাড়ি থেকে অফিস যাওয়ার পথে অন্যদিকে ঘুরে ঋতুকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। ও থাকে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে। আমাদের গাড়ির চালক কথাটা শুনে মোটেই খুশি হননি। কারণ এলাকাটা সেই সময়ে সত্যিই খুব সেনসিটিভ। ঋতুপর্ণ কিন্তু অবিচলিত। বলল, ‘আরে, চিন্তার কী আছে, ওখানে আমি ছোট থেকে আছি। ওরা জানে আমি মসজিদ ভাঙিনি, আর আমি বলে দিলে তোদের কাউকে ওরা ছোঁবে না।’ সত্যি অবশ্য কাউকে কিছু বলতে হয়নি। আমরা নির্বিঘ্নে ওকে বাড়িতে নামালাম। নামবার মুখে ও হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমার লেখাটা তো আজ প্রেস-এ যাবে, তাহলে আমি যাই তোদের সঙ্গে?’ আমরা সমস্বরে বলি, ‘না! কেন?’ কারণ রাতে ওকে পৌঁছতে আসতে পারবে না কোনও গাড়ি। আমাদের গলায় ও ঠিকই শুনতে পেয়েছিল একটু বিরক্তি! ওকে যে আমরা উটকো ঝামেলা ভাবছি, সেটা ও বুঝেও না-বোঝার অভিনয় করল। বলল, ‘ঝুমু, ভাল করে প্রুফটা পড়িস কিন্তু।’
ঋতুপর্ণর সঙ্গে এই আমার দ্বিতীয় যোগাযোগ। এবং এরপর প্রায় একযুগ— ২০০৪/২০০৫ অবধি— আমরা একসঙ্গে কাজ করি। সেইসব অভিজ্ঞতা এভাবে একদিনে বলা অসম্ভব। ২০০৫-এর পর আমি ও অভিজিৎ নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাই ঋতুপর্ণকে আর অ্যাসিস্ট করতে পারিনি। কিন্তু যখনই দেখা হয়েছে, ঠিক মনে হয়েছে, গতকালই তো একসঙ্গে ছিলাম। ‘দহন’ থেকে ‘চোখের বালি’ অবধি টানা একসঙ্গে কাজ, আড্ডা, ঘোরা, কত কিছু। ছবির চিত্রনাট্য, অভিনয় বা ডাবিং নিয়ে ঋতু যতটা খুঁতখুঁতে ছিল, পোস্তবাটা কতটা মিহি করা উচিত— তা নিয়েও ওর মতামতের শেষ ছিল না। দুপুরে খিচুড়িটা পাতলা হবে, না ঘন, না ভুনি— সে ব্যাপারেও শুটিং-এর মধ্যে ও ঠিক রায় দিয়ে দিত। ২০০৬-এর পর একসঙ্গে কাজ না করলেও, আমরা একে অন্যের কাজ ও অকাজ সব ব্যাপারেই খবর রাখতাম। দেখা হত না ঘন ঘন, কিন্তু যেদিনই হত, ঠিক আগের দেখার মুহূর্তটা থেকেই শুরু হয়ে যেত কথা।
ও চলে যাওয়ার চারদিন আগে, রবিবার সম্ভবত, ফোনে কথা হল। সেই বছর আমি জাতীয় পুরস্কারের জুরি ছিলাম। ‘চিত্রাঙ্গদা’ স্পেশাল জুরি পুরস্কার পেয়েছিল। তা নিয়ে কথা হল। অন্যান্য ছবি নিয়ে বিশদে কথা বলব— তাই ঠিক হল আগামী রবিবার দেখা করব। কিন্ত ওর বড় তাড়া ছিল, অপেক্ষা করল না।