কথা ছিল, হলের সামনেই মেসোমশাই দাঁড়িয়ে থাকবেন টিকিট নিয়ে। মেসোমশাই ছিলেন, কিন্তু টিকিট ছিল না। মানে পাওয়া যায়নি। হাউজফুল! আর সেটাই তো হওয়ার কথা। ‘খুদ্দার’-এর ওপেনিং ডে, ওপেনিং শো। অমিতাভ বচ্চন তখনও ভরপুর মেগা-তারকা। তখনও তার বক্স অফিসে ভরা কোটাল। ‘কুলি’-র সেটে অ্যাকসিডেন্টটাও হয়নি। রাজনীতি, নির্বাচন, বোফর্স, ঘুষ, স্ক্যাম তো অনেক দূরের ব্যাপার। তাই হাউজফুল থাকাটাই স্বাভাবিক!
কিন্তু বাবা কেন ব্ল্যাকারদের থেকে টিকিট নিয়ে রাখেনি, তাই নিয়ে শুভদীপ হলের সামনেই একেবারে হুলস্থূল হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দিল। হ্যাঁ, মেসোমশাই মানে, শুভদীপের বাবা। সেই ১৯৮২ সালে, আমাদের বাবারা কেউ কেউ প্রাপ্তেষু-ষোড়শ-বর্ষর ফরমুলামাফিক একটু-আধটু মিত্র-মিত্র ভাব দেখালেও, ছেলে ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে কলেজ বাঙ্ক করে নুন শো-এ ‘বচ্চন’-এর সিনেমা দেখবে বলে ব্ল্যাকে টিকিট কেটে রাখতে হবে— এটা নিশ্চয়ই বড্ড বাড়াবাড়ি ছিল। কিন্তু মেসোমশায় আমাদের এতটাই মাই ডিয়ার গোছের ছিলেন, তাঁর সঙ্গে এতটা বাড়াবাড়ি চলত। তাই ব্ল্যাকারদের কাছ থেকে কেন টিকিট কাটা হল না, তাই নিয়ে শুভদীপের মতো না হলেও, আমাদেরও একটু-আধটু রাগ হয়েছিল।
এখন বুঝি, ছেলের আবদার মেটাতে, মাসের শেষে পাঁচটা টিকিট ব্ল্যাকারদের মর্জিমাফিক দামে ঝপ করে কিনে ফেলাটা সেই সময়ের একজন মধ্যবিত্ত বাবার পক্ষে খুব সোজা ছিল না। শুভদীপের ধমক খেয়ে মেসোমশাইয়ের অপ্রতিভ মুখটাও তাই এখনও মনে আছে। যাই হোক, মেসোমশাই তাঁর সেই সময়ের অভিমান, মনখারাপ সব মনেই রেখে, পাশের হল উত্তরায় ম্যাটিনি শো-এর পাঁচটা টিকিট কেটে, আর পাঁচজনের জন্য পাঁচটা পপকর্নের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলেন। আমরা প্যাকেটগুলো ধীরেসুস্থে শেষ করে, শুভদীপেরই ঘাড় ভেঙে খানিকটা আলুকাবলি গিলে, এদিক-ওদিক শ্যামবাজার পাড়ার ফুটপাথে চক্কর মেরে, শ্রী সিনেমার সামনে টাঙানো গাঁদাফুলের মালা ঝোলানো অমিতাভের ছবি আর ‘খুদ্দার’-এর পোস্টারের দিকে আরেকবার করুণ, বেচারি চোখে তাকিয়ে উত্তরার অন্দরে সেঁধিয়ে গেলাম।
আরও পড়ুন : অরুন্ধতী দেবী তৈরি করেছিলেন সিনেমার স্বতন্ত্র ভাষা!
লিখছেন দেবারতি গুপ্ত…
সেখানে পর্দায় দেব আনন্দ-আশা পারেখের রমকম ‘যব পেয়ার কিসিসে হোতা হ্যায়’। এই ছবিতেই রফি আর লতার সেই অমর রোমান্স-বার্তা— ‘সও সাল প্যাহলে, হামে তুমসে পেয়ার থা’! পাহাড়ি উপত্যকায়, রোদ-কুয়াশার আলোছায়ায়, আশা পারেখের পিছু পিছু দেব আনন্দ। গত শতকের পাঁচের দশকে স্টাইল আইকন হয়ে ওঠা দেব সাহেবের পরনে জ্যাকেট— কিংবদন্তি হয়ে ওঠা মাফলারটা ট্রাউজার্সের ডান পকেটে গোঁজা। বাঁ হাত দিয়ে পিঠের ওপরে বেশ ফ্যাশনের ছোট্ট একটা চামড়ার ব্যাগ বেশ কায়দা করে ঝুলিয়ে রেখেছেন। আমার হঠাৎ খেয়াল হল, আচ্ছা, কলেজের গেট দিয়ে ঢোকার আগে আমিও তো আমার সস্তার কাপড়ের ব্যাগটা অনেকটা এভাবেই, স্ট্র্যাপটা ধরে কাঁধে-পিঠে ঝুলিয়ে নিই। কাকে দেখে শিখেছিলাম, মনে নেই! সেও কি দেব আনন্দকে দেখে শিখেছিল? তাই বা কে জানে!
সে যাই-হোক, দেব সাহেব যখন ১০০ বছরের পুরনো প্রেমের রিনিউয়ালের জন্য প্রায়-কিশোরী আশা পারেখের ‘সতেজ স্বাস্থ্যে ভরা’, ‘সফেন উপচে পড়া’ রূপলাবণ্য কুড়তে কুড়তে দৌড়চ্ছেন, তখন অশোক দেখলাম শুভদীপের কানের কাছে ফিসফিস করে কী একটা বলছে! ‘অশোক কী বলছে রে?’ শুভদীপকে জিজ্ঞেস করতেই মুখ ভ্যাটকাল। ‘ও বলছে, মেসোমশাই কী একটা সিনেমা দেখতে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল! এই গানটা নাকি ওর বাবার মুড ভাল থাকলে রান্নাঘরে মাসিমার ঘাড়ের ওপর গিয়ে খুব দরদ দিয়ে গাইতেন, আর মাসিমা নাকি ফিকফিক করে লাজুক হাসতেন।’
ওদিকে আমার তখনই মনে হল, অশোক তো ফাটিয়ে দিয়েছে। ‘সও সাল’ তো অনেক বড় ব্যাপার। একশো বছরে কত কী বদলে যেতে পারে। সাদা-কালো পর্দার ওই মস্ত্ রোমান্টিক যুবক-যুবতী তখন কোথায় কী করতেন, কিন্তু বছর বিশ-পনেরো আগে খাস উত্তর কলকাত্তাইয়া মধ্যবিত্ত বাঙালির গেরস্ত রোমান্সে ‘যব পেয়ার কিসিসে হোতা হ্যায়’-এর রসায়ন কীভাবে কাজ করছে, তার একটা ঝলক তো পাওয়া গেল।
পুরনো সিনেমার রি-রিলিজ এভাবেই নস্টালজিয়ার সেতু গড়ত। জুড়ে দিল স্মৃতি আর সময়। ওই রি-রিলিজের দৌলতেই তো কত বাংলা আর হিন্দি সিনেমা দেখা হয়ে গিয়েছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই, মনে-শরীরে সদ্য গজানো যুবক-যুবক ভাব নিয়ে তিন বন্ধু মিলে দেখে ফেলেছিলাম ‘তিন ভুবনের পারে’। কলকাতার উত্তর-মহল্লা আর শহরতলির পাড়া-গলিগালায় তখনও নন্দিনীদের মোটামুটি একইরকম ‘হিড়িক’ দেওয়া চলত। বাড়ির মোটামুটি বাধ্যা আমাদের ‘মন্টু’ হওয়ার মতো সাহসও ছিল না। কিন্তু যাকে কোনওদিনই বলা হয়ে উঠবে না, ‘হয়তো তোমারই জন্য’, আর যার প্রেমে ‘বন্য’ কেন, ‘বশ্য’ হতে পারাটাও সাতপুরুষের সৌভাগ্য— তেমনই কারও হাত ছুঁয়ে, আঙুলে আঙুল ছড়িয়ে আউট্রাম ঘাট ধরে হেঁটে যাওয়ার স্বপ্নটা তো মনের ভেতর পাক খেতই। কী যে একটা ভ্যানতারা হয়ে গেল! ‘অপুর সংসার’-এর অপুর চেয়েও মন্টু-অবতারে সৌমিত্রকে বেশি চেনা, কাছের আর ভাল লাগার মনে হল।
এখন ভাল লাগার তো সবসময় লজিক থাকে না, ঠিক-ভুল, উচিত-অনুচিত বলেও কিছু হয় না। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরনোর পরে যেমন ওই রূপবাণী-তেই দেখলাম, উত্তমকুমারের ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’। রি-রিলিজও অত দিন-ক্ষণ, সাল-তারিখ, ক্রোনোলজি বুঝে হত না। কিন্তু দেখলাম, ১৯৬৭-র তথাকথিত পিরিয়ড ফিল্ম আর কস্টিউম ড্রামা, আর ’৬৯-এ সমরেশ বসুর কাহিনি নিয়ে সমকালীন সামাজিক-পারিবারিক আবেগ-নাটক— দুটো ছবিতেই টালিগঞ্জের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক-রতনকে নরম মুঠোর মধ্যে রেখে কী আশ্চর্য খেলাটা খেলেছিলেন বলিউডের মোটামুটি ফ্লপ-নায়িকা তনুজা।
‘বলিউড’ কথাটা তখনও অতটা চাউর হয়নি। বম্বের সিনেমা, হিন্দি সিনেমা— এরকমটাই বলা হত। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’-তেও সত্যজিৎ সেরকমটাই লিখেছিলেন। এই বোম্বাইয়া সিনেমার রি-রিলিজের আবার একটা মজার ট্রেন্ড দেখা যেত। আটের দশকের গোড়ায়, একদা সেলিম-জাভেদের পয়দা করা ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’ হিসেবে অমিতাভ বচ্চন পর্দায় যতবার রাগী হচ্ছিলেন, জন্ম দিয়ে কেটে পড়া বাবা-সহ গোটা সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক পরিস্থিতি— সবকিছু যত বেশি বেশি করে তাঁর পবিত্র ক্রোধ আর ন্যায্য-বৈধ অ্যাকশনের আগুনে পুড়ে ছারখার-ছাই হয়ে যাচ্ছিল, ততই সেই ধর্মযুদ্ধের ‘কো-ল্যাটারেল ড্যামেজ’ হয়ে ধোঁয়া-বায়ু হয়ে উবে যাচ্ছিল বলিউডের একদা হৃদয়-জাগানো, রক্ত-মাতানো রোমান্স গাথা। অমিতাভর ছবির নারীরা ক্রমশই হয়ে উঠছিলেন পর্দার সাজানো ফুলদানি। আগে-পিছে রি-রিলিজ চেনে চলে আসত ১০-১৫-২০ বা ২৫ বছর আগের কোনও আকুল-আদর রোম্যান্স মাখামাখি প্রেমের ছবি। যেমন আমরা ‘খুদ্দার’-এর পাশের হলেই ‘যব প্যার…’ দেখলাম। ‘লাওয়ারিস’-এর সঙ্গেই রাজেশ খান্নার ‘অমর প্রেম’-ও রি-রিলিজ হয়েছিল। সেই রাজেশ খান্না— যাঁকে টপকে বলিউডের শাহেনশার মুকুটটা অমিতাভ নিজের মাথায় পরেছিলেন।
তবে রি-রিলিজের ন্যারেটিভটা সবসময়ে শুধুই অমিতাভ বনাম দেব আনন্দ-রাজেশ খান্না ছিল না। সেটা পুরনো ফ্লপ-মাস্টার অমিতাভ বনাম মেগা-তারকা অমিতাভ হতে পারত। অমিতাভ-জিনাত আমনের ‘পুকার’ দেখার কয়েকদিনের মধ্যেই তো ‘সাত হিন্দুস্তানি’ দেখেছিলাম পূর্ণশ্রী-তে। রাজ কাপুরের চিত্রনাট্যকার, বম্বে ইপটা-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ঘোর মার্কসবাদী কে এ আব্বাসের এই ছবি দিয়েই তো বলিউডে বিগবি-র হাতঘড়ি। দুটো ছবিরই বিষয় গোয়ায় পর্তুগিজ উপনিবেশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ। ‘সাত হিন্দুস্তানি’ দেখে বেরিয়ে গৌতম বলল, ‘অমিতাভ তাহলে দু’বার গোয়া স্বাধীন করেছে! প্রথম দফায় গান্ধীবাদী অহিংসার রাস্তায়— তারপর ‘রাগী যুবক’ হয়ে গিয়ে বন্দুকের নলকেই ক্ষমতার উৎস বানিয়ে!’ কলকাতার এক-আধটা পুরনো দেওয়ালে, নতুন চুনকামের এদিক-ওদিক দিয়ে দু-একটা নকশালি স্লোগান তখনও তো পড়া যেত! হিন্দি বা বাংলা সিনেমার রি-রিলিজও যেন আমাদের কাছে ওরকমই দেওয়াল-লিখন পড়ে ফেলার মতোই ছিল। এক-দেড়-দুই-আড়াই, মাঝে মাঝে তিন দশক আগেকার সিনেমাও একটা অন্য সময়, জীবনকে দেখার বা যাপনের একটা অন্যরকম ভঙ্গি, জনপ্রিয় সংস্কৃতির একটা ভিন্নতর বয়ান, ব্যক্তিগত কিছু-কিছু সুখ— আলতো কিছু মনখারাপও।
ক্লাস সিক্সে দেখা ‘ইয়াদোঁ কি বরাত’ আবার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে দেখতে গিয়ে মনের ভেতর নতুন কতরকম এতোল-বেতোল! ছোটবেলার একটা হারানো গানের সুরে, মুশকো জোয়ান তিন ভাইয়ের কেঁদেকেটে একসা হয়ে গলাগলি-জড়াজড়ির মতোই যেন বড্ড বেশি সরল, বেশি সেন্টিমেন্টাল, অতি-অতিনাটকীয় সব ব্যাপার-স্যাপার! তবু পুরনো ছবির রি-রিলিজও তো আক্ষরিক অর্থেই ইয়াদোঁ কি বরাত— স্মৃতির ‘জলুস’ শোভাযাত্রা। সমকালের ছবির পাশাপাশিই আগেকার ছবিও একইরকম বাণিজ্যিক চেইনে সিনেমাঘরের পাঁচমিশেলি দর্শকদের সঙ্গে বসে বড়পর্দায় দেখার সুযোগ, আমাদেরকে সিনেমা-ইতিহাসের বড়ো একটা প্রেক্ষিত, একটা ধারাবাহিকতার সঙ্গে যুক্ত করে দিত। আমরা সেভাবে তক্ষুনি হয়তো ব্যাপারটা বুঝতাম না। কিন্তু প্রক্রিয়াটা তো চলত! তেমন আমাদের কলেজবেলায় সাতমার পালোয়ানের মতোই পাঁচ-সাত-আটবার ‘শোলে’ দেখে ফেলা লোকজন কলার তুলে ঘুরে বেড়াত। আমি নিজেই তো কলেজে ঢুকে প্রথমবার ‘শোলে’ দেখার পরে, কলেজের পাট চুকোবার আগেই আরও দু’বার দেখে ফেলেছি। কারণ ‘শোলে’ই বোধহয় রি-রিলিজ চেইনে সবচেয়ে বেশিবার মুক্তি পাওয়া ছবি। আর প্রত্যেকবার দেখাতেই ‘শোলে’র পাঠটা একটু-একটু করে বদলেছে। যে-ছবিটাকে প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল হলিউডি ওয়েস্টার্নের ঝোলভাত সংস্করণ, যার ফিল্ম স্টাডিজগত নাম ‘কারি ওয়েস্টার্ন’— তিন নম্বর দেখাদেখিতে তার অন্দর থেকেই পাপ-পুণ্য, শুভ-অশুভ, ধর্ম-অধর্মের কতরকম মহাভারতীয় এপিক্যাল মারপ্যাঁচ বেরিয়ে আসে।
একুশ শতকের এই অতিমারী-উত্তর, ওটিটি-নির্ধারিত জনপ্রিয় সংস্কৃতির দুনিয়ায় আমরা যখন ধরেই নিয়েছিলাম, সেই শ্রী-উত্তরা-রাধা-রূপবাণীও নেই, রি-রিলিজের গপ্পও নেই, তখনই আমাদের স্মৃতিমেদুরতায় ভিজিয়ে দিয়ে, বুক মাই শো-তে ঝাঁপিয়ে এল রি-রিলিজের ঢেউ। এই ট্রেন্ডটা মোটামুটি ২০২৪ সালের শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে। বছরের গোড়াতেই পর পর মুক্তি পেয়েছিল ‘রকস্টার’, ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’, ‘চক দে ইন্ডিয়া’র মতো ছবি। এগুলোর মধ্যে কোনওটা প্রথমবার মুক্তির সময়ে বড় হিট দিয়েছিল, কোনওটা মাঝারি, কোনওটা-বা অ্যাভারেজ। কিন্তু ছবির রি-রানে এই সব প্রযোজকের হাসিই চওড়া হচ্ছে। গত বছর ভ্যালেন্টাইন-সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছিল করিনা-শাহিদ কাপুরের ‘জব উই মেট’। ২০০৭ সালের এই ছবিতে ইমতিয়াজ আলি এমন দুই নায়ক-নায়িকাকে নিয়েছিলেন, যাদের রিলের বাইরের তুফানি প্রেম পর্দায় একটাও হিট দিতে পারেনি। কিন্তু সেই সব ‘রিয়েল’-রোম্যান্সপর্ব চুকিয়ে যখন তাঁরা ঘোষিতভাবেই ‘সিঙ্গল’, তখন ‘জব উই মেট’-এ জুটি বেঁধে বক্স-অফিসে কামাল করে দিলেন। ১৭ বছর পরে শাহিদ, করিনা যখন যে যার জিন্দেগি আর সংসারে সেটল, তখন বড়পর্দায় তাঁদের সেই একদা ‘আনোখা’ লাভ স্টোরি দেখতে ২০২৪-এর জেন জি-রা উজ্জীবিত হতে পারেন, এমনইটাই নিশ্চয়ই ভাবা হয়েছিল।
তারপর বছরভরই তো রি-রিলিজের মিছিল! পুনর্মুক্তির পুনর্জ্জীবন। কত-কত ইয়াদের ইয়াদের বারাত বা বাল বরসাতও বলা যায়। সেই ২০০১-এ মুক্তি পেয়েছিল তামিল ছবির হিন্দি রিমেক ‘রহেনা হ্যায় তেরে দিল মে’। দিয়া মির্জার ডেবিউ আর মাধবনেরও প্রথম হিন্দি সিনেমা। তখন বক্স-অফিসে তেমন সাড়া মেলেনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে টেলিভিশন ডিভিডি এসব মিলিয়ে ‘রহেনা হ্যায়…’ একুশ শতাব্দীর ফিল্মি রোম্যান্সের একটা ‘কাল্ট’ ছবি হয়ে যায়। লোকে আদর করে তাকে ‘আর এইচ টি ডি এম’ বলেও ডাকতে থাকে। যেমন ‘হম আপকে…’ এইচ এ এইচ কে, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া…’ ডি ডি এল জে। এ-প্রেমের আখ্যানে যেমন বাসু চ্যাটার্জির ‘চিতচোর’-এর নরম মিঠেপাক আছে, আবার কিছু বছর আগেকার ‘কবীর সিং’-এর মতো ছবির উগ্র-টক্সিক অতি-পুরুষতান্ত্রিকতার বীজও আছে। তো রি-রিলিজের ভরা বাজারে এই ছবিও বক্স-অফিসে বেশ কয়েক কোটি টাকা কামিয়ে চলে গেছে। কিংবা ‘তুম্বড়’-এর কথাই ধরা যায়। চিত্রনাট্য লেখা থেকে শুরু করে, বারবার ফ্লোরে যাওয়া ও শুটিং আটকে যাওয়া ধরলে রাহী অনিল বার্বের এই ডিসটোপিয়ান হরর ঘরানার ছবিটা প্রায় ২০ বছর ধরে তৈরি হয়ে বক্স-অফিসে আয় করেছিল সাড়ে ১৩ কোটি টাকা। রি-রিলিজে সেই ছবিই প্রথম হপ্তাতেই ১৩ কোটি টাকা তুলে ফেলে। আর সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ব্যবসা করে হিন্দি সিনেমার রি-রিলিজের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে ফেলে। ‘তুম্বড়’-এর মতো অমন ছপ্পড় ফাড়কে না হলেও প্রথম দফায় সুপারফ্লপ ইমতিয়াজ আলির ২০২১-এর ছবি ‘লায়লা মজনু’-ও ২০২৪-এর রি-রানে বেশ সফল।
রি-রিলিজের এই সিলসিলায় গত বছরে আমরা যেমন ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’, ‘কাল হো না হো’-র মতো ছবি দেখেছি, তেমনই ‘সত্যা’, ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’ এমনকী, ‘করণ অর্জুন’ও দেখে ফেলেছি। এ-বছরের ভ্যালেন্টাইন সপ্তাহ বা পক্ষকালও ভেসে যাচ্ছে, গেছে, যাবে অনেকগুলো রি-রিলিজে। তার মধ্যে যেমন আট বছর আগের ‘সনম তেরি কসম’ আছে, তেমনই প্রায় তিন দশক আগের বলিউডের রোম্যান্স-রাজ যশরাজ চোপড়ার ‘দিল তো পাগল হ্যায়’-ও আছে। শুধু কি তাই? রি-রিলিজের নেশা এতটাই চড়েছে, ভ্যালেন্টাইন দিনের পরের সপ্তাহেই সিনেমাঘরে হাজির, নার্গিস-রাজ কাপুরের সেই প্রেম আর প্রেমহীনতার কিংবদন্তী রোম্যান্সগাথা ‘আওয়ারা’। পরিবেশকরা নিশ্চয়ই ভেবেছেন, ‘দম ভর জো উধার মু ফেরে’ গানের পিকচারাইজেশনে ক্যামেরার সামনে ও পেছনে রাজ, নার্গিসের অনন্য পর্দা-উপস্থিতিকে ব্যবহার করে, সাদা-কালো ফ্রেম জুড়ে কল, জ্যোৎস্না আর নারী-পুরুষের ভালবাসাকে যেমন মায়াময় একাকার করে দেন— মাল্টিপ্লেক্সের গোল্ডেন সিটের আদুরে আবেশে বসে থাকা এই প্রজন্মের প্রেমিক-প্রেমিকারাও সে-মোহ আবরণ বরণই করে নেবেন।
কিন্তু সেটা ঘটছে কী করে বা ঘটবে কী করে? আটের দশকে আমরা যখন মধ্য কলকাতার অপেরা-নিউ সিনেমা থেকে উত্তরে ফড়িয়াপুকুরে টকিশো হাউস অবধি রি-রিলিজের ছবি দেখছি— কলকাতার হলে তা পোষালে আলমবাজারের ‘নারায়ণী’, কামারহাটির ‘মুক্তি’ অবধি পৌঁছে যাচ্ছি, তখনও তো পুরনো সিনেমা দেখার প্রায় একমাত্র উপায়, দূরদর্শনে শনি ও রবিবারের একমাত্র স্লট। তাও আমাদের বাড়িতে ১৯৮৫ সালের আগে টেলিভিশন ঢোকেনি। ভিডিয়ো ক্যাসেটে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা আমাদের পাড়ার কোনও বাড়িতে ছিল বলে মনে পড়ে না। তাই সিনেমা নতুন হোক বা রি-রিলিজ, সেটা হলে গিয়ে দেখাটাই ছিল থাম্ব রুল। কিন্তু এই ২০২৫-এ, এগুলো কী ঘটছে? যে-পুরনো সিনেমাগুলো লোকে হলে গিয়ে নতুন করে দেখছে বা লোকে দেখবে বলে পুনর্মুক্তি পাচ্ছে, সেগুলো সবই তো টেলিভিশনের অজস্র সিনেমা চ্যানেল, ডিভিডি, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, নিদেনপক্ষে ইউটিউবে দেদার মজুত। ইচ্ছে করলেই দেখে ফেলা যায়। বিনে পয়সায়, কোনও পরিশ্রম ছাড়াই। তাহলে সেই পাবলিক গাড়িভাড়া দিয়ে, মাল্টিপ্লেক্সের দামি টিকিটে, পপকর্ন-কোল্ড ড্রিঙ্কসের জন্য গাঁটের কড়ি খরচ করে রি-রিলিজ সিনেমা দেখতে যাচ্ছে?
শুধু তো পুনর্মুক্তি নয়। ‘তুম্বড়’, ‘লায়লা মজনু’ বা ‘সনম তেরি কসম’-এর মতো ছবির ক্ষেত্রে তো এই রি-রিলিজ যাকে বলে পুনর্জীবনই বলা চলে। কেস-স্টাডি হিসেবে তো আমরা ‘সনম তেরি কসম’-কেই ধরতে পারি। হর্ষবর্ধন রানে আর পাকিস্তানি নায়িকা মাওরা হোকানে অভিনীত ছবিটা যখন ২০২৬-য় প্রথমবার মুক্তি পেয়েছিল, তখন দর্শকেরা ছুঁয়েও দেখেননি— সমালোচকরাও বড্ড ‘প্রেডিক্টেবল’, সাতকেলে পুরনো গল্প ইত্যাদি বলে উপেক্ষাই করেছিলেন। কিন্তু এই ২০২৫-এর ৭ ফেব্রুয়ারি নতুন করে মুক্তি পাওয়ার পরে, সেই ছবি ঘিরেই বিপুল উৎসাহ, উত্তেজনা, উদ্দীপনা। শো-এর পরে কোথাও দর্শকরা মাল্টিপ্লেক্সের পোডিয়ামে চড়ে নাচছেন, আবেগে গড়াগড়িও খাচ্ছেন। সমালোচকেরাও নতুন করে মাথা-টাথা চুলকে, ভুরু-টুরু কুঁচকে, ‘সনম তেরি কসম’-এ কীভাবে শিব-সতীর পুরাণ-নিকষিত রোম্যান্স-মাহাত্ম্য আর এরিক হোগানের চিরন্তন ভেজা-ভেজা নরম ‘লাভ স্টোরি’-র একটা একুশ শতাব্দীর উত্তর আধুনিক ককটেল পাকানো হয়েছে তার বিশ্লেষণে লেগে পড়েন। তবে কি ইউটিউব-বাহিত হয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম-শোভিত হয়েই একদা উপেক্ষিত, প্রত্যাখ্যাত ছবিগুলোর ব্র্যান্ড ভ্যালু বেড়ে গিয়ে জাতে উঠছে? না কি যে আনকোরা রোম্যান্টিক-জুটিকে সেবারে লোকে পাত্তাই দেয়নি, গত কয়েক বছরে তাঁরাই জুটিতে বা একা-একা নাম-টাম করার পর, পাবলিক এখন তাঁদের টানেই হলে যাচ্ছেন। প্রায়শ্চিত্ত করছে? বলা মুশকিল!
এ-বছরের ভ্যালেন্টাইন সপ্তাহ বা পক্ষকালও ভেসে যাচ্ছে, গেছে, যাবে অনেকগুলো রি-রিলিজে। তার মধ্যে যেমন আট বছর আগের ‘সনম তেরি কসম’ আছে, তেমনই প্রায় তিন দশক আগের বলিউডের রোম্যান্স-রাজ যশরাজ চোপড়ার ‘দিল তো পাগল হ্যায়’-ও আছে। শুধু কি তাই? রি-রিলিজের নেশা এতটাই চড়েছে, ভ্যালেন্টাইন দিনের পরের সপ্তাহেই সিনেমাঘরে হাজির, নার্গিস-রাজ কাপুরের সেই প্রেম আর প্রেমহীনতার কিংবদন্তী রোম্যান্সগাথা ‘আওয়ারা’।
ট্রেড-বিশ্লেষক, পণ্ডিতরা, মাল্টিপ্লেক্স চেইনের মালিকপক্ষ বলছেন, নস্টালজিয়া! নস্টালজিয়া! জিয়া নস্টাল, হিয়া টুপটাপ— স্মৃতিমেদুরতার বানভাসিরাই নাকি রি-রিলিজের লাইফবোটে ভিড় জমাচ্ছেন! সেই কোন কিশোরবেলায় ম্লান-নিভু নিভু কোনও সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমাঘরে দেখা। ঘাড়ের ওপর একগাদা বন্ধু, স্যাঁৎলা-পড়া বড় পর্দা, ঘর্ঘর-ঘ্যানঘ্যানে শব্দব্যবস্থার অত্যাচার! পর্দার ড্যাম্প-পড়া মেঘ বা মানচিত্রের ছায়া নায়িকার চাঁদমুখে! তার বদলে প্রাণের মানুষটির সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্সের ঝকঝকে পর্দা, ফোর-কে প্রোজেকশন, পর্দায় একটা আলপিন গড়িয়ে গেলেও শোনা যাবে এমন অ্যাকোয়াস্টিকস— পুরনো স্মৃতিকে নতুন উত্তাপে সেঁকে-টেকে তাজা করে দেবে। রি-রিলিজের সাফল্যের এটা একটা কারণ হতেই পারে। মাল্টিপ্লেক্স-মালিকদের আরেকটা যুক্তিও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। লোকে ‘কমিউনিটি ফিলিং’, একটা সর্বজনীন অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য পুরনো ছবি দেখতে হলে ভিড় জমাচ্ছেন! কোনও পুরনো হিট গান বা খুব পছন্দের কোনও সংলাপের মজা সিনেমাঘরের অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ারও একটা আকর্ষণ থাকতে পারে।
অতিমারী আমাদের সিনেমাহল থেকে বিচ্ছিন্ন করে টেলিভিশন, কম্পিউটার বা মুঠোফোনের এক টুকরো পর্দায় মুখ গুঁজতে বাধ্য করেছিল। এবার হয়তো তার পালটা বদলা বা ‘ব্যাকলাশ’ শুরু হচ্ছে। দিনের যে-কোনও সময়ে, যে-কোনও সাইজের পর্দার সামনে ছবি দেখতে একলা বসে পড়ার অভ্যেস ছিঁড়েখুঁড়ে, ফাটিয়ে, সমবেত মানুষ হয়তো তাই বড় পর্দার ছবির পুনর্মুক্তির উদযাপনে সামিল হচ্ছে। বাংলা সিনেমাও সেখানে পিছিয়ে থাকছে না। ইতিমধ্যেই সত্যজিৎ প্রণীত উত্তমকুমারের ‘নায়ক’ মুক্তি পেয়েছে। টালিগঞ্জের তথাকথিত বাণিজ্যিক মূলধারার সম্পূর্ণ সাজাপ্রাপ্তির এই টালমাটাল সময়ে উত্তমকুমার তাঁর নায়িকাদের সঙ্গে কবে বঙ্গজ সিনেমা উদ্ধারে নামবেন? ১৯৮০-র পরে আরও একবার?