ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • নগর দর্পণ

    পার্থপ্রতিম ঘোষ (March 4, 2025)
     

    আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তর তৃতীয় ছবি ‘মায়ানগর’ তৈরি হয়েছিল ২০২১ সালে, যদিও সেটি হলে মুক্তি পেয়েছে চার বছর কেটে যাওয়ার পর। ‘মায়ানগর’ দেখার পর, আশ্চর্য সমাপতনের মতো, মনে হবে আমাদের যে, মাত্র কয়েকমাস আগেই নির্বাচিত কিছু হলে, সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ছবিটির ফোরকে রেস্টোরড ভার্সন দেখানো হয়েছিল। ‘মহানগর’, সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি, যার কেন্দ্রীয় স্পেস ছিল— নগর কলকাতা।  সেই নগরের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বিবাহিত নারী আরতি, যে ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে প্রথম পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির জগতে পা রাখছে, সেই নারীটির স্বাধিকার-বোধের ক্রম-উন্মোচন আর দ্বন্দ্ব নিয়ে গড়ে উঠেছিল ‘মহানগর’ ছবির অন্তর্মুখী বয়ান।

    ‘মহানগর’ ছবির উপাদান এসেছিল নরেন্দ্রনাথ মিত্র-র দু’টি ছোটগল্প থেকে। দু’টি গল্পই, অর্থাৎ, ‘অবতরণিকা’ আর ‘হেডমাস্টার’ লেখা হয় ১৯৪৯ সালে। সত্যজিৎ রায় ‘মহানগর’-এর সময়-কাল এগিয়ে এনেছিলেন মূল গল্পের সময়কালের ১২ বছর পরে।  এই সময়কালকে সিনেমার বয়ানে  স্পষ্ট আর নির্দিষ্ট  করা হয়েছিল ক্যালেন্ডারের পাতায়  আর নেপথ্যে ভেসে আসা রেডিওর খবর দিয়ে। ছবি এবং শব্দ দিয়ে ‘মহানগর’ এমন একটা সময়ের কলকাতার কথা বলেছিল, যখন উত্তর-উপনিবেশ কালের আশা ও স্বপ্ন পুরোটা মোছেনি। ইতিহাসে চোখ রাখলে আমরা দেখি, একদিকে ১৯৬৩ সালে তিরুবনন্তপুরমের থুম্বা  থেকে প্রথম লঞ্চ করা হচ্ছে ভারতের মহাকাশচারী রকেট, যা উচ্চাশার  প্রতীক মনে হবে।  অন্যদিকে ঘটে গেছে দেশভাগ ও রায়টের রক্তাক্ত অধ্যায়। একবছর আগেই, ১৯৬২-তে  ভারত-চিন যুদ্ধে  ভারত পর্যুদস্ত হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেননকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। সোভিয়েত-ঘনিষ্ঠ নেহরুকে সেনা ও অস্ত্রসাহায্য চাইতে হচ্ছে কেনেডি-র কাছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর, যখন দীর্ঘকাল ব্যাপী ঠান্ডা লড়াই জারি আছে পূর্ব আর পশ্চিম ব্লকের  মাঝখানে, তখন নেহরু তার সোশ্যালিস্ট সমাজ দর্শন সত্ত্বেও স্থিত হতে চাইছেন আন্তর্জাতিক  নিরপেক্ষতার কঠিন অবস্থানে।

    আরও পড়ুন : টালিগঞ্জের নরকে তুলসী চক্রবর্তী ছিলেন পদাতিক দেবতা!
    লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়…

    এইরকম একটা  টালমাটাল প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, স্বাধীন ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশ যখন তলানিতে,  সেই সময়ের  কলকাতার ছবি এঁকেছিল সুব্রত-আরতির ‘মহানগর’, যা ‘অপরাজিত’-র স্বপ্নের  কলকাতার ছায়া নিয়েও বদলে  যাচ্ছিল দ্রুত। আর, সেই বদলের চাপে মধ্যবিত্ত পরিবারের নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপ তখন ভাঙছে।  জেগে উঠছে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধিকার-বোধ। সময়ের এই যে উত্তাপ, এই যে দ্বিমুখী টান, তা  আমরা শুনি, পড়শির রেডিওতে ভেসে আসা খবরে।  যে খবর জানায়,  ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝখানে,  বিশ্বশান্তি নিয়ে নেহরুর বার্তার কথা। ভারত-চিন শান্তির লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে সিলোনের দৌত্যের কথা। আর একইসঙ্গে রেডিওর খবর  বলে— মে দিবস পালনের কথাও। যে মে দিবস পালনের মধ্যে একই সঙ্গে প্রছন্ন হয়ে থাকে নেহরুভিয়ান স্বপ্ন আর  শ্রমের পুরুষতন্ত্র!

    ‘মহানগর’-এর এক দৃশ্যে মাধবী মুখোপাধ্যায়, আরতির চরিত্রে

    মহানগরের ‘আরতি’, এই বাতাবরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে সদ্য জায়মান এক  নারী বিশ্বের  কথা বলে। এক যুগসন্ধিকালীন  অবস্থানে  দাঁড়িয়ে একজন   নারীর জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে  এক  দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের কথাও বলে ‘মহানগর’। পরিবর্তনের এই দ্বন্দ্ব তুলে আনেন সত্যজিৎ, লিপস্টিকের নিচু সুরে বাঁধা ব্যাঞ্জনায়। আয়নায় আত্মদর্শনের মায়ায়। আরতির দৃপ্ত গ্রীবা আর কখনও জ্বলে ওঠা, কখনও  দ্বিধাক্লিষ্ট চোখের নীরব অথচ বাঙ্ময় চিত্রভাষায়। জেগে ওঠা আরতির নিজের শরীরের ওপর অধিকারবোধ প্রত্যক্ষ করি,  তার স্বচ্ছ ব্লাউজের অন্তরালে দৃশ্যমান ব্রেসিয়ারে। সময় আর মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে আরতির পোশাকের এই সামান্য বদলও ছিল বৈপ্লবিক! সুব্রতর  অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই  বাবা, প্রিয়গোপাল, ঠিক ‘জন অরণ্য’-র বাবার মতোই বলেছিলেন, ‘কলকাতা কেমন চেঞ্জ করে যাচ্ছে।’ সময়ের ক্রমিক বদল, যুগ থেকে যুগান্তের ইভলিউশন আর সেই বদলে যাওয়ার অন্তর্নিহিত ট্র্যাজেডি, ক্ষয়,  সত্যজিৎ চলচ্চিত্রের প্রায় ধ্রুব হয়ে ওঠা এক সিগনেচার ছিল। 

    প্রিয়গোপালের ‘চেঞ্জ করে যাওয়া’ কলকাতার  বয়স আরও ছয়টি দশক পার করে দিয়ে, চিত্রকর আদিত্যবিক্রম আমাদের নিয়ে এলেন ‘মায়ানগর’-এ।  সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্রভাষায় রচনা করলেন এমন এক নগর কলকাতার মায়া, ক্যামেরায় আঁকলেন এমন  নারীদের ছবি, যা ‘মহানগর’-এর চেঞ্জ করে যাওয়া কলকাতার উত্তরাধিকার নিয়েও স্বতন্ত্র।

    ‘মায়ানগর’ শুরুই  হয়, আগুনের শিখা দিয়ে। এ এমন আগুনের শিখা, যা প্রথমে বুঝি না, পরে পরিষ্কার হয়, পুড়িয়ে দিচ্ছে এক কন্যাসন্তানকে। অনাগত  ভবিষ্যতের এক progeny-কে। এই শুরুটিকে পাঠ করতে গেলে ছবির পাঠ সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর আবার প্রথম থেকে পড়তে হয়। এই শুরুরও শুরু আছে। তা হল ছবির নাম আর পোস্টার। 

    ‘মায়ানগর’-এর শুরুর দৃশ্য

    ছবিটি দেখার পর, ফিরে আসতে হয় নামের কাছে। কেন ‘মায়া’ শব্দটি এল নগরের আগে? পোস্টারে কেন রবীন্দ্রনাথের স্কাল্পচার? এমন এক রবীন্দ্রমূর্তি, যার ডান চোখের কোণ থেকে নিচে নেমে আসে ফাটল-চিহ্ন। ফাটল, অশ্রু, না কি রক্তধারা? পাঠের সরল অগ্রগমনকে ভেঙে আবার শুরুতে  নিয়ে যাওয়ার এই যে বিন্যাসের মধ্যে দর্শককে এনে ফেলা হল, সেটি  ‘মায়ানগর’ ছবির বহু বিশিষ্টতার একটি।

    ‘মায়ানগর’-এর কেন্দ্রেও আছে এক মধ্যবিত্ত বিবাহিত নারী, যার নাম এলা। এলা বললেই কানে বেজে ওঠে ‘চার অধ্যায়’ । এলা আর অন্তু বা  অতীনের নাম। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ আর তার মূর্তি ‘মায়ানগর’ ছবির এক অন্যতম প্রধান প্রতিমা,  এলা নামের অনুষঙ্গে আমাদের পাঠে, রবীন্দ্রনাথের ১৯৩৪ সালে লেখা শেষ রাজনৈতিক উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’  এসে  পড়া অস্বাভাবিক নয়। ‘চার অধ্যায়’-এর এলাও ছিল মুক্তমনা, স্বাধিকার-সচেতন এক বিপ্লবী নারী। ‘মায়ানগর’ ছবির এলাও স্বাধিকার-সচেতন। কিন্তু এই দুই এলার যাত্রার অভিমুখ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ভিন্নতা এক চলমান ইতিহাসের।  বদলে যাওয়া মূল্যবোধের।  ‘মায়ানগর’ ছবির এলাকে  ঘিরে আছে বেশ ক’টি প্রধান পুরুষ ও নারী চরিত্র।  এলার স্বামী শিশির, যে আদ্যন্ত একজন ভালমানুষ, ভাল শিক্ষক— কিন্তু  অতি-শীতল। এই অতি-শীতলতা এ-যুগে বেমানান, আর এলার সঙ্গে শিশিরের সম্পর্কও তাই ভাঙনের মুখে। আছে রাজা আর পিংকি। তারা একে-অপরকে ভালবাসে। রাজা খুচরো কাজ করে, লোন করে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখে আর  পিংকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের বিউটিফিকেশন করে। আছে বুবু, এলার বৈমাত্রেয় ভাই। বুবুর পিতা ছিল অতীতের প্রখ্যাত ‘সারকারিনা’ মঞ্চের মালিক। মঞ্চটি এখন অতীত, ভগ্ন। বুবু শরীরে ও মনে অসুস্থ, তবু সে আঁকড়ে ধরে আছে ভগ্নপ্রায় মঞ্চটি। একটা Hallucination-এর মধ্যে থেকে বুবু আশা করে বসে থাকে, কোনও এক প্রোমোটার হয়তো আসবে একদিন, যে বাঁচিয়ে  তুলবে তার সাধের মঞ্চটিকে। আর আছে কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়র ভাস্কর। এলার অতীতের রোমান্স!

    ঠিক যেমন ‘মহানগর’ ছবির কেন্দ্রে ছিল নারীবিশ্বের জেগে ওঠা, ‘মায়ানগর’ ছবিটিও বলে দুই নারীর স্বাধিকারের কথা। এলা প্রধান চরিত্র। কিন্তু এলাকে ঘিরে ঘিরে সমান্তরালে দেখতে হয় পিংকিকেও। দুই নারী-ই তাদের নিজেদের শর্তে স্বাধীন থাকতে চায়। কিন্তু আমূল বদলে গেছে স্পেস আর টাইম।

    এই সমস্ত চরিত্রর নিজেদের ছোট ছোট গল্প আছে। ছবির বয়ানে তারা প্রবেশ করে, একে একে,  অন্যের হাত ধরে। ঠিক যেমন শরীরের কোষ এক থেকে বহু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ছবির শুরুতে আসে এলা ও শিশির। এলার সূত্রে আসে পিংকি, তার বিউটিফিকেশন করতে। এলা তার স্বামীর  বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তার প্রস্তুতিকে সাহায্য করতে আসে রাজা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে  যাওয়ার সময় মুখোমুখি হয় রাজা ও পিংকি। বোঝা যায় ওদের দু’জনের সম্পর্ক। রাজার বাবা, সারকারিনা মঞ্চের পুরনো কর্মচারী, যে রয়ে গেছে বুবু-র সঙ্গে, ওই ভগ্নপ্রায় মঞ্চের ওপরতলার ঘরে। রাজার সূত্রে পরিচিত হই বুবুর সঙ্গে। আর এলার সঙ্গে ভাস্করের দেখা হয়ে যায়,  আকস্মিক, একটি মলের সিঁড়িতে। এলা ‘কল্পতরু’ নামক এক সংস্থায়  সঞ্চালিকার কাজ করতে গিয়ে , পরিচিত হন ওই কোম্পানির মালিক প্রদীপ্ত পালের সঙ্গে। প্রদীপ্ত হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এক চিট ফান্ডের মালিক হিসেবে বড়লোক হয়ে যায়।  উচ্চাকাঙ্ক্ষী এলা স্বেচ্ছায় তার অঙ্কশায়িনী হয়। 

    বহু চরিত্রের এই ক্রমিক উপস্থাপনা, তাদের অর্কেস্ট্রেশন আর সম্পর্কের উন্মোচন, চিত্রনাট্যের নিপাট মুনশিয়ানায় বোনেন পরিচালক।   

    এই যাত্রা, পৃথিবী নামক এক গ্রহের, কলকাতা নামক একদা  আলোকপ্রাপ্ত কোনও এক শহরের  ধংসের  ইতিহাসের কথা  বলে আসলে

    ঠিক যেমন ‘মহানগর’ ছবির কেন্দ্রে ছিল নারীবিশ্বের জেগে ওঠা, ‘মায়ানগর’ ছবিটিও বলে দুই নারীর স্বাধিকারের কথা। এলা প্রধান চরিত্র। কিন্তু এলাকে ঘিরে ঘিরে সমান্তরালে দেখতে হয় পিংকিকেও। দুই নারী-ই তাদের নিজেদের শর্তে স্বাধীন থাকতে চায়। কিন্তু আমূল বদলে গেছে স্পেস আর টাইম। বহু জল গড়িয়েছে কলকাতা শহরের ওপর দিয়ে, ছয়টি দশকের ব্যাবধানে।  যে সময় গড়েছিল আরতিকে,  সেই একই সময় গড়েনি এলা আর পিংকিকে। আরতির জেগে ওঠায় সহযোগী ছিল তার স্বামী সুব্রত। এলা নিজেই স্বয়ম্ভর, শরীরে ও মনে। সে নিজের শর্তে ওপরে উঠতে চায়। শিশির ভাল মানুষ হওয়া সত্ত্বেও, এক শীতল বিবাহিত সম্পর্কে ইতি টেনে  এগিয়ে যাওয়ার  সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিতে পারে। অতীতের রোমান্স, ভাস্করকে সে অবলীলায় মিথ্যে বলতে পারে । তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে যেতে সে ইতস্তত করে না। একটা খুব ‘Telling’ মুহূর্ত ধরা পড়ে , যখন ভাস্কর আর এলা এক রেস্তোরাঁয় প্রথম মিট করছে। যখন খাবারের অর্ডার দেওয়া হচ্ছে, প্রতিটি মেনু , ভাস্কর যা সাজেস্ট করেছে, এলা তাকে খারিজ করে নিজের পছন্দের আইটেমটা বলেছে। এলা যে কতখানি নিজের শর্তে বাঁচতে চায়, তার খুব ব্যাঞ্জনাময় উদাহরণ এটি। এইরকম টুকরো টুকরো অজস্র মুহূর্ত রচনা করেছেন আদিত্যবিক্রম, গোটা ছবি জুড়ে । 

    ‘মহানগর’ শুধু আরতির কথা বলেনি,  বলেছে এক চেঞ্জ করে যাওয়া নগরের কথা

    ১৯৬৩ সালে, ‘মহানগর’ যেমন শুধু আরতির কথা বলেনি,  বলেছে এক চেঞ্জ করে যাওয়া নগরের কথা।  বলেছে এক মূল্যবোধ বদলের কথা, যে বদলকে দ্রুত আঁচড়ে এঁকেছিলেন সত্যজিৎ, শিক্ষক আর ছাত্রের মধ্যেকার মূল্যবোধের অবনমনের মধ্য দিয়ে, ঠিক সেইভাবেই, আদিত্যবিক্রমের ‘মায়ানগর’ শুধু এলা আর পিংকির কথা বলেনি। ওদের কেন্দ্রে রেখে, পরিধি রচনা করেছে ক্ষয়ের শীর্ষে পৌঁছে যাওয়া, একদা  অতীতের এক রেনেসাঁ নগর। সেই বিগত রেনেসাঁর প্রতীকেই  আসেন রবীন্দ্রনাথ। আসে তার গানের remix, সমকালীনতার সিগনেচার-বাহিত হয়ে। মিংকো এরগাসম্যানের ধরা শব্দে, এই গান উচ্চকিত হয়ে কানে বাজে। দুর্নীতির মান্যতায় ধ্বসে পড়ে ফ্লাইওভার। তবু রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাজেন রবীন্দ্রনাথ, উন্মোচনে  নয়, ক্লিশে হয়ে যাওয়া অভ্যেসে। প্রতীকে আসে সারি সারি  ট্রাকবোঝাই করা রবীন্দ্রনাথের হাফবাস্ট মুর্তির মিছিল, গোটা নগরকে মুড়ে দেবে বলে। এই ‘মায়ানগর’-এ রবীন্দ্রনাথের থেকে বড় হয়ে ওঠে তার মূর্তি।  আসে এক বিরাট  ডাইনোসরের মুর্তিও। যে মূর্তি এককালে শোভা পেত সায়েন্স সিটির দোরগোড়ায়। এখন আর নেই। তাকে সরিয়ে দিয়েছে ফ্লাইওভার। এই সমস্ত আধুনিক নগর-চিহ্ন দিয়ে  এমন এক নগরের কথা বলেন পরিচালক, যা ধ্বংসপ্রাপ্ত এক মায়াসভ্যতার মতোই। ডাইনোসরের মতোই হয়তো যা বিলীন। 

    লক্ষ্য করতে হয়, কী নিপুণ অনিবার্যতায় গোখান তিরয়াকির ক্যামেরা কখনওই স্পষ্ট ফোকাসে ধরে না কর্পোরেট— কলকাতার আধুনিক স্থাপত্য। আউট অফ ফোকাসে বিমূর্ত রাখা হয় দূরের স্কাইস্ক্র্যাপার, রাতের আলোকসজ্জা, সাজানো গঙ্গার ঘাট বা ইকো পার্কের তাজমহল। ফোকাসে রাখা হয় কেবল শিয়ালদা স্টেশন, পুরনো কলকাতার গলি, বাড়ির উঠোন, লাল সিমেন্টের মেঝে, সিঁড়ি, আর প্রায়ান্ধকার, বাতিল এক থিয়েটার মঞ্চ। শুধুমাত্র ফোকাসের ব্যবহার দিয়ে পরিচালক তার ‘মায়ানগর’ সম্পর্কে এক স্টেটমেন্ট রচনা করেন, যা অভিনব!

    যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ করে, ‘চার অধ্যায়’-এর এলা, ‘মহানগর’-এর আরতি থেকে  পৌঁছে যায়  ‘মায়ানগর’-এর এলায়।  এই যাত্রা, পৃথিবী নামক এক গ্রহের, কলকাতা নামক একদা  আলোকপ্রাপ্ত কোনও এক শহরের  ধংসের  ইতিহাসের কথা  বলে আসলে।   ধংসের পরে কি অপেক্ষা করে আছে পুনর্নির্মাণ?  শুরুর শুরুতে ফিরতেই হয়।  কেন মায়া? মায়ার একটি  অর্থ অলীক। মায়ার অন্য অর্থ তো মমতা?  ধংসপ্রাপ্ত মায়া সভ্যতা অলীক,  অতীত। আর, যে মায়ায় পিংকি ঘর ছাড়তে গিয়েও আবার ফেরত আসে চৌকাঠ ডিঙিয়ে, যে মায়ায় সমস্ত কিছু হারিয়ে,  এলা আবার ফিরে আসে তার ‘অন্তু’ শিশিরেরই  কাছে, সেই মায়ানগরে হয়তো নিহিত আছে পুনর্নির্মাণের বীজ। 

    ‘মায়া’ শব্দের এই ‘ambivalence’ দিয়ে প্রায় এক ‘surreal’ মুহূর্ত রচনা করে শেষ দৃশ্যটি অনিঃশেষ হয়ে যায়। মনে পড়ায় জীবনানন্দকে। 

     ‘দূরে কাছে, কেবলি নগর, ঘর ভাঙে

      গ্রাম পতনের শব্দ হয়

      মানুষেরা ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে

      দেয়ালে দেয়ালে তাদের ছায়া তবু’… 

     
      পূর্ববর্তী লেখা
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook