সুপ্রভা (পরি)
সুপ্রভার একটি কন্যাসন্তান হল; শাশুড়িমা তার নাম রাখলেন কনকরাণী। মেয়ের রূপ দেখে যেন দিশেহারা হয়ে গেল সকলে; দিশেহারা হয়ে গেল সুপ্রভাও। জ্যান্ত পুতুল পেলে কী হবে! না পারে সে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে, না তার ভাল লাগে তাকে এক-ঠায় বসে-বসে দুধ খাওয়াতে; তবে এ-নিয়ে কেউই তাকে বকাবকি করে না। ছোটবোন বা মায়ের কোলে মেয়েটাকে দিয়ে, যখন-তখন ঘুমিয়েও নিতে পারে সুপ্রভা। তার বর ভূতেশ এসে মেয়ে আর বউকে একবার দেখে গেছে। সঙ্গে তারা এবং মেজোবউদিও ছিল। ভূতেশের সঙ্গেই মা-মেয়েও মিরাট ফিরে গেছে। তখনই ভূতেশের কাছ থেকে সুপ্রভা জানল যে, তারার যেহেতু বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তাই ভূতেশের ওখানেও আর খুব বেশি দিন থাকতে পারবে না ওরা। আর মেজোবউদির কাছে সে শুনল যে, ভূতেশকে তো ওই বাংলো ছেড়ে দিতে হবে, কারণ তার পোস্টিং হয়েছে দিল্লিতে। সুপ্রভা তো কিছুই চেনে না; ফলে এ-নিয়ে তার কোনও মাথাব্যথাও নেই। মেজোবউদি এ-ও জানাল যে, সুপ্রভার মেয়ে হবার আগেই, ছোটঠাকুরঝিরও একটি মেয়ে হয়েছে। এই কারণেই বড়ঠাকুরঝির ওপর খুব চাপ পড়ে গেছে। কিন্তু নিজের মেয়ের বিয়ে নিয়ে একটা কথাতেও সুপ্রভার কাছে একেবারেই মুখ খুলল না মেজোবউদি।
ভূতেশকে আরও কিছু দিন মিরাটেই থেকে যেতে হবে। দিল্লিতে কাজে যোগ দিয়েই যে কোয়ার্টার পাবে এমন নয়; ফলে কোয়ার্টার না পাওয়া অবধি দিল্লি গিয়েও তাকে থাকতে হবে মেসেই। এবার সমস্যা যে, ওই কচি বাচ্চা নিয়ে সুপ্রভা কতদিনই বা একা-একা কাটাবে! সুপ্রভা না থাকলে আজকাল ভূতেশের কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে! তার বউ হিসেবে তেমন শক্তপোক্ত না হলেও সুপ্রভার সরল উপস্থিতিতে সব যেন কেমন অন্যরকম হয়ে যায়; ভূতেশ বুঝতে পারে যে, মেজোবউদি, ছোটখুকি, এমনকী তারাও তাকে কেবল দুয়ে নিতে চায়; এ-সংসারে ভালমানুষ বলতে শুধু ওই দুজন— তার বউ প্রভা আর বড়খুকি বিরজাবালা। মেজোবউদিকে মিরাটে ফিরিয়ে এনে খুব সংকটেই পড়ল ভূতেশ। একে-ওকে ধরে, তারার বিয়ের নাম করে, কী যে সব দামি-দামি জিনিস কিনে ফেলছে কে জানে! ভূতেশের দায় শুধু সে-সবের দাম মিটিয়ে যাওয়া; তা ছাড়াও আশেপাশে থাকা দুনিয়ার লোকজনের সঙ্গে ‘বউদি’ পাতিয়ে বলতে শুরু করছে যে, প্রভা নাকি ভূতেশের উপযুক্ত বউই নয়। ওই মেজোবউদি না থাকলে এটুকুও উড়েপুড়ে যেত! সে যে বিধবা হয়েও বাপের ঘরে যায়নি, সে নাকি তার দায়িত্ববোধ থেকেই। নিজের রাগ বাইরে প্রকাশ না করেও, ভূতেশ কিন্তু মনে-মনে একরকম ঠিকই করে নিল যে, কচি মেয়ে নিয়ে প্রভাকে এখনই এখানে আনা না গেলেও, মেজোবউদিকে সে আর কখনও তার সংসারে ঢোকাবে না; আর বিয়ে হয়ে ভাইঝি তারা এই মিরাটে ফিরে এলেও ভূতেশ চিন্তামুক্ত; কারণ সে-ও তো বদলি পেয়ে চলে যাবে দিল্লি। ফলে আর কোনও সূত্রেই ঘাড় পাততে হবে না ভূতেশকে।
মিরাটের বাংলোর জিনিসপত্র মোটামুটি গুছিয়ে, চাবি বন্ধ করে, এবার সে চলল তার নিজের বাড়িতে মেজোবউদি আর তারাকে রেখে আসতে। তিনটে নতুন স্যুটকেসভর্তি জিনিস নিয়ে মিরাট ছাড়ল মেজোবউদি আর তারা। চৌকিদারের হাতে চাবি দিয়ে ভূতেশ বলে গেল, শিগগিরই সে ফিরবে। স্টেশনে পৌঁছতেই একজন বাংলা-বলা লোক এসে সেলাম ঠুকল ভূতেশকে। মেজোবউদি আর তারাকে দেখিয়ে দিয়ে সে বলে দিল, ওই দুজনকে সাবধানে বাড়ি পৌঁছে দিতে। মেজোবউদি অবাক হয়ে দেখল যে, তাদের দুজনের টিকিট লোকটির হাতে ধরিয়ে, রিজার্ভ কামরায় তাদের তুলে দিয়েই, অন্যদিকে চলে গেল ভূতেশ; আর কোনও কথা বলবার সুযোগই সে দিল না মেজোবউদিকে। ট্রেন ছেড়ে দিতেই নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কামরায় গুছিয়ে বসল ভূতেশ; বাবা-মায়ের কাছে ফিরে না গিয়ে এখন সে যাবে তার শ্বশুরবাড়ি, প্রভাকে দেখতে। না, কোনও খবর দিয়ে সে যাচ্ছে না। শ্বশুরবাড়িটা কি তারও একরকম বাড়ি নয়!
শ্বশুরমশাই যেমন বেজায় খুশি হঠাৎ করে ভূতেশ আসায়, তেমনই খুশি প্রভার ভাই, বোন এবং প্রভাও; এখানে তার নাম ‘জামাইবাবু’ বা ‘বাবাজীবন’। এই আন্তরিকতায় ভূতেশের মন গলে যায়; স্বার্থপরতার যে-ক্ষত নিয়ে সে এসেছিল, তাতে যেন মুহূর্তে শান্তির প্রলাপ পড়ল। মনে-মনে সে এ-ও ভাবল যে, দিল্লি না গিয়ে এই ‘আংরেজাবাদে’ বদলি নিলেই তো ভাল হত! এখান থেকে তার নিজের বাড়িতে যাতায়াতেরও সুরাহা হয়ে যেত বেশ; সরকারি কোয়ার্টারে থাকলে কেউ আর বলতে পারত না যে ঘরজামাই! মুহূর্তে সিধে হয়ে বসে ভূতেশ। চোয়াল শক্ত করে মনে মনে বলে যে, কীসব আবোল-তাবোল ভাবছে সে! ভূতেশ কি জানে না যে, যেখানেই যাও, সংসারের জঞ্জাল ঘিরে থাকবেই! কোথায় দিল্লি আর কোথায় এই গৌড়বঙ্গ! দিল্লি তাকে তিনটে ভাষায় চৌকস করে দেবে! তার ছেলে-মেয়েরাও গড়গড় করে ইংরেজি আর হিন্দি বলবে। এসব প্রান্তিক জায়গায় মানায় নাকি তাকে! দেশের বা পরিবারের উন্নতিকল্পে তো সে চাকরি নেয়নি; সে চেয়েছে নিজের উন্নতির পথটা চিনে, ধাপে-ধাপে এগিয়ে যেতে— মানে যতদূর পারা যায় আর কি!
২
প্রভা তো এক কথায় রাজিই হয়ে গেল তাদের মেয়েকে নিয়ে ভূতেশের সঙ্গে মিরাট ফিরে যেতে। তবে শ্বশুরমশাইয়ের অনুরোধে প্রভার সেই নিধিকাকাও চলল। আর কচি মেয়ের দেখভাল করতে নিধির ছেলে-বউও। খুব নিশ্চিন্ত বোধ করল ভূতেশ। এরা থাকলে ওখানকার জীবন তাদের ভালই কাটবে বলে মনে হয়। বরের সঙ্গে থাকতে পাবে, শুধু এই আনন্দেই প্রভার মুখে যেন খই ফুটছে; বাচ্চাকেও ভালই সামলাচ্ছে প্রভা। নিজেদের জন্য এই প্রথম একটা কুপে বুক করেছে ভূতেশ; পাঁচ মাসের মেয়েটাকে কোলে নিয়ে, আদর করতেও কোনও সংকোচ হচ্ছে না তার। কুপের বাইরেই নিধিকাকাদের সিট। একবার ডাকলেই এসে যাচ্ছে তারা। ভূতেশের মনে হল যে, তার বউ প্রভা আর ওই কচি মেয়েটাকে নিয়েই তো তার আসল সংসার! বাকি সব তার দায় এবং কর্তব্য; সেখান থেকে আনন্দ পাবার তো কিছুই নেই। প্রভাকে একা করে পেয়ে তার মনে হচ্ছে যে, সাহেবরা তো এভাবেই বউ, বাচ্চা, খানসামা, আরদালি নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়ায়। মাসি-পিসি-বউদি-শাশুড়ি, কে কোথায় সঙ্গে থাকে তাদের! দেখা যাক যে কতদিনে প্রভা তার সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে!
স্টেশন থেকে বেরোতেই ভূতেশ দেখল যে, একখানি সরকারি ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে তার আরদালি দাঁড়িয়ে আছে। অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের বাংলোয় পৌঁছে আর এক চমক; মেয়ে নিয়ে প্রভা আসছে শুনেই, পাশের বাংলোর বাঙালি অফিসারের গিন্নি একেবারে প্রদীপ, ফুল, মিষ্টি নিয়ে তৈরি। কনকরাণীকে বরণ করে ঘরে তুলে, সকলকে মিষ্টিমুখ করিয়ে তবে তিনি নিজের বাংলোয় ফিরে গেলেন। অভিভূত হয়ে পড়ল ভূতেশ। দেখতে-দেখতে স্নান-বিশ্রামের সময়ও হয়ে গেল। দুপুরের খাওয়া সেরে ভূতেশ বেরিয়ে গেল নিজের অফিসের দিকে। প্রভা আর নিধিকাকা চলে গেল বাগানের তদারকি করতে; নিজের একপাশে তার ছেলেটাকে শুইয়ে, অন্য পাশে প্রভার মেয়েকে চাপড় দিতে-দিতে ঘুম পাড়াতে লাগল নিধিকাকার বউ সোনাকাকি। সন্ধেবেলা বাংলোয় ফিরে ভূতেশের মনেই হল না যে, ওইদিন সকালেই তারা এ-বাড়ি ফিরেছে। কী সুন্দর পরিপাটি করে চুল বেঁধে, হেলান দিয়ে বসে, খুকিকে দুধ খাওয়াচ্ছে প্রভা! তার চোখের ওপর খোলা রয়েছে একটা বাংলা বই। মনে হয় কোনও নভেল পড়ছিল সে। ভূতেশকে দেখে বইখানি মুড়ে রেখে, পাকা গিন্নির মতোই প্রভা বলল, ‘বাবুকে জল খাবার আর শরবত দাও।’
ভূতেশ বলল, ‘কাকে বললে? এ-সময়ে তো আশেপাশে কেউ থাকে না!’
‘রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে তবে ওদের যেতে বলেছি; চৌকিদার নিধিকাকাকে তাই বলে দিয়েছে; মানে অতক্ষণই তো ওদের থাকবার কথা। আগে ছুটি দেওয়ার ব্যবস্থা নেই; সব বাংলো-কোয়ার্টারেই এটাই নিয়ম।’
‘নিধিকাকারা কোথায়? ওদের দেখছি না তো! ওদের সব জিনিসপত্রই বা কোথায় রাখল?’
‘কেন? আউট-হাউসে। জিনিসপত্রসমেত ওখানেই পাঠিয়ে দিয়েছি ওদের; এতক্ষণে সব নিশ্চয়ই গোছানোও হয়ে গেছে; সোনাকাকিমা তো হাত-কোলে করে বসে থাকতেই পারে না।’
ভূতেশ অবাক হয়ে গেল প্রভাকে দেখে; নিজের হাতে সংসার পেয়ে এতটা বদলে গেল প্রভা! ভূতেশের ইচ্ছে হল, প্রভার খাটের পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসেই জলখাবার খায়; কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ভেবে, সে চলে গেল নিজের ঘরে। চোখের ওপর ভাসতে লাগল এই বাংলোতে থাকাকালীনই এর আগে কাটানো সেই বিষাক্ত সন্ধেগুলো— অগোছালো চুলে, অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছে প্রভা; পরিপাটি সেজে জলখাবারের পিরিচ নিয়ে, তার ঘরে এসে ঢুকছে তারা; নিধিকাকা এক কোণে বসে আছে চোরের মতো; আর নেশা করার অভিযোগে খানসামা-আরদালিদের বিকেল না হতেই ছুটি করে দিয়ে, রান্নাঘরে খুন্তি নেড়েই চলেছে মেজোবউদি। এইসব ক্লেদ এবং অসহায়তা থেকে প্রভা যেন মুক্তি দিল তাকে!
রাতে শুতে যাবার আগে, আজ কতকাল পরে আবার একবার কাপড় ছাড়ল ভূতেশ; নরম ফতুয়া আর এখানকার বাজার থেকে কেনা একটা ঢিলে পায়জামা পরে, মাথা আঁচড়াতে লাগল ভূতেশ। আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে, হঠাৎই তার সংবিৎ ফিরে এল; ভাল করে তাকাতেই দেখল যে, আয়নার মধ্যে একই সঙ্গে দুটো মুখ। লম্বা শরীর ঝুঁকিয়ে মাথা আঁচড়াচ্ছিল ভূতেশ। এখন সে দেখল যে, তার কাঁধের কাছে সুপ্রভার মুখটাও; আয়নার মধ্যে দিয়েই কিছু একটা হাতে করে তুলে, সুপ্রভা কী যেন দেখাতে চাইছে তাকে; আয়নার ভেতর দিয়েই ভূতেশও জানতে চাইল, ‘কী এনেছ? এই তো শরবত খেলাম, আবার কী!’
‘আমার বড়মেয়ে, বুড়ি! বিয়ে হয়ে মিতেনির কাছে চলে গিয়েছিল; আসবার সময়ে আবার আমি নিয়ে এসেছি।’
‘মেয়ে তো ঘুমোচ্ছে! এটা তো একটা পুতুল! কোথা থেকে বার করে আনলে? কে দিল?’
‘পুতুল তো কী! এটাই বড়মেয়ে; তবে এ আমার একার মেয়ে; ওর নাম বুড়ি; কোলে নেবে?’
‘কী ছেলেমানুষি শুরু করেছ বলো তো! লোকে যে তোমাকে পাগলি বলবে তা কি জানো!’
‘পুতুল খেলা কি খারাপ! আমাকে পাগলি বললে, তুমি তাদের বকে দিয়ো তো!’
‘জ্যান্ত পুতুল পেয়েও আবার পুতুল খেলবে! তুমি কি একটুও বড় হবে না পরি!’
‘পুতুল কখনও জ্যান্ত হয় নাকি! আর ও কেন পুতুল হবে? ও তো একটা ছোট্ট মেয়ে; দেখতে-দেখতে বড় হয়ে যাবে; কিন্তু আমার এই বুড়ি ঠিক একই রকম থাকবে।’
‘আর কিছুদিন পর তো তোমার মেয়েই এই পুতুল নিয়ে খেলবে, তখন?’
‘সে পুতুল তুমি কিনে দেবে; এটা যেমন আমার বাবা আমাকে কিনে দিয়েছে; এই বুড়ি আমার কোলে-কোলে থাকবে সব সময়ে; ওকে ছেড়ে তো থাকতেই পারব না আমি!’
সোনাকাকিমার গলা পেয়েই, তার সেই পুতুলটাকে কোলে করেই, ভূতেশের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল প্রভা। ভূতেশের মনে পড়ল যে, তার বিয়েতে ‘কনে-তত্ত্বে’ একটা পুতুলের টুকরিও এসেছিল বটে; সেটা নিয়ে বড়ভাইঝি তারা টানাটানি করলে, বড়খুকি বারণ করেছিল; প্রভাকে দেখিয়ে মনে হয় সেটা সে অন্য কোথাও সরিয়েও রেখেছিল; অষ্টমঙ্গলায় বাপের-বাড়ি যাওয়ার সময়ে প্রভার জিনিসপত্রের সঙ্গে ওই পুতুলটাও নিশ্চয়ই সে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। ভূতেশ অবশ্য সঠিক জানে না যে, প্রভার কোলে-কোলে ঘোরা আজকে দেখা এই পুতুলটাই তার সেই তত্ত্বে-আসা পুতুলই কি না! তবে একটা কথা ভেবে বেশ মজা পেল ভূতেশ যে, এই পুতুলের বিয়েতেই সে একই সঙ্গে নেমন্তন্ন এবং প্রথম একখানি পত্র পেয়েছিল তার বউ প্রভার কাছ থেকে।
নানরুটি, কিমার দমপোক্ত আর একটু ক্ষীর— এই ছিল রাতের খাবারে। প্রভার তদারকিতে এক গ্লাস ইসবগুলও। খানসামার রাঁধা ওই অপূর্ব স্বাদের আমিষ খাবার খেয়ে ভূতেশের মনে হল যে, এতদিন সে-ও যেন বৈধব্য যন্ত্রণায় ভুগে আমিষ খেতেই ভুলে গিয়েছিল; হয় বড়া, নয় বড়ি; খাওয়ার ব্যাপারে বিধবা মেজোবউদির নিষেধ-বারণগুলোই যেন চেপে বসেছিল সকলের ওপর। এখানকার খানসামা শুক্তো, বড়ার ঝাল বা লাউঘণ্ট রাঁধতে না পারলেও, যে-রান্নাগুলো পারে সেগুলো তো অতি উপাদেয়; মেজোবউদির ওই ‘মোছলমান’ বিচার থেকেও সংসারটাকে একেবারে মুক্ত করে দিল সুপ্রভা। অথচ ভূতেশের কাছে একদিনের জন্যও কোনও নালিশই সে করেনি মেজোবউদির নামে। তেমনই তার রাগ নেই তারার ওপরেও; যদিও ভূতেশ জানে যে, সুপ্রভার সমস্ত শৌখিন ব্যবহার্য তাকে না জিজ্ঞেস করেই যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে ওই তারা। ভূতেশ ভেবে পেল না যে, ঠিক কোন দিক দিয়ে সে বিচার করবে সুপ্রভার— তার উদারতা না সহ্যশক্তি! ভূতেশের যেন বড় আনন্দ হল, সুপ্রভার কাছে অন্তত মনে-মনে কিছুটা পরাজয় স্বীকার করতে পেরে!
৩
কলকাতা নাকি উত্তাল হয়ে উঠেছে। এদিকে আবার দেশে-দেশেও নাকি লড়াই-যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে যে-কোনও সময়ে। প্রভা যে খুব ভয় পেয়ে গেছে তা নয়। কারণ দেশ ব্যাপারটা যে ঠিক কী, সেটাই তার কাছে অস্পষ্ট। সে শুধু তিনটে দেশ চেনে; বাপের দেশ— আংরেজাবাদ বা মালদা, শ্বশুরের দেশ— সোদপুর, আর তার বরের দেশ এই মিরাট। কিন্তু নিধিকাকা বলেছে যে, এত-এত দেশ আছে বলেই তো, এই এত বড় একটা পৃথিবীতেও নাকি ঠিকঠাক ধরানো যাচ্ছে না সব ক’টা দেশকে। সবাই তাদের সীমানা বাড়াতে চায়; আর লড়াইটাও নাকি বাঁধতে চলেছে সেটা নিয়েই। আরও বলেছে যে, ইংরেজরা যেমন এই আমাদের দেশে ঢুকে পড়েছে, তেমন নাকি তারা আরও অন্য-অন্য দেশেও ঢুকে পড়েছে। প্রভা ভাগ্যিস এত কিছু বোঝে না! তার তো সাহেব-মেম এবং তাদের পোষা নানা-জাতের কুকুরগুলো দেখে খুবই ভাল লাগে। লোকে যখন তার বরকে দেখে ‘সাহেব’ বলে, তার বেশ গর্বই হয়। তাদের মেয়েটাও ওই বাপের ধারা হয়েছে বলেই না তার নাম কনকরাণী! তবে এক-একদিন যখন অফিস থেকে ভূতেশের বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়, তখন প্রভা কাঁদতে শুরু করে। আর ভূতেশকে একা পেলেই জিজ্ঞেস করে, ‘হ্যাঁ গো, লড়াই কি বেঁধে গেল?’ তবে ভূতেশ বাড়ি না ফেরা অবধি নিধিকাকা বা সোনাকাকিমা তাকে এই বাংলোয় একা রেখে নিজেদের আউট-হাউসে শুতে চলে যায় না। মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে প্রভা বসে-বসে সেলাই করে। ভূতেশের এনে দেওয়া রেশমি সুতো দিয়ে ব্লাউজের হাতায় ফুল তোলে। মালির বউ সুমাইয়া তাকে একরকম সেলাই শিখিয়েছে, যার নাম লখনউ-চিকন। এইরকম সেলাই শুধু এ-অঞ্চলেই হয়। প্রভা এই সেলাই দিয়ে সুন্দর-সুন্দর বালিশের ওয়াড় বানিয়েছে। প্রভা এখন আর বাগানের গাছে চড়ে না; তবে লাঠি দিয়ে হনুমান তাড়ায়। নিধিকাকা যেন কোথা থেকে জোগাড় করে এনেছে মেমসাহেবদের ফেলে দেওয়া ‘প্যাটার্ন বুক’। প্রভা যেটুকু ইংরেজি জানে, তাতে সেটা পড়া যায়। সেইসব প্যাটার্ন দেখে-দেখে, সে আর সোনাকাকি মিলে উল দিয়ে কার্পেট সেলাই করে। আর যে সেলাইটা সে বাপের বাড়ি থাকতে শুরু করেছিল, সেটা শেষ করে ফেলেছে। লাল ফুল দিয়ে ভরাট করা আসনের মাঝখানটা সাদা দিয়ে ভরাট করে তাতে লিখেছে,
‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’—
সেই আসনটা শেষ করে ভূতেশকে দেখাতে গেলে সে বলেছে, ওটা ভাঁজ করে ওর অফিসের ব্যাগের সঙ্গে রেখে দিতে। কিছুদিন পরে সেই আসনটাকেই ছবির ফ্রেমে কাচ দিয়ে বাঁধিয়ে প্রভার হাতে দিয়েছে ভূতেশ; আর বলেছে, দেওয়ালে একটা পেরেক টাঙিয়ে, তাতে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিলেই ছবি হয়ে যাবে; তখন সেটা ওইভাবে সাজিয়ে রাখতে। এতে খুবই রাগ হয়েছে প্রভার; ভূতেশের জন্য বানানো আসনটায় নিজে না বসে সেটাকে বাঁধিয়ে এনে দেওয়ালে টাঙানোর ছবি করে দিতে। প্রভা ঠিক করেছে যে, তার হাতের কোনও কাজই ভূতেশকে আর সে দেখাবে না। সোনাকাকি অবশ্য বলেছে যে, ‘পরি রে, তুই-ই বটে ভাগ্য করে বর পেয়েছিস!’
আমি সুপ্রভা— বাপের বাড়িতে সবাই অবশ্য পরি বলেই ডাকে। আমার বর এমনিতে আমাকে ‘শুনছ’, ‘শুনছ’ করলেও মাঝে মাঝে কিন্তু ‘পরি’ও বলে। এবারে মিরাট এসে সব যেন কেমন বদলে গেল। এর আগে কেন যে সব অন্যরকম লাগত তা আমি জানি না; তবে লাগত তো বটেই; আমার কি তখন কিছুই ভাল লাগত না? কেন আমি স্নান না করে, বিকেলের কাপড় না ছেড়ে, বাগানময় ঘুরে-ঘুরে বেড়াতাম! সোনাকাকি এমন নরম করে কথা বলে যে, মনে হয় যেন আমার মা বা বড়ঠাকুরঝি বলছে। অনেক কিছুই আমাকে আর মনে করিয়ে দিতেও হয় না। নিধিকাকাও বয়েমের ‘গজক’ ফুরোলেই আবার ঠিক কিনে এনে ভরে রাখে। সবাই মিলে নদী দেখতেও যাওয়া হয় মাঝে মাঝে; এমনকী বাংলোর কাছেই ‘অঘোরনাথ’ মন্দিরেও। এটাও আমার শ্বশুরবাড়ির কৃপানাথ মন্দিরের মতোই শিবের মন্দির; নিধিকাকা তার বউকে একদিন বলছিল যে, এই মন্দিরের আর একটা নাম ‘কালি পলটন মন্দির’ হলেও এটা নাকি কালী মন্দির নয়; এ-দেশের সেপাইরা নাকি সাহেবদের বিরুদ্ধে লড়বে বলে এই মন্দিরে জমায়েত হয়েই লুকিয়ে-লুকিয়ে মতলব আঁটত। সাহেবদের মতো রং নয় বলেই কি ওদের ‘কালি-পলটন’ বলত!
আমার বর লোকটা যে কেমন ঠিক বুঝতে পারি না। আগে যেমন রাগী ছিল, এখন আর তেমন নেই; কিন্তু মজা করে গপ্পো করতে পারে না; অনেক ব্যাপারে ‘আলোচনা’ করতে পারে। এটা অবশ্য নিধিকাকা আমাকে বলেছে। সুন্দর হাতের লেখায় চিঠি আর হিসেবপত্র লেখে। টাকাও গুনে-গুনে রাখে। নিজের আলমারির চাবিটা ঠিক খেয়াল করে অফিসের ব্যাগে ভরে। আমাকে আদর করার সময়ে মনে হয়, এটা-ই ওর সবচেয়ে ভাল লাগে। আর খুশি হয় আমার বানানো খাবার খেয়ে। নিজের সব জিনিসেও খুব যত্ন। সব সময়ে ফিটফাট। কিন্তু এর বাইরে আর কিছুতেই উৎসাহ নেই। গান, নাটক, খেলা, বাগান, সাঁতার বা সিনেমা-থিয়েটার— এসবের কোনও একটাতেও কেন যে কোনও উৎসাহ নেই কে জানে! আর এও খুব আশ্চর্য যে, খবরের কাগজ ছাড়া আর কিছুই পড়ে না! তবে নিধিকাকার ছেলেটাকে সময় পেলেই ইংরেজি পড়ায়। আর নিধিকাকাকেও বলে কীসবের যেন ব্যবসা করতে।
সোনাকাকি খেয়াল করেছে যে, এ-মাসে আমার নাকি মাসিক হয়নি; তার মানে পেটে আবার বাচ্চা এসেছে! আর এ যদি হয়, তো খুবই আনন্দের; কারণ বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে আবার বেশ লম্বা সময় থাকতে পারব আমি! দেখা যাক আমার বর কী বলে! তবে তার মধ্যে লড়াই-যুদ্ধ লেগে গেলেই কেলেঙ্কারি হবে; কেউই কি বেঁচে থাকব তখন! পুরো পৃথিবীটাই নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে একেবারে! সবাই মরে যাবে ভাবতেই আমার মেয়ে কনকরাণীর কথা ভেবে ভীষণ কান্না পায় আমার। আমরা সবাই মরে গেলে ওকেই বা তখন কে দেখবে!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র