আঠারো শতকের অন্তিমভাগ, আরও স্পষ্ট করে বললে, ১৭৮৪ সাধারণাব্দ। প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম জোন্স-এর হাতে কলকাতায় গড়ে উঠল ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’। প্রাচ্যভূমির জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সংগঠিতভাবে বোঝার জন্যই এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। এখন সেই বোঝাপড়ায় উপনিবেশের স্থায়িত্বের পরিকল্পনা নানা শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়ে ছিল নিশ্চয়ই। আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে মিলে ছিল খ্রিস্টধর্মের ভূত। সাধে কি আর ২৩ অক্টোবর, ১৭৮৬ নাগাদ ওয়ারেন হেস্টিংস-কে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন জোন্স: ১৭৮৫-তে প্রকাশিত চার্লস উইলকিন্স-এর ইংরেজি অনূদিত ‘গীতা’ পড়ে মন মজলেও রয়ে যায় টুকিটাকি আপত্তি। হতে পারত, অনুবাদ আরও আক্ষরিক, প্রয়োজন ছিল শ্লোকের সংখ্যা নির্দেশ। লিখিত সংস্কৃত বাণী বাঁকাছাঁদের অক্ষরে ছাপানো দরকার ছিল, যেমনটা খুব সুন্দরভাবে ‘বাইবেল’-এর অনুবাদ রয়েছে। জোন্সের বিচারে ছাপা বই হিসাবে ‘গীতা’ সম্পূর্ণ হতে পারত, যদি তা আক্ষরিকভাবে ‘বাইবেল’-এর মুদ্রিত রূপের অনুরূপ হত। ছাপাই পুস্তকের আদর্শ নিদর্শন হিসেবে বাইবেলের সাক্ষ্য পেশ এবং ‘গীতা’-র সঙ্গে আন্তঃসম্পর্ক গড়ার চাহিদা বোঝাতেই ‘খ্রিস্টধর্মের ভূত’ কথাটি ব্যবহার করা।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুঁথি সংগ্রহের ইতিহাসে এশিয়াটিক সোসাইটি বা জোন্সের জরুরি অবদান রয়েছে। ওপরের গৌরচন্দ্রিকা লেখার অর্থ, মনে করিয়ে দেওয়া— পুঁথি যতই অতীতের বস্তু হোক না, তাকে সংগ্রহ এবং চর্চার মধ্যে আধুনিক ঔপনিবেশিক ক্ষমতাতন্ত্রের সবিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাহলে কি বলতে চাইছি, ব্রিটিশ উপনিবেশ জাঁকিয়ে বসার আগে, পুঁথি সংরক্ষণ বা চর্চা হত না? না, এমনটা একেবারেই নয়। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি থেকে সপ্তদশ শতকের গোড়া পর্যন্ত বিষ্ণুপুর তথা মল্লভূমে বীর হাম্বিরের রাজদরবারে পুঁথি সংগ্রহের বন্দোবস্ত ছিল। একইভাবে বলা চলে, কোচবিহার রাজপরিবার পুঁথি সংগ্রহের বড় আড়ত। বিশেষত, রাজা নরনারায়ণ-এর (১৫৩৩-১৫৮৭ সাধারণাব্দ) আমলে এই শ্রীবৃদ্ধি নজর কাড়ার মতো। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রখ্যাত কবি শঙ্করদেব নরনারায়ণের সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। অতঃপর প্রশ্ন এই, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এশিয়াটিক সোসাইটির পুঁথি সংগ্রহের ধরনটা ঠিক কোথায় আলাদা হয়ে উঠল? এই পৃথকত্বের নানা মাপকাঠি আছে। আপাতত, একটির দিকে নজর দেওয়া যাক।
আরও পড়ুন : হিন্দু-ব্রাহ্ম বাঙালিদের মধ্য়ে খ্রিস্টধর্মর প্রভাব পৌঁছল কী করে?
২০ ফেব্রুয়ারি, ১৭৯৪ সাধারণাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটির একাদশ অভিভাষণে বলবেন জোন্স: ‘আয়ুর্বেদ’ নামক গ্রন্থটি প্রায় বিলুপ্ত। এই হারিয়ে যাওয়া কৌতূহলী ইউরোপিয়ানদের (‘curious European’) জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও ‘হিন্দু’-দের জন্য ব্যাপারটা বেশ ভালই হয়েছে। দৈবপ্রত্যাদিষ্ট জ্ঞান উন্নতির পক্ষে বিশেষ বাধা। ভাল-মন্দের তফাতটা আক্ষরিকভাবেই গড়ে উঠছে কে শাসক আর কে শাসিত— তার নিক্তিতে। সোজা কথায়, জোন্স বলতে চাইলেন, পুরনো দিনের পুঁথিপত্র আর এসবের চর্চা বাপু সাহেবদের জন্য। নেটিভ প্রজা আগে এসব দৈবটৈবর শেকল ছেড়ে বেরক, তারপর না হয় দেখা যাবে। ঠারেঠোরে মোদ্দাকথা এই: আঠারো শতকের অন্তভাগে উইলিয়াম জোন্সদের হাতে যে নতুন ইতিহাসবিদ্যার পত্তন হচ্ছিল, উপমহাদেশে তা চর্চার অধিকারী কে হবে— এই প্রশ্নে উত্তরের ঝোঁকটা ‘ইউরোপিয়ানদের’ দিকেই হেলে ছিল।
পুঁথিপত্রের সঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটির পণ্ডিতদের যে সম্পর্ক, তার সঙ্গে দৈনিক বোঝাপড়ার যোগ ছিল না। ভারতের নানা জ্ঞানবিজ্ঞানের শাখা বিষয়ে তাঁদের উৎসাহের অন্ত ছিল না, কিন্তু সেই আগ্রহ মৃতদেহে ধূপ-চন্দনের সুবাস আর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বছর বছর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মতো। এই প্রাণহীনতার বড় সাক্ষ্য আঠারো শতকের প্রাচ্যবাদীদের যৌনতা বোঝার প্রক্রিয়া। আস্তিক্য-পরম্পরার কামের দেবতা মদনকে নিয়ে জোন্সের আগ্রহ। সে আগ্রহ শুধু জানাবোঝা নিয়ে নয়— তার সঙ্গে জুড়েছে সৃষ্টির আনন্দ। মনসিজ-কে নিয়ে একটি স্তোত্র রচনা করেন জোন্স। অতঃপর ৬ জানুয়ারি, ১৭৮৪ নাগাদ কামদেবের উদ্দেশে লিখিত স্তোত্রের খসড়ারূপ চার্লস উইলকিন্সকে পাঠালেন সংশোধনের জন্য। স্তোত্রটি পড়লে বোঝা যায়, অনঙ্গদেবের ইতিহাস তথা পরিচিতি নিয়েই জোন্সের যাবতীয় আগ্রহ। সেটা মদন, মায়ার সন্তান হোক বা অন্য কিছু।
জোন্সের চিন্তা থেকে যা হারিয়ে যায় তা হল— কামশক্তি। যৌনজ্বালা কেমন, এই আপাত নিরীহ প্রশ্নটি যত সহজ মনে হয়, আখেরে তা কিন্তু নয়। চতুর্থ থেকে পঞ্চম সাধারণাব্দের কবি কালিদাস-এর ‘অভিজ্ঞান-শকুন্তলম্’ নাটকে মিলবে ‘কাম’ বিষয়ে অনুসূয়া, প্রিয়ংবদা এবং শকুন্তলার কথোপকথন। সখী অনুসূয়া শকুন্তলার উদ্দেশে বলবে: “মদনের ব্যাপারে আমরা কিছু-ই বুঝি না। কিন্তু ‘ইতিহাস-কাহিনিতে’ ‘কামার্ত’ মানুষের যেরূপ অবস্থার কথা শুনেছি, তোমার অবস্থাও ঠিক তেমন। এখন বল; কার জন্য তোমার এই জ্বালা?” কামার্ত মানুষের অবস্থা চিনতে অনুসূয়া-র ‘ইতিহাস-কাহিনি’-র শরণ খেয়াল করার মতো। প্রাক-ঔপনিবেশিক চিন্তায় ‘ইতিহাস’ অর্থে, সাধারণত ‘মহাভারত’ এবং ‘রামায়ণ’-কে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। কালিদাসের কথা এই জন্যই বললাম যে, আশ্রমকন্যারা কামজ্বালা-কে বৌদ্ধিক পথেই চিনেছেন। জোন্সের বৌদ্ধিক বীক্ষায় কামের স্থান রইলেও ‘কামজ্বালা’-র প্রশ্নটি প্রায় বাতিলের পর্যায়ে।
এই বাতিলের বড় কারণ, ‘ইতিহাস’-এর কঠিন দাঁড়িপাল্লায় ‘কাম’-কে বারে-বারে যাচাই করে যাওয়া। ‘যৌনজ্বালা’-কে যথাযথভাবে আধুনিক যুগে বোঝার অন্যতম কারিগর অস্ট্রিয়ান মনোবৈজ্ঞানিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত ‘Totem and Taboo’ গ্রন্থে ‘social anthropology’-সঙ্গে কথোপকথনে নামলেন ফ্রয়েড। আদিম যুগের অজাচার-ভীতিকে বুঝতে নৃ-বিজ্ঞানীরা পাড়ি দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সমাজে। নিকট-আত্মীয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক যেন মূর্তিমান ত্রাস প্রাচীন সমাজের অনাচেকানাচে। এমন সম্পর্ক গড়লে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শাশুড়ি-জামাইয়ের মেলামেশা বা পুত্রবধূ ও শ্বশুরের আলাপ-সালাপ আরও নানান সম্পর্কে যতই যৌন উদ্বেগ খোঁজে পান নৃ-বিজ্ঞানীরা, ‘কামনা’র প্রশ্নটি নিথর শবদেহ। কামের প্রাণশক্তির জাগরণ ঘটে, যখন ফ্রয়েড নৃ-বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন ‘psychology of neurotics’। বলা চলে, ‘libido’ প্রশ্নটির পুনর্বিচারের মাধ্যমেই ‘কামশক্তি’-কে সামনে আনলেন ফ্রয়েড।
ইতালিয়ান চিন্তাবিদ Giorgio Agamben তাঁর ‘Nudities’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ধর্মতাত্ত্বিক সেইন্ট অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০ সাধারণাব্দ)-এর চোখে ‘libido’ পাপের প্রধান সহচর। ‘spirit’-এর বিরুদ্ধে ‘libido’-র অবস্থান। শারীরিক কামনা-বাসনায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার সঙ্গেও রয়েছে ‘libido’-র কারসাজি। অগাস্টিনদের নেতির বৃত্ত থেকে ‘libido’-র পুনর্বিচারে ফ্রয়েডের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অগাস্টিন ‘libido’ বলতে যা ভেবেছিলেন, আর ফ্রয়েড ‘libido’ বলতে যা বুঝলেন— দুয়ের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় ‘libido’-র বাংলা পরিভাষা করেছেন ‘যৌন-তাড়স’। আলাদা করে পরিভাষার খোঁজ শিবাজীর আগ্রহ নয়, বরং দেশীয় শব্দভাণ্ডারে ছড়িয়ে থাকা নানা যৌনতা-বিষয়ক শব্দসন্দর্ভকে পাশ্চাত্য তত্ত্বভুবনের পাশাপাশি রাখেন তিনি। যৌনতা-বিষয়ক বিলাতিয়া নানা শব্দকে যদি বাংলা শব্দের সঙ্গে সাজিয়ে একটি তালিকা গড়েন শিবাজী, তবে তা দেশী ভাষায় যৌনতা-চর্চায় তা বিশেষ আলো ফেলবে।
এশিয়াটিক সোসাইটির পুঁথি সংগ্রহের তালিকা, তার ধরন বিষয়ে বিস্তারে আলোচনা করেছেন গৌতম ভদ্র, ‘ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার?’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে। এশিয়াটিকের পুঁথি সংগ্রহের দুই বাঙালি কান্ডারি ছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তাঁরা যেমন করে পুঁথি তালিকা বানিয়েছেন কিংবা প্রতিবেদন লিখেছেন, সেখানে রয়েছে বিশেষ বর্গ তৈরির ঝোঁক। ৩১ ডিসেম্বর ১৯১১ নাগাদ ‘Asiatic Society of Bengal’-এর ‘Honorary Secretary’, G. H. Tipper-কে লিখিত প্রতিবেদনে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে সব বর্গের চিরুনিতল্লাশি করেন, তার কয়েকটি: ‘Astronomy’, ‘Mimamsa’, ‘Grammar’, ‘Upanisads’, ‘Naya’, ‘Vedanta’, ‘Samkhya’, ‘Yoga’, ‘Kavya’, ‘Rhetoric’, ‘Purana’, ‘Tantra’, ‘Medicine’, ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, এইসব প্রতিবেদনের লিখিত ভাষা ইংরেজি ছিল। আঞ্চলিকতার গুরুত্ব ছিল না এমন নয়, কিন্তু তাকে এক সূত্রে বাঁধাই ছিল মূল লক্ষ্য। হরপ্রসাদের কালে পুঁথি সংগ্রহের জন্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা পাড়ি দিতেন বারাণসী, পুরী, নেপাল, মিথিলা, বিহার— আরও কত কত জায়গায়। ওড়িশায় পুঁথি খুঁজতে যাওয়ার নানা কারণের মধ্যে একটি ছিল, বেদ সংগ্রহ। ৩১ জানুয়ারি, ১৯০৬-এর প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেই লিখেছেন হরপ্রসাদ: বাংলায় বেদের পুঁথি মেলা বিরল ব্যাপার হলেও ওড়িশাতে বিষয়টা একেবারেই তেমন নয়। বৈদিক সংস্কৃতির নানা আচার-অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা যথাযথভাবে পালন করে থাকেন সেখানে।
এই নানা ধারার ভিড়ে মিশে ছিল আদিরসাত্মক পুঁথির সংগ্রহ। ওই যে ‘কামজ্বালা’-র কথা আলোচিত হয়েছিল পূর্বে, সেই ‘যৌনজ্বালা’-র সঙ্গে মিশে আছে আদিরসাত্মক পুঁথির ভাঁড়ার— এমন ভাবলে ভুল হবে। বরং বিচার করলে আদিরসাত্মক পুঁথির বড় একটি অংশই যৌনজ্বালার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছে। অধিকাংশ আদিরসের পুঁথিতে নায়ক-নায়িকার শ্রেণিবিচার, কোন নায়কের সঙ্গে কোন নায়িকার মিলন হওয়া উচিত— ইত্যাদি উপদেশাত্মক বাণীর রমরমা। ‘কামজ্বালা’ বিষয়ক প্রতর্কের জরুরি ব্যতিক্রম ‘কুট্টনীমতম্’। ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত খোঁজ করা পুঁথির এক প্রতিবেদনে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সোসাইটির Honr. Secretary, T. H. Holland-কে জানিয়েছিলেন ‘কুট্টনীমতম্’-এর আবিষ্কারের খবর। ১৮৯৭ নাগাদ নেপাল থেকে হরপ্রসাদ-সংগৃহীত এই পুঁথির হরফ ছিল বাংলা। ‘কুট্টনীমতম্’- এর কবি ভট্ট দামোদর গুপ্ত কাশ্মীররাজ জয়পীড় বিনয়াদিত্য-র (৭৭৯-৮১৩ সাধারণাব্দ) মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ‘কুট্টনীমতম্’-এর পাতায় ঘুরেফিরে যে প্রশ্নটি আবর্তিত হয়েছে, তা হল, ‘কামজ্বালা’-র স্বরূপ কেমন? উত্তরের অনেকগুলি বাঁক রয়েছে। কিন্তু একধরনের ‘কামজ্বালা’ হয়, যা গড়ে তোলা। যা নির্মাণের জন্য যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়। ‘কুট্টনীমতম্’ গ্রন্থের কর্তাসত্তা যাদের হাতে রয়েছে, তাঁরা মহিলা। আপাত-অর্আপাতঅর্থে,রূপটি গণিকা মারফত প্রতিফলিত হলেও নারীর ক্ষমতায়নের বয়ান পাতায়-পাতায় ফুটে উঠেছে। ‘কামজ্বালা’-র দুনিয়া গড়তে চাই যোগ্য দূতী। যে হবে কথায় চৌকস। গণিকা মালতী যে পুরুষটিকে অধিকার করতে চায়, তার কাছে হাজির হয়েছে করিতকর্মা দূতী।
কামোদ্দীপক বাক্যের পসরা সাজিয়ে যুবকের মনে বসন্তের রঙ লাগানো চাই। মনে হতে পারে, রসালো কথা বলা— সে এমন কী কঠিন কাজ! কিন্তু এই কথা শুধুই কথা নয়, এর সঙ্গে জুড়ে আছে পারফরমেন্স। কামোদ্দীপনের দুনিয়া গড়তে দূতীর অভিনয়-ক্ষমতা কার্যকর ভূমিকা নেয়। দূতী যেমন করে বাক্য-সহযোগে ‘কামজ্বালা’-র মুলুক গড়ে, তার সংক্ষিপ্তসার: [১] মালতীর অতিবিশাল নিতম্ব যেন স্বয়ং মদনের বাসগৃহ। এই নিতম্ব দেখলে কপিল মুনিরও তপস্যা ভঙ্গ হবে। [২] মালতীর ঊরু! সে তো অপ্সরা রম্ভার মতো। দেখলে স্বয়ং মদনদেবেরই অবস্থা খারাপ হবে। [৩] ভাগ্যিস মালতী এখনও কুমার কার্তিকের চোখে পড়েনি, নাহলে কোথায় থাকত কার্তিকের ব্রহ্মচর্য। [৪] স্বয়ং মধুসূদন যদি মালতীকে দেখেন, তাহলে তাঁর মনে হবে বক্ষলগ্না লক্ষীকে বৃথাই বয়ে চলেছেন।
‘কামজ্বালা’ গড়ে তোলার এই পথকে আজকের নৈতিকতা দিয়ে বুঝলে চলবে না। প্রাগাধুনিক সমাজকে আমরা সবসময় ঠাকুর-দেবতার আবরণে মুড়ে রাখতে চাই। মানুষ যেন দেবতার পানে কাতর চোখে তাকিয়ে ছিল সর্বদা। কিন্তু অষ্টম-নবম শতকের কবি দামোদর গুপ্ত ‘যৌনজ্বালা’-র প্রশ্নে দেবতা এবং মানুষকে সম্মুখ সমরে দাঁড় করালেন। আমজনতা, মালতী, লক্ষ্মী, মধুসূদন— সবাই এক লক্ষ্যে ধাবিত। মর্ত্যমানুষের যৌনক্ষমতায় দেবতাও ম্লান হয়ে যায়। এই খেলাটা কিন্তু মোটেও একপাক্ষিক নয় যে, শুধু মালতী-কে দেখলে মধুসূদন লক্ষ্মীর কথা ভুলে যাবেন। একইভাবে, সুন্দরসেন নামক এক যুবকের রূপের কথা বলতে গিয়ে দামোদরের বচন: সুন্দরসেনের সোনার ফলকের মতো বিরাট বক্ষ দেখলে নারায়ণের বক্ষস্থিত লক্ষ্মীও নিজের আসন কষ্টকর মনে করতেন।
‘Prosperity of trade’ কথাটির বাংলা পরিভাষা হিসেবে একটি সংস্কৃত শব্দের শরণ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘পণ্যসিদ্ধি’। আপাতত, ‘পণ্য’ শব্দটুকু বাদ দিয়ে, আর একটি নতুন শব্দ গড়া যায়, ‘যৌনসিদ্ধি’। যৌনসিদ্ধি-র মধ্যে যৌনতাকে উদ্যাপনের সংকেত রয়েছে। যৌনসিদ্ধি যৌনসুখের আবহ গড়ে তোলে। যা অপ্রাপ্য, অকল্পনীয়, অগম্য— তার দুয়ারে হাজির করে যৌনসিদ্ধি। ভাষাকে বাদ দিয়ে যৌনসিদ্ধি অসম্ভব। ‘কামজ্বালা’-র বিশ্ব গড়তে ভাষার প্রশ্নটি আদিম ও অনিবার্য।
কিন্তু কামজ্বালা বা যৌনসিদ্ধির প্রশ্নে ‘ভাষা’ বলতে ঠিক কী বলতে চাইছি? ভাষা এক্ষেত্রে শুধুমাত্র বচন নয়। শুধুমাত্র বলা বা না-বলার মধ্যেই আটক নয় ভাষা। ভাষা আপাত-অর্থে, অসংগতিপূর্ণ এককগুলির মধ্যে সম্পর্কসেতু খুঁজে চলে। ভাষা সেই বিশেষ শক্তি, যা দেবতা এবং মানুষের কর্তৃত্ব লোপ করে যৌনসিদ্ধির পতাকা তোলে। ভাষা দৈনন্দিন উপস্থিতির মধ্যেই ভিন্ন এক সময়ঝরনা গড়ে তোলে, যা আত্মসুখের প্রধান আড়ত।
কালিদাসের ‘বিক্রমোবর্শীয়ম্’ নাটকে পুরুরবা যখন পাগল হয়ে উঠেছে ঊর্বশীর জন্য, তখন প্রিয়জন বিদূষক রাজার উদ্দেশ্যে হেসে বলে: ‘অহল্যাকে লাভ করতে উৎসুক ইন্দ্রের সহায় যেমন বজ্র সেইরূপ তুমিও যখন ঊর্বশীর জন্য উন্মত্ত হবে, তখন সহায় হব আমি।’ কার্যত বলতে চাওয়া হল, অহল্যাকে পেতে বজ্র যেমন ইন্দ্রের কোনও কাজে লাগেনি, তেমনই ঊর্বশীকে পাওয়ার পথে বিদূষক আসবে না কোনও কাজে। অহল্যার সঙ্গে ইন্দ্র যেমন করে যৌনসংগমে জড়ায়, তা সামাজিক নৈতিকতায় মন্দ বই আর কিছু নয়। কিন্তু বিদূষক এবং পুরুরবার কথোপকথনে এমন এক নৈতিকতা ধরা পড়ে, যেখানে ইন্দ্রের অহল্যার সঙ্গে সম্পর্ক নেতির বৃত্তে বিবেচিত নয়। বরং শোকে কাতর পুরুরবাকে মানসিক বল দেয় ইন্দ্র এবং অহল্যার গল্প।
বিদূষক পুরুরবাকে যা বললেন, তা ভাষা নয়, ভাষা হল অহল্যা, ইন্দ্র, বিদূষক এবং পুরুরবার আন্তঃসম্পর্কের প্রক্রিয়া। ভাষা এবং কামজ্বালার প্রশ্নটি এক্ষেত্রে নৈতিকতার কোনও চেনা বৃত্তে অবস্থান করে না। তবে এমন ভাবলে ভুল হবে যে, প্রাগাধুনিক রচনাকাররা দেবতা এবং মানুষের যৌনতাকে সর্বদা এক নিক্তিতে মেপেছেন। ঊর্বশীর সন্তান আয়ু-র কথা জানতে পেরে বিস্মিত পুরুরবা বিদূষক-কে বলে, ঊর্বশীর গর্ভলক্ষণের কথা জানা ছিল না তার। মোদ্দা কথা: পুরুরবার সন্দেহ, আয়ু কি আদৌ তার ঔরসজাত সন্তান! বিদূষক রাজার উদ্দেশে বলে: “দিব্যাঙ্গনাদের মধ্যে মনুষ্যধর্ম আশা কর না। তাদের চরিত্র দৈবপ্রভাবে গুপ্ত”। বিদূষক কথিত “মানুষীধম্ম” কথাটির নানা অর্থ থাকতে পারে। একটি সহজ বক্তব্য: দিব্যাঙ্গনা বলেই রাজার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি গর্ভের লক্ষণ। কিন্তু বিদূষকের কথায় আরও একটি বয়ান রয়েছে: যেখানে যৌন সম্পর্কে নীতির প্রশ্নে মানুষ এবং দিব্যাঙ্গনার নৈতিকতার ভিন্নতাকে চিহ্নিত করা হয়। ভালবাসা, যৌনসুখ এবং সন্তানলাভকে এক বৃত্তে ফেলে ভাবনার প্রবণতায় প্রশ্নে তোলে বিদূষক। সন্তান এবং মাতৃত্ব যে প্রেমের প্রশ্নে বড় বাধা হতে পারে তা কালিদাসের বয়ানে স্পষ্ট। পুরুরবা এক হরিণ-হরিণীকে দেখে বলেছিল: “এই হরিণ নিজের প্রিয়া হরিণীর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে, হরিণীও হরিণের দিকে আসছিল কিন্তু স্তন্যপায়ী সন্তানের কবলে বন্দী হয়েছে।” হরিণ-হরিণীর মিলনে সন্তানই বড় বাধা। প্রশ্ন উঠবে, নারী কি সন্তানের এই বাধা ডিঙিয়ে প্রেমিকের দুয়ারে পৌঁছতে পারে? কালিদাস যা-ই বলুন, ‘কুট্টনীমতম্’-এর কবি দামোদর গুপ্ত বলবেন: “অন্তরে প্রেম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে নারীদের অকরণীয় কিছুই নেই। পুরুষবিশেষে আসক্তা সীমন্তিনী, জননী, জন্মস্থান, আত্মীয়-স্বজন, অর্থ এমন কি জীবন পর্যন্ত ঘাসের মতো মনে করে।” সহজ কথা: তেমন প্রেম, আর তেমন পুরুষ হলে সন্তানের আগল ডিঙিয়ে এগতে পারে নারী। এই বয়ান কিন্তু নারী অবিশ্বাসিনী ইত্যাদি নেতিবাচক সন্দর্ভের অংশ নয়। বরং আক্ষরিকভাবেই প্রেমের শক্তি তথা প্রেমের ব্যাপ্তি চিহ্নিত করা হয়েছে।
এশিয়াটিক সোসাইটির পুঁথি ঘাঁটলে জিজ্ঞাসার এমন অনেক নতুন পরতের কাছে পৌঁছতে পারি আমরা। কিন্তু সেই পথে সবচেয়ে বড় বাধা, পুঁথি নিজেই। যাঁরা পুঁথি নিয়ে চর্চা করেন, অন্তত নানা ভারতীয় ভাষায়, তাঁদের মধ্যে আশ্চর্য এক পুঁথি ফেটিশ কাজ করে। প্রশ্ন এটা নয় যে, পুঁথিতে কী লেখা আছে, তার চেয়ে বেশি পুঁথি নামক বস্তুটির প্রতি তাঁদের আগ্রহ আছে কি না। পুঁথির বিষয়বস্তুর প্রতিও তাঁদের মনোযোগ রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও ওই পুঁথি নামক বস্তুটিকে ঘিরেই আকর্ষণের বৃত্ত। একটা সময় ছিল, যখন পুঁথি গবেষকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে কত পুঁথি আছে— তার বিশেষ গুরুত্ব ছিল, পুঁথিতে কী লেখা আছে, তার থেকেও বেশি পুঁথির মালিক হওয়াই অভিপ্রেত।
বলা ভাল, এই ধরনের পুরনো মনোবৃত্তিকে বাতিল করে নতুন করে পুঁথির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার সময় এসেছে। দেশ-বিদেশের নানা লাইব্রেরি, পুঁথি ডিজিটালি প্রকাশ করছে। ঘরে বসে ব্রিটিশ লাইব্রেরি, endangered archive, https://eap.bl.uk/-এর বিপুল পুঁথির সংগ্রহ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায় আজ। অধিকাংশ ভারতীয় ভাষায় গবেষণার ক্ষেত্রে পুঁথি গবেষক এবং পুঁথির মধ্যে একধরনের জড়, স্থবির সম্পর্কের বুনট গড়ে ওঠে। বাধার এই কারণ পুঁথি নিজেই। পুঁথিকে নিয়ে এক ভুয়ো কৌলীন্যের আবহ কাজ করে গবেষকদের মনে। কিন্তু পুঁথির সঙ্গে গবেষকের সম্পর্ক যদি সংরাগময় না হয়, তাহলে পুঁথি জীবশিলা হয়ে উঠবে একদিন। পুঁথি এবং ভারতীয় ভাষার গবেষকদের মধ্যে যদি শৃঙ্গার-আবহ না তৈরি হয়, তাহলে দূরত্ব ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্য নয়।
কেউ যেন ভুলেও না ভেবে বসেন পুঁথি এবং গবেষকের যৌন সম্পর্কে, কামসূত্রের মতো গ্রন্থ প্রয়োজন। বরং ঠিক উলটো, ‘ন্যায়শাস্ত্র’, ‘মহাভারত’, ‘সাংখ্য’ দর্শন— যে কোনও পুঁথির সঙ্গে সম্পন্ন হোক লীলাবিলাস। না-হলে সেদিন আসতে দেরি নেই, যখন পুঁথির দেহ থেকে মিলবে পূতিগন্ধ। বাতাসে ভেসেও আসছে সেই সুবাস/কুবাস।