বাংলার মিষ্টি নিয়ে রয়েছে হাজারও ইতিহাস আর তত্ত্বকথার আঁকিবুঁকি। কিন্তু সেই ইতিহাস ব্যস্ত থেকেছে কেবল মিষ্টির স্থানকাল আর স্রষ্টার প্রসঙ্গ নিয়ে। সেখানে অজানা রয়ে গেল মিষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বঙ্গনারীর অন্দরমহলের গল্প। ইতিহাসের পিদিম সেদিকে আলো দেয়নি। আসলে মিষ্টি মানে শুধুমাত্র স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ নয়, এই তিনের বাইরে গিয়েও তার রয়েছে নিজস্ব রূপটানের গল্প, যে-গল্প বাংলার মেয়ে-বউরা রচনা করেছে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। এই চর্চা অনুচ্চারিত রয়ে গেল। মনে রাখা হল না, যেভাবে বারো মাসের তেরো পার্বণে রূপটানের চর্চা শুরু হয়, ঠিক সেই একই নিয়মে মিষ্টির রূপটানের কাব্যও রচনা করেছেন বাংলার মেয়েরা। আমরা জানতেও চাইনি, মিষ্টান্ন রূপটানের কাব্যকৌশল কীভাবে বাংলার মেয়েদের ঘরকন্নার অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। মিষ্টির সঙ্গে নকশা যুক্ত করে মিষ্টির স্বাদ সৌন্দর্যে যুক্ত করতে হবে দৃষ্টিনান্দনিক গুণ, এই ছিল তাদের উপলব্ধি। এমন উপলব্ধির প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে সেকালের মেয়েদের ‘রূপটান’চর্চা।
এটা সেই সময়ের কথা, যখন অন্দরমহল মানেই হল নারীর ত্রিভুবন। সেই ঘেরাটোপের ভুবনেই চলে তার আত্মজীবনী রচনার প্রস্তুতি কিংবা মনন ও ভাবনাকে সঙ্গী করে সেখানেই নারী গড়ে তোলে তার নিজের কথা বলার জগৎ। বিষয় ছিল অনেক। কেশচর্চা, রূপ দেখার কথা, সাজের গল্প, বিয়ের পদ্য, দেওরের বউদিদি আলাপ, গয়নার বাক্স, জামাই-আদরের কৌশল, রুমাল কাব্য, পতির পুণ্যে সতীর পুণ্যে সূচের ফোঁড়, দূরবিন চালনা, বিলিতি এসেন্স, ইংরেজি বিস্কুট, সঙ্গে ‘বেস্পতিবারের ব্রত’, শনি-মঙ্গলবারের নিরামিষ পাত— আরও কত কী! এই ‘কত কী’-র মধ্যেই বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে মিষ্টির নকশার প্রসঙ্গ। আসলে নিজেদের রূপটানের চর্চার সঙ্গে মিষ্টির রূপটানের ভাবনাকে তারা বিচ্ছিন্ন করে দেখেনি। দু’জায়গাতেই সেদিন প্রকৃতি তার সম্পদ দিয়েছে দু’হাত ভরে।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, সন্দেশ খেয়ে কেউ যদি বুঝতে না পারেন সেটি নকুড় নন্দীর না কি ভীম নাগের, তা হলে তিনি বাঙালি নন! লিখছেন জয়ন্ত সেনগুপ্ত…
রূপটানের চর্চায়, বঙ্গললনার সাজঘরে সেদিন প্রকৃতির উজাড় সম্পদ। লাক্ষা থেকে আলতা বের করার কৌশল সেদিন তাদের নখদর্পণে। হিঙ্গুল দিয়ে কী উপায়ে রাঙানো হবে হাতের নখ, সেই শৈলী তাঁরা জানতেন, একইসঙ্গে জানতেন কুঙ্কুম দিয়ে টিপ তৈরির নিয়মকানুন। চন্দন দিয়ে মুখের অলকাতিলকা আঁকা সেদিন বঙ্গললনার শৈল্পিক পরিচয় বহন করত আর বুকে পত্রলেখা আঁকা হত কস্তুরী দিয়ে। কাজল তো পরতেনই সবাই, সেই সঙ্গে চন্দনচূর্ণই ছিল তাঁদের পাউডার। তাছাড়া দালচিনি, এলাচগুঁড়ো ও খসখস মিশ্রণের সঙ্গে কস্তুরী ও কর্পূর মিশিয়ে তাঁরা তৈরি করতেন সুগন্ধি পাউডার। আয়ুর্বেদশাস্ত্র বলে থাকে, দালচিনি পড়ন্ত যৌবনশ্রীকে উজ্জ্বলতা দেয়। এছাড়াও দেখা যায়, একটুকরো লাউ প্রতিদিন তাঁরা মুখে ঘষে যৌবনশ্রী অক্ষুণ্ণ রাখার মন্ত্র জানতেন। খেতেন একটুকরো ঘৃতপক্ক রসুন বা রসোনা। অন্যদিকে চুলের জন্য পছন্দ ছিল আমলা ও তিল তেল। আর সুগন্ধির ওপর বাঙালি মেয়েদের আকর্ষণ ছিল দেখার মতো। তাঁরা নানারকম সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। জটামাংশী নামে এক গাছের শেকড় দিয়ে মেয়েরা পোশাককে সুগন্ধি করে নিতেন।
এছাড়া ‘বর্ণপ্রসাদক’-রূপে হলুদ, ত্বক মসৃণ করার জন্য দুধের সর, সাবানের বদলে ক্ষার, ঠোঁট রাঙানোর জন্য পান, চোখে পরার জন্য কাজল— রূপটানের এসব উপকরণ তো ছিলই। কেশকে তাঁরা সুগন্ধি করতেন ধূপের ধোঁয়ায় চুল শুকিয়ে। এক কথায় নিজের সৌন্দর্যের বিন্যাস নিয়ে অন্দরমহলের যে-চর্চা ছিল, সেই চর্চার ছাপই অবধারিতভাবে গিয়ে পড়ল বঙ্গললনার হাতে তৈরি মিষ্টির ওপরে।
সেদিন বাঙালির আপ্যায়ন এবং অতিথিকে আহার দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন ঘরের মেয়েরাই। সেই পরিবেশন হবে এক কথায়, শিল্পসম্মত। বলা হয়ে থাকে, পঞ্চব্যঞ্জন রন্ধনের মধ্য দিয়ে যেমন বিচার করা হত গৃহকর্ত্রীর রন্ধনকুশলতার, আবার একইভাবে ভোজনের শেষ পর্বে গৃহিণীর মিষ্টান্ন পরিবেশনও ছিল মনে রাখার মতো। কারণ গৃহকর্ত্রী সেখানে যে-মিষ্টি পরিবেশন করতেন, তার মধ্যে তাঁরা যুক্ত করতেন নিজেদের শিল্পচেতনার পরিচয়। সেই কারণেই গৃহিণীদের মিষ্টি পরিবেশন ছিল বাঙালির গর্বের একটা পর্ব। সেসব মিষ্টির সঙ্গে বিজ্ঞাপনের চটকদারি যোগাযোগ ছিল না। সেসব মিষ্টি ছিল সেকালের বঙ্গবালাদের নিজস্ব সৃষ্টি। তাই সেই মিষ্টি তারা শুধুমাত্র স্বাদ-তৃপ্তির কথা ভেবে বানাতেন না, একইসঙ্গে সেই মিষ্টিকে তাঁরা করে তুলতেন দৃষ্টিনন্দন। স্বভাবতই চন্দ্রপুলি, নারকেল নাড়ু, সন্দেশ কিংবা ক্ষীর— যাই হোক না কেন, সবের জন্যই মেয়েরা নিজে হাতে ছাঁচের নকশা কাটতেন।
তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, মিষ্টিকে মিষ্টি নকশার ছাঁদে ফেলে মনভোলানো উপায়ে প্রস্তুত ও পরিবেশন করা। আসলে এ শুধু মিষ্টি পরিবেশন নয়, এর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বাইরের অতিথির সামনে অন্তঃপুরবাসিনীর নিজেকে বা নিজের আত্মপরিচয়কে তুলে ধরার বাসনা। ছাঁচের আকার শুধুই জ্যামিতিক— তা নয়, বরফি, বৃত্ত, অর্ধচন্দ্র, বর্গাদার, ত্রিকোণ ছাড়াও ছিল লিচু, মাছ, শঙ্খ, আতাফল, পদ্ম ইত্যাদি। আবার এর কোনও-কোনওটি হত বাটির মতো, কোনওটি-বা সমতল। ফলফলারি আর ফুল-লতাপাতার সঙ্গে-সঙ্গে নকশা-ছাঁচ ভরিয়ে তোলা হত মাছ, পাখি, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া ইত্যাদি দিয়ে। অনেকেই আবার ব্রতর আলপনার সঙ্গে মিলিয়ে-মিলিয়ে ছাঁচের নকশা তৈরি করতেন।
লোকশিল্পর গবেষক তারাপদ সাঁতরা বলেছেন, ‘আর হত বাংলা পদ্যছন্দে বা সংস্কৃত ভাষায় দু থেকে চার লাইনে উৎকীর্ণ উপদেশ বা সৎবাক্য সমন্বিত ছাঁচ।’ উদাহরণস্বরূপ, একটি ছাঁচে বাংলা পদ্যছন্দে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘মাটি হতে হইয়াছে মানুষের ভাব/সেইত মানুষ যার মাটির স্বভাব’। আর একটি ছাঁচে উৎকীর্ণ করা হয়েছে বেশ একটি কৌতুক কবিতা, ‘মন ছটপট, মনরঞ্জন, মন রইল বোসে, চোখের জলে পিরিৎ গেল নরদসা দে ভেষে ভোক্ষনেম’ ইত্যাদি।
আনুষ্ঠানিক পর্বের ছাঁচের মধ্যে ‘গাত্রহরিদ্রা’, ‘শুভবিবাহ’, ‘ফুলশয্যা’, ‘মিলনরাত্রি’, ‘সুখে থাকো’ ইত্যাদি প্রতিলিপি উৎকীর্ণ করা ছাঁচের উল্লেখ করতে পারা যায়।… উল্লেখ্য যে, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গ্রামবাংলার মেয়েরা ছাঁচের মধ্যে ‘বন্দেমাতরম’ কথাটিও ব্যবহার করতে ভুলে যাননি। এক-একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে সেই ক্রিয়াকর্মেও উপযোগী ছাঁচ ব্যবহার করার রীতি প্রচলিত ছিল। গায়ে হলুদের তত্ত্বে যেমন ফলফলারি, ফুল-লতাপাতা ও পশুপক্ষীর ছাঁচ ব্যবহৃত হত, তেমনই ফুলশয্যার তত্ত্বে প্রজাপতি-অঙ্কিত ছাঁচ সর্বদাই অগ্রাধিকার লাভ করত। আবার দীর্ঘলাঙ্গুল হনুমান নিবিষ্টচিত্তে সন্দেশ ভক্ষণে রত— এরকম নকশাও দেখা গেছে। বলা বাহুল্য, নতুন জামাইয়ের অভ্যর্থনায় শ্যালিকারা অথবা প্রবীণ বেহাইয়ের আপ্যায়নে রসিকা বেহানেরা যে এগুলি কাজে লাগাতেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পরিহাসপ্রিয়তার সঙ্গে বাঙালির গৃহশিল্প সামগ্রীর এই শিল্পচেতনা— এই দুইয়েরই মণিকাঞ্চন যোগ বাঙালির জীবনকে করে তুলেছিল রসসমৃদ্ধ।
এই বিষয়ে বাগনানের আনন্দ নিকেতন কীর্তিশালার আধিকারিক জানালেন, ‘আগেকার দিনে অনেক বাড়ির মেয়ে-বউ পরপুরূষের সামনে মুখ খোলা রেখে আসতে পারতেন না। এমনকী, নিজের মেয়ে-জামাইয়ের সামনেও তাঁরা আসতেন ঘোমটা মাথায় দিয়ে। তখন ছাঁচের নকশায় তোলা বাক্য মিষ্টির মধ্যে যাতে সামনের ব্যক্তি সঠিকভাবে পড়তে পারে অতিথি, সে-কথাও ভাবা হত। এইসব ছাঁচ যেন কথা বলে উঠত নীরবে, নিস্তব্ধে।’
তারাপদ সাঁতরা ভারি সুন্দরভাবে বলেছেন এই প্রসঙ্গে— ‘সন্দেশ বা আমসত্ত্বের এই ছাঁচগুলি তৈরি করা হয় মাটি দিয়ে পরিকল্পনামতো ফলক বানিয়ে। আমসত্ত্বের ছাঁচের বেলায় দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত নরম পাথরের থালার ওপর নরুন দিয়ে খোদাই করে তৈরি। মাটির যে ধরনের ছাঁচ তৈরি করা হবে, সেটির পরিকল্পনামতো আকার অনুযায়ী নরম কাদা দিয়ে একটি ফলক তৈরি করে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এবার নরুন দিয়ে কেটে কেটে সেই ফলকটির ওপর তোলা হয় প্রার্থিত নকশাটি। এ ছাড়া ছোটো ভাঙা পাথরবাটির নীচের অংশে নরুন দিয়ে কেটে কেটে ছাঁচও বানাতেন সেকালের গৃহলক্ষ্মীরা। শিল্পজ্ঞান ও কারিগরি বৃদ্ধির সংমিশ্রণে পল্লিবালারা যে শিল্পসৃষ্টি করেছেন তা আজকের যুগে গ্রাফিক আর্টের শিল্পবৃদ্ধির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। গৃহশিল্প সামগ্রী পর্যায়ে আমরা আলপনা, কাঁথা এবং অন্যান্য শিল্পকর্মে যে সব নকশা সচরাচর দেখে থাকি, তার সব ধরনই কিন্তু এইসব ছাঁচে দেখা যায়। বস্তুর মাধ্যম হয়তো পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু তার রূপবৈচিত্র্যে তফাৎ ঘটেনি। আসলে বাঙালি রমণীর হাতে খোদাই করা ছাঁচ বাংলার আলপনা ও কাঁথার নকশা থেকে অভিন্ন এবং অভিন্ন এই বঙ্গসংস্কৃতি থেকেও।’
এমনভাবেই অন্দরমহলে থেকেই বাংলার মিষ্টির গায়ে নিজেদের রূপটান-চর্চায় উদ্ভাসিত সৌন্দর্য-চেতনার আত্মচরিত লিখে গিয়েছিলেন বাংলার মেয়েরা। যে-কথা ইতিহাস সেভাবে বলে গেল না।