হরশঙ্কর – তিন
কোনওভাবেই যা মেলাতে পারল না হরশঙ্কর, তা হল রোড্ডা কোম্পানির ওই বন্দুকের দোকানটায় ভূতেশ সেদিন কেন ঢুকেছিল! তবে হরশঙ্কর এ-ব্যাপারে নিশ্চিত যে, গা ঢাকা দিয়ে সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়লেও, ভূতেশের নজর সেদিন কিন্তু সে এড়াতে পারেনি; একটাই যা শান্তি, তা হল, ভূতেশের চাপা স্বভাব। ফলে বন্দুকের দোকানে তাকে দেখে, ভূতেশ কোথাও গল্প ছড়াবে না; তাছাড়াও হরুর কাছে খবর আছে যে মীরাটে নিজের পোস্টিং নিয়ে ভূতেশ এখন খুবই ব্যস্ত। মীরাট প্রসঙ্গ মনে আসাতেই হরুর মাথায় খেলে গেল, তবে কি আর্মি বিভাগে কাজের সঙ্গে বন্দুকের সম্পর্কই ভূতেশকে এদিকে টেনে আনছে! এমনও ভাবতে শুরুর করল এই হরু যে, ভূতেশ কি ওইদিনই প্রথম এল, না কি মাঝে মাঝেই সে আসে! ওই দোকানে হরুর যাতায়াত লক্ষ করতেই কি ভূতেশেরও আনাগোনা শুরু হল!
কিন্তু একটা ব্যাপারে হরু নিশ্চিত যে, হরুকে ওখানে দেখেই ওই ‘কটা-ভুতো’ অনায়াসে আঁচ করে নেবে, কলকাতার সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে তার গোপন আঁতাত; তবে রক্ষা একটাই যে নিজের গা-বাঁচানো স্বভাবের ‘কটা-ভুতো’র মুখ থেকে এ-ব্যাপারে কিছুই কোনওদিন আন্দাজ পাওয়া যাবে না! টাকাপয়সা বা দামি-গেরস্ত জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা থাকায়, হরুকে নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাবে না সে। ভূতেশের চোখে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে প্রথমে বেশ আত্মপ্রসাদ হয়েছিল হরুর; যেন সে খানিক জাতে উঠল। কিন্তু মনের সেই ভাবটা মিলিয়ে যেতেও খুব বেশি সময় লাগল না হরুর; মুহূর্তে মনে হল, আচ্ছা ভূতেশ তাকে খবরা-খবর সংগ্রহের দালাল ভেবে বসল না তো! মানে, unpaid–vagabond-informer! যাকে বলা যায় আদর্শবাদের ধুয়ো-ধরা এক ছিঁচকে যোগাযোগকারী মাত্র! এ-কথাটা একদিক থেকে তো মর্মান্তিক ভাবেই সত্যি; না সে বিশ্বাস করে এইসব গুলি-গোলা-বোমা-বন্দুকের সন্ত্রাসে, না নিজে বন্দুক ধরেছে কোনওদিন; না সে ঠিক করতে পেরেছে তার নিজের জন্য বেছে নেওয়া কোনও একটা একমুখীন পথ; মেসে থাকার সুবাদে এই বউবাজার অঞ্চলের যেসব ছেলেদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে, তারা তো তার মতো কনফিউসড নয়; বিশ্বব্যাপী মতাদর্শের পরোয়াও নেই তাদের। একটাই লক্ষ্য— অস্ত্র সংগ্রহ, বৃটিশ নিধন এবং সন্ত্রাস তৈরি করে তাদের তাড়ানো। ফলে ভূতেশের চোখে না সে বিপ্লবী, না কোনও কেউকেটা হয়ে ওঠার নিশ্চিত কোনও সম্ভাবনাও। বিষণ্ণ হরশঙ্কর নিজের ভাবনার জালে আর বেশি না জড়িয়ে অন্য দিকে মন ফেরাল।
২
পোস্টাফিসে গিয়ে পোস্টমাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে ঢুকেই নিশানাথের দিকে নজর পড়ল তার; ঠিকই তো! এদিকে আসাই হয়নি কয়েক সপ্তাহ; তার মানে নিশানাথের হাতে পাঠানো মায়ের চিঠিগুলোও তো জমে আছে! তার কাছ থেকে জবাব না পেয়ে মা-ও নিশ্চয়ই উদ্বেগে আছেন! তাকে দেখেই নিশানাথ বেরিয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই হরু তাকে ইশারায় থামাল; তাদের দুই ভাইকে একসঙ্গে দেখে আর কেউ কিছু লক্ষ না করলেও, তাঁর ঘরের জানলা দিয়ে পোস্টমাস্টারবাবু ঠিকই দেখতে পেলেন। তাঁর চোখে আমন্ত্রণের ইঙ্গিত পেয়ে, একটু আগে পরে করে তাঁর ঘরে ঢুকে এল নিশি ও হরু দুজনেই। মায়ের আগের চিঠিদুটো হরুকে না দিয়ে, নিশানাথের দিকে হাত বাড়িয়ে প্রথমেই তিনি নিয়ে নিলেন তার হাতে পাঠানো মায়ের আজকের চিঠিটা। নিশানাথ বেরিয়ে গেলে, হরুর সঙ্গে দু-এক কথায় বুঝিয়ে দিলেন যে, সে আসবার আগেই নিশির সঙ্গে যে তাঁর কথা হয়ে গেছে। সাবধান করতে যা বললেন তার মোদ্দা কথা এই যে, এ-অঞ্চলে থেকে খবরা-খবর চালান দেওয়াটা তার পক্ষে কতখানি বিপজ্জনক; কারণ পাড়ার বিপ্লবী দলে সেই-ই একমাত্র মেসবাবু এবং পরগাছা; তার ওপর হরুর ঘরটা বেশির ভাগ সময়তেই চাবি বন্ধ দেখাচ্ছে। অভিজ্ঞ পোস্টমাস্টারবাবুর এই সন্দেহও উড়িয়ে দিতে পারল না হরু যে, বিপাকে পড়লে পুলিশ তো তাকে সন্দেহ বশে পাকড়াও করবেই; এবং অন্য দিকে তার দায় নেবে না ওই দলবদ্ধ সন্ত্রাসবাদীরাও। হরু বুঝতে পারল যে, নিশিও আর রাজি হবে না মায়ের চিঠি বয়ে এনে বিপদ বাড়াতে; এমনকী হয়তো মাকেও ছাড় দেবে না পুলিশ। মায়ের লেখা প্রথম দুটো চিঠিতে চোখ বুলিয়ে সদ্য-আসা চিঠিটা পড়ত-পড়তে, স্তম্ভিত হয়ে গেল হরু; মা লিখেছেন,
জয় জয় কালীমাতা সহায় :
বাবা হরু, ২ মে, ১৯০৭
তোমার নিকট হইতে যে নিয়মিত পত্রোত্তর পাইব না ইহাই স্বাভাবিক। মন না মানিলেও ইহা জানি যে স্বয়ং মা কালী আমাদের সহায়; তিনিই রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন। কিন্তু ইদানীং যে-রূপ কানে আসিতেছে তাহাতে উদ্বেগ বাড়িয়া যাইতেছে। কলকাতার বাহিরেও, তোমাকে বারংবারই দেখা গিয়াছে শ্রীরামপুরের নানা জায়গায়; কেহ কারণ জিজ্ঞাসিলে বলিয়াছি কর্মসূত্রে তুমি সেথায় গিয়াছ; কিন্তু জনান্তিকের এমত ধারণাও কানে আসিতেছে তুমি নাকি খৃষ্টান হইবার বাসনায় ঘুরিতেছ; যে বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে তোমার প্রতিবাদ, সুবিধা লাভের আশায় তাহাদেরই ধর্মে ধর্মান্তরিত হইতে চাওয়া ! ইহা হইতে বড় অধর্ম আর কীই-বা হইতে পারে! কোনও খৃষ্ট-কন্যার পাণিগ্রহনেচ্ছু হইয়া এমন কাজ করিলেও তাহা একবার জানাইয়া করিও। সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হইয়া এ বিষয়ে কোন মতামত দেওয়া হইতে নিজেকে সংযত করিলাম।
নিশি-মারফৎ এই পত্র বিনিময় হইতেও আপাতত বিরত হইলাম। বিগত বছরে কোনও অর্থ চাহিয়া পাঠাও নাই দেখিয়া ইহাও অনুমান হইতেছে নিজেকে চালাইয়া লইতে এখন হয়তো বা যা-হোক কিছুটা সক্ষম হইয়াছ তুমি।
বিবাহ-ইচ্ছা হইলে জানাইও; সঙ্কোচের কারণ দেখি না।
আঃ – মা
পত্রখানা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকল হরশঙ্কর। ডালহৌসি অঞ্চলে গাছগাছালি ঘেরা এই এলাকাটাকে রেলিং দিয়ে সীমানা দেগে পার্ক বানানো হয়েছে; হয়তো সেজন্যই এত নিরিবিলি এবং ফাল্গুন মাসের ভরদুপুরের গরমেও কী সুন্দর ছায়া! লোকমুখেই এর নাম হয়ে গেছে ‘লেডি কার্জন পার্ক’। কার্জন সাহেব চলে গেলেও সৌধ বানাতে ওস্তাদ ছিলেন তিনি। যদিও তাঁর নামে কোনও রাস্তার নামকরণ এখনও অবধি হয়নি। কার্জনের কথা মনে আসতেই হরশঙ্করের খেয়াল হল, আর এক সাহেবের কথা— Henry John Stedman Cotton; হরু মনে-মনে বেশ একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করে ভাবল যে, শ্রীরামপুরে গিয়ে ভাগ্যিস খোঁজ খবর শুরু করেছিল সে! তবে না সেখান থেকেই সে জানতে পারল এই সাহেবের সম্পর্কে!
একইসঙ্গে হাসি পেল মায়ের আশঙ্কার কথা ভেবে! মাইকেল মধুসূদনের খ্রিস্টান হয়ে যাওয়ার দাগাটা বাংলার শিক্ষিত হিন্দু পরিবারগুলো এখনও মনে হয় ভুলতে পারেনি। তার মায়ের ভয় যে অমূলক নয় সেটা হরু বোঝে; কারণ ব্রাহ্ম এবং খ্রিস্টানদের সঙ্গে তার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দাদামশায়ের দেদার মেলামেশা; তাদের দিদিমার জীবনেও কখনও কখনও যা উৎপাত হয়েই দেখা দিয়েছে। তবে মায়ের আশঙ্কা যে শুধু তার ধর্মান্তরের ভাবনাকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে তা নয়; সেই সঙ্গে ইঙ্গিত করেছেন হরুর বিয়ের ব্যাপারেও। ফলে নিজে সে যা ভাবতেই পারেনি, সে দিকেও তার মনটাকে উসকে দিল মায়ের ওই চিঠিটি।
মনে-মনে উত্তর সাজিয়ে যেন গুছিয়ে একখান জবাব দিতে বসল হরু। মেসবাড়ি এবং কাগজের চাকরি— এ-দুটো থেকেই সরে আসতে চাইছিল সে; সরে আসতে চাইছিল সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে গোপন আঁতাত থেকেও। প্রথমেই মনে এসেছিল চন্দননগরের কথা। তারপর শ্রীরামপুর; ফরাসি আর ডাচ ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল এসব জায়গায়; কিন্তু মজা হল এই যে, সোদপুর-ব্যারাকপুর অঞ্চলে বড় হয়ে এসব জায়গার নাম শুনলেও গঙ্গা পেরিয়ে সে কখনও দেখতে আসেনি। ফরাসডাঙা বা শ্রীরামপুর দুইই হল ফিরিঙ্গিদের এলাকা। কয়েক বছর আগে সে এসেছিল, তারকেশ্বর, সিঙ্গুর, বড়াগাছা অঞ্চলে স্বদেশিদের হাল হকিকত জানতেই। কী মনে হতে ঘুরতে-ঘুরতেই হাজির হয়েছিল ফরাসডাঙ্গা বা চন্দননগর; আবার ওইভাবেই ফরাসডাঙ্গা থেকে শ্রীরামপুর; অবাক হয়ে গিয়েছিল এখানকার চার্চ, ইস্কুল-কলেজ, বাগান এবং বাড়িগুলোর নকশা দেখে। ব্যবসা-বাণিজ্য জমাতে ফরাসি এবং ওলন্দাজরা নোঙর করেছিল নদী-অঞ্চল ঘিরে; কিন্তু ব্রিটিশরা তাদের তাড়িয়ে শুরু করছিল শুধু ব্যবসা দিয়ে নয়, প্রশাসন দিয়েই এ-অঞ্চলগুলোর দখল নিতে। হরশঙ্করের ইচ্ছে হয়েছিল ফরাসি ভাষাটা শিখে, কোনও রকমে একটা কাজ জুটিয়ে নিয়ে, এখানেই থেকে যেতে। নিজের ইংরেজি জ্ঞানের ওপর ভাল দখল থাকার কারণেই এমন একটা ইচ্ছে তার হয়েছিল। হরশঙ্কর ব্যাকুল হয়ে উঠল মাকে একখানা চিঠি লিখে সব ব্যাপারটা খোলসা করে দেবার। বুঝিয়ে বলা যে, উদ্বেগের কারণ নেই। শান্তিতে জীবন কাটানোর জন্যই সে একটা বিকল্প পথ খুঁজছে।
৩
New India: Or India in Transition— চমৎকার বই। Henry John Stedman Cotton সাহেবের লেখা। ১৮৮৫-তে প্রকাশ হলেও এ-বই তার হাতে আসে সম্প্রতি। খোঁজ নিয়ে হরশঙ্কর জানতে পারে যে, লর্ড কার্জনের পথের কাঁটা যে শুধু মিন্টো বা কিচনার ছিলেন তাই নয়, মস্তবড় ভূমিকা পালন করেছিলেন এই কটন সাহেবও। কটন জন্মেছিলেন মাদ্রাজে; তবে সেই শৈশবেই তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল লন্ডনে; পড়াশোনা শেষ করে রীতিমতো যোগ্যতা অর্জন করে এখানে আসেন তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিয়ে। মেদিনীপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্ঠিয়া, মেহেরপুর বা ঝিনাইদা এসব অঞ্চলে রীতিমতো বসবাসও করেছেন এই কটন। সামাল দিয়েছেন ভয়াবহ বন্যা এবং ভূমিকম্প। চিটাগাং, আসাম এইসব এলাকায় থাকার কারণে ওইসব অঞ্চলও তাঁর কাছে খুবই সড়গড়। কার্জন যদিও কটনের প্রশংসা না করে পারেননি; কিন্তু সচেতন হয়ে কিছু কথা গিলেও ফেলেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ নীতির প্রতিবাদ করে যে-গুটিকয় সাহেব লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম এই কটন। তা ছাড়াও সে জেনেছে যে ‘Home Rule Movement’-এও সমর্থন আছে কটন সাহেবের। এইজন্যই বছর তিনেক আগে বম্বেতে ডাকা কংগ্রেস দলের সর্বভারতীয় সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন যে একমাত্র সাহেব, তিনিও এই কটন। এছাড়াও হালে, ১৯০৫ জানুয়ারি মাসে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে কলকাতার টাউন হলে যে-মিটিংটা হয়েছিল, সেখানেও সভাপতির আসনে সেই কটন। হরশঙ্কর ঠিকই বুঝেছিল যে, কার্জনকে ঠেকাতে যেমন মিন্টো বা কিচনারদের মতো মাথা লাগে, তেমনই সন্ত্রাস সামাল দিয়ে নেটিভদের আলাপ-আলোচনামুখী করতে লাগে কটনের মতো উদারমনস্ক কিছু দক্ষ প্রশাসকও।
হরশঙ্করের মন বলছে যে, কোনও রকমে একবার কামাখ্যা গিয়ে, সদ্য স্থাপিত ওই কটন কলেজে দরখাস্ত জমা দিলেই একটা চাকরি হয়ে যেতেও পারে; তার মনে হল এই কটন সাহেবই তাকে তরিয়ে দেবেন। সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলে সহজ হবে সাহেবেদের নজরে পড়ার। লেখাপড়া জানা নেটিভ ‘ভদ্রলোক’ তো বলতে গেলে হাতে গোনা; কিন্তু কলকাতায়, লুকিয়ে-চুরিয়ে থেকে গেলেও অচিরেই সে যাদের নজরে পড়বে তারা হল, সেপাই বা ইংরেজ পুলিশ।
আমি হরশঙ্কর। একবারে হুট করে ট্রেনে উঠে পড়ে কামাখ্যা চলেছি। সদ্য হওয়া কটন কলেজে একটা চাকরির আশায়। সোদপুর ছেড়ে কলকাতা আসতে খুব কষ্ট হয়েছিল; অথচ একদিনের সিদ্ধান্তে কলকাতা ছাড়তে যেন মুক্তির আনন্দ। একেবারেই অচেনা এক জগৎ; না জানি সেখানকার ভাষা, না কেউ চেনা মানুষ অপেক্ষা করে আছে। ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গের ফলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসাম এখন পুব বাংলার অন্তর্ভুক্ত; ঢাকা যার রাজধানী। মায়ের কাছে গপ্পো শুনেছি তাঁদের কামাখ্যা মন্দির দর্শনের। ব্যাস ওইটুকুই। আর কানে এসেছে বৃটিশদের তৈরী ‘আসাম রাইফেল’ নামে আর্মি সংগঠনের কথা। এখানকার আদিবাসীদের হয় সৈন্য, না হয় চা-বাগানের মজুর, নয়তো কয়লাখনির শ্রমিক বানিয়ে চলেছে তারা। অপরিশোধিত খনিজ-তেল, কয়লা আর চায়ের ব্যবসা জমাতেই রেল লাইন আর রাস্তা তৈরি হচ্ছে দ্রুত। এরকম একটা পরিস্থিতিতে কটন সাহেব একটা কলেজ বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন কী করে? ভেবেই তো ভীষণ চঞ্চল হয়ে পড়ছি!
হাওড়া থেকে রেলে চেপে যেতে দু-রাত তো লাগবেই; পথে কিছু খাওয়া জুটবে কি না তাই বা কে জানে! সোজা ডিব্রুগড়ে নেমে খুঁজে বার করতে হবে কামাখ্যা মন্দির। আর কোথাও থাকার জায়গা না জুটুক মন্দির চাতালে ঠিক জায়গা হয়ে যাবে; এদেশের এই এক সুবিধে। মন্দিরগুলোই বিনা-পয়সার পান্থশালা; চোর-গুণ্ডা না বদমাশ— এমন সন্দেহের কোনও বাছ-বিচার নেই। চাইলে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে দু-একজন বাঙালিকেও। ফলে কটন কলেজ খুঁজে পেতে অসুবিধে হবে না।
মা কি ভাবছেন, বিরজাবালা আর জয়নারায়ণকে একটা খবর দিয়ে আসা উচিত ছিল কি না, তনুদার রেফারেন্স কাজে আসত নিশ্চয়ই— এত সব ছাইপাঁশ মাথা থেকে তাড়িয়ে কটন সাহেবের লেখা বইয়ের পাতা খুলে বসলাম। কয়লার গুঁড়ো মাখার ভয়ে ইচ্ছে করেই জানলার ধারের সিটটার থেকে সরে বসেছি। কামরার ভেতরে হলদেটে আলো বা ট্রেনের দুলুনি— কোনওটাতেই পড়তে অসুবিধে হচ্ছে না আমার।
‘A constructive policy is needed, which shall not only guide and control events during the period of transition but shall also, when necessary, abstain from interference. The difficulty is to pass from the old order without disturbance.’
সাহেবের ভাবনায় বেশ চমক আছে; মজা আছে শব্দ ব্যবহারেও। ‘english prejudice’, ‘wise conservation’— এসব তো বেশ নতুন বলেই ঠেকছে। সব থেকে আনন্দ হচ্ছে সাহেবদের প্রতি তাঁর সাবধানবাণী পড়ে। তিনি লিখছেন যে স্বাধীনতা আন্দোলনকে যেন ‘schoolboy agitation’ ভেবে লঘু করে না দেখা হয়; কারণ তাঁর মতে, ‘Present generation is the father of the next’।
তবে আমার মনে যে দুর্মর আশা জেগেছে, তাতেও ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে এ-দেশের মনস্ক যুবাদের সম্পর্কে তাঁরই মূল্যায়ন; ভূতেশের ওই তাচ্ছিল্যের জবাবে তো এটা আমারও উত্তর—
‘Wise in their own reticence, dignified in their self-respect, the true leaders of native opinion, pursue their own course with as little communications with Europeans as is consistent with the exercise of their full influence. Englishmen hear little of them and the Government, as a rule, knows them not; but their names are house-hold words among the homes of the people’.
ঘুম পায়নি মোটেই; এক চরম আত্মবিশ্বাসের আনন্দে বইটা বন্ধ করে থম মেরে বসে রইলাম। জানলার বাইরে ভিজে ভিজে সবুজ বনানী আর থেকে থেকেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে পার হওয়া; আমার বুকের ধুকপুকানির সংগতে ট্রেনের কু-উউ— ঝিক ঝিক…।
উত্তেজনা এমনই, যেন দেখা করতে চলেছি স্বয়ং কটন সাহেবের সঙ্গেই। বৃটিশ পার্লামেন্টের লিবারাল দলের সমর্থক, অগাস্ট ক্যোঁতয়ের মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং বঙ্গভঙ্গ-আইন ও কার্জন বিরোধী একজন সংবেদী মানুষ; এবং প্রমাণিতভাবে কর্মদক্ষ।
চাকরি জুটুক বা না জুটুক, গঙ্গাপাড়ের নিশ্চিন্ত জীবন একবার অন্তত ভেসে যাক উত্তাল ব্রহ্মপুত্রে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র