আড্ডা ভ্রাম্যমান
আজ বাঙালি আড্ডা মারতে ভুলে গেছে। ব্যাঙ্গচিত্রী চণ্ডী লাহিড়ী, এই আড্ডা মারার বিষয়টা খুবই অপছন্দ করতেন। বলতেন, সময় নষ্ট। সময়কে মূল্যবান করার ক’টা উপায় আবিষ্কার হয়েছে? তা আর জানা যায়নি। তার জন্যও তো সময় নষ্ট করতে হয়। সময়কে আমরা নানা ধরনে ভাগ করেছি, কাজের সুবিধের জন্য। এর মধ্যে আড্ডার কোনও জায়গা নেই। আড্ডা হচ্ছে এমন এক বিষয়— যেখানে সময়জ্ঞান থাকে না। সময়কে তখন মাপাও যায় না। সময় যেমন তরতর করে বয়ে যায়, এ তেমনই।
বাঙালির আড্ডা, নির্ভেজাল আড্ডা। রায়সাহেব খুব আড্ডা দিতে ভালবাসতেন। ভূতে বিশ্বাস করতেন, অন্তত অবিশ্বাস করতেন না, শুনেছি। ম্যাজিক জানতেন। ঘরোয়া নানা খেলা জানতেন। যেমন, মেমরি গেমস, ইত্যাদি। এসব আড্ডা থেকেই হয়তো সংগ্রহ করতেন। কবি উৎপলকুমার বসু বুকপকেটে একটা ছোট্ট নোটবুক রাখতেন। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে বেশ আড়াল করে প্রায় গোপনে কিছু লিখে রাখতেন। হয়তো কবিতার রসদ, কবিতার লাইন অথবা কোনও সংকেত!
আরও পড়ুন : লেখকরা ছুটি নিয়ে লেখালিখি করলে তা আর ছুটি হল কই? লিখছেন প্রচেত গুপ্ত…
রায়সাহেব এত আড্ডাপ্রিয় ছিলেন যে, শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ সেই আড্ডা নিয়েই দীর্ঘ চর্চা ঢুকিয়ে দিলেন। রবি ঘোষের মুখে এই প্রসঙ্গ টানলেন। উৎপল দত্ত বিরুদ্ধে গেলেন। আড্ড জমে উঠল। বিরুদ্ধতা করার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। কারণ একটা বিশেষ সংলাপে ওঁকে বসতে হবে, সংলাপকে বৈশিষ্ট্য দেওয়ার জন্য। বললেন, ‘আমি বাঙালির আড্ডাকে ছোট করছি না’, তার আগে অনেকে আড্ডা মেরেছেন— প্লেটো, অ্যারিস্টটল এমন মহারথীরা, কিন্তু আজ সবই তো ‘নিম্নগামী’। এই কথা বলতে বলতে নিম্নেই গেলেন, মানে সোফায় বসে পড়লেন। মুখের কথা আর শরীরের ভাষা মিলে গেল।
সত্যিই আড্ডা মারতে মারতে শরীর নানা ভঙ্গি করে। কেউ বিছানায়, বা ফরাসে এলিয়ে পড়ে। তখনই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র মতো, ঘরে বালিশ আনতে ছুটবেন শুভেন্দু, কাবেরী বসুর জন্য। যার পরিণতিতে তাঁদের একটা প্রেম-দৃশ্য ঘটে যাবে বন্ধ দরজার ওপারে। শুভেন্দুর হাত নিজের স্তনের উপর রাখতে যাবে কাবেরীর চরিত্র, বুকের ধড়ফড়ানি বোঝানোর জন্য।
এভাবেই আড্ডা এগোয়। গসিপ এগোয়। গসিপের জন্ম হয়, দরজা বা দেওয়ালের ওপারে।
কেউ কেউ সটান-সিধে বসে আড্ডা মারতে ভালবাসে। আড্ডা যত এগোয়, শরীর তত শিথিল হয়। স্নায়ুগুলো দুর্বল হতে থাকে। মনটা হালকা হয়ে ঘরের সিলিংয়ে গিয়ে আটকে যায়। আমরা বলি ‘বোয়্যান্সি’। ভাসমান মন। আড্ডার বিষয় ঘুরে যায়। তাতে সামান্য যৌনতা ঢোকে। মনে পড়ল, কখনও কখনও, উৎপলদা অধৈর্য হয়ে বলে উঠতেন, আরে অনেকক্ষণ কবিতা চর্চা হল, একটু নিন্দেমন্দ না করলে, সব বড্ড জোলো আর পানসে লাগছে।
ওঁদের খুব প্রিয় বিষয় ছিল, শঙ্খ ঘোষের সমালোচনা। ডাঃ ভূমেন গুহ, কবি, প্রচণ্ড রেগে যেতেন, কারণ শঙ্খদা ওঁর প্রিয় মানুষ ও কবি। একবার এমন আড্ডায়, আইনস্টাইন চলে এলেন। মাঝখানে এসে বসলেন। ভূমেনদা পক্ষে, আর উৎপলদা বিপক্ষে। কারণ উৎপলদা টেনে এনেছেন সত্যেন বোসকে। কী এক বোস-আইনস্টাইন ঝগড়া বা বড়দের ডিসকোর্স হয়েছিল— তা নিয়ে তুমুল বিবাদ। বেচারা পার্বতী মুখোপাধ্যায় ঘটনাচক্রে উৎপলদাকে সমর্থন করে ফেলেছেন, টের পেলেন রাতে। কেচকী, পালামৌ-এর ঠান্ডায় আমরা গিয়েছিলাম একসঙ্গে। মাঝরাতে লেপ কেড়ে নিলেন, পাশে শোয়া ডাঃ ভূমেন গুহ। চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, উৎপলের দলে ভেড়া? ঠান্ডায় কাঁপুন, তবে আমার শান্তি হবে। আমরা জানি কেন পার্বতীদা উৎপলকুমার বসুকে সমর্থন করেছিলেন। উৎপলদার প্রতি ওঁর বিশেষ দুর্বলতা ছিল। খুব মানতেন। তার মধ্যে পাড়ার লোক। রোজ সন্ধেটা মনোরম কাটে। সুখে-দুঃখে। দু-জনেই বয়স্ক। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। যদিও উৎপলদা মজা করে বলতেন, ‘শোনো, তোমরা কিন্তু, পার্বতীর কথা একদম বিশ্বাস ক’রো না। ও প্রচণ্ড গুল মারে, বানিয়ে বানিয়ে তিলকে তাল করে।
একথার সমর্থন পাওয়া গেল এক সন্ধ্যায় ওঁর স্কুলের বন্ধুদের কথায়। তারা আমাকে বলে ওঠে, ‘আপনারা পার্বতীর কথা বিশ্বাস করেন? ও কিন্তু প্রচণ্ড মিথ্যে কথা বলে।’ উনি তো অপ্রস্তুত। আমরা খুব মজা পাচ্ছি। আসলে ওঁর ওই বাড়িয়ে বলা-বানিয়ে বলার জন্য, কারও কোনও ক্ষতি হয়নি কখনও। হার্মলেস লাইজ।
‘আগন্তুক’-এর সেই দৃ্শ্যে রবি ঘোষ বলে উঠলেন উৎপল দত্তকে, ‘এই একটা জিনিস আপনি বিদেশে কোথাও পাবেন না… আড্ডা। যেটা না করলে বাঙালির ভাত হজম হয় না।’ উৎপল দত্ত নানা কথার মারপ্যাঁচের পর শেষ অস্ত্র ছাড়লেন— তা যদি হত তবে, রবীন্দ্রনাথও আড্ডা দিতেন। রবি ঘোষ একেবারে ব্যাকফুটে চলে গেলেন। বেশ ঘাবড়ে গিয়ে, মাথা নেড়ে বললেন, ‘তাই তো! রবীন্দ্রনাথ কি আড্ডা দিতেন?’
রবীন্দ্রনাথ আড্ডা দিতেন কি দিতেন না— তাই নিয়েও আড্ডা হয়। আসলে আড্ডা একটা মানসিক অবস্থান। সবসময় আড্ডার মুড বা মন থাকে না। সব মানুষ, আড্ডা-লগ্নে জন্মায়নি। আবার বহু মানুষ সারাজীবন শুধু আড্ডাই দিয়ে গেলেন। কলম ধরলেন সামান্য। বলতে লাগলেন, লিখলেই কথার প্রাণ চলে যাবে। কথা, কথা আর কথা। কাপের পর কাপ কালো কফি আসছে, কেউ একজন জয়েন্ট বানিয়েই চলেছে, গাঁজার গন্ধে ঘর ম-ম করছে, সে এক মহা ভুরিভোজ! রায়সাহেবের আড্ডায় এসব পাওয়া যাবে না। একবার কমলকুমার মজুমদারকে উনি অনুযোগের সুরে বলেন, ‘আপনি তো আমাদের আড্ডাতে একেবারেই আসেন না।’ কমলকুমারের তৎক্ষণাৎ উত্তর, ‘ও বাবা, ওখানে,বড় বড় লোকের আনাগোনা, ওখানে আমি?’ রায়সাহেবও কম যান না। সুকুমার পুত্র! বলে ওঠেন, ‘খবর দিয়ে আসবেন, আমি কিছু ছোটলোক নিয়ে এসে রাখব।’
আমাদের ঘরোয়া আড্ডায় এত বিভাজন ছিল না। বয়সেরও কোনও বাছবিচার ছিল না। যদিও দীপকদা কিছু কবিকে ঢুকতে দিতেন না। উনি হঠাৎ-হঠাৎ ছাঁকনি বের করতেন। অনেকেই ভয় পেত।
দীপক মজুমদার যে কী জিনিস— তা আমি সবচেয়ে বেশি টের পেয়েছি। আমার মধ্যেও উনি ঢুকে পড়েছেন। কিছু বদগুণ এসে গেছে। আসলে এই ভয়ংকর অ-সংস্কৃত পরিবেশে, আত্মরক্ষার জন্য একটা-দুটো দীপক-সন্দীপন-সুবিমল লাগে।
আমাদের আড্ডায় বহু বিচিত্র মানুষ আসতেন। দর্শনের মাধব মিত্র, অঙ্কের মিহির চক্রবর্তী, শিল্পী প্রকাশ কর্মকার, রবীন মন্ডল, বিজন চৌধুরী, ডাঃ-কবি ভূমেন গুহ, কালীকৃষ্ণ গুহ, নমিতা চৌধুরী, অনুরাধা মহাপাত্র, ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না, গল্পকার তপনকর ভট্টাচার্য, শিল্পী দীপ্তেশ ঘোঘ দস্তিদার, সুদেষ্ণা, প্রবীর, উৎপলকুমার বসু, হেডমাস্টার। একবার গৌরক্ষ্যাপা বাউলকে নিয়ে গৌতম মহীন চ্যাটার্জি চলে এল, আড্ডার চেহারা পাল্টে গেল। আমিই একমাত্র ছবির তাড়া বগলদাবা করে নিয়ে যেতাম ওই আড্ডায়। চা ছিল মূল পানীয়, তবে রাম-হুইস্কির ব্যাবস্থা থাকত, চাঁদা তুলে।
আমার সাম্প্রতিক ঘরোয়া প্রিয় আড্ডা হয়ে উঠেছে, প্রচেতা ঘোষ, ওরফে লালা, তাপস ঘোষ, মানস ভট্টাচার্য-র সঙ্গে। পর্যাপ্ত মদ, মানে হুইস্কি বা ঠান্ডা বিয়ার, খাদ্য, লালা, মানস সঙ্গে করে আনে। মানসের গিন্নি চিকেন রেঁধে পাঠায়। প্রাইভেসির জন্য নামটা দিলাম না। কিন্তু আমরা প্রতিবার দূরভাষে তাঁর রান্নার প্রশংসা করতে ভুলি না। তিনি অপর প্রান্তে বেশ খুশিই হন, মনে হয়। অনীতা মাঝে মাঝেই যোগ দেয়। তবে এই আড্ডায় যাঁরা আসেন, অতিথি উপস্থিতি হিসেবে, তাঁদের মধ্যে মার্কেজ থেকে মুরাকামি, সন্দীপন, সুবিমল তো পাকাপাকি আছেন। শিল্পীদের মধ্যে পিকাসো, দালি জমিয়ে দেন। দু-চার পেগ চড়ে গেলে আমার গলাও চড়ে যায়। ছবি নিয়ে বড় বড় কথা বলি। মুজিব দু-একবার ঢুকে পড়ে। সেদিন বেশ রঙিন হয়ে ওঠে আড্ডা, কারণ মুজিব বেশ চঞ্চল। ও স্থির থাকতে পারে না। ভিডিও করে। রানিং কমেন্ট্রি করে। মনে ধারাবিবরণী। তা ফেবু-তেও যায়। গল্প, কবিতা, ছবি, নাটক, চলচ্চিত্র— সবই ঢুকে পড়ে। মানসের কাগজ-আপিসের গল্প আর আফ্রিকা তো থাকবেই। আর থাকবে একটা চামচ। এটা পড়ে নিশ্চয়ই সবার কৌতূহল হচ্ছে, চামচ? হ্যাঁ, মানসের কফি-তে চিনি লাগে। এবং তার জন্য একটি চামচ। খাওয়াদাওয়ার জন্য চামচ অপরিহার্য। কোনওদিন পানীয় একটু বেশি হত। সবার পা টলমল। আমি আর রাতের আহার না নিয়ে সটান বিছানা। নেশা কমে এলে মাঝরাতে মশারি টাঙাতে হত। গিন্নি হোস্টেলে থেকেছে। রুমমেট মশারি টাঙিয়ে ওর অভ্যাস এমন করেছে, বাকি জীবন আর মশারি টাঙাবে না ঠিক করেছে। আমি যতদিন আছি, মদের ঘোরেও মশারি টাঙাব— ঠিক করে রেখেছি।
আড্ডা আমাদের প্রাণ। আমরা কি এইভাবে বাঙালি হয়ে উঠতে পারব?
তবে আজকাল আর তেমন আড্ডা মারার সুযোগ হয় না। কেউ তেমন আসে না। আট-নয়ের দশকে প্রচণ্ড আড্ডার বন্যা বইত। সময়টা অন্যরকম ছিল। সকাল-বিকেল, রাত গড়িয়ে যেত। সেই স্বর্ণযুগ আর নেই। দেশের বাড়িতে পাঁচের দশকে আড্ডার তোড় দেখেছি। বড়দের আড্ডা, মেয়েমহলের আড্ডা, বুড়োদের আড্ডা, মায়েদের আড্ডা, কাজের লোকের আড্ডা, গাঁজাড়ুদের আড্ডা, দেশি মাতালদের আড্ডা। আমি এই সবের মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম। অবাধ গতিবিধি ছিল আমার। কেউ আমাকে মানুষ বলে মনে করত না বলে, আমি ছায়ার মতো হেঁটে বেড়াতাম। কেউ আমকে তাকিয়ে দেখত না। আমি অদৃশ্যই রইলাম। মনে মনে আড্ডা চলল।
বিদেশে, লন্ডনের পূর্বপ্রান্তের রাশিয়া লেনের, অরুণ হালদারের দোতলার ঘরে জমজমাট আড্ডা বসেছে নয়ের দশকে। মধ্যমনি অরণেন্দুদা। বিই কলেজের প্রাক্তনী। স্থপতিকার। গান বেঁধেছেন বহু। তা বেশ বিখ্যাত। বহুদিন লোকে জানতই না, এগুলো, কার লেখা? সবাই মঞ্চে উঠে অবলীলায় গেয়ে যেত, স্বীকৃতি না দিয়ে। মহীন, গৌতম প্রথম গানগুলো নিয়ে ক্যাসেট করে, তখন সবাই প্রকাশ্যে জানতে পারে। সেই অরুণেন্দুদা গিটার নিয়ে এসে গান ধরেছেন। নিজের লেখা, নিজের সুর দেওয়া, গলার আওয়াজটা বেশ মিহিমতো, ঠিক বাঁশপাতার বাঁশির মতো। বহুকাল পরে যাদবপুরে একবার-মাত্র মঞ্চে তুলতে পেরেছিলাম। কিছুকাল আগে প্রয়াত হলেন। আড্ডার সঙ্গে গান, আমার ডেরায়, রাতভর হয়েছে— যতদিন গৌতম বেঁচে ছিল। গানে ভুবন ভরিয়ে দেব গোছের ব্যাপার।
আড্ডা ভ্রাম্যমাণ। ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আজ এখানে, কাল শান্তিনিকেতন, পরশু ল্যাডলীর আখড়া, সোনাঝুরি ছাড়িয়ে। কখনও ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে, কখনও কার্জন পার্কের ঘাসে। গঙ্গার ধারে, অথবা,ভাসমান ক্রুজে। আবার ভয়ংকর সুন্দরবনের বাঘের ডেরায়, নদীর ধার ঘেঁষে মাঝরাতে, পুরুষ-মহিলা-পরিবৃত হয়ে। আড্ডায় হাসির ফোয়ারা। বাঘ পালিয়ে বাঁচে।
শিল্পীদের আড্ডা বসত ছয়ের দশকে, দক্ষিণে সুতৃপ্তিতে, উত্তরে বসন্ত কেবিন, কফি হাউসে, মধ্য কলকাতায় বরিশালে। বারদুয়ারি বা খালাসিটোলা ঠিক এই তালিকায় পড়ত না। তার উত্তাপ ভিন্ন। শান্তিনিকেতনের কালোর দোকানকে এই তালিকায় রাখা যায়। তেমনই সাংবাদিকদের ডেরা, বা প্রেস ক্লাব, যেখানে আমরা মদের চাট হিসেবে আড্ডাকে ব্যবহার করতাম।
এই গল্পের শেষ নেই! তাই আজ এই পর্যন্তই থাক!