গবার হয়তো একটু তন্দ্রা এসেছিল, মান্কের আচমকা চিৎকারে ধড়মড় করে জেগে সোজা হয়ে বসল। পাউরুটির কারখানা মানে রাত জেগে কাজ, যতই অভ্যেস থাকুক, কখন যে চোখ লেগে আসে নিজেও টের পাওয়া যায় না। মান্কে এর আগে দু’বার তাগাদা দিয়ে গেছে। তৃতীয়বার এসে গবাকে ঝিমাতে দেখেই বাছা-বাছা খিস্তি ঝাড়তে শুরু করল। খিস্তিগুলো সব মান্কের নিজস্ব মৌলিক সৃষ্টি, প্রত্যেকটা কপিরাইট পাওয়ার যোগ্য। ল্যাংড়া মানুষ বলে হয়তো এসব চর্চার দিকে ঝোঁক বেশি। একেকটা এমন ধারালো, শুনলে মরা মানুষও পাশ ফিরে শোবে। পচা আদা আর খুঁতো মানুষ, দুটোরই ঝাঁঝ বেশি!
কোয়ার্টার পাউরুটির ফর্মার মধ্যে ময়দার লেচিগুলো ভরা প্রায় শেষ। হাফ-পাউন্ডগুলো জ্বলন্ত উনুনের মধ্যে, ওগুলো নামলেই কোয়ার্টারগুলো চড়ানো হবে।
লালচে আলোয় গবার ঘামে ভেজা থমথমে মুখখানা ফণাধরা সাপের মতো কঠিন হয়ে উঠল। কিন্তু সে কাঠিন্য ছোবল পর্যন্ত স্থায়ী হল না। এই এক দোষ গবার। তেড়েফুড়ে রাগতে গিয়েও আপনা থেকেই কেমন যেন গুটিয়ে যায় সে। ওর বউ বাসন্তী ডাকসাইটে কুঁদুলে। সে সুযোগ পেলেই ওকে দুয়ো দিয়ে ‘ম্যাদামারা’, ‘মিয়োনো মুড়ি’, ‘কেন্নো’, আরও নানা কুকথা বলে। শুনলে ভেতরে ভেতরে রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে, অথচ বাসন্তীর খান্ডারনি চেহারার সামনে মুখ খুলতে সাহস হয় না।
বাসন্তীর কথা মনে হতেই গবার মনে এতক্ষণ ভুলে থাকা চাপা উদ্বেগটা আবার ফিরে এল। গবার মাকে নিয়ে সে গত কয়েক দিন যে মহাভারত চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে। যে করেই হোক, আজ হপ্তার টাকাটা আদায় করতে হবে। মান্কে হয়তো সেটা না দেওয়ার মতলবে পায়ে পা দিয়ে গোলমালটা পাকিয়ে তুলতে চাইছে। এখন উত্তর দিতে গেলেই বিবাদটাকে মান্কে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাবে যে টাকা চাইবার পরিস্থিতি থাকবে না। সেই ফাঁদ এড়াবার জন্যে গবা মুখ বুজে খিস্তিগুলো হজম করে দ্রুত হাত চালাতে শুরু করল।
ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। আজ হাটবার। একটু বাদেই সাইকেল নিয়ে ফড়েরা এসে হাজির হবে। আশপাশের এলাকাগুলোতে এখানকার পাউরুটির চাহিদা ভালই। অনেক দূর-দূর থেকে ফড়েরা মাল নিতে আসে। বছর খানেক হল, জঙ্গলপুর মোড়ে এনায়েত মিঞা নতুন পাউরুটির কারখানা খুলেছে। বাজার দখল করার জন্যে সে নিত্যনতুন ফিকির বার করছে। কখনও ফড়েদের বকশিশ দিচ্ছে, কখনও বা পাউরুটির মোড়কের মধ্যে লটারির সাংকেতিক নম্বর লিখে রাখছে। সেই নম্বর লেখা কাগজের মোড়ক নিয়ে এলেই পঞ্চাশ-একশো টাকা নগদ পুরস্কার। সময়মতো মাল না পেয়ে খদ্দেররা যদি ওখানে চলে যায়, মালিক দায়টা গবার ঘাড়েই চাপাবে।
গবার খেউরি না হওয়া মুখের কাঁচা-পাকা দাড়ি বেয়ে বিন বিন করে ঘাম নামছে। আদুল গা থেকে টুপিয়ে নামা দু-এক ঘাম ফোঁটা ময়দার লেচির মধ্যেও পড়ছে। কিন্তু উপায় নাস্তি। বার বার ঘাম মোছার সময় কোথায়? কাজ শেষ হওয়ার আগে সুয্যি উঠে গেলেই চিত্তির! মান্কে হপ্তা না দিতে পারার জুতসই অজুহাত পেয়ে যাবে।
সেই যে কাল সন্ধেবেলা ভানু মাল টেনে এল, তারপর সারা রাত দোকানের বাইরে বেঞ্চে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। ফলে একা হাতে ময়দা মাখা, লেচি কাটা, ফর্মায় ফেলা, উনুনে সেঁকা, সবই সামলাতে হয়েছে। হারামজাদা মান্কে এসব দেখতে পায় না।
ফর্মা থেকে গরম পাউরুটি বের করে কোম্পানির নাম ছাপা মোম-কাগজের জামা পরিয়ে প্যাকিং বাক্সে ভরার দায়িত্ব বিশুর। কিন্তু গতকাল হপ্তা পায়নি, তাই আজ কাজে আসবে না বলে সে শাসিয়ে গিয়েছিল। গবা অবশ্য অনেক বুঝিয়েছিল। পুজোর মাত্র মাস দুয়েক বাকি। এ সময়ে কর্মচারী খেদাতে পারলে মালিকের লাভ। বোনাসটা বেঁচে যাবে। মান্কের বাপ হারু, মানে হারাধন পাল পয়লা নম্বর ফেরেব্বাজ, অন্যের টাকা মারতে ওস্তাদ। পুজো যত কাছাকাছি আসে, বাপ-বেটায় মিলে কর্মচারী খেদাবার ফন্দি খোঁজে। কিন্তু বিশুটা যা গোঁয়ার, মনে হচ্ছে আজ ডুব মারবে।
ক্লান্তিতে শরীর যেন ভেঙে আসছে। হারুর কাছে বেশিদিন লোক টেঁকে না বলে মাঝে মাঝে দুনো খাটনি খাটতে হয়। পুরনো কর্মচারীদের মধ্যে একমাত্র গবাই আছে; বাকিরা আসছে আর যাচ্ছে, ছ’মাসও কেউ থিতু হচ্ছে না। পাউরুটি তৈরির কারিগর পাওয়া দুষ্কর বলে পালমশায় এবং তার পুত্তুররা গবাকে এতদিন খানিকটা সমীহ করে এসেছে বটে, তবে ইদানীং সেই সমীহটুকুও তলানিতে এসে ঠেকেছে। ওদের ধারণা, গবার শাগরেদি করতে করতে ভানু চালিয়ে দেবার মতো কাজ শিখে নিয়েছে, সুতরাং গবা না থাকলেও কাজ আটকাবে না।
ভানু পাঁড়মাতাল, অর্ধেক দিন কাজে আসে না, তবু বাপ-ছেলেরা মিলে সমানে তোল্লাই দিয়ে দিয়ে ছোকরার মাথা খাচ্ছে। ভাবছে, গবা গেলে মালের বোতল হাতে ধরিয়ে ভানুকে লড়িয়ে দেবে। মাতাল মানুষ, মদ পেলে বিশ্ব-সংসার ভুলে যায়। সুতরাং মাঝে মাঝে বোতলের সঙ্গে উপরি হিসেবে ন’কড়া ছ’কড়া হাতে দিলেই কাজ হয়ে যাবে, হপ্তা শেষে মজুরির হিসেব চাইবে না।
হারাধন পালের অন্য ছেলেগুলোও বাপের মতো চিটিংবাজ। ওরা মাল গস্ত করার জন্যে ফি-বচ্ছর একজন করে নতুন মহাজন ধরে। কখনও বড়বাজার, কখনও হাওড়া, কখনও বা শিয়ালদার কোলে মার্কেট। প্রথমে নগদে, তারপর অল্প অল্প ধারে মাল নেয় এবং তাগাদার আগে শুধু দেনাই শোধ করে না, উপরন্তু মাছ, মুরগি, ফলপাকড় কিনে ভেট দেয়। জিজ্ঞেস করলে বলে, বাড়ির জিনিস!
এভাবে মহাজনের সঙ্গে সম্পর্কটা যখন বেশ মাখোমাখো হয়ে আসে, ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে এক লপ্তে মোটা টাকার মাল ধারে নিয়েই ধাঁ হয়ে যায়। তারপর অন্য বাজারে অন্য মহাজনের দরজায় গিয়ে হাজির হয়।
দৈবাৎ খুঁজেপেতে কখনও কোনও মহাজন তাগাদায় এলে বাপ দেখায় ছেলেকে, ছেলে দেখায় বাপকে। পাওনাদারের সামনে হারু পাগলের মতো কাঁদে, বুক চাপড়ায়, মাথার চুল ছেঁড়ে। তার পরেও যদি দেখে তাগাদায় আসা লোকটা নাছোড়বান্দা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তখনই শুরু হয় আসল নাটক। হারু লুঙ্গিতে মালকোছা মেরে হুঙ্কার দিতে দিতে ছেলেদের দিকে তেড়ে যায়। ছেলেরাও বাপকে বউয়ের ভাই সম্বোধন করতে করতে তেড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়ে। অতঃপর বাপ-ছেলের হাতাহাতি, ঘুসোঘুসি এবং কুৎসিত গালাগালিতে পরিস্থিতি এমন কদর্য হয়ে ওঠে যে পাওনাদার প্রাণ নিয়ে পালাতে পথ পায় না।
প্রথম প্রথম এসব দেখে গবা মীমাংসার চেষ্টা করত। পরে বুঝেছে, পুরোটাই নাটক, পাওনাদার চলে গেলেই বাপ-বেটাতে একসঙ্গে মাল খেতে বসে যাবে।
গতকাল হপ্তা দেওয়ার সময়ে বিক্রির টাকার হিসেব নিয়ে বাপ-ছেলেতে একই নাটক শুরু করেছিল। ঝগড়ার মাঝে বিশু টাকা চাইতে, দুজনেই এমন তেড়ে এল যে, গবার আর টাকা চাইতে সাহস হয়নি।
আজ অন্তত টাকাটা না পেলেই নয়। মাস খানেক হল গবার মা এসে এখানে আছে। বাসন্তী কোনও কালেই শাশুড়িকে দেখতে পারে না। প্রতিবার বুড়ি এলে দু-চারদিন যেতে না যেতেই সে এমন অশান্তি শুরু করে যে বাড়িতে কাক-চিল বসতে পারে না।
গত দিন দশেক বাড়িতে টানা কুরুক্ষেত্র চলছে। তিতিবিরক্ত গবা ঠিক করেছিল, গতকাল হপ্তা পেলে যাতায়াতের ভাড়ার সঙ্গে বাড়তি কয়েকটা টাকা দিয়ে মাকে ফের গাইঘাটায় পাঠিয়ে দেবে। সেখানে দাদার কাছেও যে মা খুব একটা শান্তিতে থাকতে পারে, তা না। বউদির স্বভাবও কিছুটা বাসন্তীর মতো, মাকে দু-দণ্ড টিকতে দিতে চায় না। বুড়ি তাই এক বউয়ের তাড়া খেয়ে আরেক বউয়ের সংসারে গিয়ে ওঠে, আবার মাস পেরোবার আগেই সেখান থেকে উৎখাত হয়ে ফের পোটলা কাঁখে পথে নামে, মাকুর মতো কোথাও থিতু হতে পারে না।
মায়ের হেনস্থা দেখে বড় কষ্ট হয় গবার। নিজের পছন্দের বিয়ে, প্রথম প্রথম অবশ্য বাসন্তীকে বোঝাবার বিস্তর চেষ্টা করেছে, মাঝে মাঝে মৃদু বকাঝকাও করেছে। কিন্তু তাতে হয়েছে হিতে বিপরীত। একটানা ঝগড়া চালিয়ে যাওয়ার অপরিসীম ক্ষমতা বাসন্তীর, একবার শুরু হলে বাঁশতলার বৃষ্টির মতো চলতেই থাকে! তবে শুধু ঝগড়া নয়, বাসন্তীর তূণীরে শাশুড়ি এবং তস্য পুত্রকে জব্দ করার অন্য তিরও আছে। সেটা হল ওকে ভূতে পাওয়ার রোগ। ঘরে বড়সড়ো কোনও অশান্তি হলেই তাকে ভূতে পায়। তখন সে এটা ভাঙে, সেটা ছেঁড়ে, এলোচুলে আগানে বাগানে ঘুরে বেড়ায়, কখনও আবার হাটের পাশে বটগাছটার হেলানো ডালটায় ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে দোল খায় আর খোনা গলায় আবোল-তাবোল বকে।
তবে একই ভূত বার বার ঘাড়ে চাপে বলে চেনা হয়ে গেছে। সে যে বাসন্তীর কোনও ক্ষতি করবে না, সে ব্যাপারে গবা নিশ্চিত। তাই ভূতে পেলে গবার আসল দুশ্চিন্তা ভূত নামানোর খরচ নিয়ে। ভূত যতই চেনা হোক, ওঝার সর্ষেবাণ না খেয়ে সে বাসন্তীর ঘাড় থেকে নামে না। ওঝাও ঝোপ বুঝে কোপ মারে, এক পয়সা কম দেবার জো নেই! তবে হ্যাঁ, হাজু কাওরা সর্ষেবাণ মারতে মারতে যখন জিজ্ঞেস করে, ‘কে তুই’, তখন বাসন্তী খোনা গলায় জবাব দেয়, ‘আঁমি বঁঙ্কু গোঁ গুঁরুমশাই, হাঁয়দারপুঁরির ক্ষেঁত্তর নাপতের বেঁটা!’
ক্ষেত্তর নাপতের ছেলে বঙ্কু বছর দুয়েক হল বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। নতুন বিয়ে করেছিল ছোকরা। জঙ্গলপুর মোড়ে চালু চায়ের দোকান, বাপ-বেটাতে মিলে চালাত। সেদিন ক্ষেত্তর দুপুরে খেয়ে উঠে হাটে গিয়েছিল বেগুনচারা কিনতে। ফিরে দেখে দোকান বন্ধ, বঙ্কু গেছে বউকে নিয়ে বাঁদুড়ের পল্লিশ্রী হলে সিনেমা দেখতে। ব্যাস! আর যায় কোথায়, নতুন বউয়ের সামনেই সে ছেলেকে জুতোপেটা করেছিল। অপমানে সেদিনই বঙ্কু ফলিডল খেয়ে পাটক্ষেতের মধ্যে শুয়ে পড়েছিল। আর এখন সেই ঝামেলা এসে জুটেছে গবার কপালে। বার বার সেই বঙ্কুই নাকি বাসন্তীর ঘাড়ে এসে ভর করছে!
দাদা-বউদি অবশ্য বলে, ভূতে পাওয়াটা আসলে বাসন্তীর শাশুড়ি খেদানোর কৌশল। তার মতো ডাকসাইটে ঝগড়ুটে মেয়েছেলের ঘাড়ে বসবাস করা কি মেনিমুখো বঙ্কুর কাজ! অত ঘাড়ে চাপবার শখ হলে বঙ্কু তো নিজের বউয়ের ঘাড়েই চাপতে পারে! সে মরার পর মাস ছয়েক-ও পেরোয়নি, যার জন্যে বিষ খেল, সেই আদরের ভুলুরানি কিনা নেতাই খাঁড়ার ছেলে হুলোর সঙ্গে পালিয়ে গেল! এখন কপালে পুরনো আধুলির সাইজের পেল্লাই সিঁদুরের টিপ পরে দিব্যি দেঁড়েমুশে সংসার করছে! বঙ্কু এমনিতেই মেনিমুখো, বিশ্বাসঘাতিনী ভুলুরানির অমন নধর ঘাড় থাকতে সে খামোকা কেন বাসন্তীর মতো জাঁহাবাজ মেয়েছেলের ঘাড়ে চাপতে যাবে!
গবারও যে সন্দেহ হয় না, তা নয়, কিন্তু কথাটা সে কাউকে বলতে পারে না। একে বাসন্তীতে রক্ষে নেই, সঙ্গে ওর বাপ ধীরেন ময়রা দোসরও আছেন। লোকটা পয়লা নম্বর টিকরমবাজ। আগে সে হাটে হাটে গুড়ের জিলিপির দোকান দিত। বাপ ভাজত, মেয়ে বেচত। রাজ্যে পালাবদলের পর ধীরেন জিলিপি ছেড়ে দালালি শুরু করেছে। ইদানীং পঞ্চায়েত প্রধানের চেলাগিরি করে ভালই শাঁসেজলে আছে। তার কাজ হল সব জায়গা থেকে প্রধানের নাম করে তোলা আদায় করা। এ ব্যাপারে সে যে আপন-পর ভেদ করে না, গবা তা হাড়ে হাড়ে টের পায়। পান থেকে চুন খসলেই জামাইকে থানা-পুলিশের ভয় দেখায়। তার ওপর লোকটা সম্পর্কে শ্বশুরও বটে, অতএব কিল খেয়ে কিল হজম করা ছাড়া উপায় কী!
বাসন্তীকে ভূতে ধরলে ধীরেনের যেন ফুর্তি বেড়ে যায়। একবার খবর পেলেই হল! সঙ্গে সঙ্গে গাঁজাখোর হাজু কাওরাকে ধরে আনে। বলে, তার মতো ভূতের ওঝা নাকি এ দিগরে নেই!
গাঁজাখোরটা এসেই কয়েক ছিলিম গাঁজার ভুষ্টিনাশ করে খানিকক্ষণ ব্যোম হয়ে বসে থাকে। তারপর অং-বং-চং কীসব মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে একখানা মুড়োঝাটায় আগুন জ্বালিয়ে তার মধ্যে সর্ষে আর শুকনো লংকা ছেড়ে দিয়ে বাসন্তীর নাকের কাছে ধরে। আগুনে পড়ে সর্ষেগুলো চিড়বিড় করে ফুটতে ফুটতে ওর চোখেমুখে আছড়ে পড়ে। শুকনো লংকার ঝাঁজে দম আটকে আসে। ভূত বেচারা তখন পালাতে পথ পায় না!
বঙ্কু ঘাড় থেকে নেমে গেলে ওঝার পেন্নামিটা ধীরেনই হাত পেতে নেয়। জামাই সরাসরি দিতে গেলে পাছে ওঝা বেশি চেয়ে বসে! গবা সব বোঝে, কিন্তু তার অবস্থা ফাটা বাঁশে আটকে যাওয়ার মতো। তাই শ্যাম ও কূল, উভয়ই রক্ষা করার বাধ্যবাধকতায় সব জুলুমই হজম করতে হয়।
বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতে বাইরে তাকিয়ে গবা দেখল, পুবের দিকটা ফর্সা হয়ে এল। অথচ বিশুর দেখা নেই। মেজাজটা আরও খিচড়ে গেল গবার। তার মানে তাকেই এখন বসে বসে একরাশ পাউরুটির গায়ে মোম মাখানো কাগজের জামা পরাতে হবে!
এনায়েত মিঞা পাউরুটির কারখানা খোলার সময় গবাকে অনেক সাধাসাধি করেছিল। বিপদ বুঝে হারু পাল বোনাসটা কিছু বাড়িয়ে দেবে বলে কথা দিয়ে রেখেছে। তবে গবা জানে, বাটপাড়ের বাড়ির ভোজ, না আঁচানো পর্যন্ত বিশ্বাস নেই।
উনুন থেকে কোয়ার্টারগুলো নামিয়ে গবা সবে একটা বিড়ি ধরিয়েছে; এমন সময়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মান্কে এসেই চিৎকার শুরু করল, ‘বাহ্! বেশ তো লাটসাহেবের মতো ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে বিড়ি টানা হচ্ছে! ওদিকে ঘড়িতে কটা বাজে, সে খেয়াল আছে? যত্তসব কামচোরের দল!’
গবা উত্তর না দিয়ে বিড়ি টানছে দেখে মান্কে আরও ক্ষেপে গেল। এক ঠ্যাঙে ভর দিয়ে বাপ-মা তুলে খিস্তি শুরু করল। গবা বুঝল, আজও হপ্তা পাওয়ার কোনও আশা নেই। একে সংসারের অশান্তি, তার ওপরে কারখানায় কাজের চাপ এবং হপ্তা না পাওয়ার আশঙ্কা, সব মিলিয়ে গবার মাথাটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল।
হঠাৎ তার মস্তিষ্কে যেন বিস্ফোরণ ঘটে গেল। মান্কের চোখে চোখ রেখে মেরুদণ্ড টান টান করে উঠে দাঁড়াল। তারপর কিছু বুঝে ওঠবার আগেই মান্কের গালে ঠাস করে বিরাশি সিক্কার চড় কষিয়ে দিয়ে হিসহিসে গলায় বলল, ‘খিস্তিগুলো তোর বাপ-মাকে দে রে, শুয়োরের বাচ্চা!’
মান্কে ভাবতেই পারেনি, চিরকাল খিস্তি হজম-করা গবা এমন মারমুখী হয়ে উঠতে পারে। আচমকা থাপ্পড় খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে সে মেঝের মধ্যে ডাঁই করে রাখা গরম পাউরুটির স্তূপের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
গবা আগুন চোখে একবার সেদিকে তাকিয়ে দেয়ালে পেরেকের গায়ে ঝোলানো জামাটা কাঁধের উপর ফেলে হনহন করে বেরিয়ে পড়ল।
বাইরে বেরিয়ে দেখল, পুবের আকাশে লালচে আভা ফুটতে শুরু করেছে। একটা থাপ্পড়ের বিনিময়ে পাওনা টাকার সঙ্গে পুজোর বোনাসটা খুইয়েও বিন্দুমাত্র অনুতাপ হল না গবার। বরং এতদিনকার কেন্নোর মতো যাপন থেকে বেরতে পেরে মনটা এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেল। ভোরের হাওয়ায় একটুখানি দাঁড়িয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে বাড়ির পথ ধরল।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে হয়তো একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। হাটের পাশে মস্ত বটগাছটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে হঠাৎ বিকৃত স্বরের হাসির শব্দ শুনে চমকে তাকাতেই বুকের মধ্যেটা ছ্যাঁত করে উঠল। সাহসে ভর করে আরেকটু এগিয়ে দেখল, সেই হেলানো ডালটায় পা ঝুলিয়ে বসে স্বয়ং বাসন্তী হি হি করে হাসছে।
মুহূর্তে ধীরেন ময়রা এবং হাজু কাওরার খুশিয়াল মুখটা মনে পড়ে গেল গবার। পরক্ষণেই নিজের বিধবা মায়ের অসহায় চেহারাটা মনের পর্দায় ভেসে উঠল।
গবা ভূতে-পাওয়া মানুষের মতো ছুটে গিয়ে হ্যাঁচকা টানে গাছ থেকে বাসন্তীকে নীচে নামাল। তারপর সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই চুলের মুঠি ধরে তার গালে সপাটে কয়েকটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল।
আচমকা মার খেয়ে ককিয়ে কেঁদে উঠল বাসন্তী। গবা অবাক হয়ে শুনল— সম্পূর্ণ স্বাভাবিক গলা, সেই কান্নার শব্দে খোনাস্বরের লেশমাত্র নেই!
বউকে চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে যেতে গবা কঠিন স্বরে বলল, ‘শোন, এখন থেকে আমার মা আমার সঙ্গেই থাকবে, তুই মানিয়ে নিয়ে থাকতে না পারলে…’
ভোরের লালচে আলোয় শক্ত চোয়ালের রাগী মুখখানা কেমন যেন অচেনা মনে হল বাসন্তীর। বরাবরের মতো পালটা আক্রমণ কিংবা নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল না সে। এমনকী গালাগাল দিতেও ভুলে গেল। বিন বিন করে কাঁদতে কাঁদতে বাধ্য মেয়ের মতো গবার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল।
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত