ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছায়াবাজি : পর্ব ৩৪


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (January 11, 2025)
     

    একলা ঘরের রোদ

    শিল্প এত পথ অতিক্রম করেছে আর এত ধরনের মানুষ শিল্প করেছেন, মাঝে মাঝে মনে হয় আর নতুন কিচ্ছুই বলার নেই। কিন্তু কয়েকটা ছবি তার কাহিনি নির্বাচনে অবাক করে দেয়। চিলির ছবি ‘ইন হার প্লেস’ (চিত্রনাট্য: ইনেস বোর্তাগারে ও পালোমা সালাস, পরিচালনা: মাইতে আলবের্দি, ২০২৪) বিস্ফোরণ ঘটাতে চায় না, কিন্তু একটা দগদগে বেদনার জায়গা শান্তভাবে উন্মোচন করতে চায়। ছবিটায় দেখানো হচ্ছে ১৯৫০-এর দশক। গোড়াতেই ঘটে একটা খুন। অবশ্য ‘খুনি কে’ সেই প্রশ্ন এখানে ওঠে না, কারণ এক বিখ্যাত লেখিকা একটা নামী হোটেলে সবার সামনে বন্দুক বের করে এক পুরুষকে গুলি করেছেন। কিন্তু ছবি এই লেখিকাকে নিয়ে নয়, বরং এই মামলার বিচারকের মহিলা-সহকারীকে নিয়ে, যে নিতান্ত এক মধ্যবিত্ত মেয়ে। বিচারকের কথায় সে আদালতের কাজকম্ম করে, বিচার চলাকালীন সাক্ষীদের কথা নথিবদ্ধ করে। আর বাড়িতে সংসার সামলায়। সকালে উঠে স্বামী আর দুই ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে, ছেলেদের মারামারি খুনসুটি সামলে, সবাইকে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে দেয়, কখনও সে নিজে এসে বসার আগে খাবার ফুরিয়ে যায়। স্বামী ওই ডাইনিং স্পেসেই একটা স্টুডিও-মতো করেছে, সেখানে লোক ছবি তোলাতে চলে আসে। মহিলা কোনওমতে একটা কাপড় জড়িয়ে নিয়ে আড়ালে চলে যায়, স্বামীকে ছবি তোলা সম্পর্কে দু-একটা উপদেশও দেয় (বোঝা যায়, সে ফোটো তুলতে জানে কিন্তু অবসর পায় না)। তড়িঘড়ি অফিস বেরোনোর সময়ে স্বামীকে বার বার বলে দেয় অমুক যন্ত্রটা সারাইয়ের ব্যবস্থা করতে, যা অবশ্যই হয়ে ওঠে না।

    মহিলা সংসারে অনাদৃতা নয় একেবারেই, কিন্তু অফিস থেকে ফিরেই তাকে রান্না শুরু করতে হয়, কখনও বাথরুম যেতে গিয়ে দ্যাখে ছেলেটা ঢুকে গেল, কখনও চান শুরু করতে না করতেই জল ফুরিয়ে যায়। যেরকমটা মধ্যবিত্ত পরিবারে দেশে-দেশে কালে-কালে হয়ে এসেছে। লেখিকার মামলাটা চলাকালীন, এই মেয়েটিকে একদিন দায়িত্ব দেওয়া হয় লেখিকার বাড়ি থেকে কয়েকটা জামাকাপড় নিয়ে আসতে। অভিজাত পাড়ায় লেখিকার তকতকে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে আমাদের নায়িকা অবাক। বিরাট রৌদ্রস্নাত ফ্ল্যাট, দারুণ সাজানো, প্রচুর বই, দামি পোশাক, খানদানি আসবাব। সবচেয়ে বড় কথা, এই বাড়ি একা একজন নারীর। আর কারও সেখানে বিনা অনুমতিতে প্রবেশাধিকার নেই, আর কেউ সেখানে তাঁর নিভৃত সময়ে হুড়ুদ্দুম ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। এক অখণ্ড আমি-ময় যাপন চলে এখানে। ইচ্ছেমতো বই পড়ো, স্নান করো, সোফায় শুয়ে রোদে তাকিয়ে হিজিবিজি ভাবো, অথবা টাইপইটারে খটখট লেখো পরের উপন্যাস। তোমার অবসর, তোমার এলাকা, তোমার নিরালা কোণ, তোমার সারাক্ষণ। মেয়েটা চাবিটা জমা দেয় না, নিজের কাছে রাখে, আর মাঝে মাঝেই পালিয়ে আসতে থাকে এই নিভৃত বাসায়, সেখানে এসে সে চুপ করে সময় কাটায়, নিজের সঙ্গে নিজে। তার সংসারে আর যা-ই থাক, এই নিঃশর্ত আশ্রয় তো নেই। মেয়েটা লেখিকার পারফিউম ব্যবহার করে, তাঁর পোশাক পরতে শুরু করে, তাঁর সাজিয়ে রাখা বই পড়তে শুরু করে।

    আরও পড়ুন : একটা ছবিকে আকর্ষণীয় করতে সাড়ে-তেত্রিশ ভাজায় উদ্দাম বিটনুন ছড়ানোর সিদ্ধান্ত খুবই উদ্ভট…

    এদিকে মামলায় সাক্ষীদের বয়ানে জানা যায়, লেখিকা তীব্র ও প্রবল ভাবে পাহারা দিতেন ব্যক্তিগত বৃত্ত, যে পুরুষের সঙ্গে মিশতেন তার বিবাহপ্রস্তাব বার বার ফিরিয়েছেন কারণ তাঁর বিশ্বাস প্রবণতা অভিজ্ঞতা তাঁকে নিজের জীবন কারও সঙ্গে নিবিড় ভাগ করে নিতে দেবে না। সেই পুরুষ একটা মেঝে পালিশ করার যন্ত্র কিনে দিলে সেটাকে তিনি টান মেরে নদীতে ফেলে দেন, কারণ তিনি গৃহবধূ হবেন না, তাঁর সেটা কাজ নয়। তিনি লিখবেন, এবং পূর্ণ স্বাধীন থাকবেন, তাঁকে তুমি ভালবাসলে ভাল, কিন্তু অধিকার করতে চাইলে তিনি ছোবল শানাবেন। তিনি আদালতে অপরাধ অস্বীকারও করেন না, এবং মানসিক পরীক্ষার সময় তাঁকে যদিও ইঙ্গিতে বলা হয় অস্বাভাবিক প্রমাণিত হলে তিনি খালাস পেয়ে যাবেন, তাতেও তিনি রাজি হন না। খুনটা তিনি করলেন কেন, তা নিয়েও নায়িকাকে আশ্চর্য তত্ত্ব শোনায় লেখিকার এক বন্ধু। চিলির বিখ্যাত লেখিকা মারিয়া লুইসা বোম্বাল ১৯৪১ সালে ওই হোটেলেই তাঁর এক পুরুষসঙ্গীকে (বোম্বাল তাঁকে ভালবাসলেও সেই পুরুষ তখন আর ভালবাসতেন না) গুলি করেন, যদিও পুরুষটি মারা যাননি। তাই এই লেখিকার গুলি-করাটাও নাকি এক ‘উদ্ধৃতি’, এর বেশি কিছু নয়। বোম্বালকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, এঁকেও নিশ্চয় হবে। লেখিকাকে তখন পাঠানো হয়েছে এক আশ্রম-কাম-বন্দিশালায়, সেটা সন্ন্যাসিনীরা পরিচালনা করেন। আদালত থেকে আমাদের নায়িকাকে বলা হয়, লেখিকাকে অতিরিক্ত আরমে রাখা হয়েছে কি না, তদন্ত করে এসো। তা-ই দেখতে এবং ফোটো তুলতে বহুকাল পরে বাবার দেওয়া ক্যামেরা বার করে মেয়েটি, এবং গিয়ে দ্যাখে লেখিকা অনবরত লিখে চলেছেন কয়েদখানায় থাকার অভিজ্ঞতা। সেদিন মেয়েটা আরও কতকগুলো ছবি তুলে আনে।

    বহু ছবির কেন্দ্রে বহু আকাঙ্ক্ষাই থেকেছে, প্রেমের, প্রতিশোধের, প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের, কিন্তু শুধু নিজের গন্ধে কস্তুরীমৃগসম আকুল বুঁদ হয়ে বসে থাকার আকাঙ্ক্ষা, একেলা জগত ভুলে পড়ে থাকা একটা ঘরের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছবি বানানো বেশ বিরল।

    এরপর এক সময় স্বামী সন্দেহ করে সে অন্যের সঙ্গে প্রেম করছে এবং তাকে অনুসরণ করে যখন বোঝে সে লেখিকার অ্যাপার্টমেন্টে বহু সময় কাটায়, তাকে বলে, তুমি এক খুনির সম্পত্তি ভোগ করছ, তার পোশাক পরছ, অলঙ্কার পরছ, সুগন্ধি মাখছ, এসব কিচ্ছুই তো তোমার নয়! নায়িকা তা বোঝে তো বটেই, কিন্তু নাছোড় ভাবে এই সময়টুকু ভোগ করতে চায়, স্বামীকে বলেও, আমি সংসারে এত আওয়াজ আর সহ্য করতে পারছি না। যখন আত্মীয়েরা আসে, ওইটুকু জায়গায় হইহল্লা করতে থাকে, তার স্বামীর খুব ভাল লাগে, সে পরিবারসুদ্ধু সবাইকে নিয়ে হুল্লোড় করে বাঁচতে চায়, কিন্তু আমাদের নায়িকার কান্না পায়, কারণ সে তদ্দিনে নিজেকে ভোগ করতে শিখেছে, নিজের সান্নিধ্যে ফুটে ওটার অভ্যাস লালন করেছে।তাকে ওই লেখিকার ফ্ল্যাটে প্রশ্রয়-দিঘির মতো ঘিরে থাকে অনর্গল নীরবতা, আর সে নিজের মতো রান্না করে খায়, মদ খায়, আয়নায় নিজেকে দ্যাখে এবং যেন সে এই লেখিকাই হয়ে ওঠে, স্বনির্মিত, আত্মনির্ভর, স্বয়ংসম্পূর্ণ এক মানুষী, এমন এক সমাজে— যেখানে কোনও কোনও সমিতির সামনে লেখা থাকে: নারী ও সেলসম্যানের প্রবেশ নিষেধ। আমাদের নায়িকা যেন ফ্ল্যাটটার সঙ্গে লেখিকার জীবন, মনন, স্পর্ধার ছোঁয়াচ আয়ত্ত করেছে। 

    শেষে লেখিকা খালাস পায় (কারণ চিলির নোবেলপ্রাপ্ত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল মিস্ক্রাল রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লেখেন সাজা মকুব করার জন্য), আর আমাদের নয়িকারও স্বপ্নছুটি শেষ হয়, কিন্তু ছবিটায় যেন ভার্জনিয়া উলফ-এর ‘আ রুম অফ ওয়ান’স ওন’ বইটা মূর্ত হয়ে ওঠে। ছবি জুড়ে নায়িকাকে তার স্বামী ও সন্তানেরা ‘জজসাহেব’ বলে খ্যাপায়, কারণ সে আদালতে কাজ করলেও বিচারক হতে কোনওদিনই পারবে না। নায়িকাকে স্বামী একটা মেঝে পালিশের যন্ত্র উপহার দেয়, যা সে মোটে নদীতে ফেলে দিতে পারবে না (কারণ তার তো এতে সাংঘাতিক খুশি হয়ে ওঠার কথা), কিন্তু তা না পেরে সে কেঁদে ফ্যালে। যখন সবাই খাওয়ার টেবিল ঘিরে আড্ডা মারছে, নায়িকা রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফ্যালে কিন্তু কলের জলের তলায় একলা সেই হাত ধরে তাকে কাঁদতে হয়। বাড়ির লোক, জজসাহেব, সহকর্মী— কেউই খারাপ নয়, কিন্তু তাদের বহু আলগোছ মন্তব্যে হালকা নারীবিদ্বেষ ঝিকিয়ে ওঠে। আমাদের মনে হয়, যথেষ্ট ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নারীর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ হল না, তার একটা নিজস্ব অঞ্চল নেই বলে, তার যথেষ্ট আর্থিক স্বাধীনতা নেই বলে, তার পরিবেশে তার প্রতি অসম্মান খচিত আছে বলে। নায়িকা যখন লেখিকার পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়, আমরা তাকে চুরি মনে করতে পারি না। আমাদের মনে হয়, সে কিছুদিন এই জীবনটা ধার নিয়েছে, আহা নিক, একজন আশ্চর্য প্রতিভা ও অনমিত জেদের জোরে যা পেয়েছে, ও নাহয় কিছুদিন ফাঁকি দিয়েই তার তাপ সংগ্রহ করল, যেন বঞ্চিত নারীজাতির প্রতিনিধি হিসেবে সে একজন দৃপ্ত নারীর কাছে একটু সূর্য চেয়ে নিচ্ছে কয়েক মুহূর্তের জন্য। সে হয়তো ছবি তুললে অনেক বড় শিল্পী হত, ক্রমাগত বই পড়ার অবকাশ পেলে তার হৃদয়ও হয়ে উঠত সমৃদ্ধ ও প্রসারিত (সে স্বপ্ন দ্যাখে, অনেক মেয়ে মিলে বই পড়তে-পড়তে একটা বাসে চলেছে, সংগীতের তালে তদের শরীর নড়ছে)। উলফ লিখেছিলেন, শেক্সপিয়রের এক সম-প্রতিভাসম্পন্না বোন থাকলে তাকে পুরুষশাসিত সমাজ নাটক লিখতে দিত না। এই নায়িকাও যেন সেভাবেই, আরও সহস্র নারীর মতো, সমাজের লোহামুঠির চাপে ধুলো হয়ে গেল। নিভৃত আশ্রয়ের প্রতি তার কামনার কথা জেনে স্বামী তাকে জড়িয়ে কেঁদে ফ্যালে বটে, তার প্রতি সহমর্মিতার অভাব হয়তো নেই জীবন-বন্ধুদের, কিন্তু সমানুভূতি জোগাড় করা কঠিন। কেউ তাকে চা দিতে বলবে না— এই প্রতিশ্রুতিময় আড়াল, স্বামীর নাকডাকে জেগে উঠতে না হওয়ার প্রশান্তি: এর মূল্য কে বুঝবে।

    বহু ছবির কেন্দ্রে বহু আকাঙ্ক্ষাই থেকেছে, প্রেমের, প্রতিশোধের, প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের, কিন্তু শুধু নিজের গন্ধে কস্তুরীমৃগসম আকুল বুঁদ হয়ে বসে থাকার আকাঙ্ক্ষা, একেলা জগত ভুলে পড়ে থাকা একটা ঘরের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছবি বানানো বেশ বিরল। এবং ছবিটা কোথাও প্রকট কর্কশ ভাবে নারীস্বাধীনতার ঝান্ডা তোলে না, একটা লোকের নিজের যত্নের তৃষ্ণাটুকু, নিজেকে মর্যাদা দেওয়ার খিদেটুকু দরদি দৃশ্যে দেখিয়ে যায় শুধু। হয়তো পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারেরা নারী হওয়ায় এই বিষয় ও ধরন নিবিড়তর হয়েছে। ছবির কেন্দ্রে খুনের ঘটনাটা সত্যি। ১৯৪১ সালে মারিয়া লুইসা বোম্বাল পুরুষবন্ধুকে গুলি করেন, আর ১৯৫৫ সালে লেখিকা মারিনা ক্যারোলিনা গিল একই হোটেলে তাঁর প্রেমিককে গুলি করেন। কিন্তু সত্যি ঘটনাগুলোর পাশে গড়ে তোলা হয়েছে কাল্পনিক নায়িকাকে, এক প্রান্তিক চরিত্রকে, ছাপোষা নারীকে, যে চাপা পড়ে গেছে গতানুগতিক জীবন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, পরিবারের প্রত্যাশা, চিরকালীন প্রথার তলায়। দুই খ্যাত নারী-সাহিত্যিকের সত্যি ঘটনাকে ব্যবহার করে, কিন্তু সেই ব্যতিক্রমী নারীদের বদলে সাধারণ মেয়ের কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছবিটা স্বতন্ত্র হয়েছে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook