কাকে দিয়েছ রাজার পার্ট! প্রোগ্রামের প্ল্যানিং চলার সময় বারবার এই কথাটাই মাথায় ঘুরছিল আমার। পয়লা সারির বাংলা নিউজ চ্যানেল। সেখানে হবে ক্রিকেট বিশ্বকাপের ধারাবাহিক কার্টেন রেজার- ‘ক্যারিবিয়ান ডায়েরি’।
২০০৭ সালে ক্যারিবিয়ান্স দ্বীপপুঞ্জে বিশ্বকাপের আগেই এমন হাইপ তুলে দিতে হবে, যেন ক্রিকেট-পাগল বাঙালি শুধু ওই চ্যানেলই দেখে। আসল খেলার সময় তো মাঠে নেমে লাভ নেই, তখন শুধু অফিসিয়াল চ্যানেলেই খেলা দেখা যাবে। তাই খেলার আগেই এই বাণিজ্যিক খেলা। দারুণ ভাবনা, সন্দেহ নেই। মার্কেটিং টিমও খুব উত্তেজিত, ভাল বিজ্ঞাপন আসবে। প্রথম যে ভাবতে পারে এরকম অভিনব কিছু, তারই জিত হয়। সেটা অবশ্য পরে প্রমাণিতও হয়েছিল।
কিন্তু এই চমৎকার পরিকল্পনায় আমি যে ‘অড ম্যান আউট’। আমার সঙ্গে কস্মিনকালেও খেলাধুলোর কোনও সম্পর্ক নেই, দুনিয়া-কাঁপানো ক্রিকেটারদের নাম বলতে বললে আমার দুটো আঙুলের আটখানা কড় ছুঁতে পারব কি না, সন্দেহ। সে-কথা আমি অকপটে জানালাম প্রথমেই। আমাকে বোঝানো হল, ক্যারিবিয়ান ট্যুরে সঙ্গে নামকরা ক্রীড়া সাংবাদিক যাচ্ছেন, যাঁকে আন্তর্জাতিক স্তরের প্লেয়াররা আদর করে ডাকনামে ডাকেন (পরে দেখেছিলাম এতটুকু বাড়িয়ে বলা নয়)। ক্রিকেট ব্যাপারটা তিনিই সামলাবেন। আর ক্যামেরাম্যানও তুখড়। আমার দায়িত্ব প্রোগ্রামটাকে ভাবনা, স্ক্রিপ্ট, চমক দিয়ে এমনভাবে রান্না করা, যাতে অন্য চ্যানেলগুলো ভেবলে যায়!
ভাবতে বসলাম। ক্যারিবিয়ান্স আর ক্রিকেট নিয়ে কিছু হোমওয়ার্ক তো করতেই হল। এত অসাধারণ প্রকৃতি, এত বর্ণময় সংস্কৃতি, এত আশ্চর্য জীবনযাপন ক্যারিবিয়ান দ্বীপ-দেশগুলোর, শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম, ট্র্যাভেলগের সঙ্গে ক্রিকেট মিশিয়ে একদম অন্যরকম স্বাদের টিভি অনুষ্ঠান উপহার দেব বাংলার দর্শককে। আটটা দ্বীপে ঘুরব আমরা, লম্বা ট্যুর।
প্রথম গন্তব্য, অ্যান্টিগা। ভিভ রিচার্ডসের দেশ। কিন্তু কলকাতা থেকে সেখানে পৌঁছতে গেলে লন্ডনে স্টপ ওভার নিতে হবে। ঠিক হল, লন্ডনে ক’টা দিন থাকব আমরা। দুটো কারণ। এক, ক্লান্তি কাটবে, আর দুই, লর্ডস সমেত ক’টা জায়গায় শুটিং করব আমরা ‘ক্যারিবিয়ান ডায়েরি’-র মুখবন্ধ এপিসোডের জন্য। সেই আমার প্রথম লন্ডন দেখা এবং লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। যে প্রণয়ডোর আজও অটুট।
জানুয়ারির বরফমোড়া সেই লন্ডন সফর, সংক্ষিপ্ত হলেও আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল, নার্ভাস ভাবটাও কিছুটা কেটে গেছিল। সে বড় সুখের সময়, তখন কলকাতা আন্তর্জাতিক উড়ান মানচিত্রে এতটা ব্রাত্য ছিল না। তখনও কলকাতা থেকে বেশ কিছু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকার কয়েকটা শহরে ফ্লাইট চালাত। তাছাড়া ছিল স্বদেশি এয়ার ইন্ডিয়া, কলকাতা থেকে সকালে উঠে সোজা লন্ডন পৌঁছে যেত সন্ধেয়। ভারতীয় সময় ব্রিটিশ ঘড়ি থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা এগিয়ে। মনে আছে, আমাদের এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটে অনেক সিট ফাঁকা ছিল। তখনও মনে হয় বাঙালি ঠিকঠাক বিশ্ব-বাঙালি হয়ে ওঠেনি। তাই নির্মম শীতের লন্ডনে তার অরুচি ছিল। ফলে আমাদের পোয়াবারো, আমরা মাঝখানের সারিতে পাশাপাশি তিনটে সিটের হাতলগুলো তুলে কম্বল-মুড়ি দিয়ে লম্বা ঘুম দিয়েছিলাম।
শুনেছিলাম, প্লেন ল্যান্ড করার সময় নিচে লন্ডন ব্রিজের আলোর মালা মিস করা চলবে না। তাই জানলায় নাক ঠেকিয়ে যথাসম্ভব দেখলাম সেই দৃশ্য। এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের সময় নিজেরটা ভুলে হাঁ করে দেখছিলাম পাশের কাউন্টারে বাংলাদেশের গ্রাম থেকে আসা বৃদ্ধা মা জলভরা চোখে দোভাষীর সাহায্যে সাহেবকে বোঝাচ্ছেন, প্রবাসী ছেলেকে কত বছর পরে দেখবেন বলে পাড়ি দিয়েছেন এতটা পথ। বাইরে পা রেখে পিলে তো বটেই, সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই চমকে গেল। ঠান্ডা এরকমও হয়? একদা জার্মানিবাসী নিকটাত্মীয়ের থেকে ধার করা ভিক্টোরিয়ান কোট (পুরনো ফ্যাশনের হলেও যথেষ্ট কাজের) তুচ্ছ সেই কামড়ের কাছে। তাপমাত্রার হিসেবে শীতের দার্জিলিং বা দিল্লিও কিন্তু কম যায় না। ২ থেকে ৬ ডিগ্রির মধ্যে হামেশাই থাকে। কিন্তু লন্ডন ৩ হলেও তার ছুরির ফলার মতো হাওয়া আর ঝিরিঝিরি তুষারপাতে আমার মতো শীতকাতুরে বাঙালিকে একেবারে ডাউন করে দেয়। ফিজিক্যালি অ্যান্ড ইমোশনালি। আর ক্যাবের ভাড়া তো গোদের ওপর বিষফোড়া। হোটেলটাও বেশ দূরে। উপায় নেই, সস্তায় পুষ্টিকর পেতে হবে তো!
সেই হোটেলও আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল। কীভাবে খাট থেকে পা বাড়িয়ে সোজা ঢুকে যাওয়া যায় টয়লেটে (এত ছোট ঘর যে, মাঝখানে দাঁড়ানোর জায়গা প্রায় নেই), বেসিন থাকে ঘরের ভেতর শিয়রে এবং বেসমেন্টের কমন কিচেনে রান্না খুবই মজাদার। রান্নার আগে বাজারের গল্প। হোটেলে জিজ্ঞেস করে জানলাম, একটু হেঁটে গেলে প্যাডিংটন টিউব স্টেশনের পাশেই আছে ভারতীয় মুদিখানা। চাল-ডাল-আলু-ডিম সবই পাওয়া যায়। এরপর দীর্ঘদিন বাইরের খাবার খেতে হবে, তাই ভাবলাম ক’জনে মিলে সিদ্ধ ভাত খাই লন্ডনে বসে।
এখানে আর-একটা টিপস দিয়ে রাখি। সেটা সফরসঙ্গী নামী সাংবাদিকের কাছ থেকে পাওয়া। দীর্ঘ ট্যুরে পেট ঠিক রাখতে গেলে বাড়ি থেকে কিছুটা চিঁড়ে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। উনি এনেছিলেন বেশ অনেকটা, বালিশের ওয়ারে বেঁধে। আর এনেছিলেন গুঁড়ো দুধ। প্রথমে দেখে হাসি পেলেও, পরে বুঝেছিলাম এর কেরামতি। যখন সাবওয়ে আর ম্যাকডোনাল্ডস খেতে খেতে অরুচি ধরেছে, চিঁড়ে অল্প জলে ভিজিয়ে গুঁড়ো দুধ আর চিনি দিয়ে খেলে একেবারে অমৃত মনে হবে। অনেকটা রাবড়ির মতো বললেও বাড়াবাড়ি হবে না।
সিদ্ধ ভাতের পরিকল্পনায় সকাল সকাল দায়িত্ব নিয়ে বেরলাম। প্রথম হার্ডল, রাস্তা পেরনো। আমার রাজপথ-ভীতি মিডিয়াতে অনেকেরই জানা। পরে ইউরোপ-আমেরিকার বহু শহরেই দেখেছি, ফুটপাথের ধারে পোস্টে বাটন থাকে, টিপলে সিগন্যাল লাল হয়ে যায়। অত বছর আগে মনে হয়, লন্ডনে সেরকম ছিল না। এখানে রাস্তা খুব চওড়া আর এত জোরে গাড়ি আসছে যে, আমি ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়েই আছি। শেষকালে ত্রাতা হয়ে এগিয়ে এল পুলিশ। হাত দেখিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাকে ইশারা করল পেরনোর জন্য। আমি একদৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে কোনওমতে ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ। নির্ঘাত গাড়িচালকরা অবাক হয়ে আমাকে দেখছিলেন, কোথা থেকে এল এই চিজ মহানগরে?
গুজরাতি দোকান। জিনিসপত্র ঠাসা, বোঝাই যায় রমরমিয়ে চলে। মনে পড়ে, ২০০৭ সালেও কলকাতায় পাড়ার বাজারে ভোলাদা বা চিনুকাকুর দোকান থেকে মুদি দ্রব্য কিনত বাঙালি? বস্তা থেকে বেলচা-জাতীয় জিনিস দিয়ে তুলে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে খবরের কাগজের ঠোঙায় ভরে এগিয়ে দিতেন যখন, ফাউ থাকত কুশল প্রশ্ন দাদা, ছেলের জ্বর সারল? মেয়ের রেজাল্ট কেমন হল? এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে আমি অচেনার আনন্দে তাকিয়ে ছিলাম ঝলমলে তাকগুলোর দিকে। ‘মে আই হেল্প ইউ?’ বলে এগিয়ে এল একটি তরুণ। সেই নামিয়ে দিল এক প্যাকেট বাসমতী চাল (বিদেশে সাধারণ সিদ্ধ বা আতপ চাল দেখিনি), এক ছোট ক্রেট ডিম, মাখন ইত্যাদি। এসবের ফাঁকে ফিসফিস করে জানতে চাইল, আমি ভারতীয় কিনা। হ্যাঁ বলাতে অল্প হেসে বলল, ‘কী কষ্টে যে আছি এখানে। খুব খারাপ ব্যবহার মালিকের।’ কথা আর এগল না কারণ ততক্ষণে নজর পড়ে গেছে ক্যাশ কাউন্টারে বসা মালিকের। কড়া গলায় হিন্দিতে বললেন, ‘খালি আড্ডা। কাজে মন নেই।’ ছেলেটি মুখ নিচু করে অন্যদিকে চলে গেল। এর থেকেও বাজে ব্যাপার, দাম মেটানোর সময় উনি হিন্দিতে জানতে চাইলেন, ‘ও তোমাকে কী বলছিল?’
হটপ্লেট মোটেই সুবিধের জিনিস নয়। এতে যে কীভাবে সিদ্ধভাত রান্না হবে কে জানে। একে মেজাজ খারাপ আলু পাইনি বলে। পাশে যে স্প্যানিশ মেয়েটি রান্না করছিল, তার কাছে ক্র্যাশ কোর্স করতে হল। সেও বেশ বিরক্ত কারণ ব্রেকফাস্ট করতে এসে দেখেছে ফ্রিজে যে জ্যামের কৌটো রেখে গেছিল, সেটা থেকে কেউ পুরোটাই খেয়ে গেছে। রান্নাঘরের পাশেই বসবাস হোটেল মালিকের। একটু আগেই দেখেছি, সে আর তার বৌ সোফায় বসে স্ন্যাকস খাচ্ছে। ভাবলাম, ভারি তো দুটো আলু, মহিলার কাছে চাইলে কি দেবে না? চাইলাম, আর যারপরনাই অবাক হলাম। আমাকে সোজা জিগ্যেস করল, ‘বদলে তুমি কী দেবে?’ আমি কথা খুঁজে পাওয়ার আগেই মিটিমিটি হেসে বলে কিনা, ‘দেখেছি একটু আগে ইন্ডিয়ান সুইটস খাচ্ছিলে। প্যাকেটে আরও আছে। দাও।’ সত্যিই তো আমি একটু আগে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কলকাতা থেকে আনা একটা পেল্লায় সাইজের জলভরা সন্দেশ খাচ্ছিলাম। ঠিক লক্ষ্য করেছে। এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে কেনা সন্দেশ এই ঠান্ডায় শুকনো হয়ে গেছে, তার ওপর পরশু থেকে খেয়ে খেয়ে আমরা বোরড হয়ে গেছি। তাই ডিলটা মন্দ লাগল না। দুটো বড় সাইজের আলুর বদলে দুটো জলভরা নলেনগুড়ের কড়াপাক সন্দেশ। ডিম আর মাখন ভাতে আলুসিদ্ধ যোগ, আহা অমৃত! শুধু পাওয়ার অপেক্ষা। কর্তা-গিন্নি দুটো সন্দেশ হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে আর খাচ্ছে! খুশির আলো দুজনের মুখে।
আলো, মানে রোদ ব্যাপারটা যে এমন মহার্ঘ, কে জানত! আমরা গ্রীষ্মকাতর দেশের মানুষ, বেশি গরম আর কম গরম, এই দুটো ঋতুতে অভ্যন্ত, রোদে পুড়ে তিতিবিরক্ত। আর লন্ডনের মানুষ বিষণ্ণ হয়ে থাকে বছরভর মেঘলা আকাশ আর টিপটিপে বৃষ্টিতে। একদিন সকালে সবে রান্নাঘরে নেমেছি, বাইরে প্রবল হইহই, চেঁচামেচি। এই কিচেনে একটা মজার সিঁড়ি আছে, বেসমেন্ট থেকে সোজা উঠে গেছে ফুটপাথ ফুঁড়ে। আমি তড়িঘড়ি উঠে গেলাম বাইরে। দেখি, বাচ্চা-বুড়ো সবাই নাচছে ফুটপাথে। এমনকী, সেই ছোটখাট ভিড়ে কোট-টাই পরা অফিসযাত্রীও আছে। সামনের বিশাল গাছটার মাথায় সোনালি আলোর নাচন। রোদ উঠেছে। আমিও নেচে নিলাম কয়েকপাক।
প্রথম দর্শনে জটিল মনে হয়েছিল টিউব ম্যাপ। লন্ডনের মাটির নিচটা টিউব রেলের নেটওয়ার্ক দিয়ে মোড়া। সারা শহর ও শহরতলী ঘোরা যায় দ্রুত। তখন ছিল, সকালে একটাই টিকিট কেটে নিলে সারাদিন যত খুশি ঘোরার সুবিধে। এখন চালু অয়েস্টার কার্ড, আমাদের মেট্রো কার্ডের মতই, টাকা ফুরিয়ে গেলে রিচার্জ করতে হয়। আমরা সেই অল ডে টিকিট কেটে ঘুরতে লাগলাম। বাকিংহাম প্রাসাদ, ২২১ বি. বেকার স্ট্রিট, হাইড পার্ক এসব নিয়ে বলার জন্য ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হয়। আমি শুধু বলব ক্রিকেটের মক্কা লর্ডস আর মাদাম তুসো মোম মিউজিয়ামের চেম্বার অফ হররস নিয়ে। আপনারা বলতে পারেন, এগুলো নিয়ে বলার কী আছে, টিকিট কেটে যে কেউ তো ঢুকতে পারে। কারণ আছে মশাই। ২০০৭ সাল থেকে মাত্র বছরপাঁচেক আগে দাদাগিরি চলেছিল লর্ডসের যে ব্যালকনিতে, সেখানে নিয়ে যাব আপনাদের। আর চেম্বার অফ হররস-এ যা ঘটেছিল, সেজন্য মাদাম তুসো কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই মনে রেখেছে আমাকে।