ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ঢাকা ডায়েরি: পর্ব ১১


    খান রুহুল রুবেল (January 14, 2022)
     

    পিঠাপুলির দিনগুলি

    ‘আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স,
    মাঠে-মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ— ভাঁড়ারের রস;

    মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়
    সকালবেলার রৌদ্রে; কুঁড়েমির আজিকে সময়।’

                                                      — জীবনানন্দ দাশ

    ফানুসের উৎসবে আলো আর আগুন হয়ে ছিল বৎসরের প্রারম্ভ, রাত্রির আকাশ। ফানুসের আগুনে হতাহতের ঘটনাও নেহাত ফেলনা নয় এবার। এ এক নতুন উৎপত্তি বা উৎপাত শুরু হয়েছে। যে-কোনও উৎসবের আনন্দই কিছুটা বেয়াড়া স্বভাবের, বেপরোয়া ছন্দের, তবু কিছুটা সংযম অন্তত চাই যাতে যমে না টানে। আনাড়ি হাতে বাজি পোড়ানো, ফানুস ওড়ানো, রাতভর তারাদের ভাতঘুম এলোমেলো করে তারস্বরে চিৎকার— এর প্রতিকার না হলে প্রকৃতির প্রতিশোধ আসবেই। পরের দিন ছুটি। ‘কুঁড়েমির আজিকে সময়’। জানুয়ারি শুরু হওয়া মানে, পুরোপুরি জেনে যাওয়া যে, বাঙাল মুলুকে এখন সম্পূর্ণ শীতকাল। এখন সকালের আলো বহুক্ষণ বেড়ালের মতো অবলুপ্ত ও নিদ্রাতুর। বেলা দশটার দিকে সোনালি বোয়ালের পেটের মতো প্রথম রোদ কুয়াশার নদীর ভেতর ঘাই মেরে ওঠে। এরপর দ্রুত গতিতে, যেন সে স্কুলে দেরি করা বালক-বালিকা, এমনভাবে বেলায় মিশে যায়। কুঁড়েমির সাথে কোথাও কি কুঁড়েঘরের সম্পর্ক আছে? জানি না। কিন্তু এই শীত, বাইরে উজালা দিন, কলঘর থেকে টপটপ জলপতনের শব্দ, আমাকে ক্রমশ শস্য আর সর্ষের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। ইশকুল শুরু হওয়া বয়সে প্রতি ডিসেম্বর মানে স্কুল ছুটি। তখন বছরগুলি ছিল এক শতাব্দীর সমান দীর্ঘ। কিছুতেই শেষ হত না। অবশেষে যখন ডিসেম্বর মাস সমাগত, আমাদের স্কুলের পাশে মধুমতী ও কুমারের জল যখন দীর্ঘকায় মানুষদের জন্য হেঁটে পার হবার নিশ্চয়তা, বার্ষিক পরীক্ষার পুলসিরাত পার হয়ে বেহেশ্‌তের দুয়ার তখন আমাদের জন্য উন্মোচিত। বেহেশ্‌ত মানে তখনকার লক্কড়-ঝক্কড় রাস্তায় তিন ঘণ্টার পথ। দাদাবাড়ি আর নানাবাড়ি । দুই বাড়িতে দুই সপ্তাহ করে থাকা হত। গঞ্জের বাজার থেকে ভ্যানগাড়ি না পেয়ে আমরা মাটির রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করতাম। সেই রাস্তা ছায়াপথের সমান দীর্ঘ, মনে হত মামাদের বাড়ি বুঝি পৃথিবীর শেষ সীমানায়। হাঁটতে-হাঁটতে যখন মটরশুঁটির ক্ষেত আদিগন্ত হয়ে গেছে আর মধ্যে মধ্যে ভূতুড়ে তালগাছ ও হাসিখুশি খেজুর গাছের সংখ্যাহীন পদাতিকের মতো সারি-সারি দাঁড়িয়ে আছে, বোঝা যেত, আর কিছু পরেই পিঠেপুলির দিন।

    মামাবাড়ি পৌঁছতে-পৌঁছতে সেই দুপুর। বিকেল থেকেই নানী ঢেঁকিঘর (রান্নাঘর সংলগ্ন আলাদা ঘর, যেখানে চাল বা শস্য গুঁড়ো করার জন্য ঢেঁকি রাখা হত) পরিস্কার করে ফেলতেন। বড় গৃহস্থ বাড়িতে রান্না-বাড়ার মাপ-পরিমাপ নেই। রান্না হচ্ছে, একদল খেয়ে চলে যাচ্ছে, ফের রান্না চড়ছে, আরেক দল খেয়ে যাচ্ছে। এই দলের মধ্যে অনেকেই বাড়ির লোক নয়। আমি এমনকী প্রায় অচেনা পথচারীকেও পাত পেতে খেতে দেখেছি। সন্ধ্যা থেকে শুরু হবে চাল গুঁড়ো করার পালা। সেদ্ধ, সাদা-সাদা, ছোট-ছোট আকারের চাল। অনায়াসে চিবিয়ে খাওয়া চলে। ঢেঁকিতে কী বিস্ময়কর ক্ষমতায় আমাদের মা-খালারা পাড় দিতেন। ধুপ-ধুপ শব্দে মাথার ভেতরে নিয়ে আমরা ভাইবোনরা লম্বা টানা বিছানায় ঘুমিয়ে পড়তাম। সকাল হতে-হতে চার-পাঁচরকম পিঠা তৈরি। দুই রকমের ধূপি (ভাপা), পাটিসাপটা, পুলি, দুধপুলি, দুধচিতই এইসব। পিঠা ছাড়াও থাকত সারারাত জ্বাল দেয়া খেজুর রস। গাঢ়, মোহনীয়, স্বাদে তীব্র। এর ঘ্রাণ এতটাই যে, মায়েদের শাড়ি আর নারকেল তেলের ঘ্রাণ ম্লান হয়ে পড়ে থাকত উঠোনের বাতাসে-বাতাসে।

    পিঠাকে চিরকাল গ্রামীণ উপকরণ ও দেশগাঁয়ের জিনিস বলেই ভেবে আসা হয়েছে। শহরে কোথা সে গুড়? কোথা সে নারকেল? কোথা সে চালের গুঁড়ো? কোথা সে খেজুর রস? নবনীপূর্ণ সঘন দুধের হাঁড়ি? কিন্তু গত পনেরো বছরে গ্রামগুলো থেকেও এসব উপাদান উধাও হতে শুরু করেছে। কোনও গ্রামই আর এখন কিলোগ্রাম নয়, বড়জোর আধাগ্রাম। 

    ২.
    ঢাকায় পাটিসাপটা কৌলীন্য হারিয়েছে। সারা বছর বিভিন্ন বেকারি শপে, আধুনিক মিষ্টির দোকানে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে মিটিং-এ জলখাবার হিসেবেও এর জনপ্রিয়তা প্রচুর। তবুও পাটিসাপটা আর দুধচিতই খাবার লোভে হাজির হলাম পিঠা উৎসবে। শুধু পিঠা খাবার আলাদা দোকানও আছে অবশ্য বেইলী রোডে। কিন্তু শীতের কাল, পিঠা বানানোর এই নগরযজ্ঞ চেখে দেখার বাসনাও কম নয়। কয়েক বছর ধরে নিয়মিতই এমন পিঠামেলা হয়। পিঠাকে চিরকাল গ্রামীণ উপকরণ ও দেশগাঁয়ের জিনিস বলেই ভেবে আসা হয়েছে। শহরে কোথা সে গুড়? কোথা সে নারকেল? কোথা সে চালের গুঁড়ো? কোথা সে খেজুর রস? নবনীপূর্ণ সঘন দুধের হাঁড়ি? কিন্তু গত পনেরো বছরে গ্রামগুলো থেকেও এসব উপাদান উধাও হতে শুরু করেছে। কোনও গ্রামই আর এখন কিলোগ্রাম নয়, বড়জোর আধাগ্রাম। যে-সকল লোকেরা এসব পেশায় যুক্ত ছিলেন, যেমন নারকেল গাছি, খেজুর গাছি (গাছি: যিনি খেজুর গাছ হতে রস সংগ্রহ করার জন্য গাছ কাটেন, পেশাদার রস সংগ্রাহক ও গুড় প্রস্তুতকারক) বলে এখন কিছু নেই। সেসব ধানের চাষও এখন কমে এসেছে। যারা এসব করতেন, তাঁরা অধিকাংশই পরলোকে। উত্তরাধিকারী যারা, তারা হয় শহরে কলকারখানায় কাজ করে, নয়তো রিকশা-ভ্যান চালায়, অটোরিকশা চালায়, কেউ-কেউ আবার মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে কাজও করে। বাপ-দাদার পেশা তারা ত্যাগ করেছে। আগে নাগরিক মানুষের জন্য লম্বা একটা ছুটি শীতকালে বরাদ্দ থাকত। অন্তত ছাত্রছাত্রীদের জন্য তো বটেই। এখন চাকরিতে বড় আঁটোসাঁটো সময়সূচি। আলাদা করে অনেকটা সময় নিয়ে গ্রামদেশে যাবার সুযোগ নেই চাকুরেদের। আর ছাত্রছাত্রীদের প্রতিযোগিতার ঠেলায় এখন আর ছুটি বলে কিছু নেই। কিছু না কিছু তাদের লেগেই আছে।  যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল বদলও একটা কারণ মনে হয়। আগে বড় শহরের সাথে গ্রামের যোগাযোগ ছিল দুর্গম। ফলে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে দলবেঁধে গ্রামে যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। এখন সারা বছরই হয়তো যাওয়া আসা করা যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় ও তথ্য সংগ্রহ সহজ হওয়ায় এখন লোকে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বেড়াতে যাচ্ছে বেশি। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের প্রসারে প্রতিদিনই দূরের আত্মীয়র সাথে কথা বলা, এমনকী ভার্চুয়ালি দেখা করাও সম্ভব। কারণ যাই হোক, শীতের ছুটিতে গ্রামে যাবার প্রবণতা কমে গেছে বহুলাংশে। ফলে পিঠা খেতে হলে আপনাকে নাগরিক উপায়েই তা প্রস্তুত করতে হবে। পিঠার কাছে যাওয়া আর নেই, বরং পিঠাকেই নিয়ে আসতে হবে শহরে। 

    পিঠা উৎসবে গিয়ে দেখা গেল, পিঠার নকশায় রকমারি বাহার। তার চাইতে বাহার পরিবেশনে। খেতে যাঁরা এসেছেন তাঁরাও পৌষ-মাঘের অনুকূল পোশাক পরেই হাজির হয়েছেন। এই নাগরিক উৎসবের পিঠায় একটা বড় পার্থক্য যেটা সহজেই চোখে পড়ে, সেটা পিঠার আকার। পেল্লায় সাইজের মালপোয়া, ক্ষীরপুলি, পাটিসাপটা, ভাপা পিঠা দেখে রসনা কিছুটা নড়বড়ে হওয়া বিচিত্র নয়। গ্রামে পিঠা হত সংখ্যায় অজস্র, কিন্তু আকারে ছোট। খুব বড় আকারে বা আকৃতিতে স্বাদ ও ঘ্রাণ অত্যুত্তম বজায় রাখা মুশকিল। গ্রামে যেহেতু সংরক্ষণের উপায় ছিল না, ফলে প্রচুর পিঠা একবারে বানিয়ে দু’তিনদিনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ইচ্ছেমতো খেয়ে শেষ করাই ছিল দস্তুর। এখানে পিঠা বড় হবার কি কোনও বাণিজ্যিক কারণ রয়েছে? স্বাদে না হোক, আকারের কারণে যাতে লোকে অভিযোগ সীমিত করে আনে? সে যা হোক, প্রতিটি জানুয়ারি থেকে প্রতিটি জানুয়ারি পৃথিবী বদলে যায়। ফলে আগের সকল ভাল, এখনের সকল পরিত্যাজ্য, এ-ভাবনা খুবই অযৌক্তিক। পিঠা খেয়ে আরেকটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল, প্রত্যেকটা পিঠার স্বাদ একইরকম। এই অভিজ্ঞতাটা কিছুটা অদ্ভুত। একই হাঁড়িতে রাখা সবগুলোর পিঠার স্বাদ কখনওই এক লাগত না। এখানে বোধ করি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করায় স্বাদে সমতা বিধান হয়েছে। পিঠায় গুড় বা ক্ষীরের গন্ধের চেয়ে গরম মশলার গন্ধ অধিক, যেটা আলাদা করে নাকে লাগে। নাগরিক জিভের কথা ভেবে মিষ্টি কম দেওয়া হয়েছে। আর যে-কোনও পিঠার বাইরের পরত বেশ নরম। দুধচিতই খেতে গিয়ে বোঝা গেল এখানে চিতই আর দুধের মিল দেওয়া হয়েছে, সম্মিলন হয়নি। সেটা অবশ্য সম্ভবও নয় যদি না দুধ-গুড়-রসের যে তরল ক্ষীর তৈরি হয়েছে সেটা যথেষ্ট গাঢ় না হয়, এবং পিঠা অনেকক্ষণ ধরে যদি রসে জারিত না করা হয়। সবচাইতে বেদনাদায়ক ব্যাপার ঘটেছে নারকেলপুলিতে। সেখানে সকল আছে, নারকেলটাই বিলুপ্ত হয়েছে। সে যাই হোক, স্বাদ তো অভ্যাসের ব্যাপার। এ-স্বাদই হয়তো সাধ্য-সাধনায় সদ্ভাবে পরিণত হবে। আর পিঠা উৎসবে পিঠাই তো সব নয়, উৎসবের উৎস আরও অনেক কিছুই । সেসব পাওনা ভুললে চলবে কেন? 

    পিঠা উৎসব থেকে ফিরতে-ফিরতে দেখি একপাশে ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে! তা হবে, কিছুদিন পরেই তো পুরানো ঢাকায় সাক্রাইন উৎসব! শীতের ইতিহাস তো ঘুড়ি থেকে ঘুড়িতে শীত ও রোদ বিলি করবার ইতিহাস। আর একটা ছুটির দিন পাব তো তখন? শহরে প্রথম ঘুড়ি যেদিন উড়বে, তখন থেকেই তো আমাদের শীতের ইতিহাস শুরু।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook