কবিতা, যাপন, দ্রোহ

Allen Ginsberg

কবিতা, প্রতিবিম্ব। তবে টালমাটাল সময়ের প্রতিবিম্ব কেমন হওয়ার কথা? আদপেই কি তা ছন্দ, মাত্রা, বিভক্তির চিরাচরিত নিয়ম মেনে পাতার পরতে পরতে লক্ষ্মী ছেলের মতো থেকে যাবে? তা বোধহয় নয়। প্রতিবারই যখন যুগ থেকে যুগের সূচনা হয়েছে, কবিতাকে পড়তে হয়েছে এমন সব সুঠাম হাতের কবলে, যারা পুরনো পাথরেই শান দিয়ে বের করে এনেছে আগুন; তৈরি করেছে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে মাথা চারা দিয়ে ওঠা প্রতিসংস্কৃতির এক অকুণ্ঠিত দলিল। 

পাঁচের দশকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যালেন গিন্সবার্গ এমনই একজন রূপকার। তাকে শুধু কবি বললে তার শিল্পের ব্যাপ্তির চারপাশে বেড়ি দেওয়া হবে; বোধ করি গিন্সবার্গ এবং তার সমসাময়িক কবিরা চানওনি খাতায়-কলমে, একরকমের  নির্ধারিত করে দেওয়া কবিত্ব বহন করতে। বরং যা তাঁরা চেয়েছিলেন, এবং হয়ে উঠেছিলেন, তা কৌশলগত দিক থেকে একরকমের বেপরোয়া, অস্তিত্ববাদী শিল্পের যাপন, যার নির্মাণের অভিমুখ সর্বদাই স্থির ছিল বিনির্মাণের দিকে। তবে এই বিনির্মাণটি কীসের? 

অ্যালেন গিন্সবার্গ কী এবং কেন তা বুঝতে হলে, প্রথমেই বোঝা প্রয়োজন, অ্যালেন গিন্সবার্গ কী কী নন, এবং হতে চাননি। প্রতিরোধের সব শিল্পীর ক্ষেত্রেই বোধ করি এটিই একমাত্র বোঝার ভাষা হয়ে উঠেছে। সংস্কৃতির প্রাঙ্গণে আমরা এই মুহূর্তে এক জোড় শব্দবন্ধ প্রায়ই ব্যবহার করি— ‘মেইনস্ট্রিম’ এবং ‘অলটারনেট’। বলা বাহুল্য, আমাদের মেইনস্ট্রিম সংস্কৃতি বর্তমানে একরকমের বাণিজ্যসর্বস্বতার ঘেরাটোপে আটকে আছে— কমার্শিয়াল সিনেমা, কমার্শিয়াল সাহিত্য, এবং আরও অন্যান্য যা কিছু। এর বিপরীতে অবস্থান করে স্বাধীন শিল্পের চর্চা— যার স্বাদ, পদ্ধতি, এবং রাজনীতি সহজ করে বলতে গেলে, প্রতিষ্ঠানবিরোধী। বিট আন্দোলনের জন্ম এই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা থেকে, শুধু তফাত এটাই যে, আমাদের বাণিজ্যধর্মী শিল্পের বিপ্রতীপে দাঁড়ানো অলটারনেট শিল্প চাইলে সহজেই দায় এড়াতে পারে ফিলিস্তিনের জেনোসাইড থেকে, অথবা নিভৃত আড়ালে সরে যেতে পারে দুই দেশের করযুদ্ধের প্রাঙ্গণ থেকে।

আরও পড়ুন : আদতে মেরিলিন মনরো বলে কেউ ছিল? না কি নর্মা জিন সারাজীবন অভিনয় করে গেলেন ওই বিশেষ ভূমিকায়? লিখছেন সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়…

কিন্তু বিট কবিরা সরে যেতে যাননি, সরেননি গিন্সবার্গ। সরাসরিভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনের আখ্যা না পেলেও বিট কবিদের এই সাড়া-জাগানো কবিতার ঢেউ পাড় ভাঙল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী মার্কিনি মধ্যবিত্ত সুখী চিন্তাধারার। ঠান্ডা যুদ্ধের আবহে যখন প্রথম বিশ্ব তার নাগরিকদের বুঁদ করে রাখছে একরকমের বস্তুবাদী, বর্ণবাদী, অর্থসর্বস্বতার আফিমে, বিট কবিরা তাঁদের আঘাত হানলেন ভদ্রলোকি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। যে-সমস্ত হতদরিদ্র, লড়াই করা, পরিশ্রান্ত মানুষদের প্রান্তিক করে তুলেছিল উচ্চবিত্ত আমেরিকান সাবার্বিয়া, তার সমস্ত গরলটি নীলকণ্ঠের মতো ধারণ করলেন বিট-রা। 

১৯৫৬ সালে যখন ‘হাউল’ প্রকাশিত হয়, গিন্সবার্গ তখন বছর তিরিশের তরুণ। ‘হাউল’-এর যে স্ট্রিম অফ কনশাসনেস, তা বোধ করি কবির একার না— এ এক আশ্চর্য পলিফোনিক গর্জন, যা আমেরিকা, তথা বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের সমষ্টিগত বিবেকে অবস্থান করে। এই গর্জন সেইসব মানুষের, যাঁরা শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ নির্বিশেষে ভিয়েতনাম যুদ্ধের রণক্ষেত্রে যেতে চাননি, যাঁরা দিন গুজরান করেন আমেরিকার অলিতে-গলিতে, সম্ভবত একবেলা খাবার ও একবেলা নেশায় আচ্ছন্ন থেকে, সেইসব মানুষেরও, যাঁরা লিঙ্গনির্বিশেষে খোলাখুলিভাবে ভালবাসতে চেয়েছেন তার পাশের মানুষকে এবং পড়েছেন রাষ্ট্রের চোখরাঙানির কবলে।

ডাডাইস্ট কার্ল সলোমনকে উদ্দেশ্য করে লেখা এই ম্যানিফেস্টোপ্রতিম কবিতার জন্য গিন্সবার্গকে পড়তে হল রাষ্ট্রীয় রোষানলে— তার বিরুদ্ধে আনা হল সমকামিতা এবং অশ্লীলতার অভিযোগ। কমিউনিস্ট-ভীত ম্যাকার্থিযুগের ‘শ্লীল’ এই রাষ্ট্রযন্ত্র, যা এতদিন চোখ ফিরিয়ে ছিল তার অভুক্ত, অর্ধমৃত শ্রেণির দায়ভার নেওয়া থেকে, তার আনা এই অভিযোগ একপ্রকার প্রতিষ্ঠাই দিল অ্যালেনকে। তিনি হয়ে উঠলেন সমসাময়িক সময়ের ‘পিস দে রেসিস্টেন্স’।

কার্ল সলোমনের সঙ্গে অ্যালেন গিন্সবার্গ, ব্রংক্স ভেটেরেনস হাসপাতালে

তবে শুধু অ্যালেন নন, বিট আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে থাকা সকলেই গড়ে তুললেন এই প্রতিরোধ। আলাদা লেখার টেবিল থেকে উঠে আসা আলাদা আলাদা কবি হিসেবে নয়, বরং এরা পরস্পরের কাছাকাছি থেকেছেন জীবনে, যাপনেও। কলেজ-পরবর্তী সময়ে একধরনের কমিউনধর্মী জীবন কাটাতে শুরু করেন এই বিটনিক দল। তাঁদের মুক্ত চিন্তা, মুক্ত যৌনতা, বেহিসেবি নেশাগ্রস্ততার এই জীবনশৈলী, যাকে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল সংস্কৃতির পরিপন্থী বলে, তা বোধ করি মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির আবরণ সরিয়ে দিয়ে একরকমের চক্ষু উন্মীলন করারই প্রচেষ্টা। যা ‘হাউল’-এ বর্ণিত আবর্জনাময়, আগ্রাসনকামী, বস্তুসর্বস্ব এক মার্কিন সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে, প্রাণপণে সরে এসে, ছুঁতে চাইছিল অন্তর্নিহিত এক আধ্যাত্মিকতাকে। একইসঙ্গে এই যাপন একধরনের ইমারসন-ও বটে, যা স্রষ্টাকে তার সৃষ্টি থেকে আলাদা হতে দেয় না কখনওই। এই নিয়ে কোনও দ্বিরুক্তি নেই যে, অ্যালেন যা লিখেছেন, তা তিনি বেঁচেছেনও বটে। 

১৯৬১ সালে তিনি তার স্ত্রী পিটার অরলভস্কির সঙ্গে আসেন কলকাতায়, এবং কিছু সময় কাটান বেনারসেও। পূর্বের ধর্মতত্ত্ব তাঁকে আকৃষ্ট করেছে বারবার— আধ্যাত্মিকতার সন্ধানে তিনি দলাই লামার দ্বারস্থ হয়েছেন সুদূর তিব্বতে, আবার বেনারসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কৃষ্ণনামও করেছেন। পশ্চিমি দুনিয়ার পূর্বের ধর্মের প্রতি এই আগ্রহ নতুন নয়, বরং মাঝে মাঝে দৃষ্টিকটুও লাগতে পারে, কিন্তু গিন্সবার্গের ক্ষেত্রে যে তা লাগেনি, তার কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, গিন্সবার্গ তার সমস্ত পশ্চিমি মোড়ক পশ্চিমের মাটিতেই ফেলে দিয়ে এসে একধরনের অভিজ্ঞতামূলক জীবনের সন্ধান করেছেন তাঁর সমস্ত ভ্রমণের আধারে। এবং দ্বিতীয়টি হল এই যে, তাঁর এই যাপন এবং অনুভব জায়গা করে নিয়েছে তাঁর কবিতার ভাষা এবং আধারে। 

অ্যালেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু হয়ে ওঠেন লুসিয়ান কার। লুসিয়ানের সূত্র ধরেই অ্যালেনের ঘনিষ্ঠতা হল জ্যাক কেরুয়াক, উইলিয়াম এস বারোজ, নেইল ক্যাসাডি ও গ্রেগরি কর্স-এর সঙ্গে, যাঁরা পরবর্তীতে প্রত্যেকেই হয়ে ওঠেন বিটনিক যুগের ধারক ও বাহক। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এবং ওয়েস্ট এন্ড ক্যাফেতে প্রায়শই দেখা যেত একঝাঁক এই তরুণ তুর্কিকে। এদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনও ছিল ভারি রঙিন— লুসিয়ান তাঁর দীর্ঘদিনের অনুরাগী এবং স্টকার ডেভিড ক্রেমারকে আত্মরক্ষার্থে খুন করে বসলেন। অ্যালেন এই ঘটনায় জড়িত না থাকলেও, তাঁর বাকি বন্ধুরা এই ঘটনা চাপা দিতে সাহায্য করল লুসিয়ানকে। তবে এই ঘটনার জন্য কলম্বিয়া এক বছরের জন্য সাসপেন্ড করল অ্যালেনকে।

অ্যালেনের নিজের ছাত্রজীবন ছিল এমন টুকরো টুকরো বেপরোয়া ঘটনায় ভরা। যৌবনের এই ঘটনাবহুলতা, সমপ্রেম, কার্ল সলোমন, মেসকালিন-আচ্ছন্ন দিন গুজরানের আয়না হয়ে ওঠে ‘হাউল’, ‘কাদ্দিশ’ এবং অন্যান্য কবিতা— যা অ্যালেন লিখেছেন তাঁর জীবন দিয়ে।

তবে অ্যালেন চাননি কৃতী ছাত্র, কৃতী কবির জীবন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানধর্মী জীবন ভেঙে বেরিয়ে আসাই ছিল তাঁর ভবিতব্য। অতএব, বন্ধুরা তাঁদের সম্মিলিত যাপন শুরু করলেন পাঁচের দশকের বোহেমিয়ান কালচারের প্রাণকেন্দ্র গ্রিনউইচ ভিলেজ-এ। বোহেমিয়ান এই জীবন না বেছে নিতে চাইলে, গিন্সবার্গ সহজেই বেছে নিতে পারতেন সাংবাদিকতার পাকপাকি একটি চাকরি, খ্যাতি এবং যশ। কিন্তু গিন্সবার্গ যে বেছে নিলেন এই দলগত, মিশে থাকার যাপন, এই যাপনই যেন সময়ের নিরিখে হয়ে উঠল বিট যুগের ‘এক্সকুইজিট কর্পস’। তাই গিন্সবার্গ-এর জন্মদিনে, গিন্সবার্গ-এর কথা বলতে গিয়ে চলে আসে তাঁর সুহৃদ, সহ-কবি, এবং বন্ধুদের নাম— গ্রেগরি কর্স, নিল ক্যাসাডি এবং জ্যাক কেরুয়াকের কথা। এই বন্ধুত্ব এবং সম্মিলিত প্রতিস্পর্ধিতার সান্নিধ্য— যা স্পষ্ট করেছে তার শিল্পীসত্তা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অ্যালেন ছিলেন আমাদের ‘শক্তি-সুনীল’-এরও বন্ধু। 

১৯৬১ সালে তিনি তার স্ত্রী পিটার অরলভস্কির সঙ্গে আসেন কলকাতায়, এবং কিছু সময় কাটান বেনারসেও। পূর্বের ধর্মতত্ত্ব তাঁকে আকৃষ্ট করেছে বারবার— আধ্যাত্মিকতার সন্ধানে তিনি দলাই লামার দ্বারস্থ হয়েছেন সুদূর তিব্বতে, আবার বেনারসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কৃষ্ণনামও করেছেন। পশ্চিমি দুনিয়ার পূর্বের ধর্মের প্রতি এই আগ্রহ নতুন নয়, বরং মাঝে মাঝে দৃষ্টিকটুও লাগতে পারে, কিন্তু গিন্সবার্গের ক্ষেত্রে যে তা লাগেনি, তার কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, গিন্সবার্গ তার সমস্ত পশ্চিমি মোড়ক পশ্চিমের মাটিতেই ফেলে দিয়ে এসে একধরনের অভিজ্ঞতামূলক জীবনের সন্ধান করেছেন তাঁর সমস্ত ভ্রমণের আধারে। এবং দ্বিতীয়টি হল এই যে, তাঁর এই যাপন এবং অনুভব জায়গা করে নিয়েছে তাঁর কবিতার ভাষা এবং আধারে। 

গিন্সবার্গ তাঁর ১৯৪৭-’৯৫ অবধি কবিতা সংগ্রহের সূচক হিসেবে, ‘প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র’ থেকে লিখছেন, ‘কোনও কষ্ট নেই, কষ্টের কোনও কারণও নেই, নেই কোনও নির্বাণ, নেই পথ, নেই জ্ঞান, কোনও প্রাপ্তি নেই। কারণ কোনও অপ্রাপ্তিই নেই।’ গিন্সবার্গের ক্ষেত্রে বলা যায়, কবির জীবন, তাঁর যাপনই তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি, তাঁর একান্তভাবে বাঁচার শিল্প। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে, গিন্সবার্গ তাঁকে আমন্ত্রণ জানান তাঁর, তাঁদের গ্রিনউইচের বাড়িতে। সুনীলের বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায়, অ্যালেনদের এই অ্যাপার্টমেন্টের দরজা সর্বদাই খোলা থাকত তরুণদের জন্য। সময়-নির্বিশেষে এঁরা দলে দলে আসতেন এবং গিন্সবার্গ তাঁদের সঙ্গে কখনও গাইতেন উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা, আবার কখনও কৃষ্ণনাম। সুনীল লিখছেন, জ্যাক কেরুয়াক, (‘অন দ্য রোড’-খ্যাত এবং অ্যালেনের সমসাময়িক বিটনিক কবি), সেই সময়ে বছরে তিন-চারটি করে উপন্যাস লেখেন। তার বিষয়বস্তু নিয়ে জ্যাককে ভাবতেই হয় না, কারণ জ্যাকের বন্ধুদের জীবন, তার ঘটনাবহুলতাতেই কুলিয়ে যায় উপন্যাসের দেহ। এমন সময়ে আলেনেরই বন্ধু কবি গ্রেগরি কর্স একদিন জ্যাককে ঈষৎ মত্ত অবস্থাতেই ফোন করে খুব রাগারাগি করে বলেন, ‘এই জ্যাক, তুই আমাদের নিয়ে বই লিখছিস, আমাদের রয়্যালটি দিবি না কেন রে। দে টাকা দে!’

তবে এ নিছকই বন্ধুমহলের অন্তরঙ্গ রসিকতা। এই রসিকতা ছিল গিন্সবার্গের নিজের জীবনেও— এত অশ্লীলতার অভিযোগ কাঁধে বহন করেও, গিন্সবার্গ ছিলেন স্মিত, রসিক। তিনি একবার চে গুয়েভারাকে ‘কিউট’ বলার অপবাদে বহিষ্কৃত হন কিউবা থেকে। ঝাঁকড়া চুল এবং আলুথালু শার্ট পড়া দুষ্টু চোখের গিন্সবার্গকেও অনেকেরই ‘কিউট’ লাগত বইকি! প্রেম এবং বন্ধুত্ব বারবার এসেছে বহুগামী অ্যালেনের জীবনে। যদি উইলিয়াম বারোজ এবং লুসিয়েন কার হয়ে থাকেন  গিন্সবার্গ-এর শিক্ষাগুরু, তবে কেরুয়াক ছিলেন অ্যালেনের বন্ধু, অ্যালেনের প্রেম। ১৯৭০-এর মাঝামাঝি, সুহৃদ জ্যাক কেরুয়াকের মৃত্যুর পরে, গিন্সবার্গ সূচনা করেন জ্যাক কেরুয়াক ‘স্কুল অফ ডিসেমবডিড পোয়েটস’— বৌদ্ধধর্মী একটি প্রতিষ্ঠান, যা গ্রীষ্মকালীন সময়ে পড়াত কবিতা ও বৌদ্ধধর্ম। 

আজীবনকাল অ্যালেন তাঁর লক্ষাধিক কপি বিক্রি হওয়া কবিতার বইয়ের সিংহভাগ উপার্জনই ব্যয় করেছেন তাঁর বন্ধু, সহশিল্পী ও অনুরাগীদের জন্য। অ্যালেনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, কবি-সাহিত্যিকদের প্রাপ্যের ভাগ হওয়া উচিত ন্যূনতম। এই ন্যূনতম ভোগবাদের জীবন অ্যালেন বজায় রেখেছেন শেষ পর্যন্ত; নেননি সরকারি সাহায্য, বা চাকরি।

তবে তাঁর বেহিসেবি, ছন্নছাড়া, আদ্যন্ত প্রেমিক পুরুষের এই জীবন তাঁকে রেহাই দেয়নি নির্মমতার হাত থেকে। ‘হাউল’, ‘কাদ্দিশ’, ‘হোয়াইট শ্রাউড’, ‘কসমপলিতান গ্রিটিংস’-এর অগুনতি কবিতার পরেও শেষ দিন অবধি তাঁর কলম চলেছে অবিশ্রান্ত।

গিন্সবার্গ মারা যান বন্ধু-পরিবেষ্টিত হয়ে, তাঁর ইস্ট ভিলেজের অ্যাপার্টমেন্টের কামরায়। সংকটমূলক বিভিন্ন আরও অসুখের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর লিভারে বাসা বেঁধেছিল কর্কট রোগ। বিট কবিদের প্রসঙ্গে জন ক্লিওলান হোমস বলেছিলেন, বিট কবি হওয়ার অর্থ হল, নিজের সর্বনিম্ন অবস্থানে অবস্থিত থেকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করা উত্তরণের দিকে। অ্যালেন আজীবনই তাই করে গিয়েছেন; নিউ ইয়র্ক শহরের আন্ডারগ্রাউন্ড এবং দার্শনিক আধ্যাত্মিকতার মধ্যে অ্যালেন গিন্সবার্গ অবস্থান করেছেন এক সেতুবন্ধনের কারিগর হিসেবে।

গিন্সবার্গের জীবনের কথা বলতে গিয়ে এবং একুশ শতকে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রাপ্তি, অথবা তাঁর থেকে পাওয়া প্রাপ্তির যে হিসেব আমরা এতক্ষণ করছিলাম, তা বোধ করি এবার বন্ধ করার সময় হল। কারণ, যে দর্শন তিনি বেঁচেছেন, তাতে অ্যালেনের ‘নেই কোনও নির্বাণ, নেই পথ, নেই জ্ঞান, কোনও প্রাপ্তি নেই। কারণ কোনও অপ্রাপ্তিই নেই।’