ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছায়াবাজি : পর্ব ৩০


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (September 7, 2024)
     

    দয়ার শেকল

    পরাধীনতার ন্যায় আরাম যে কম আছে, তা আমরা জানি, কিন্তু তত্ত্বগত ভাবে স্বীকার করি না। এদিকে প্রত্যেকেরই পরমতম সাধ হল আমায় কেউ ঝুঁটি ধরে আগাগোড়া চালিয়ে নিয়ে যাবে আার আমি তদনুযায়ী প্রতিটি পা ফেলব, তবে ঝুঁটিখান আলতো পাকড়ালে ভাল। উদ্ভট ও দুর্বোধ্য ছায়াছবি দেখলে তাকে বিশ্লেষণ করে বহু দিকে যাওয়া যায়, এই হচ্ছে সেই ছবি দেখার অন্যতম মজা। ইয়রগস ল্যান্থিমস-এর সাম্প্রতিক ছবি (‘কাইন্ডস অফ কাইন্ডনেস’, চিত্রনাট্য:  ইয়রগস ল্যান্থিমস, এফথিমিস ফিলিপৌ, পরিচালনা: ইয়রগস ল্যান্থিমস, ২০২৪) দেখলে মনে হয়, তিনি হয়তো বলছেন, কেউ আমাদের পুরোপুরি পরাধীন করে রাখলে, আমরা সেই আদেশ-আছড়ানোকে দুরন্ত দয়ার ঘটনা বলেই মনে করব। ছবিটা তিনটে ছোট সিনেমার সংকলন, যার প্রতিটিতেই মূল চরিত্রগুলির অভিনয় একই লোকেরা করেছেন।

    প্রথম গল্পে দেখা যায়, ছবির নায়কের শুধু কাজকর্ম নয়, জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত তার বস-এর নিয়ন্ত্রণে। একটা হাতে-লেখা নোট চলে আসে, সারা দিনটা সে কীভাবে যাপন করবে, নির্দেশ-সহ। ব্রেকফাস্টে কী খাবে, স্ত্রীর সঙ্গে কখন সঙ্গম করবে, কোন গল্পের বই পড়বে। সে দিব্যি খুশিমনে এই পরাধীনতা মেনে নেয়, কিন্তু মুশকিল হয় যখন বস তাকে বলেন, গাড়ি চালিয়ে আরেকটা গাড়িকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারতে। সে ধাক্কা মারে বটে, কিন্তু যথেষ্ট জোরে নয়। ওই গাড়ির লোকটাও মরে না, আর আমাদের নায়ক ধাক্কা মেরেও হাসপাতালে যায় না। এদিকে বসের নির্দেশ ছিল, তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। পরেরদিন সে যখন বসের কাছে ক্ষমা চায়, বস বলেন, কোনও অসুবিধে নেই, ফের দু’দিন পরে ওই গাড়িটাকে ধাক্কা মারবে। কিন্তু সে-গাড়ির লোকটা যদি মরে যায়? বস বলেন, গেলে যাবে। আর লোকটা নিজেই মরে যেতে রাজি। এবং সত্যিই লোকটাকে প্রথম দৃশ্যে আমরা দেখেছি বসের বাড়িতে আসতে। তাহলে কি ওই লোকটার জীবনও বস নিয়ন্ত্রণ করেন? এদিকে নায়ক খুব খানিক ভেবে বসকে জানায়, গত ১০ বছর সে তাঁর প্রতিটি আদেশ অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চললেও, একটা মানুষকে তা বলে খুন করতে পারবে না। বস সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে ছাড়িয়ে দেন, তাঁর সঙ্গে নায়কের ঈষৎ প্রেমের সম্পর্কও ছিল, তাও শেষ হয়ে যায়। বস বলেন, সে তার বাড়ি-গাড়ি রাখতে পারে, যেখানে খুশি যেতে পারে, যা খুশি খেতে পারে, যার সঙ্গে খুশি যৌনতা করতে পারে। নায়ক এক সময়ে বউয়ের কাছে স্বীকার করে, তার প্রতিটি সিদ্ধান্ত-কাজ-অকাজ বসের নির্দেশেই ঘটেছে, বউয়ের সঙ্গে প্রেমও, এমনকী এতদিন ধরে বউয়ের যে এতগুলো মিসক্যারেজ হয়েছে, কারণ তার বসেরই ঠিক করে দেওয়া কয়েকজন ডাক্তার এমন ওষুধ দিয়েছে যাতে গর্ভপাত হয়ে গেছে। স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। চাকরি-বাকরি নেই, বিশেষ পয়সাকড়ি নেই, অন্যত্র চাকরি খুঁজে লাভ হয় না, লোকটা খুব দ-য়ে পড়ে যায়। এর মধ্যে একটা মেয়ের সঙ্গে একটু প্রেম-প্রেম ভাব হয় বটে, কিন্তু লোকটা ক্রমে আবিষ্কার করে, এই মেয়েটিও ওই বসেরই অঙ্গুলিহেলনে চলছে। সেও একটা হাতে লেখা নোট পায় এবং তদনুযায়ী গোটা দিন যাপন করে। শেষকালে আমাদের নায়ক সেই (গাড়ির) লোকটিকে খুন করে ও শেষ শটে নায়ককে বস ও তার সঙ্গিনীর মাঝখানে সাদরে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। 

    লোকটা পরম শান্তিতে ঘুমোয়, যখন তার নিয়ন্তার কাছ ঘেঁষে শুয়ে থাকে, যখন সে তাঁর কাজ করে তাঁর বাহবা পায়। বস কি তবে তার প্রতি সদয়? বাড়ি, গাড়ি, প্রেমের জন্য মেয়ে বেছে দেওয়া, নিরন্তর উপহার— এসব কি দয়ার লক্ষণ? না কি, একটা লোকের সত্তার টুঁটি টিপে অধীনস্থ রাখা চরম নির্দয়তার প্রকাশ? লোকটাকে বস যখন স্বাধীন করে দেন, সেই স্ববশতা তার দম বন্ধ করে দেয়। যদ্দিন নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হত না, গোটা জীবনটা সম্পূর্ণ অন্যের ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল ছিল, এক আশ্চর্য নিশ্চিন্দি তাকে আবৃত রেখেছিল। কোনও একটা মুহূর্তের দায়ও তাকে গ্রহণ করতে হয়নি। এখন সামনে তেত্রিশ হাজার পথ, যে-কোনও একটা বেছে নেওয়ার প্রকাণ্ড দ্বিধা, এবং তা বেছে নেওয়ার পরিণামের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ যে কত মণ পাষাণ-বহন, বুঝতে পেরে লোকটি কেন্নো হয়ে যায়। পরে নিজের মূল্যবোধ চুলোর দোরে দিয়ে ফের প্রভুর ক্রোড়ে ফিরে তার শান্তি। তাহলে কি বস আসলে ঈশ্বর? যিনি প্রত্যেককে নিয়ন্ত্রণ করেন, অনিচ্ছুককে হত্যাকারী বানান, মৃত্যুপ্রার্থীকে মৃত্যু দেন? যাঁর হাতের তালুর বাইরে চলে গেলে আমরা নিজেদের অসহায় নিরালম্ব এবং অতল গর্তে পড়ে যাওয়া আতুর মনে করি? যিনি ললাটে সবটাই পূর্বনির্ধারিত রেখেছেন— এই অজুহাতে আমরা নিজ ব্যর্থতা ও গোবরলিপ্ত ন্যাজের সাফাই প্রস্তুত রাখি?

    আমার কী হবে তা আমার হাতে নেই এই আশ্বাস পাওয়ার জন্য, আমার কৃতকর্মের জন্য আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না এই ভরসা পাওয়ার জন্য, আমার জীবনের চিন্তা ও পরিকল্পনার বকলমা অন্যকে সঁপে দিলেম এই নির্ভাবনায় স্নানের জন্য— বহু মানুষ একটা বেদি খোঁজে, যেখানে নিজেকে সাষ্টাঙ্গ উৎসর্গ করে সে ভোঁসভোঁস ধ্যানে তলিয়ে যাবে।

    পরের ছবিতে একজন হারিয়ে যাওয়া বউ ফিরে আসে কিন্তু তার হাবভাব দেখে স্বামীর মনে হয় এ অন্য লোক। সে যা খেতে ভালবাসত না, এখন তাই খায়। খুব রুচিশীলা নরম-সরম ছিল, এখন একটু বেশি তামসিক। যৌনতার প্রতি একটু বেশি আগ্রহী, এমনকী যৌনতায় সে স্বামীকে শাসন করতে চায়। জুতোও তার পায়ে ভাল ফিট করে না। স্বামী যাকেই বলে, সে এ-কথা উড়িয়ে দেয়, স্বামী এক সময়ে পাগলের মতো হয়ে যায়, তাকে চাকরি থেকে ক’দিন বিশ্রাম দেওয়া হয়। স্বামী এবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয় ও স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। স্ত্রী রাজি হয় না, সে গর্ভিণী, এদিকে স্বামী তাতেও বিস্মিত (আগে হয়তো ডাক্তারেরা বলেছিল সে মা হতে পারবে না)। স্বামী অভিমানে অনাহারে আছে দেখে স্ত্রী বলে, তুমি যা খেতে চাও আমি রেঁধে দেব। স্বামী বলে, তোমার একটা আঙুল কেটে খেতে দাও। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে স্ত্রী নিজের একটা আঙুল কর্তন করে খেতে দেয়। একদিন স্বামী বলে, তোমার লিভারটা খেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিছুক্ষণ পর স্ত্রী (লিভার বের করতে গিয়ে) নিজের পেট কেটে মরে যায় এবং সঙ্গে-সঙ্গে দেখা যায় আরেকজন হুবহু তার মতোই দেখতে মহিলা, মানে আরেকটা সে-ই, দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে। তবে কি আসলে এই বউই হারিয়ে গেছিল এবং যে মরে পড়ে আছে সে আগন্তুক? গল্পের মানে বোঝা শক্ত, কিন্তু আসল প্রশ্ন: প্রেমে ও নিঃশর্ত সমর্পণে নিজেকে কেটে খুন করা কি দয়ার প্রকাশ না দীনতার? আজ বউয়ের নতুন ধরনধারণ আমার পছন্দ হচ্ছে না বলে যদি আমি পুরনো সত্তার বউকে ফেরত চাই, তবে নির্দয় ভাবে তাকে শাস্তি দিয়ে (সে যদি সম্মত হয় সেই শাস্তিতে) সেই রূপটায় ফিরিয়ে নেওয়া কি নিষ্ঠুরতা, না আমাদের দাম্পত্যের পক্ষে তা অনুকূল, সুতরাং প্রয়োজনীয়? যে লোক ভালবাসা ও আনুগত্যে শেষ অবধি নিজের বিরুদ্ধে যায়, যে স্বামীর হাতে মার খেয়ে বলে ‘ওর দোষ নেই, কড়া-কড়া ওষুধ খাচ্ছে তো, মেজাজটা চড়ে থাকছে, আমারই মুখে মুখে কথা বলা উচিত হয়নি’ (স্ত্রী এ-কথা তার ভ্রূণ নষ্ট হওয়ার পর বলে ডাক্তারকে, কিন্তু স্বামী আবার মনের ডাক্তারকে বলে, স্ত্রী নিজেই নিজের মুখে ও পেটে আঘাত করেছে), সে কি নিজেকে ও ভালবাসাকে চরম অপমান করছে? এবং যাকে সে নিজের দয়া বলে ভুল করছে তা নিজের প্রতি প্রখর নির্দয়তা, সুতরাং চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা? আমাদের সম্পর্ক প্রায়ই এমন হয় যেখানে একজন একপেশে দাতা এবং আরেকজন একবগ্গা গ্রহীতা, সেই সম্পর্ক বহু সময়েই আমাদের কাছে সুখের আভাস নিয়ে আসে। কিন্তু সত্যি-সত্যি কি আমরা এখানে নিজেকে এবং অন্যকে পরিপূর্ণভাবে ঠকিয়ে চলছি না? অবশ্য ছবির নামে ‘দয়া’ কথাটা আছে বলে সর্বত্র সেটাকেই বেঁকিয়েচুরিয়ে খুঁজতে হবে তার মানে নেই, আর এতেও সন্দেহ নেই, এই স্তরের নির্দয়তা-ভর্তি ছবির এই নাম দেওয়ার মধ্যেও এক পেল্লায় মুচকি বর্তমান।

    তৃতীয় ছবিতে আমরা দেখি একটা কাল্ট-এর প্রধান একজন লোক এবং তার স্ত্রী। সেখানে প্রতিটি সদস্যই (পুরুষ-নারী নির্বিশেষে) যৌনতা করতে পারবে—  হয় এই প্রধান অথবা তার স্ত্রীর সঙ্গে। কখনওই অন্য কারও সঙ্গে নয়। আমাদের নায়িকা তার স্বামী ও সন্তান ছেড়ে যোগ দিয়েছে এই কাল্টে। স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হলেও সে নিরাসক্ত থাকে। একটা সময়ে তার স্বামী তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মদের সঙ্গে ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে ধর্ষণ করে। ফলে কাল্ট থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। তখন সে অস্থির আকুল কেঁদেকেটে বলতে থাকে, যে-কোনও মূল্যে আমি আবার কাল্টে ভর্তি হতে রাজি। কাল্টের প্রধানা বার বার বলেন, তা কেন, তুমি বরং বাড়ি যাও। স্বামী এবং সন্তান নিয়ে গুছিয়ে সংসার করো, সে তো খারাপ নয়। বহু মানুষ তো তা-ই করছে, তার মধ্যে তো কোনও মালিন্য নেই। সে বলে, সে তা করতে চায় না, চুম্বনের জন্য গেটের কঠিন লোহার ফাঁকে ওষ্ঠাধর বাড়িয়ে দেয়। পরে যখন স্বামী সন্তানের সঙ্গে দেখা হয়, এমন সব কথা বলে যাতে দুজনই তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। এই গল্পটা আর না বাড়িয়ে এইটুকু বলা যায়, এখানেও সেই কারও অধীন হওয়ার তৃষ্ণা, তার দ্বারা প্রতি পদে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, নিজেকে নিঃশর্ত অর্পণ করে দেওয়ার ব্যাকুলতা, তার আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার কামনা।

    আমরা লক্ষ করি, প্রথম গল্পে বস-এর প্রতি প্রেমে ও সমর্পণে নিজের সন্তান নষ্ট করা, দ্বিতীয় গল্পে স্বামীর প্রতি আনুগত্যে সন্তান নষ্ট সত্ত্বেও চুপ থাকা, তৃতীয় গল্পে কাল্ট-পতির প্রতি প্রণতির চোটে সন্তানকে উপেক্ষা করা। ফট করে মনে হবে, এ তো স্বাভাবিক জীবন নয়। যে-স্নেহকে আমরা মনে করি নির্মলতম, তাও কেন একটা লোক আত্মাহুতির সঙ্গে জড়িয়ে নেবে? কিন্তু পরাধীনতার যে-তৃষ্ণা আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, তা বহু সময়েই কঠিন মুষ্টিতে দণ্ড ও নিগ্রহকে যথোচিত রক্ষণাবেক্ষণ বলে মনে করে, প্রকৃত লালনপালন মনে করে, এবং বেদনা পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করে। আরও প্রভু আরও আরও, এমনি করে মারো, অমনি করে মারো। আমার কী হবে তা আমার হাতে নেই এই আশ্বাস পাওয়ার জন্য, আমার কৃতকর্মের জন্য আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে না এই ভরসা পাওয়ার জন্য, আমার জীবনের চিন্তা ও পরিকল্পনার বকলমা অন্যকে সঁপে দিলেম এই নির্ভাবনায় স্নানের জন্য— বহু মানুষ একটা বেদি খোঁজে, যেখানে নিজেকে সাষ্টাঙ্গ উৎসর্গ করে সে ভোঁসভোঁস ধ্যানে তলিয়ে যাবে। তাকে নিয়ম করে বেস্পতিবার সন্ধেবেলা পেটানোই হয়তো তার প্রতি দয়া প্রদর্শন। বা এক ধরনের দয়া নিক্ষেপ। কে জানে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook