সত্যি বলতে, রফিসাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেকটাই বেশি বয়সে। আমার দাদা আমার থেকে ছ-বছরের বড়। তাই গানের ক্ষেত্রে দাদা যা ভালবাসত, সেসবই পৌঁছত আমার কানে। তার মধ্যে থেকেই আমি আমার পছন্দ নির্ধারণ করতাম। কিশোরকুমার থেকে জন ডেনভার, পরশপাথর থেকে মাইকেল লার্নস টু রক, এলটন জন থেকে অঞ্জন— সবই ওঁর সূত্রে পাওয়া। আর সেখানে রফিসাহেব ছিলেন ব্রাত্য। রফিসাহেবকে আবিষ্কার করি যখন নিজের কৌতূহলের জন্য গুরু দত্ত, দিলীপকুমার, দেব আনন্দ, শাম্মি কাপুরকে নিয়ে ঘাঁটতে শুরু করি। হঠাৎ মনে হল, নিজের হাতের সামনে থাকা একটা জানলা— যা এতদিন খুলিনি, বাইরে আহামরি কোনও দৃশ্য নেই ভেবে— আনমনে জানলাটা খুলে বাইরেটা দেখেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। রফির গান আমার ভিতরে তার সব রূপ-রস নিয়ে সেঁধিয়ে গেছে।
আজও ভাবি, জীবনলাল মুট্টু যদি অফিস যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা লাহোরের নুর মহল্লা দিয়ে সেদিন না নিতেন, তাহলে ভারতীয় প্লে ব্যাক-এর ইতিহাস কেমন দেখতে হত! জীবনলাল মুট্টু ছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ। লাহোরের ব্যস্ত গলি নুর মহল্লা দিয়ে যাওয়ার সময়ে তিনি একটি সেলুনের ভেতর থেকে প্রায় বিবশ করে দেওয়ার মতো কণ্ঠস্বর শোনেন এবং থেমে সেলুনের ভেতর উঁকি দিয়ে চমকে যান। দ্যাখেন, একজন সদ্য যুবা তার কাস্টমারের দাড়ি কামিয়ে দিতে-দিতে নিজের মনে গান করছে। এইভাবে, প্রায় রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া গেছিল লাহোরের দাদার সেলুনে কাজ করা ফিকো-কে, যার ভাল নাম মহম্মদ রফি। এও যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া। কারণ এই রাস্তাতেই শিশু রফি পেয়েছিলেন প্রথম সুরের আশ্রয়। অমৃতসরের গলিতে রফির পাড়ায় এক ফকির আসতে গান গাইতে-গাইতে মাধুকরী করতে। সেই ফকিরের সুরে আচ্ছন্ন রফি হাঁটতেন তাঁর পিছন-পিছন। মন থেকে তাঁকেই নিজের গুরু ভেবেছিলেন ছোট্ট রফি।
নউশাদ-কে সবাই সমীহ করতেন, কারণ তিনি ছিলেন গানের ক্ষেত্রে আপসহীন। সেই নউশাদকে পর্যন্ত রফিকে ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠাতে হত, না-হলে রফি নতুন গান পেলে তা তোলার জন্য বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়তেন। একই কথা জীবনের প্রায় শেষদিকে কাজ করা তরুণ সুরকার অনু মালিকেরও, গানের প্রতি তাঁর ছিল সর্বান্তঃকরণ সমর্পণ। সেই সমর্পণ থেকেই হয়তো একটি ঝামেলার সূত্রপাত। লতা মঙ্গেশকর একসময়ে গানের জন্য রয়েলটি দাবি করেন, বিরোধিতা করেন রফি। ফলে দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দেন দুই কিংবদন্তি। সবার হয়ে দু’জনকে বুঝিয়েছিলেন শচীনকত্তা। পরে একটি অনুষ্ঠানে দু’জন শচীনকত্তার ‘দিল পুকারে আরে আরে আরে’ গেয়ে মঞ্চে ঢুকে নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নেন।
আমি যখন জন্মাই, ততদিনে আমার ঠাকুরদা শয্যা নিয়েছেন। তার ঘর থেকে আসা মলমূত্র-ফিনাইলের যে মিলিত গন্ধ আসত, তা একজন চার বছর বয়সি শিশুর ভাল লাগার কথা নয়। আমার ঠাকুরদার একটা শোয়ানো টেপ ছিল, তাতে সন্ধের দিকে আস্তে-আস্তে একটা গান বাজানো হত ঠাকুরদার মাথার কাছে। ঠাকুরদার প্রিয় গান। ‘সুহানি রাত ঢাল চুকি/না জানে তুম কাব আওগে’। তখন ভাবিনি, আজ ভাবি, গানটা শুনে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে ঠাকুরদা যে-ঘরঘর শব্দটা বের করতেন, ওটা কার জন্য। বোঝার চেষ্টা করি, শারীরিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া একটা মানুষ কাকে খুঁজত সিলিং-এর চুনকামে নিজের মড়া চোখ দিয়ে। বয়স বলুন, পক্ষাঘাত বলুন, তা তো হয়েইছিল আমার ঠাকুরদার— শুধু গানটার বয়স বাড়েনি। এই গান কি পারত একটা ক্যাথিটার-পরানো স্যালাইন-ঝোলানো মানুষকে নিয়ে উড়াল দিতে? জানতে পারিনি, পারলে ভাল হত।
আমি নিজের জীবনে একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ভুল মানুষকে বিশ্বাস করেছি, ভুলভাল কাজ করেছি, কিন্তু জীবন যখন তোম্বা মুখ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে, আমার হাসি পেয়ে গেছে। ও পাগলকে কী করে বোঝাই, ‘বরবাদিওঁ কা সগ মানানা ফিজুল থা/বরবাদিওঁ কা জশ্ন মানাতা চলা গ্যয়া/হার ফিকর কো ধুয়ে মে উড়াতা চলা গ্যয়া’। সাহির লুধিয়ানভির কথায় এই গানটা যেন আমাদের মতো রামছাগলদের কথাই বলে, যারা জেনেশুনে ঠকে যাই প্রত্যেকবার।
১৯৮০-র জুলাই। কী সর্বনেশে সময় আজ ভাবি! সাতদিনের পার্থক্যে দুই ইন্দ্রপতন। ২৪ জুলাই উত্তমকুমার, ৩১ জুলাই রফি। অথচ দু’জনের একজনেরও যাওয়ার সময় হয়নি তখন। রফি, মৃত্যুর দিনও এক বাঙালি সুরকারের সঙ্গে পুজোর গান তুলেছিলেন। তাঁরা চলে যাওয়ার পর রফি অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন। কিন্তু ডাক্তার আসার আগে সব শেষ। রফির জানাজার কিছু ভিডিয়ো এখনও ইউটিউব-এ আছে, সেখানে দেখবেন সব থেকে বেশি কাঁদছে সে, যাকে সবাই শুধু মজাই করতে দেখেছে চিরকাল। হ্যাঁ, কিশোরকুমার, যাঁর ঝড় রফির ঢেউকে চ্যালেঞ্জ করেছে সবচেয়ে বেশি। শেষযাত্রায় প্রবল প্রতিপক্ষের নতমস্তক, এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারে একজন শিল্পী?
রফিসাহেবের জীবনে নেশা যদি কিছু থেকে থাকে, তা হল ঘুড়ি। নিজের প্রিয় কালো ঘুড়ি নিয়ে ছাদে উঠলে, তাঁর সময়ের হিসেব থাকত না। এত মৃদুভাষী মিষ্টি মানুষ, অথচ ঘুড়ি হাতে পেলে বদলে যেতেন পুরো। কাউকে রেয়াত করতেন না। রফির মৃত্যুর পর নউশাদ নিজের বাড়ির ছাদ থেকে বন্ধুর উদ্দেশে ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন। সেই ঘুড়ির গায়ে উর্দুতে লিখে দিয়েছিলেন বন্ধু রফির সঙ্গে বানানো নিজেরই সুরের গান, ‘ও দূর কে মুসাফির, হামকো ভি সাথ লে লে রে, হাম রহে গ্যয়ে আকেলে…’