ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • ক্রিকেট, দেশ ও দ্বেষ

    রোদ্দুর মিত্র (March 18, 2025)
     

    বিকেল সাড়ে চারটের রাজধানী এক্সপ্রেস। দোলের ছুটিতে ঘরে ফেরার ভিড়। গুগল বলছিল, নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং অর্ডার ততক্ষণে টলোমলো। তবু নিউজিল্যান্ড ২৫১ রানের একটি ভদ্রস্থ টার্গেট সেট করবে। রোহিত শর্মা সুপার হিউম্যান-সম ইনিংস খেলবেন। গ্লেন ফিলিপ্স আরও একটি অত্যাশ্চর্য ক্যাচ ধরবেন। ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতবে।

    এটুকু সকলেই জেনেছেন। এই সমস্তটার ভেতরে, বাফার করতে থাকা ডিজনি প্লাস হটস্টারের বাইরে, অসম্ভব টেনশনে যখন কাইল জেমিসন, শ্রেয়স আইয়ারের ক্যাচটি ফেললেন, তখন একজন বছর ষোলো বলে উঠল, ‘নিউজিল্যান্ডের চেয়ে পাকিস্তানের মানুষবেশি চোখের জল ফেলবে!’

    কাট টু কলকাতা। ইন্ডিয়া জিতেছে। পরপর দু-খানা আইসিসি ট্রফি। রাস্তায় বেরিয়েছে বাইক-মিছিল। জয়ের দানবিক উল্লাস। হিপ হিপ হুররে। মোচ্ছব। জয় শ্রীরাম। ভারতমাতা কী জয়! যে মিছিলে ভারতের তেরঙা পতাকার সঙ্গে অ্যাংরি-হনুমানের গেরুয়া পতাকাও সামিল।

    আরও পড়ুন : কুম্ভমেলাতেই প্রথম হয়েছিল রামমন্দিরের ঘোষণা?
    লিখছেন জয়দীপ মিত্র…

    কাট টু দুবাই। প্রেজেন্টেশন সেরিমনির মঞ্চে আইসিসি’র প্রেসিডেন্ট জয় শাহ একা হাতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি তুলে দিলেন রোহিত শর্মার হাতে। আয়োজক দেশ পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডের কোনও সদস্য সেই মঞ্চে নেই। এ-ঘটনা বিরলতম!

    কাট টু সোশ্যাল মিডিয়া। এক জনৈক সদর্পে লিখলেন: ইন্ডিয়া জিতেছে। যারা এই ঐতিহাসিক জয়ের সমালোচনা করবেন, সকলেই দেশদ্রোহী।

    চারটি পৃথক ঘটনা, আসলে কমন একটি চিন্তার সুতোয় বাঁধা। আবিশ্বে, ক্রিকেটের মাটিতে ভারত শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব বিরোধহীন। কেন? রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি নির্দ্বিধায় অসামান্য খেলোয়াড়। ক্রিকেট-পণ্ডিতরা বলেছেন, ভারতের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের নেপথ্যে ছিল অক্ষর প্যাটেল, হার্দিক পাণ্ডিয়া-র মতো বিশ্বমানের অল-রাউন্ডার। সঙ্গে বরুণ চক্রবর্তীর ম্যাজিক। কিন্তু যে কথা জিজ্ঞাস্য, শ্রেষ্ঠত্বের প্যারামিটার বলতে এ-যুগের ভারতবাসী কী বোঝেন? বোঝেন কেবলমাত্র আমাদের দুই পড়শি— বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান। অর্থাৎ, এই দুই দেশের নিরিখে, ভারতের ক্রিকেট কতখানি উন্নত— তা-ই আমাদের উপজীব্য। আরও গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, হালফিলের অধিকাংশ ক্রিকেট-ভক্ত অদ্ভুত এক ক্রিকেটীয় ভাষ্য তৈরি করে বুঝতে চায়, পাকিস্তানকে হারানোই যেন প্রকৃত বিশ্বজয়। যে ভাষ্যের মধ্যে ক্রিকেটীয় বোধ সম্পূর্ণ শূন্য। আছে কেবল অ্যাংরি-হনুমানের পতাকা। বন্য উদ্দামতা। জয় শাহ এবং কেন্দ্রীয় শাসক দল-সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদের এক গ্লোরিফায়েড ইমেজ।

    ভারতের জয়ে ক্রিকেটভক্তদের উল্লাস

    দক্ষিণপন্থা এমন করেই থাবা ফেলেছে। ক্রিকেট যেহেতু আমার দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, তাই সিনেমার মতোই ক্রিকেট জনসমর্থনের অন্যতম হাতিয়ার। আকাশ চোপড়ার ধারাভাষ্যে ‘আত্মনির্ভর’ শব্দটি বারংবার উঠে এসেছিল সুচতুরভাবেই। অথচ আত্মসমালোচনা বিনা আত্মনির্ভর হওয়া সম্ভব আদৌ?

    ঠিক এইখানেই কয়েকটি অপ্রিয় প্রশ্ন ওঠে। যে প্রশ্নগুলি ভারতের জয়কে কখনওই খাটো করে না, বরং ভারতের প্রশ্নহীন আনুগত্যের জোয়ারধারায় কিঞ্চিৎ প্রতিরোধ!

    প্যাট কামিন্স বলছেন, আইসিসি ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রতি নমনীয়। অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছে। রোহিত অ্যান্ড কোং, ফাইনাল-সমেত টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচ দুবাইয়ের একটি মাঠেই খেলল! যেখানে অন্য সাতটি দেশ ঘুরে মরল কখনও পাকিস্তান, কখনও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মাঠে। আমরা জানি যে, সমগ্র পৃথিবীতে, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সবচেয়ে ধনী। আইপিএল-এর দয়ায় অর্থমূল্য বেড়ে হয়েছে ২০,৬৮৬ কোটি। কাজেই আইসিসি-র ওপর ভারতের প্রভাব অবলীলায় বেশি। এবং সুস্পষ্ট। তবে আজকাল দেখি তার নির্লজ্জ আস্ফালন।

    অল্প সময়ের জন্য অতীতমুখী হই। ফিরে যাই ২০২৪। টি-২০ বিশ্বকাপ। ভারতীয় দল ট্রফি নিয়ে যখন দেশে ফিরেছে, একটি ওপেন বাস প্যারেডের আয়োজন করেছিল বিসিসিআই। মেরিন ড্রাইভ থেকে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম। সেই প্যারেডে দেখা যায়, যশপ্রীত বুমরার হাত থেকে জয় শাহ, ট্রফিখানা একপ্রকার কেড়েই নিলেন। একবার নয়। বহুবার। ছবি তুললেন আরও। যেন এ-ট্রফির জন্যে ভারতীয় দল যতখানি উপযুক্ত, ঠিক ততখানি জয় শাহ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রেজেন্টেশন সেরিমনিতেও প্রায় এক দৃশ্য। একমুখ হাসি-সমেত রোহিত শর্মাকে জড়িয়ে ধরলেন। একা-একাই ট্রফি তুলে দিলেন। দেশপ্রেম ভাল। তবে এ-ও সত্য যে, আইসিসি-র প্রেসিডেন্ট পদটি নিরপেক্ষ।

    আমরা জানি যে, সমগ্র পৃথিবীতে, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সবচেয়ে ধনী। আইপিএল-এর দয়ায় অর্থমূল্য বেড়ে হয়েছে ২০,৬৮৬ কোটি। কাজেই আইসিসি-র ওপর ভারতের প্রভাব অবলীলায় বেশি। এবং সুস্পষ্ট। তবে আজকাল দেখি তার নির্লজ্জ আস্ফালন।

    এহেন প্রশ্নগুলি রাষ্ট্রকে প্যাঁচে ফেলে। অতএব, দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়াই দস্তুর। ক্রিকেটেও যেমন খুল্লমখুল্লা বলে দেওয়া হচ্ছে, বিরুদ্ধ মত পোষণ করলেই ‘চল ফোট’! তা আসলে বর্তমান ভারতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিরই কুৎসিত প্রতিফলন। শোভনলাল দত্তগুপ্তর ফ্যাসিবাদ-সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে। লিখছেন: ‘…ইতালি এবং জার্মানি— উভয় ক্ষেত্রেই মুসোলিনি এবং হিটলার এক কাল্পনিক, অদেখা ভবিষ্যৎ নির্মাণে লিপ্ত হয়েছিলেন, যার উৎস অনুসন্ধানে তাঁরা গৌরবান্বিত করেছিলেন অতীত ইতিহাসকে। দু’টি দেশেরই ফ্যাসিস্ট নেতৃত্ব গোটা সমাজকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখতে খাড়া করেছিলেন এক ‘অপরায়নের’ তত্ত্ব, যার মূল কথাটি ছিল সমাজের শত্রুদের এক কাল্পনিক ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করা, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সমস্ত ফ্যাসিবিরোধী শক্তি।’ অর্থাৎ, কেন উইলিয়ামসনের স্থিতধী ব্যাটিং যদি আপনার পছন্দ হয়, চায়ের দোকানে, বাজারে কিংবা বাজারি সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ব্যাটিং-এর সামান্য প্রশংসাও করেন, তবে আপনি রাষ্ট্রের চোখে ‘অপর’। কেন ভারতীয় দলের নীল জার্সিতে, হ্যাশট্যাগ ব্লিড ব্লু-তে গেরুয়া রঙের স্পষ্টছাপ? যারা জিজ্ঞেস করে, তাঁরা ‘অপর’। ক্রিকেটীয় এপিসেন্টার মুম্বই তথা ঐতিহাসিক ওয়াংখেড়ে থেকে ধীরে ধীরে সরে গিয়ে, আমেদাবাদে স্থায়ী হল অকস্মাৎ— প্রশ্নটি পাড়লেই আপনি যেন ‘অপর’। দেশের অন্য নাগরিকের মনে ও মগজে তো এ-প্রশ্নের উদয় হয়নি। দিব্যি আছে। মদ-মাংস খাচ্ছে। ফুর্তি করছে। ইন্ডিয়া জিতলে বলছে, জয় শ্রীরাম।

    দুই ভারত একেবারে পৃথক। যারা মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, সম্মিলিতভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করছেন খুলেআম, তারা দেশকে এবং দেশের ক্রিকেটকে পড়তে চাইছেন এক ভাষায়। এক রঙে। এক ধর্মে। শুধুমাত্র পুঁজি দিয়ে। সেটা অসম্ভব। অসম্ভব বলেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মঞ্চ থেকে সামান্য দূরে, যখন ভারতীয় দল উল্লাসে আহ্লাদে মাতোয়ারা, একা-একাই নেচে ওঠেন সুনীল গাভাসকর। সুনীল গাভাসকরের অপার সারল্য আমাদের ‘উত্তর-আধুনিক’ ভারতবর্ষের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ভারত বহুমাত্রিক। ভারতীয় খেলোয়াড়দের নির্মম ও নির্মোহ সমালোচনা করেছি বলে এমনটা নয় যে, দেশের জয়ে প্রাণ খুলে নাচব না। গাইব না। তবেই আমার দেশ জিতে যায়।

    জিতে যায় প্রকৃত ক্রিকেট।

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook