দশম শ্রেণিতে উঠব-উঠব’র সময় থেকেই ভারতীয় বাচ্চাদের একটা কথা শুনতে হয়। প্রশ্নবাণে ভরে ওঠে আকাশ। বাবা-মা, কাকু-কাকিমা, জেঠু-জেঠিমা, প্রতিবেশী, যাকে চিনি না সেই রকম কাকু— সবার একটাই প্রশ্ন, ক্লাস টেনের পর কী নেবে? কী নিয়ে পড়াশুনা করবে?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই একটা লেজুড় জুড়ে দেন অবশ্য— সাইন্স নিয়ে পড়লেই ভাল, অনেক সুযোগ ভবিষ্যতে। এবার যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে সে যে কী চায়, কেন চায়, এসব নিয়ে ভাবা আমাদের যাবতীয় ভারতীয় আচার-আচরণ, ন্যায়-নীতি, দর্শন ইত্যাদিতে নেই। চাপিয়ে দিতে পারলে যে প্রাপ্তির আনন্দ, তা ভারতীয়দের হৃদয়কে আরও শুদ্ধ করে তোলে।
বিশেষ করে বাঙালি পরিবারের কথা বলতে পারি, কারণ আমার নিবাস কলিকাতা শহরে। তাই যা দেখেছি তাই নিয়েই কথা বলা ভাল। যে বাঙালি বাড়িতে ছাত্র/ছাত্রী রয়েছে এবং দশম শ্রেণির পর শিক্ষাক্ষেত্র নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছে, তার গোটা বেঁচে থাকার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে একটিই বিষয়— বিজ্ঞান কেন পড়া উচিত।
সে ভাল কথা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, কমার্স সব কিছুই পড়া উচিত, যার যেটা ইচ্ছে। তবে আমার আশ্চর্য হওয়ার কারণটা অন্য। যে দেশের মানুষের রোজকার জীবনযাপনের সবটা জুড়ে শুধুই অলৌকিক ঘটনা ঘটে, অলমাইটি নেমে এসে বাণী দেন, ঈশ্বর সব ঠিক করে দেন, সেই দেশে বিজ্ঞান পড়া আমার বন্ধুরা কী করবে? সামান্য বেড়াল রাস্তা কাটলে মুশকিল, বেচারা শালিক পাখি কী দোষ করল কে জানে! কারণ তাকে একা দেখলেও মুশকিল। মেন্সট্রুয়েশন-এর সময় মেয়েরা মন্দিরে ঢুকলে মুশকিল। আরও কত কী!
যে দেশের ধর্মান্ধতা এত, সেখানে কেউ কোনওদিন বিজ্ঞান পড়ে, বুঝে, কাউকে বোঝাতে পারবে? ‘আমফান ঝড় এসে করোনাভাইরাস উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল’— এই কথার যুক্তিহীনতা ব্যাখা করলে, কোন কাকু বা পিসিমা শুনবে?
এবার সমস্যার মধ্যে পড়েছি আমরা, ছাত্রছাত্রীরা। সবার অঢেল চিন্তা আমাদের পড়াশুনো নিয়ে। কিন্তু দেশ জুড়ে অশিক্ষা আর মধ্যমেধার যে-উদ্যাপন, সেই উৎসবের মধ্যে শিক্ষিত হলেই তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। শিক্ষা অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু যদি কোনও কারণে বোধ, বিবেচনা, মনন তৈরি হয়, তবে বাড়ির সামনে গুলিও খেতে হতে পারে। গত বেশ কয়েক বছরে, যাদের একটু চোখ-কান-মুখ খোলা, তারা বুঝেছে, দেশে শিক্ষার অপকারিতা, জানার খারাপ দিক। ‘পড়াশুনো করে কী হবে’ বা ‘যতটুকু জানো তাই দিয়েই হবে’ প্রভৃতির প্রচলন বাড়তে বাড়তে এখন একটা অসুস্থতায় পরিণত হয়েছে। জানা বা বোঝার যে মূল কাজ, প্রশ্ন করা আর উত্তর খোঁজা, তার সমস্ত দরজাই বন্ধ। বাঙালি বাড়িতে ভাল বাচ্চা সে, যে কোনও প্রশ্ন করে না, মাথা নিচু করে থাকে, কেউ ভুল বললেও তাকে ঠিকটা দেখিয়ে দেয় না, এবং সর্বোপরি তর্ক বলে যে একটা বস্তু হয় তা সম্পর্কে যে অবগত নয়।
স্কুল শিক্ষাতেই অবশ্য ইতি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রাখলে তো শিরে সংক্রান্তি! আমি ভাল ছেলের মতো বাড়িতে ভাত আর ডাল খেয়ে, মায়ের আশীর্বাদ ও বাবার সতর্কতার উপদেশ কানে নিয়ে কলেজ গেলাম তো ঠিকই, কিন্তু এর কোনও নিশ্চয়তা নেই যে সেদিন মার না খেয়ে আদৌ বাড়ি ফিরব কি না। এমনটা হতেই পারে, কোনও অভিনেতা-নেতা/ গায়ক-নেতা/ কেউকেটা-নেতা/ মুখে মুখোশ পরা নেতার ভাই-বোনেরা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রচণ্ড মারল। তখন আমি আর আমার বন্ধুরা ছাত্র হিসেবে কিছুই করতে পারব না! বাবা-মা বকবে, পুলিশ-কাকু শুনবেন না, আর টিভিতে এই খবরটা দেখতে দেখতে দেশের সকল বুদ্ধিদীপ্ত, প্রগতিশীল নরনারী বলবেন, ‘কলেজে পড়াশুনো করতে গিয়ে এসব যে এরা কী করে?’
কী মুশকিল বলুন তো! তর্ক করা যাবে না, প্রশ্ন করা যাবে না, কোনও বিষয় নিয়ে জানা থাকলেও সেটা নিয়ে বেশি কথা বলা যাবে না। কিন্তু অন্যদিকে গোটা সামাজিক যোগাযোগের মধ্যে থাকা সবাই বলবে, বিজ্ঞান পড়ো কারণ ‘চান্স’ আছে!
তাহলে আমরা কী পড়ছি? কেন পড়ছি? গর্ব করে যে বলছি আমি শিক্ষিত, তা কেন বলছি? এই যে শিক্ষাটি এনার্জি ড্রিঙ্কের মতো সকাল-বিকেল জলখাবারের পর দেওয়া হচ্ছে, সেটা কোথায় কাজে লাগাব? এই দেশের প্রেক্ষাপটে বোধহয় তার প্রয়োগ করা আরও কঠিন হয়ে উঠছে দিন-দিন।
শিক্ষার ওপর এই আক্রমণ আরও বেশি করে আমাকে আর আমার ছাত্রছাত্রী বন্ধুদের হতাশ করে দিচ্ছে। না, এই চিত্র যে সব বাড়িতে তা বলছি না। বহু পরিবার আছে, যারা ছেলেমেয়েদের নিজেদের মতো পড়াশুনো নিয়ে ভাবার স্বাধীনতা দেয়। তবে রোগটা কি সেখানেই শেষ?
বড্ড হতাশ লাগছে। যা শিখেছিলাম, জেনেছিলাম, সবটা গুলিয়ে দিতে চাইছে চারিপাশের দিন-রাত। তবে একটাই সুবিধে, এখন মনে হচ্ছে আবার পড়তে হবে। গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে শিক্ষা, পড়াশুনা, জানা, জ্ঞান, বোধ এই সবকিছুকে যেভাবে নিচু চোখে দেখা শুরু হয়েছে, তাতে ইচ্ছে করছে আবার পড়ি, জানি, শিখি।
আমার তো দায় নেই কোনও বিধান দেওয়ার। আমি কেবলই প্রশ্ন করছি, কারণ এটাই আমার বয়েস আরও বেশি করে প্রশ্ন করার। তাই কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। কে উত্তর দেবে জানি না, তবে আমি খুবই বিচলিত। সেই বিচলিত ছাত্র একটা প্রশ্ন করেছে। দেখা যাক, উত্তর পাই নাকি। আমি সত্যি আবার পড়তে চাই।