ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • অনা-মুখো

    অম্লান চক্রবর্তী (April 17, 2025)
     

    বিয়েবাড়িতে কবজি ডুবিয়ে ভাল-মন্দ খাওয়ার আনন্দ অনাদিবাবু প্রায় ভুলতে বসেছিলেন। কে যে ছড়িয়ে ছিল গুজবটা! সামনে একবার পেলে বাপের নাম খগেন করে ছেড়ে দিতেন। কী করে যেন বাজারে রটে গিয়েছিল যে অনাদি মুখোপাধ্যায় যেখানে নিমন্ত্রিত, সেই বিয়ে ভাঙতে বাধ্য। আজ নয় কাল। লেখাপড়া করা লোকই কুসংস্কারের ডিপো হয়, এ অনাদিবাবু দেখে এসেছেন। তাঁর নিজের অনেক দোষ থাকতে পারে, তবে থালা বাজিয়ে করোনা থামানোর মতো হাস্যকর কিছু তিনি করেননি। কিন্তু তাঁর পড়শিরা করেছে। এখনও চোখে ভাসে, কানে বাজে। হাউজিং-এর বেশির ভাগ পরিবার ব্যালকনিতে ভিড় করে হাতা-চামচে দিয়ে থালা বাজাচ্ছে আর দাঁত বার করে হাসছে। কেউ সেলফি নিচ্ছে, কেউ ভিডিও করছে, কেউ ভিডিও কল করে কাউকে দেখাচ্ছে। আর সেই সমবেত আওয়াজে ছিটকে গিয়ে এলাকার যাবতীয় কুকুর ল্যাজ গুটিয়ে দূর থেকে ঘেউ-ঘেউ করছে। সেও এক দৃশ্য।

    এই লোকগুলোই যে অনাদিবাবুকে ‘অপয়া’ অপবাদ দিয়ে বিয়ের অতিথি-তালিকা থেকে পাকাপাকি নির্বাসিত করবেন, তাতে আশ্চর্য কী! পুরনো বন্ধু অলোক তবু সৎ সাহস দেখিয়েছিল। ওর মেয়ের বিয়ের আগে এসে বলেছিল, ‘দ্যাখ অনাদি, মিতুলকে তো তুই জানিস। বিয়ে করবে না পণ ধরে ছিল। অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। কোনও রিস্ক নিতে পারব না ভাই। তোকে ওর বিয়েতে নেমন্তন্ন করতে পাচ্ছি না। তোর বউদি বলেছে বিয়ের পরে যে-কোনওদিন তুই এসে তোর ইচ্ছেমতো খেয়ে যাস। মাঝখান থেকে তোকে গিফ্‌টও দিতে হবে না।’ অনাদিবাবু অবশ্য নবদম্পতির জন্য রিস্টওয়াচ সেট পাঠিয়েছিলেন, অলোক আপত্তি করেনি। 

    অনাদিবাবুর অবাক লেগেছিল। এরা কি অন্ধ? কাজের লোক, চাইনিজ জিনিস আর বিয়ে— এগুলো যে আজকাল টেঁকে না, এরা কি জানে না? বিয়ে ভাঙতে একসঙ্গে বছর কয়েক সংসার করাই যথেষ্ট, তার জন্য আলাদা করে শনির দৃষ্টির প্রয়োজন নেই— এটুকু কি মাথায় ঢোকে না? এই যে ডিভোর্স ল-ইয়ারদের এত রমরমা— সবই কি অনাদিবাবুর জন্য? লোকে তো বলছে বিয়ে ব্যাপারটাই নাকি উঠে যাবে, অন্তত বড় শহরগুলোতে। কলকাতার বুকেই অনেক ছেলেমেয়ে আছে, যারা লিভ-ইন করছে কিন্তু বিয়ে করছে না। তাহলে?

    পড়ুন ঋভু চট্টোপাধ্যায়ের গল্প: হাওয়া-বাতাস অথবা কিছুই না

    তাছাড়া এমন তো নয় যে অনাদিবাবু যেসব বিয়েতে গেছেন, তার একটাও টেঁকেনি। অন্তত হাফডজন বিয়ে তার উপস্থিতি সত্ত্বেও এখনও অক্ষত-অটুট আছে। কিন্তু সে-কথা শুনছে কে? ফেক নিউজের যুগ। একটা অপপ্রচার মানুষের মনে গেঁথে গেলে সময়ের সাথে সেটা আরও দৃঢ় হয়ে বসে। মানুষ তা-ই বিশ্বাস করে, যা সে করতে চায়। সেটা সত্যি হতে হবে, এমন কোনও মাথার দিব্যি নেই। তাকে বিয়েতে নেমন্তন্ন করলেই ডিভোর্স সুনিশ্চিত— এই অবাস্তব ধারণাটা যে কোনওদিন উপড়ে ফেলা যাবে, অনাদিবাবু সে-আশা ছেড়েই দিয়েছেন। নীচে লেটারবক্সে কে যেন রং দিয়ে ঢেকে ‘অনাদি মুখোপাধ্যায়’কে ‘অনামুখো’ করে গেছে। অনাদিবাবু আর পালটাননি শেষপর্যন্ত।

    অলোকের অন্তত বুকের পাটা ছিল। পাশের ফ্ল্যাটের তপনবাবু তো বড়ছেলের বিয়ের আগে দরজায় দাঁড়িয়ে রীতিমতো তোতলাচ্ছিলেন, ‘জানেনই তো আজকালকার ছেলেমেয়েদের। গেস্টলিস্ট নিজে বানিয়েছে— বেশির ভাগই নিজের বন্ধুবান্ধব। খুব বেশি লোককে বলা হয়নি। সোসাইটির অনেককেই বলতে পারিনি। আপনাকেও বলা গেল না। কী লজ্জার কথা! কী ভাষায় যে ক্ষমা চাইব…” এত হাত কচলাচ্ছিলেন যে, অনাদিবাবুর ভয় হচ্ছিল ভদ্রলোকের হাতের রেখাগুলো না মুছে যায়।   

    এদিকে বউভাতের দিন দেখা গেল, অন্তত শ-পাঁচেক লোক গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে গেছে। অঞ্চলের কেষ্ট-বিষ্টু থেকে শুরু করে হাউজিং-এর রাম-শ্যাম-যদু, কেউই বাদ যায়নি। বাদ গেছেন শুধু ‘অপয়া’ অনাদি মুখুজ্জে। একবার ভেবেছিলেন অনাহুত হয়ে ভেতরে ঢুকে গুষ্টিসুদ্ধ তপনবাবুর পিলে চমকে দেবেন। কিন্তু একই হাউজিং-এ থাকতে হবে ভেবে শেষপর্যন্ত আর এগোননি। পূর্ণিমা দেবী পরদিন মোবাইল খুলে খাবারের ছবি দেখিয়েছিলেন। ‘জিভেজল কেটারার’ নাকি জব্বর খাইয়েছিল। বিশ্বনাথের কৃপায় বাষট্টি বছরে এসেও অনাদিবাবুর হজমশক্তি প্রবল। বিশ্বনাথ তার স্কুলের বন্ধু, এবং শরীরচর্চার অনুপ্রেরণা। সেই চর্চা অনাদিবাবু এখনও বজায় রেখেছেন। ফলে শরীর এখনও মজবুত। এখনও আধকিলো মটন হজম করতে তার ওষুধের দরকার পড়ে না। সুযোগ পেলে দেখিয়ে দিতেন খাওয়া কাকে বলে! 

    ‘ভারি তো কেটারারের খাবার। আমি চম্পারন মটন করে এনেছি। খেয়ে বলবেন কোন অংশে কম। মাঝের তাকে সামনের দিকে রইল…’ পূর্ণিমা দেবী ফ্রিজে টিফিনবক্সটা গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন। 

    অনাদিবাবু বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা জলপাইগুড়ি জেলা কোর্টে উকিল ছিলেন, মা প্রাইমারি স্কুলে পড়াতেন। অনাদিবাবু ঢাকুরিয়ায় একটি ব্যাঙ্কে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ছিলেন। সংসারও পেতেছিলেন, কিন্তু বিয়ের দু’বছরের মাথায় স্ত্রী মারা যান। আত্মীয়স্বজন বলেছিল, কিন্তু অনাদিবাবু আর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। এদিকে প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে। নিঃসঙ্গ অনাদিবাবু জীবনের সায়াহ্নে এসে সেই ফাঁদে ধরা দিলেন। 

    নীচের তলার পূর্ণিমা সরখেল মেয়েদের একটি নামী স্কুলের দাপুটে হেডমিস্ট্রেস ছিলেন। স্বামী অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলে একমাত্র মেয়ে পুপুকে একা হাতে বড় করেন। পুপু কৃতি ছাত্রী। বস্টনে পড়াশুনা শেষ করে এখন নিউ জার্সিতে স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট সংসার। মা-মেয়ে তো নয়, যেন দুই বন্ধু। অনাদি আঙ্কেলকে পুপুর খারাপ লাগে না। মা যদি আঙ্কেলকে বিয়ে করতে চায়, মেয়ে জানিয়ে দিয়েছে, তার আপত্তি নেই। হাউজিং-এ বুড়ো-বুড়ির সম্পর্ক নিয়ে ফিসফাস যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। তবে পূর্ণিমা দেবী তোয়াক্কা করেন না। সারাজীবন অবাধ্য ছাত্রী এবং তাদের পয়সাওয়ালা বাবা-মায়েদের দাবড়ে এসেছেন। সেই দাপট এখনও তার ব্যক্তিত্বে ঝলমল করে। বেশির ভাগ চুল পেকে গেছে, কিন্তু রং করান না। আসলে কে কী ভাবল পরোয়াই করেন না। লোকে তাকে সমীহ করেই চলে।

    তাছাড়া সময়ও পালটেছে। শহুরে ফ্ল্যাট কালচারে প্রতিবেশীর মধ্যে দূরত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি কমেছে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর অস্বাস্থ্যকর প্রবণতা। অতীতের গোটাটাই সোনালি ছিল, আর বর্তমান শুধুই উচ্ছন্নগামী— এই ধরনের সিনিসিজম অনাদিবাবুর মধ্যে একেবারেই নেই। এই যে পূর্ণিমা দেবী যখন-তখন তার ঘরে আসেন, একসঙ্গে তাঁরা পার্কে হাঁটতে যান— অতীতে সম্ভব ছিল? এই সঙ্গটুকুর জন্যই একাকিত্বের বোঝা এখন তার অনেকটাই হালকা মনে হয়। শুধু হাউজিং-এর বাঙ্কোয়েট হলে ‘অমুক ওয়েডস তমুক’ দেখলেই অনাদিবাবুর দুঃখ হয়। জানেন তিনি ডাক পাবেন না। কিন্তু সেই দুঃখও তার শিগগিরই উবে গেল। শুধু তাই নয়। অ্যাদ্দিন যা অভিশাপ হয়ে ছিল, রাতারাতি তাই শাপে বর হয়ে দেখা দিল।   

    নিরাপত্তার কথা ভেবে অনাদিবাবু অবশ্য ঘুরপথই নিলেন। পূর্ণিমা দেবীর দেওয়া একটা আদ্দির পাঞ্জাবি পরে অটো করে দেড় কিলোমিটার গেলেন। আগেই ড্রাইভারকে ফোন করে দিয়েছিলেন। কালো রঙের সেডানটা একটু বাদেই এসে দাঁড়াল। ক্রিম কালারের সিট। পেছনের দরজার দিকে এগোতেই চোখে পড়ল সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে পেল্লাই একটা ফুলের তোড়া আর একটা চৌকো গিফ্‌টবক্স।

    সূচনা হল। এক রাতে একটি অচেনা নম্বর থেকে একটি অদ্ভুত মেসেজ দিয়ে। মেসেজের মর্মার্থ হল— অনাদিবাবু প্রেরককে চিনবেন না, কিন্তু তিনি কি ‘সামান্য কিছু’ অর্থের বিনিময়ে কলকাতা শহরেই একটি বিয়ের নিমন্ত্রণ স্বীকার করবেন? ‘সামান্য কিছু’র পাশে ব্র্যাকেটে লেখা ‘INR 50K’। বদলোকের রসিকতা ভেবে অনাদিবাবু উত্তর দিলেন না। পরদিন সকালে আবার মেসেজ এল যে, টাকাটা ক্যাশে দেওয়া হবে। আর সম্মতি জানালে বিস্তারিত তথ্য ফোনে জানানো হবে। অনাদিবাবু ভীষণ অস্বস্তিতে পড়লেন। একটু পরে কফি নিয়ে পূর্ণিমা দেবী এলেন। অনাদিবাবু বলব-বলব করেও বলে উঠতে পারলেন না। লাঞ্চের পর অনাদিবাবু সাহস করে মেসেজের উত্তরে লিখলেন ‘OK’। মিনিট দুয়েক বাদে তার ফোন বেজে উঠল। ওপারে মাঝবয়েসি কেউ নিরীহ গলায় বললেন, ‘হ্যালো, মিস্টার মুখার্জি বলছেন?’

    পরের সাত মিনিট অনাদিবাবু প্রায় একতরফা শুনেই গেলেন। মাঝে অবশ্য বারকয়েক ‘আচ্ছা’ বলেছিলেন। মোদ্দা কথাটি দাঁড়াল, অনাদিবাবুর খ্যাতি কলকাতা শহরের অন্যপ্রান্তে কোনও সুপ্রিয়বাবুর কানে পৌঁছে গেছে। সুপ্রিয়বাবুর নিজের মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে, বছর না-ঘুরতেই এবং ভাইয়ের সঙ্গে সদ্ভাব নেই। ভাইঝি নন্দিনীর বিয়ে এ-মাসের তেইশে, বাইপাসের ধারে একটি পাঁচতারা হোটেলে। তাই অনাদিবাবু যদি একবার বিয়েবাড়িতে তাঁর বিশেষ ক্ষমতাটি নিয়ে দাঁড়ান, তাহলে সুপ্রিয়বাবু ও তার গিন্নি ধন্য হন। অনাদিবাবুর জন্য শুরু থেকে শেষপর্যন্ত থাকবে একটি সেডান। ড্রাইভারের কাছে থাকবে বিয়ের গিফ্‌ট এবং অনাদিবাবুর ‘অ্যাপিয়ারেন্স ফি’। যদিও কেউ জানতে চাইবে না, বিয়েবাড়িতে অনাদিবাবুর পরিচয় হবে তিনি সুপ্রিয়বাবুর বিজনেস পার্টনার। কোনও ছদ্মনামের প্রয়োজন নেই। সুপ্রিয়বাবু বা অন্য কারুর সঙ্গে দেখা করবার বা আলাপের বাধ্যবাধকতাও নেই। শুধু সময়মতো পৌঁছে, উপহারটি তুলে দিয়ে, রুচিমতন খেয়েদেয়ে বিদায় নিলেই কর্তব্য শেষ। ড্রাইভার বাইরে অপেক্ষা করবে। অনাদিবাবু চাইলে রাতে গোটা শহর ওই গাড়িতে ঘুরে তারপর বাাড়ি ফিরতে পারেন।

    নিরাপত্তার কথা ভেবে অনাদিবাবু অবশ্য ঘুরপথই নিলেন। পূর্ণিমা দেবীর দেওয়া একটা আদ্দির পাঞ্জাবি পরে অটো করে দেড় কিলোমিটার গেলেন। আগেই ড্রাইভারকে ফোন করে দিয়েছিলেন। কালো রঙের সেডানটা একটু বাদেই এসে দাঁড়াল। ক্রিম কালারের সিট। পেছনের দরজার দিকে এগোতেই চোখে পড়ল সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে পেল্লাই একটা ফুলের তোড়া আর একটা চৌকো গিফ্‌টবক্স। ড্রাইভার পেছনে ফিরে একটা ইনভিটেশন কার্ড বাড়িয়ে দিল। বুড়ো মানুষটার নিরীহ মুখখানা দেখে অনাদিবাবুর অস্বস্তি অনেকটাই কেটে গেল, তবুও গোটা রাস্তা তিনি চুপ করে থাকলেন।

    হোটেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে পাশাপাশি দুটো বাঙ্কোয়েট হল। দুটোরই বাইরে ফুল দিয়ে বর-কনের নাম লেখা ছিল। কার্ডের সঙ্গে মিলিয়ে, একজনকে জিজ্ঞাসা করে অনাদিবাবু যা-আছে-কপালে বলে ঢুকে পড়লেন। হলের একপ্রান্তে স্টেজ করা হয়েছে, তার ওপর সিংহাসনে বসে বর-কনে। প্রোগ্রাম করা রোবটের মতো তারা নিস্পৃহভাবে উপহার নিচ্ছে, আর ক্যামেরাম্যানের নির্দেশমতো অক্লান্তভাবে পোজ দিয়ে যাচ্ছে। দুজনেরই পাশে একটি করে মেয়ে দাঁড়িয়ে একটি চমৎকার কনভেয়ার বেল্টের মতো ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। হাতে-হাতে চালান হয়ে সব গিফ্‌ট জমা হয়ে পেছনে একটি বিচিত্র পিরামিড খাড়া হয়েছে। 

    ওয়েটারের হাতে ড্রিঙ্কসের ট্রে দেখে অনাদিবাবুর তেষ্টা বেড়ে গেল। কিন্তু এক হাতে ফুলের তোড়া আর অন্য হাতে গিফ্‌ট নিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না। একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে অনাদিবাবু গটগট করে স্টেজে উঠে বরের হাতে তোড়া আর কনের হাতে উপহার ধরিয়ে তেমনি দ্রুত নেমে এলেন। ক্যামেরাম্যান পোজ দেবার অনুরোধ করেছিল, তিনি পাত্তাই দিলেন না। কনের বাবা-মা হতে পারে, এরকম এক দম্পতিকে সুপ্রিয়বাবুর বিজনেস পার্টনার বলে নিজের পরিচয় দিতে গেলেন, কিন্তু তাদের বিশেষ আগ্রহ দেখা গেল না। 

    ‘একী! আপনার হাতে ড্রিঙ্কস নেই কেন? হোপ ইউ আর নট অ্যানাদার হোপলেস টিটোটলার!’ বলে ভদ্রমহিলা হাতে একটা গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে খিলখিল করে উঠলেন। অনাদিবাবুও ‘বাঁচা গেল’ ভেবে অন্য দিকে সরে পড়লেন। 

    ড্রিঙ্কসে চুমুক দিতে-দিতে কিছুক্ষণ ভিড়ের মধ্যে সম্ভাব্য সুপ্রিয়বাবুকে আবিষ্কারের বৃথা চেষ্টা করে অনাদিবাবু শেষপর্যন্ত ক্ষান্ত দিলেন। খাবারের কাউন্টারগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা প্রতিহিংসার ভাব জেগে উঠল। গুছিয়ে খেয়ে নিজেকে টেনেহিচঁড়ে যখন গাড়িতে তুললেন, নিজেকে মনে হল সদ্য-হরিণ-গেলা-পাইথন। 

    সন্ধেবেলা যেখানে গাড়িতে উঠেছিলেন, মাঝরাতে সেখানেই নামলেন। নামার আগে ড্রাইভার একটা পেটমোটা বাদামি খাম ধরিয়ে দিয়েছিল। পাঞ্জাবির পকেটে সেটা ঢুকিয়ে গাড়ি ইউ টার্ন নিয়ে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত অনাদিবাবু অপেক্ষা করলেন। এ-রাস্তায় অনেক রাত পর্যন্ত অটো চলে। তারই একটা ধরে অনাদিবাবু যখন হাউজিং-এ ফিরলেন, তার স্মার্টওয়াচে তখন সাড়ে বারোটা।  

    ‘এগজ্যাক্টলি একশোটা নোট…’ গোনা শেষে পাঁচশো টাকার বান্ডিলে রাবার ব্যান্ড পরাতে-পরাতে পূর্ণিমা দেবী বললেন। ‘এত বড় একটা কাণ্ড করে বসলেন, জানালেন না পর্যন্ত।’ 

    ‘আরে! ভয়ের তো কিছু ছিল না…’ অনাদিবাবু আশ্বস্ত করলেন। ‘হামেশাই বাইরের লোক বিয়েবাড়িতে ঢুকে খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আমি তো রীতিমতো উপহার নিয়ে গেছিলাম। ওই ব্যুকেটার দামই কম করে হাজার টাকা হবে। কী ছিল না মেনুতে! মোগলাই, চাইনিজ, লেবানিজ, মেডিটেরেনিয়ান, কন্টিনেন্টাল, ভিয়েতনামিজ… এলাহি কারবার। সঙ্গে ঢালাও ড্রিঙ্কস। তোমাদের তপনবাবুর কিডনি বেচেও এমন পার্টি দেবার মুরোদ নেই।’

    ‘এখনও তপনবাবুকে ক্ষমা করতে পারেননি দেখছি…’ কাগজ সরিয়ে পূর্ণিমা দেবী উঁকি দিলেন। ‘দেখুন, সাধারণ মানুষের মন এমনিতেই দুর্বল। প্রিয়জনের সামান্যতম বিপদ হতে পারে, এমন কোনও ঝুঁকি কেউ চান না। আর এ তো সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের স্নেহ।’

    ‘অর্থাৎ তোমার পুপুর বিয়ে যদি এখানেই হত, আমাকে নেমন্তন্ন করতে না। তাই তো?’

    ‘মাসির গোঁফ থাকলে মাসিকে কী বলে ডাকতাম? এরকম হাইপোথেটিকাল প্রশ্ন শুনলে ভীষণ রাগ হয়। পুপুর বিয়ে নিউ জার্সিতে হয়ে গেছে। অতগুলো টাকা খরচ করে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যেতেন আমেরিকা? বলুন, যেতেন?’

    ‘আমিও গোঁফওয়ালা মাসির ধাঁধাঁর উত্তর দেব না। নেমন্তন্নই করলে না! যেতাম কি না, বলব কেন?’

    পূর্ণিমা দেবীর মুখে একটা লাজুক আভা চলে এল। ‘তাছাড়া তখনও তো তেমনভাবে আপনাকে চিনিনি।’

    ‘আর এখন?’ অনাদিবাবু মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন।

    ‘এখন হাড়ে-হাড়ে চিনি।’

    ‘তাহলে আমার চিনিওয়ালা নির্জলা চায়ের কথাও নিশ্চয়ই জানো। আমার মতো হবে না, তবু আজ চা তুমিই বানাও।’

    অনাদিবাবুর নির্জলা চা মানে সসপ্যানে জল পড়বে না। দু’কাপ চা হলে, পৌনে তিন কাপ দুধ ঢেলে তাতে চার চামচ সি-টি-সি চায়ের গুঁড়ো আর দু’চামচ চিনি পড়বে। তারপর জ্বাল করতে হবে যতক্ষণ না চায়ে টেরাকোটা রং ধরছে। 

    ‘আপনার চা পানীয় নয় মশাই, পুরোপুরি খাদ্য। ওই ক্কাথ-হাফকাপ খেলেই একবেলার মতো পেট ভরে যায়। কী করে যে দিনের পর দিন এ-জিনিস খান!’ পূর্ণিমা দেবী হেসে বলেন।

    ‘বাঙালির হিন্দি শোনোনি? সব কিছুই ‘খাতা হ্যায়’। আমার চায়ের বেলায় অন্তত ব্যাকরণের এই ভুলটি হয় না।’

    এরপর শুরু হল ময়দানের জনতা যাকে বলে ‘খেপ খেলা’। অনাদিবাবুর খ্যাতি কলকাতায় আটকে রইল না। বছর দুয়েকের মধ্যে বাইরে থেকেও ডাক আসতে শুরু করল। অনাদিবাবুও তাঁর ক্রমবর্ধমান চাহিদা দেখে পূর্ণিমা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে শপিং মল থেকে কয়েক সেট শেরওয়ানি-পাজামা এবং কোট-টাই কিনে ফেললেন। হাউজিং-এর বাকিরা কিছু জানতেও পারল না। শুধু দেখল অনাদিবাবুর সাদামাটা টিভি পালটে ঘরে এল পেল্লাই সত্তর ইঞ্চের এলইডি টিভি। বেতের পুরনো সোফার জায়গা নিল একটা এল-আকৃতির ভিয়েনা লাউঞ্জার সেট। এদিকে ভোরের দিকে মাঝে মাঝেই তার জন্য আসতে শুরু করল উবের-ওলার গাড়ি। গন্তব্য: এয়ারপোর্ট। 

    ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে একদিন তপনবাবুর মুখোমুখি হয়ে গেল। ভদ্রলোক বলেই বসলেন, ‘কী মশাই, ব্যবসা-ট্যবসা শুরু করেছেন নাকি? খুব হিল্লিদিল্লি করে বেড়াচ্ছেন মনে হচ্ছে?’ 

    অনাদিবাবু একটু হেসে বললেন, ‘এই একটা কনসালটিং কাজ। কাঁহাতক আর ঘরে বসে থাকা যায় বলুন। মাঝেমধ্যে একটু দিল্লি-বম্বে যেতে হয়।’

    ‘তা দিন না, এমন একটা কনসালটিং কাজ ধরিয়ে। আমিও তো বসেই আছি!’ তপনবাবু একটু আকুতির সুরেই বললেন।

    ‘খোঁজ পেলে নিশ্চয়ই জানাব। চলি, অ্যাঁ? এ-সময়ে আবার এয়ারপোর্টের মুখটায় খুব ভিড় হয়।’

    পূর্ণিমা দেবী মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা করেন, কিন্তু অনাদিবাবু তাঁকে বোঝান। ‘আরে, আমি চুরি-ছিনতাই বা বেআইনি কিছু তো করছি না। আমি শুধু ‘অ্যাপিয়ারেন্স ফি’ নিই। সেলেব্রিটিরা পয়সা নিয়ে দুর্গাপূজা উদ্বোধন করে, শোনোনি? এটা তেমনি একটা নিরীহ, সম্পূর্ণ আইনসম্মত ব্যাপার। কোনও ছলচাতুরি নেই। আমারও প্রফেসশনাল এথিক্‌স আছে— শুরুতেই জানিয়ে দিই যে ডিভোর্স কিন্তু আমার হাতে নেই। আমি গিয়ে শুধু দাঁড়াতে পারি, বাকিটা কপাল। তাতে যদি রাজি থাকো, তাহলে কথা হোক। নয়তো পথ দ্যাখো। সিম্পল।’

    মুখে বললেও বাইরের ভোলের সঙ্গে-সঙ্গে ভেতরেও যে তার একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন হচ্ছে, অনাদিবাবু টের পাচ্ছেন। আগে যেটা তিনি ডাহা কুসংস্কার বলে জানতেন, আজকাল তা বিশ্বাস করতে ভীষণ ইচ্ছা করে। হয়তো সত্যিই তার মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আছে! যারা তাঁর এই ক্ষমতায় বিশ্বাস করে, তারা সবাই কি বোকা? গত মাসেই বিজনেস ক্লাসে সুরাট গেছেন এক হিরে ব্যবসায়ীর হয়ে। কয়েকশো কোটি টাকা ভদ্রলোকের টার্নওভার। বোকা হলে এত টাকা হত? যার ব্যবসাবুদ্ধি এত প্রখর, এবং যে এক পয়সা বাজে খরচ করে না, সেই মানুষটা এত খরচা করে তাকে নিয়ে যাবে কেন, যদি না অনাদিবাবুর সত্যি কোনও স্পেশাল পাওয়ার থাকে? টাকার কুমির, অথচ লোকটা নাকি বিদেশে চায়ের খরচ বাঁচাতে পকেটে টি-ব্যাগ নিয়ে ঘোরে; গিজারের গরম জল গ্লাসে নিয়ে তাতে ডুবিয়ে চা বানিয়ে খায়। সেই লোকটা খামোখা এতগুলো টাকা অনাদিবাবুর পেছনে অপচয় করবে?      

    ‘একটা জিনিস বুঝেছি,’ কফি খেতে খেতে অনাদিবাবু বললেন, ‘জানো, দুনিয়ায় সবারই একটা প্রয়োজনীয়তা আছে, কেউ ফ্যালনা নয়। নইলে আমার মতো অপয়াকেও লোকে গ্যাঁটের টাকা খরচ করে নিয়ে যায়?’

    উলটোদিকের চেয়ারে পূর্ণিমা দেবী অবাক হয়ে বললেন, ‘শুধুমাত্র পারিবারিক শত্রুতার জন্য এত লোক এত খরচা করে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছে বিয়ে ভাঙাতে?’

    ‘আরও আছে। কেউ সাময়িক বিয়ে করছে পদবির জন্য। কেউ বিয়ে করছে শুধুমাত্র অ্যালিমনির জন্য। আরও আছে। মাসদুয়েক আগে দিল্লিতে একটি পাঞ্জাবি মেয়ের ডাকে ওরই বিয়েতে গেছিলাম। আমাকে স্পষ্ট বলল, শিল্পপতি বাবার চাপে বিয়ের পিঁড়িতে বসছে। প্রেমিক দু’বছর অপেক্ষা করবে। তার মধ্যে আমার হাতযশে ভালয়-ভালয় ডিভোর্স না হলে ডোমেস্টিক ভায়লেন্স বা স্বামীর পরকীয়া প্রমাণ করিয়ে প্রেমিকের কাছে ফেরত আসবে। পাঞ্জাবি মেয়েরা এমনিতেই ডানাকাটা পরির মতো। তার ওপর ওর চোখদুটিতে এমন একটা দ্যুতি দেখেছি, যা কোনওদিন ভুলব না। প্রেমের এমন নির্ভীক চেহারা দেখিনি। কতই-বা বয়েস, ২৮-২৯ হবে। খুব শ্রদ্ধা হল, জানো। ফিজটা ফেরত দিতে চাইলাম, মেয়েটা নিল না। বিয়ের সময়ে লেহেঙ্গা-চোলিতে একেবারে অপ্সরা মনে হচ্ছিল। ফুলের পাপড়ি ছেটাতে-ছেটাতে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করলাম বিয়েটা যেন শিগগিরি ভেঙে যায়।’

    সন্ধেবেলা পূর্ণিমা দেবী আরেকবার এলেন। পুপু ফোন করেছে, আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলতে চায়। নানারকম রঙ্গরসিকতা হল। যাবার আগে পূর্ণিমা দেবী মোবাইল খুলে মেয়ের মেসেজ দেখালেন। ‘তোমাদের বিয়ের প্ল্যান থাকলে আমার আপত্তি নেই। এখানে আকছার হচ্ছে। শুধু আগে থেকে জানাবে, যাতে ছুটি নিয়ে আসতে পারি। ‘বাপের বিয়ে দেখিয়ে দেব’ পর্যন্ত শুনেছি। ‘মায়ের বিয়ে দেখিয়ে দেব’ শুনিনি। এমন অকেশন মিস করতে চাই না। চাও তো এখানে ডেসটিনেশন হানিমুনের ব্যবস্থা করতে পারি…’ শেষে একটা চুমু ইমোজি।

    অনাদিবাবু হাত ধরে পূর্ণিমা দেবীকে পাশে বসালেন। ‘তোমার ধারণা ব্যাপারটা আমার মাথায় আসেনি?’

    ‘কী করে জানব? কখনও তো বলেননি…’ পূর্ণিমা দেবী মুখ নামিয়ে বললেন।

    ‘বলিনি, কারণ মনে হয়েছে ঠিক হবে না। লাভের চেয়ে ক্ষতির ভয় বেশি।’

    ‘ঠিক ব্যাঙ্কারের মতোই শোনাল কথাটা। আপনি কি গসিপ ভয় পান? সে তো আমাদের নিয়ে এমনিতেই হয়।’

    ‘গসিপ নয় পূর্ণিমা। সত্যি-সত্যি যদি আমার শনির দৃষ্টি হয়? বিয়েতে আমার উপস্থিতি যদি সত্যি অভিশপ্ত হয়? আর নিজে উপস্থিত না থেকে কী করে বিয়ে করা যায়, সেটাও আমার জানা নেই।’ 

    ‘তাহলে বাঘের ঘরেই ঘোগের বাসা?’ পূর্ণিমা দেবী হেসে ফেললেন। ‘আপনার মনেও কুসংস্কার?’

    ‘তুমিই তো বলেছিলে— সাধারণ মানুষের মন দুর্বল, প্রিয়জনের সামান্যতম ক্ষতিও সে কল্পনা করতে পারে না।’

    ‘তাহলে?’ পূর্ণিমা দেবী বললেন।

    ‘তাহলে আবার কী! সেই তেনাদের মতো… চিরদিন ধরে আমাদের সপ্তপদী-গমন হবে। পূর্ণিমা, দু-জনের জন্য দু-জনে তো রইলাম। আর আমাদের মাঝে যা আছে, তা তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমি ছাপোষা মানুষ, এর চেয়ে বেশি লোভ করতে ভয় করে।’ 

    ‘লোভ আমারও নেই। আপনি যে ভেবেছিলেন, এবং সেটা যে মুখ ফুটে বললেন, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। একটু পুডিং বানিয়েছিলাম, আনতে ভুলে গেছি। যাই, নিয়ে আসি। ডিনারের পর খাবেন।’

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook