নামতা মুখস্তের যে ছেলেমানুষি প্রতিযোগিতায় প্রাইমারি স্কুলে প্রায় সকলেই নেমেছি, যেখানে, সতেরো-আঠেরো কিংবা উনিশের ঘরে গিয়ে নিশ্চিত আটকে যেত কথা, যেখানে আমাদের মগজের কাঠবাদামে সজোরে চাপ দিলেও মাঝে মাঝে খুলত না খোল— সেই সময়ে, নয়ের দশকের শেষ দিকে বা এই শতকের একেবারে শুরুতে আমরা হাতে পেতাম একটা বই, ‘ফিগারিং দ্য জয় অফ নাম্বারস’। সেই বইয়ের পাতা উলটে কেউ কেউ জানতে পেরেছিলেম, কীভাবে দ্রুত সংখ্যার যোগ-বিয়োগ সেরে ফেলা যায়, কীভাবে দ্রুত বের করা যায় বর্গমূল— আরও কত কী! পরদিন স্কুল গিয়ে পাশের বেঞ্চে বসা বন্ধুকে চমকে দিতে এগুলো সারা সন্ধে রপ্তও করেছি কত! শকুন্তলা দেবীকে প্রথম চেনা ওই বই থেকেই, দুনিয়ার কাছে যার আরেকটা নাম আছে—‘হিউম্যান কম্পিউটার’।
তারপর জানলাম আরেক অবাক করা তথ্য, ১৯৮০ সালে নাকি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল এই শকুন্তলা দেবীকে, ততদিনে সংখ্যাতত্ত্বের দুনিয়ার খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি, দেশের জনতার কাছে বিস্ময়-প্রতিভা, তা সেই প্রতিভাকেই চ্যালেঞ্জ জানাল ব্রিটিশ কলেজ। কী ছিল সেই প্রশ্ন? তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল— ৭৬৮৬৩৬৯৭৭৪৮৭০ এবং ২৪৬৫০৯৯৭৪৫৭৭৯-এর গুণফল কত? চিন্তা নেই, ক্যালকুলেটর বের করে লাভ নেই। টু দ্য পাওয়ার না দিয়ে সংখ্যাটা স্ক্রিনে আঁটবে না। কিন্তু এঁটেছিল শকুন্তলা দেবীর মগজে। আর এই গুণ করতে চোখ বন্ধ করে শকুন্তলা কত সময় নিয়েছিল জানেন? ২৮ সেকেন্ড!
তাঁর নামের পাশে আন্তর্জাতিক সিলমোহর পড়ে গেল ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ শব্দটির।
আরও পড়ুন : ড্রাকুলার অন্দরে রয়েছে আসলে ব্রাম স্টোকারের নিষিদ্ধ ও গোপন সম্পর্কের হদিশ! লিখছেন দীপ ঘোষ…
নয়ের দশকে স্কুল-কলেজে এই বড় সংখ্যার মুখে মুখে যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ করার যে একটা বিরাট চল এসেছিল, মগজে শান দেওয়ার এই রেওয়াজের নেপথ্যে একজন মহিলা-ই, শকুন্তলা দেবী। আজকের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে সত্যিকারের ইন্টেলিজেন্ট মানুষ।
খুব সম্প্রতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রবাসী বাঙালি অধ্যাপকের বক্তব্য শুনছিলাম, তিনি বলছেন, গত কয়েক বছরে আমেরিকার দশ থেকে কুড়ি বছর বয়সি ছেলেমেয়েরা অদ্ভুতভাবে ক্যালকুলেটর-ডিপেন্ডেন্ট হয়ে পড়েছেন, সামান্য দুই-তিন অঙ্কের যোগ করাও ক্যালকুলেটার ছাড়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে তাঁদের কাছে। তিনি আরও বলছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এসে যাওয়ার পর মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই হবে, আরও বেশি করে যন্ত্র-নির্ভরতা, এতে ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট সামগ্রিকভাবে কমতে পারে, বা কমছেও।
যন্ত্র ও যন্ত্রীর এই যে সম্পর্ক, যন্ত্রের ব্যবহারের সীমারেখা টানা নিয়ে যে আবহমান বিতর্ক— সেখানে শকুন্তলা দেবীর এসে পড়া একটা অধ্যায়। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ভারতে যে কন্নড় পরিবারে শকুন্তলার জন্ম, তার সঙ্গে গণিতশাস্ত্রের দূরদূরান্ত অবধি কোনও সম্পর্ক ছিল না। বাবা ছিলেন সার্কাসের কর্মী। মেয়ের ওই ৫-৬ বছর বয়স থেকে মুখে মুখে সংখ্যা গণনা করার আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে তিনি কাজ ছেড়ে দেন, ঠিক করেন মেয়েকে নিয়ে যাবেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজে। মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয় শকুন্তলাকে দেখে চমকে গেল, সে-সময়ে ওর বয়স মাত্র নয়। ১৯৪৪ সালে ডাক এল লন্ডন থেকে, লন্ডনের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পরখ করতে চায় তার ক্ষমতা, তিনি গেলেন-দেখলেন-জয় করলেন। শুধু লন্ডন না, ১৬ বছর বয়সে তাঁর ঐশ্বরিক প্রতিভা দেখে চমকে গিয়েছিল ইউরোপের তাবড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি।
সাতের দশকে, যে সময়ে দেশে অস্থির পরিস্থিতি, ইন্দিরার সরকারের প্তন, জরুরি অবস্থা, অন্যদিকে খাদ্য আন্দোলন— এই সবকিছুর ভেতরে থেকেই শকুন্তলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর নিবিড় সাধনা, আর তাই ১৯৭৭ সালে সাদার্ন মেথডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ঘটিয়ে ফেললেন এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তিনি একটি ৩৪ ঘরের সংখ্যার তেইশতম মূল বের করলেন ৫০ সেকেন্ডে, যে ক্যালকুলেশনটি করতে কম্পিউটারের সময় লেগেছিল ৫৯ সেকেন্ড। এর পর আটের দশকে তো তাঁর নামই উঠেছিল গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে।
শকুন্তলা দেবীর বর্ণময় জীবনের প্রভাব উপমহাদেশে বিরাট। উদার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর, নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই যখন ক্রমশ আধুনিক গণনাযন্ত্রগুলি আসতে লাগল বাজারে, ততই মানুষ বুঝতে শুরু করল মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা, যন্ত্রের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে একটা উদাহরণ হয়ে থাকলেন শকুন্তলা, খবরে প্রকাশিত হল তাঁর ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট ১৬০, ভারতের গড় আইকিউ-র প্রায় দ্বিগুণ।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শকুন্তলার জীবন কেন আলোচিত হওয়া আশু প্রয়োজন?
১৯৭৭ সালে সাদার্ন মেথডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ঘটিয়ে ফেললেন এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তিনি একটি ৩৪ ঘরের সংখ্যার তেইশতম মূল বের করলেন ৫০ সেকেন্ডে, যে ক্যালকুলেশনটি করতে কম্পিউটারের সময় লেগেছিল ৫৯ সেকেন্ড। এর পর আটের দশকে তো তাঁর নামই উঠেছিল গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে।
কারণ, মনস্তাত্ত্বিকদের রিসার্চ বলছে, মানব-মস্তিষ্কের মোট নিউরন সংখ্যার ৬৫ শতাংশ আমরা ব্যবহার করি, এবং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই শতাংশ কমতে থাকে, কারণ নিউরনের ক্ষয় হয়। এই নিউরনের ক্ষয় ঠেকাতে দরকার মেন্টাল এক্সারসাইজ। গত কয়েক বছরে প্রবলভাবে প্রযুক্তির উন্নতি মানুষের ব্রেন ফাংশনিং কমিয়ে দিয়েছে ব্যপক হারে এবং তার ফলস্বরূপ বাড়ছে ডিমেনশিয়ার মতো অসুখ। এদিকে আরও একটি তরজা এখানে উঠে আসতে পারে, আমেরিকার মতো দেশে যে-বিতর্ক হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল, প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে যেভাবে মেশিনকে প্রোমোট করা হয়, তা কতটা অস্বাস্থ্যকর, কারণ শিশুকাল থেকেই যন্ত্রনির্ভরতা মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশের অন্তরায়; অন্যদিকে যুক্তি ছিল, যন্ত্রের কাজই মানুষের কাজের ভার লাঘব করা— চাকা আবিস্কার থেকে আজ অবধি যা ধ্রুব সত্য, তাহলে কেন ব্যবহার হবে না যন্ত্র?
শকুন্তলা দেবীর জীবন এখানে একটি উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে, যেখানে তাঁর কেরিয়ারের রূপকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতেই পারি যে, যন্ত্রের ব্যবহার ততক্ষণই ভাল, যতক্ষণ মানুষ যন্ত্রকে চালনা করছে, এর বিপরীতটি ঘটলেই গোলমাল, শকুন্তলার মতো ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট নিয়ে হয়তো নিরানব্বই ভাগ মানুষই জন্মান না, কিন্তু ব্রেন ফাংশনিং-এর মেথডের মাধ্যমে যে মস্তিষ্কের ক্রমাগত উন্নতি সম্ভব, তা একটা বড় সময় জুড়ে মানুষ বিশ্বাস করেছে শকুন্তলাকে দেখে।
তাই এই আধুনিকতম যন্ত্রসভ্যতার একেবারে ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে শকুন্তলা দেবী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এক চরিত্র, তাই তাঁর ১২তম মৃত্যু দিবসে পৌঁছে, এই যন্ত্র বনাম যন্ত্রীর চিরকালীন বিতর্ককে খানিক উসকে দেওয়ার পরিসর মেলে এখনও।