ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ডেটলাইন : পর্ব ৫


    তপশ্রী গুপ্ত (September 16, 2024)
     

    পর্ব ৪

    অশোক বন, হাতি, এয়ার রেড

    গোয়েন্দা গল্পে যেমনটা লেখা থাকে, তেমনটা কিন্তু বাস্তবেও হয়। মানে আমার সঙ্গে হয়েছে একাধিকবার। ফেলুদা বলুন বা মিস্টার মস্ক— দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে ছুটি কাটাতে গিয়েছে সমুদ্রের ধারে কিংবা ইতিহাসের শহরে, একটা দিন কাটতে-না-কাটতেই নির্ঘাত একটা খুন হয়ে যাবে, অন্ততপক্ষে অমূল্য কিছু চুরি যাবে। ব্যস, হয়ে গেল ছুটির দফারফা। তার বদলে মগজাস্ত্রে শান দিয়ে ছুটোছুটি শুরু কালপিটের খোঁজে। কলম্বোতে দ্বিতীয় সফরে সেটাই ঘটল। তবে আমাদের ভাগ্য ভাল, একেবারে শেষদিনে ঘটেছিল ভয়াবহ ঘটনাটা। তার আগে ক’টা দিন আমরা কিন্তু ছিলাম চমৎকার মুডে। কখনও সাড়ে চারশো বছরের পুরনো গল ফোর্টের ওপর দাঁড়িয়ে নীচে দেখছি ভারত মহাসাগরের ঢেউ (সচিন তেন্ডুলকরের প্রিয় গল স্টেডিয়াম পাশেই, শুনেছি ছক্কা মারলে বল সোজা সাগরে পড়ত), কখনও-বা পিন্নাভেলেতে হাতিদের অনাথ আশ্রমে গিয়ে ফুট তিনেক লম্বা ফিডিং বটলে দুধ খাওয়াচ্ছি, আমরা খাঁচায় বন্দি আর পালে-পালে হাতি সামনে দিয়ে ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে নদীর দিকে স্নান করবে বলে। বলা বাহুল্য, ট্র্যাভেল শোয়ের শ্যুটিং এগোচ্ছিল দুর্ধর্ষ গতিতে। গলে সুনামি শিবিরে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বছর চারেক পরও দগদগে সেই ক্ষত। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর সকালে ভারত মহাসাগরের দানবিক ঢেউ ভাসিয়ে নিয়েছিল উপকূলের দেশগুলোকে। সেই ভয়ংকর বিপর্যয়ে প্রাণ হারিয়েছিল, গৃহহীন হয়েছিল লক্ষ-লক্ষ মানুষ। গল যেহেতু সমুদ্রের একেবারে ধারে, তাই এখানে সুনামির তাণ্ডব ছিল মারাত্মক। সারা পৃথিবী থেকে ত্রাণ এসেছে অনেক, তবু মুছতে পারেনি ধ্বংসের চিহ্ন। আমাদের দেখে একদিকের দেওয়াল ভাঙা একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল রিচার্ড। ক্যামেরার সামনে সেই অভিশপ্ত ছাব্বিশের কথা বলতে লাগল গড়গড় করে। বুঝলাম, গত চার বছরে এত মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিয়েছে যে কিছুটা যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে মাঝবয়সি লোকটা। ওর চোখের সামনে ভেঙে পড়ল বাড়ি, ভেসে গেল বউ-বাচ্চা, ও কোনওমতে একটা খুঁটি ধরে বাঁচল। অনেকক্ষণ ধরে বর্ণনার মাঝখানে রিচার্ডের চোখ বার বার ভরে এল জলে। আঙুল তুলে দেখাল জলের দাগ ধরা দেওয়ালে কাত হয়ে থাকা ঘড়িটা, সোয়া ন’টা বেজে থেমে রয়েছে। বলল, ‘জানেন, ইচ্ছে করে ঠিক করিনি। সুনামি আসার সময়টা এভাবেই থেকে যাক, সব হারানোর সাক্ষী হয়ে।’

    আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হল ক্যান্ডিতে হোম স্টে-তে থাকতে গিয়ে। এমনিতেই ক্যান্ডিকে বলা হয় শ্রীলঙ্কার সাংস্কৃতিক রাজধানী। লেকের ধারে হলে রোজ সন্ধেয় দারুণ শো হয়, সিংহলী নৃত্যগীত থেকে চড়ক স্টাইলে জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, মশালের আগুন মুখে পুরে নেভানো— একেবারে খাঁটি ওরিয়েন্টাল ফ্লেভারের টানে ছুটে আসেন বিদেশিরা। তার ওপর সারা পৃথিবী থেকে বৌদ্ধরা আসেন তীর্থ করতে ক্যান্ডিতে কারণ এখানকার টেম্পল অফ দ্য টুথ রেলিক মন্দিরে রাখা রয়েছে ভগবান বুদ্ধের দাঁত। স্বাভাবিক ভাবেই ইউনেস্কো এই শহরকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমার অবশ্য সবচেয়ে ভাল লাগল এক সিংহলী পরিবারের সঙ্গে দুটো দিন কাটিয়ে। আমাদের দেশে এমন অথেন্টিক হোম স্টে কোথায় আছে জানি না। কারণ শান্তিনিকেতন বা উত্তরবঙ্গে দেখেছি, হোম স্টে আসলে হোটেলেরই নামান্তর। মালিক এসে আলাপ করবেন আর বড়জোর খাবার টেবিলে সঙ্গ দেবেন। ক্যান্ডিতে কিন্তু হোম স্টে মানে সিংহলী কালচারের মধ্যে এক ঝলক হলেও ঢুকে পড়ার সুযোগ। সারাদিন অবশ্য আমার আর ক্যামেরাম্যানের টিকি পেতেন না ওরা, সন্ধেবেলা কিন্তু জমিয়ে আড্ডা। শুধু কি আড্ডা, টিভি দেখার ফাঁকে গৃহিণীর অনুরোধ, ‘আমি ডিনারের জোগাড়টা দেখি, তুমি প্লিজ একটু ছেলেমেয়ের হোমওয়ার্কটা করিয়ে দাও।’ সারাদিন দৌড়নোর পর এখন আবার লেখাপড়ার চাপ? কিন্তু সত্যি বলছি, বাচ্চাদুটোকে পড়াতে বসে একটুও ক্লান্ত লাগল না। বরং আধঘণ্টাটাক বেশ ভাল কাটল। ওদিকে আবার রান্নাঘর থেকে ডাক এসেছে, এ-বাড়ির কর্তার সঙ্গে হাত লাগাতে হবে। আজকের স্পেশাল মেনু শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত কিরিবাথ আর চিকেন কারি। ধুয়ে রাখা চালে ময়দা আর নারকেলের দুধ মেশাতে বললেন ভদ্রলোক। তারপর ফুটখানেক লম্বা একদিক আটকানো বাঁশের চোঙার ভেতর ভরতে বললেন। এবার মুখটা বাঁশের ঢাকনা দিয়ে ভাল করে আটকে বড় সসপ্যানে ফুটন্ত জলে ফেলতে হবে। কিছুক্ষণ সেদ্ধ করার পর তুলে বাঁশের চোঙা থেকে সিলিন্ডারের মতো ভাত বার করে প্লেটে রেখে ছুরি দিয়ে কাটতে হবে। হই হই করে সবাই মিলে খাওয়া হল। তারপর আর এক প্রস্থ গল্প। ক্যান্ডি শহর থেকে একটু বেরোলেই পুরো গ্রীষ্মের দার্জিলিং। মেঘলা, টিপটিপ বৃষ্টি, চা বাগান, হালকা ঠান্ডা। পাহাড়ি পথ বেয়ে গাড়িতে বা বাসে সিথাএলিয়া। আসলে সীতা— তামিলরা ত কে থ বলেন কিনা! এখানেই অশোকবন, এরা বলে অশোক বাটিকা, সীতাকে অপহরণ করে এই অসাধারণ প্রকৃতির মাঝখানেই নাকি বন্দি করে রেখেছিল রাবণ। মনে-মনে বললাম, এত রোম্যান্টিক ছিল বুঝি দশমাথাওয়ালা রাক্ষস? হনুমানজির পা বলে যে-বিশাল ছাপটা দেখালেন গাইড, সেটা দেখে বরং মনে হতে পারে দানব। প্রচুর গাছগাছালি, দূরে পাহাড়ের গা-টাও সবুজ জঙ্গলে ঢাকা, তিরতির করে বয়ে চলা নদী— সব মিলিয়ে চমৎকার পরিবেশ। তবু বন্দিনি সীতা চেড়ি পরিবৃত হয়ে কি আর সেসব উপভোগ করতেন? নুয়ারা এলিয়া রিসর্ট চাইলে একটা রাত থেকে যাওয়া যায়।

    পিন্নাভেলেতে হাতিদের অনাথ আশ্রম

    আবার কলম্বো ফেরা, একটা দিন থেকে দেশের ফ্লাইট ধরব। ট্যুরের শেষ ল্যাপে বেশ খুশি আমরা, শ্যুটিং যা ভেবেছিলাম তার থেকে অনেক ভাল হয়েছে। এখনও বাকি দুটো স্পট, কলম্বোর শহরতলিতে। বিকেলের মধ্যে চটপট সেরে ফেলে বিশ্রাম, পরদিন দুপুরে চেন্নাইর ফ্লাইট। এই দিনটা আর হোটেলে নয়, এক বন্ধুর পরামর্শে আমরা চেক ইন করেছি ওয়াইএমসিএ-তে। তারিখটা ভোলার নয়, ২৮ অক্টোবর, ২০০৮। সে-রাতেই মৃত্যুকে দেখেছিলাম একেবারে ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলতে। তার বিন্দুমাত্র আঁচ কি পেয়েছিলাম রোদ-ঝলমলে চমৎকারে সকালে? মোটেই না।

    সকালে বাস ধরে দহিওয়ালা। শহরের কাছেই অসাধারণ বেড়ানোর জায়গা মাউন্ট লাভিনিয়া। পাহাড় আর সাগর একসঙ্গে থাকলে এমনিতেই একটা মাদকতা জাগে। বোল্ডারে লেগে ফুঁসে ওঠা ঢেউয়ের ফেনা যেন হাতছানি দেয়। হাঁটুজল পেরিয়ে ওই পাথরের মাথায় বসতেই হবে, পা ধুইয়ে দেবে নীল জল। এমন ফটো অপরচুনিটি কি ছাড়ে ট্যুরিস্টের দল? লাভিনিয়া নাকি এক নটীর নাম, যার প্রেমে পড়েছিলেন ব্রিটিশ গভর্নর টমাস মেটল্যান্ড। সেই অসম প্রেমের কী পরিণতি হয়েছিল, তা জানি না। তবে এটুকু বুঝলাম, প্রেয়সীকে অমরত্ব দিয়ে গেছেন সাহেব এই সুন্দরী সৈকতের নাম লাভিনিয়া রেখে। সুনীলের উপন্যাসে পড়েছিলাম, নীললোহিতের বড় শখ ছিল প্রেমিকাকে পাহাড় উপহার দেবে, কিন্তু বেকার বাঙালির সে-সাধ্য হয়নি। বিদেশি রাজপুরুষের সঙ্গে কি তার তুলনা চলে? সৈকতে স্টেজ বেঁধে দেখলাম রক মিউজিকের তোড়জোড় চলছে। গিটার, ড্রামস সেট করছে ঝাঁকড়া চুলের ছেলেরা। তারা হেসে হাত নাড়ল, আমরাও ফিরতি হাসি পাঠালাম। তাড়া আছে, এবার যেতে হবে নেগম্বোতে। বিমানবন্দরের কাছে জেলেদের গ্রাম। সেখানে সমুদ্রের জল এত স্বচ্ছ যে, নীচে কোরাল রিফ দেখা যায় স্পষ্ট। এই গল্প শুনে নিয়েছি আগেই একদিন লোকাল ট্রেনে। আমার যেমন স্বভাব, রেলে, বাসে, অটোতে একটু ইন্টারেস্টিং মনে হলেই আশেপাশের লোকের সঙ্গে আলাপ জমানো। আমার পাশেই বসেছিলেন এক বৃদ্ধ। কথায়-কথায় জানলাম, তিনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, সপ্তাহে দু’দিন নেগম্বো থেকে কলম্বো আসেন মেয়ের বাড়িতে, নাতিকে অঙ্ক করাতে। নেগম্বোর যা গল্প শুনলাম তাঁর মুখে, ওখানেই কথা দিয়ে দিলাম, ফেরার পথে যাব। উনি আন্তরিকভাবে বললেন ওর বাড়িতে যেতে, উনি ঘোরাবেন আমাদের। আমি তো এক কথায় রাজি, সিংহলী মধ্যবিত্ত বাড়ির অন্দরমহলটা দেখতে পাব। সেই কথা রাখতে দুপুর একটার রোদ মাথায় নিয়ে চললাম নেগম্বো।

    টেম্পল অফ দ্য টুথ

    যেন এক টুকরো গোয়া। ছবির মতো ছোট্ট গ্রাম নেগম্বো। সেখানে ছিমছাম বাংলো টাইপ বাড়ি অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের। বাড়ির গিন্নি আমাদের খুব আপ্যায়ন করলেন ঠান্ডা শরবত খাইয়ে। কিন্তু আলাপ জমল না কারণ ওঁর সিংহলী ছাড়া অন্য ভাষা জানা নেই। তবু ইশারা আর গৃহকর্তার সৌজন্যে কিছু কথাবার্তা হল। এর মধ্যে খবর পাঠিয়ে আনা হয়েছে স্ট্যানলিকে। নানা পাটেকরের মতো দেখতে বলে আমি প্রথমেই বেশ ইমপ্রেসড হলাম। তার ওপর আরও অনেক শ্রীলঙ্কানের মতো স্ট্যানলিও ঝরঝরে ইংরেজি বলে। দীর্ঘকাল ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকার ফল। পদ্মা নদীর মাঝির কুবেরের মতো জলের জীবন তার হাতের তালু। স্ট্যানলি আসলে পোড় খাওয়া মৎস্যজীবী। আমাদের পাঞ্জাবের সম্পন্ন কৃষকদের মতো নাইকির স্নিকার্স পরা জেলে। নির্জন সৈকত পেরিয়ে কাচ-স্বচ্ছ জলে হাঁটু পর্যন্ত নামতেই নীচে প্রবাল প্রাচীর। একটু ঝুঁকেই ছুঁয়ে ফেলা যায়। আসলে তখনও নেগম্বো জায়গাটির সন্ধান সেভাবে পায়নি ট্যুরিস্টরা। তাই সেই কোরাল রিফ ভার্জিন। প্রাণভরে শ্যুটিং করতে-করতে গোধূলি ঘনিয়ে এল। ভরা মন আর খালি পেট নিয়ে আমরা কলম্বোর পথ ধরলাম। মনে আছে, বিরিয়ানি খেয়েছিলাম সেদিন সন্ধেতে। ভারতীয় রেস্তরাঁ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ঢুকলাম বটে, কিন্তু বিরিয়ানিটা তেমন জমল না। যাই হোক, ন’টার মধ্যে ওয়াইএমসিএ-তে ঢুকতে-ঢুকতে ঠিক করলাম, ফ্রেশ হয়ে ক্যামেরাম্যান আমার ঘরে চলে আসবে। এত বিশাল রাশ হয়েছে শ্যুটিং-এ যে ঘণ্টা দুয়েকে কিছুটা অন্তত বেছে লগ করে নেব। যেমন কথা, স্নানটান সেরে বিছানার ওপর বসলাম দুজনে প্রচুর ক্যাসেট (তখন মিনি ডিভি ক্যাসেটে শ্যুট হত) ছড়িয়ে। ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে মন দিয়ে ইন আর আউট পয়েন্ট ডায়রিতে নোট করতে লাগলাম। সাইরেন বাজল ক’বার, সে বাজতেই পারে, কলম্বো যখন একটা বড় বন্দর। হঠাৎ দুমদাম, মারাত্মক বাজি ফাটতে শুরু করল। মানে তখন আমি বাজি ভেবেছিলাম, কারণ দু’দিন পরেই দিওয়ালি। আমি আবার ক্যামেরাম্যানকে বললাম, ‘দেখেছিস, এখানেও আমাদের দেশের মতো বাজি ফাটে, অনেক ভারতীয় থাকে কিনা!’ যেই-না বলা, ঝুপ করে পাওয়ার অফ হয়ে গেল। সেটাও কী আর এমন ব্যাপার! কিন্তু পাঁচতলার জানালার কাচের পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে আগুনের গোলা ছুটছে কেন? অন্ধকারের মধ্যে দরজায় ধাক্কা, সঙ্গে কে যেন আতঙ্কে চিৎকার করছে, ‘এয়ার অ্যাটাক। মেঝেতে শুয়ে পড়ো উপুড় হয়ে। খাটের নীচে ঢুকে যাও।’ আমরা আগুপিছু না ভেবে ওই অন্ধকারে লম্বা হয়ে খাটের নীচে মেঝেতে মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম। ওদিকে শুনতে পাচ্ছি, গুলিগোলা চলছেই। কতক্ষণ কে জানে, হালকা আলোর রেখা দরজায়, সঙ্গে আবার সেই গলা, ‘তাড়াতাড়ি উঠে এসে সবাই জড়ো হও সেন্টারের লবিতে। ফাস্ট, ফাস্ট।’ যন্ত্রের মতো উঠে ছুটলাম। ততক্ষণে গোলাকার লবি ঘিরে থাকা সব ঘর থেকে লোক বেরিয়ে জড়ো হয়েছে। সারা পৃথিবী যেন মধ্যরাতে মিলে গেছে এই হলঘরে। ওয়াইএমসিএ বিদেশিদের পছন্দের জায়গা। হোটেলকর্মীর হাতে ধরা ইমারজেন্সি আলোয় দেখলাম, শ্বেতাঙ্গ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ, আমাদের মতো ব্রাউন থেকে মঙ্গোলিয়ান চেহারা, কে নেই! শোয়ার সময় হয়ে গেছিল, তাই অনেকেই স্বল্পবাস, সেদিকে কে খেয়াল করে? প্রাণ থাকে কি না সন্দেহ। মর্টারের আঘাতে প্রাচীন বাড়ির কোনদিক ধুসে পড়বে কেউ বলতে পারে? গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কাঁপছে সবাই। কথা বলার শক্তিও নেই। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি আমরা ক’টি প্রাণী, পরস্পরের দিকে। চিনি না, জানি না, কার দেশ কোথায় বলতে পারি না। শুধু জানি, একটা বিপর্যয় আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কাছাকাছি, পাশাপাশি, এই মৃত্যু উপত্যকায়। বাঁচলে একসঙ্গে বাঁচব, মরলে একসঙ্গে মরব। ততক্ষণে জেনেছি, আমাদের কাছাকাছি কলম্বোর একটা বিদ্যুৎকেন্দ্রে এয়ার রেড চালিয়েছে এলটিটিই। ল্যান্ড বা সি টাইগার্স-এর তুলনায় স্কাই টাইগার্স তেমন শক্তিশালী ছিল না। মাত্র কয়েকবার তারা আঘাত হেনেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেরকম একটি হানাদারির সাক্ষী থাকা।

    পরে ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে সুধীন দত্তের একটা বিখ্যাত কবিতার লাইন, ‘একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে/থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি।’ কতক্ষণ পর যে ওই দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম, হিসেব করার কথা মাথায় আসেনি। আসলে বেঁচে আছি, এই ঘোরটাই আচ্ছন্ন করে ছিল মাথা। পরদিন সকালে প্রথমেই খোঁজ নিলাম, প্লেন উড়বে তো? বেলার দিকে বাড়ির ফোনে, প্রিয়জনের গলা শুনে কেঁদে ফেললাম। ওরা তো আগের রাত থেকে কাঁদছে। ফোনের লাইন নিঃশব্দ। টিভির পর্দা জুড়ে অশান্ত কলম্বো।

    দুঃস্বপ্নের ছবি দিয়ে শেষ হল শ্রীলঙ্কা পর্ব। এর পর আমরা যাব কম্বোডিয়া।

    ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook