ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বার্ধক্য, যৌনতা, ক্রস কানেকশন


    দেবারতি গুপ্ত (May 4, 2024)
     

    সমালোচনা— সিনেমা, ‘বেলাইন’
    মুখ্য চরিত্র—  পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রেয়া ভট্টাচার্য, তথাগত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ
    পরিচালনা— শমীক রায়চৌধুরী

    শমীক রায়চৌধুরীর ‘বেলাইন’ ছবিটি কোনও এক পুরনো ফিল্ম ক্রিটিকের একটা উক্তি মনে করিয়ে দেয়— ‘ব্যাখ্যা করা কঠিন কিন্তু বুঝতে পারা সহজ।’ (Difficult to explain but easy to understand) অর্থাৎ কিছু-কিছু ছবির ক্ষেত্রে সমালোচকদের তেমন কোনও কাজ থাকে না শুধু দর্শককে উৎসাহিত করে হলমুখো করা ছাড়া। কারণ এই ধরনের ছবির বিচার দর্শকই ভাল করবেন। নিজের প্রথম ছবিতেই শমীক বাংলা ছবির বাজারচলতি অতি উত্তম, না-অতি সুচিত্রা-মার্কা রাস্তা ছেড়ে বেশ বেলাইনে হেঁটেছেন।

    বার্ধক্যের একাকিত্ব মানসিক অবসাদ এনে দেয়, সে তো নিজেদের মা-বাবাদের দেখলেও বুঝতে পারি। আমরা নিজেদের কর্তব্যটুকু করে সরে পড়ি তখন। সত্তরোর্ধ্ব মানুষগুলোর সঙ্গী হয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে দুষ্কর। কখনও ভেবে দেখেছি, বয়স্ক মানুষগুলোর কিছু অপূর্ণ যৌন বাসনা থেকে যেতে পারে? যা তাদের মনের ও শরীরেরও বিকার ঘটায়? আসলে আমরা বার্ধক্যে বাণপ্রস্থে পাঠানো জাত। ‘বুড়োদের আর বাঁচতে দেব না’ মন্ত্র আমাদের গভীরে সেঁধিয়ে আছে। মায়া-মমতা আর কিঞ্চিৎ দায়িত্ব দিয়ে সংসার নামক জাঁতাকলে বুড়ো-বুড়িদের আসবাব বানিয়ে রেখে দিই। মা-বাবাদের ওষুধ-হাসপাতালকে স্বাভাবিক ধরে নিতে অসুবিধে নেই কিন্তু যৌনজীবনের একাকিত্ব নিয়ে আমাদের সমাজে কথা বলা মানা। ফেলে আসা যৌনতা, যৌবনের দিনগুলোর জন্য মন এবং শরীর কেমন করা যে মানসিক ব্যাধির উৎস হতে পারে, তা ভাবলেই পাপ হবে। এমনকী এই নিয়ে কথা বললে সমাজ ইডি বা সিবিআই-ও লেলিয়ে দিতে পারে। আশ্চর্য হব না।

    খাজুরাহো-অজন্তার আশ্চর্য এই দেশে যখন সুস্থ যৌনজীবনের আকাঙ্ক্ষা প্রাগৈতিহাসিক মনে হয়, তখন তাই নিয়েই এক অসাধারণ আখ্যান বানিয়েছেন শমীক। ভদ্রবিত্ত বাঙালির যাবতীয় সুললিত দৃশ্যকামনায় খোঁচা মেরে তিনি শুরুই করেছেন কমোডে মলত্যাগে মগ্ন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে। একটা পুরনো অ্যাটাচ্‌ড বাথরুমওয়ালা ঘরে তিনি একাই থাকেন। সঙ্গী বলতে এক টিভি। সেখানে বুড়োর প্রিয় সিরিয়াল চলে সকাল-সন্ধে। বনেদি বাড়ির স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় তরুণ যুগল। স্ত্রীর নাম সতী। সেই সতীলক্ষ্মী বউ অন্তঃসত্ত্বা হলে তার সন্দেহপ্রবণ স্বামী প্রশ্ন করে, সতীর সন্তানের পিতা কে? সেই প্রশ্ন শুনে সতী টিভির পর্দায় তিনবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আর বুড়োও আশঙ্কা, আবেগ আর আপ্লুত ভাব নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। পরাণের আরেক ছলনাময়ী সঙ্গিনী আছে। কালো রঙের ঠাকুর্দার আমলের ল্যান্ডফোন। সেই ল্যান্ডফোনে ক্রস কানেকশন হয়ে আসা এক তরুণীর অসুখী যৌনজীবনের অবসাদ পরাণবুড়োর একাকিত্বে গড়িয়ে আসে। বুড়োর তখন ইচ্ছা করে পরাণডারে গামছা দিয়া বাঁধতে। এভাবে শমীকের প্রথম ছবির কথা বলতে গিয়ে রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’ ছবিতে সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে উঁকি মারার প্রগলভতা যদি ক্ষমা করেন, তাহলে বলতে পারি যে, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বেলাইন’-এ যে-অভিনয় দেখিয়েছেন তা প্রায় বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের অভিনেতাদের কথা মনে পড়ায়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এরকম এক অভিনেতাকে মূলত ‘কমেডি ভাল করেন’ বলে আমরা দেগে দিয়েছি। যাই হোক, বেলাইন হয়ে আসা নারী-পুরুষের লিভ-ইন জীবনে নিত্য কান পাতা শুরু করেন পরাণ। ওর কল্পনায় এই যুগলকে দেখায় অবিকল সিরিয়ালের সতী আর তার সন্দেহপ্রবণ স্বামীর মতন। এখানে বলতেই হয়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনেতা শ্রেয়া ভট্টাচার্য আর তথাগত মুখার্জি মন্দ সঙ্গত দেননি। বিশেষ করে দুজন অত্যন্ত সাবলীল ভাবে যৌনমিলন দৃশ্য রূপায়িত করেছেন— যা বাংলা ছবির অভিনেতাদের কাছ থেকে প্রায় আশা করা যায় না। যে-জাতির অভিনেতারা স্ক্রিনে সামান্য চুমু খেতেও কোষ্ঠকাঠিন্য বোধ করে, তাদের মধ্যে শ্রেয়া-তথাগত উদাহরণ হয়ে থাকবে।

    পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার শমীকের সাহস আর সততা হল নারীর অপূর্ণ যৌন খিদেকে অকপটে সংলাপে ও অভিনেতার অভিব্যক্তিতে ব্যক্ত করতে পারা। মিলনরত পুরুষ তৃপ্ত হবার পরেও যে অনেকটা বাকি থেকে যায়, নারীর শরীরী সন্তুষ্টি যে সমান গুরুত্বপূর্ণ— তা আমরা জানলেও নিজেদের কাছেই এখনও মানতে রাজি নই।

    পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার শমীকের সাহস আর সততা হল নারীর অপূর্ণ যৌন খিদেকে অকপটে সংলাপে ও অভিনেতার অভিব্যক্তিতে ব্যক্ত করতে পারা। মিলনরত পুরুষ তৃপ্ত হবার পরেও যে অনেকটা বাকি থেকে যায়, নারীর শরীরী সন্তুষ্টি যে সমান গুরুত্বপূর্ণ— তা আমরা জানলেও নিজেদের কাছেই এখনও মানতে রাজি নই। সেই বিষয় রীতিমতো ঘোষিত হয়েছে শ্রেয়ার অভিনয়ে আর শমীকের সংলাপে। যখন কোনও ভারতীর নারী এই শরীরের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে, তখন আদর্শ ভারতীয় পুরুষের যা করার কথা তথাগতও তাই করে। শ্রেয়ার যৌনাঙ্গে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। তারপর অবশ্য আবারও ভারতীয় পুরুষের মতোই তথাগত অনুতাপ করতে থাকে। ঠিক যেন পুরুষোত্তম রাম। রক্তাক্ত শ্রেয়া তার গোপন বন্ধুকে মোবাইলে আক্ষেপ করে জানায়, তার বোধহয় শরীরের চাহিদা একটু বেশিই। আমাদের মনে অনুরণিত হয়, এই খিদে মেয়েদের থাকতে নেই। কোনও বয়সেই থাকতে নেই। যৌবনেও নয়, মাঝবয়সে তো নয়ই।

    এ-যাবৎ তো কাহিনি-অভিনয়ের কথা হল। কিন্তু এই আখ্যানকে সিনেমা করে তোলার পেছনে যে-পরিকল্পনা ও কারিগরিবিদ্যা প্রয়োগ করা হয়েছে, তাই নিয়ে আলোচনা অবশ্যকর্তব্য। গোটা ছবিটাই প্রায় দুটি ঘরের মধ্যে, তাই চিত্রগ্রহণে নতুনত্ব আনতে খুব সচেতনভাবে বিগ ক্লোজ-আপের ব্যবহার হয়েছে। অভিনব ফিলটার প্রয়োগ করে সিনেমাটোগ্রাফার সুপ্রিয় দত্ত পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাড়ি কামানোর দৃশ্যে এই বিগ ক্লোজের ব্যবহার করেছেন। যৌনতার অভাব কীভাবে মনের বেদনাকে বিকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তা যেমন পরাণের মাপা অভিনয় তুলে ধরেছে, এই সাফল্যের ঠিক ততটাই দাবিদার সুপ্রিয়র লেন্স। ঠিক তেমনি বিগড়ে যাওয়া টিভির ঝিরি ঝিরি, শাওয়ার থেকে অবিরাম গতিতে পড়তে থাকা জলের ঝিরি ঝিরির সঙ্গে অনায়াসে মিলে যাওয়ার মতো দৃশ্যায়ন বহুদিন মনে থাকবে। এক্ষেত্রে পরিচালক সংলাপ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে নিজ মাধ্যমের নিজস্বতাকে সঠিক দৃশ্যায়নের মাধ্যমে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। ‘বেলাইন’ আখ্যান উত্তীর্ণ হয়ে সিনেমা হয়ে উঠেছে। সঙ্গে সংলাপ ভৌমিকের পরিণত সম্পাদনা আর অয়ন ভট্টাচার্য ও অভীক মুখার্জির যথাযথ শব্দ-পরিকল্পনা ‘বেলাইন’-এর চলচ্চিত্রায়নকে পূর্ণতা দিয়েছে।

    পরিশেষে এত ভালর পর কিছু ভাল না-লাগার কথা বলতে চাই। কিছু সহ-অভিনেতাদের অহেতুক অব্যয় আর ‘অ্যাঁ-উঁ-ও’ ইত্যাদির ব্যবহারে আর একটু পরিমিত হওয়া দরকার ছিল। আর আমাদের মধ্যবিত্ত অভিনেতারা যখন নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন হার-হাভাতেদের অভিনয় করেন, তখন অহেতুক হেঁকেডেকে অভিনয় করেন কেন বুঝি না। এ-ধরনের বাংলা ছবিতে তো মিঠুন চক্রবর্তী হবার দরকার নেই! অমিত সাহা বা ঋত্বিক চক্রবর্তীদের মতো উদাহরণ তো আমাদের হাতের কাছেই আছে। সেদিকেও তো তাকানো যায়!

    ক্লাইম্যাক্স ও ছবির পরিণতির কথা অবশ্যই গোপন থাক। আলোচনা শুরু করেছিলাম দর্শকের হলমুখো হবার বাসনা নিয়ে। আমি পঞ্চম সপ্তাহে নন্দনে গিয়ে দেখে এলাম। এহেন তাপপ্রবাহের মধ্যেও বাঙালি দুপুর দেড়টার শো-তে রীতিমতো ভিড় করেই দেখছে। এ এক বড় আশার চিত্র। আপনারাও যদি কেউ ‘বেলাইন’-এর জন্য লাইন লাগান সিনেমাহলের সামনে, আশা করি হতাশ হবেন না!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook