শাফিকা – তিন
খোকা কোলে নিয়ে বাড়ি এল শাফিকা। হাসপাতালের বরাদ্দ, সকালের খাবারের চা-পাঁউরুটিটাই একটু বেশি করে খেয়ে নিয়েছে সে; এরপর সেই দুপুরের খাবার; সেটা তো বাড়ি গিয়ে পাবে। তবে কখন যে তা খেতে পাবে, কে জানে! বড়বিবির খোকা হওয়ার পর থেকেই সে জেনেছে যে, বিস্তর নিয়ম-নির্দেশ পালতে হবে তাকে। তবে এটা সে সঠিক জানে না যে, বড়বিবির জন্য পালনীয় যে সব ‘হুকুম’, সেগুলো তার ক্ষেত্রেও লাগু কি না; কারণ বড়বিবি হল এই সংসারের খাস-বিবি। তা ছাড়াও তার বাপের বাড়ির লোকেরা আছে, তার হয়ে সব কিছু দেখভাল করবার জন্য। তার মিয়া কি আর এসবে নাক গলাবে! যেটুকু যা, তা হবে ওই বড়বিবির মেজাজ-মর্জি মতোই। অতসব নিয়মে যে কিছু যায়-আসে না, শাফিকা সেটা জানে; আর এ-ও জানে যে, খোকার জন্মের চল্লিশ দিন পরে তাকে তো আবার সেই সংসারেই জুতে যেতে হবে। এই যে চল্লিশটা দিন, এ হল বাচ্চা হবার ধকল সামলে, মায়ের শরীরকে সুস্থ হতে দেবার নিদান; দেহের এবং মনেরও বিশ্রাম। হাসপাতালের পাকাঘরে এবং রেলিংয়ের খাটে শুয়েও স্বস্তি হয়নি তার। সমানেই ভেবেছে, নিকাহ হয়ে তক, গোয়ালঘরের পাশে ওর নিজের সেই একটেরে ঘর আর কাঠের চৌকির ওপর একভাঁজ কাঁথা বিছিয়ে পাতা, ধোয়া-কাচা বিছানাটার কথা। একটাই ভাল যে ছেলেটা জন্মাল আশ্বিন মাসে। গরমও কম, আবার শীত পড়তেও দেরি আছে। ঘরে গিয়ে একবার পড়তে পারলে হয়! যে সময়টা ঘুঁটে দিত, সে সময়টাতেই জুত করে বসে, ক’টা কাঁথা বুনে নেবে ছেলের জন্য। মিয়াকে বলে, দু’খানা পুরনো ধুতি সে আগেই কিনে রেখেছে সস্তায়; তালতলা মার্কেটে কী না পাওয়া যায়! তার আর ক’খানাই বা কাপড়, যে তা থেকে সরিয়ে কাঁথা বানাবে? তার নিজেরই তো কাটে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে পরে! এমন ছাপা কাপড় দু-একবার তো তাকে মিয়াই কিনে এনে দিয়েছে তার আম্মার নাম করে। তাতেই সে জেনেছে যে পুরনো কাপড়ও বাজারে কেনাবেচা হয়; আর, পুরনো বলেই হয়তো সব বুঝেও, কোনও কথা শোনায়নি বড়বউ। তবে, অপাঙ্গে শাফিকাকে তার সেই আড়চোখে দেখাটা সে যে না বুঝিয়ে ছেড়েছে এমনও নয়; এমনকী বাঁকা চোখে, তাকে ওভাবেই দেখেছে তানি-বানিও।
মুসলমান সমাজে অনেক নিয়ম এবং অনেক জাঁক; তবে সবেতেই ওই গরিব-বড়লোক মেনে কিছু ছাড়ও আছে। বড়বিবির ছেলে হওয়ার সময় যেটুকু যা করণীয়, তার সবটাই করেছে তার আব্বু আর আম্মা মিলে। শাফিকার আর কোথায় আব্বু আর কোথায়ই বা তার আম্মার হাতে পয়সা! তবে শাফিকার হাতে আছে ‘গোসল’। ঘরে ফিরেই কি আর পুকুরে গিয়ে ডুব দিতে পারবে! নাড়ির রক্ত তো এখনও বন্ধ হয়নি তার! গোয়ালঘরের কাছে এক বালতি পানি রেখে, বড় মেয়ে তানি এসে বলল, ‘গোসল করে নাও; ভাই তো ঘুমোচ্ছে; ওকে আমি দেখছি।’
‘বানিকে একটু ডাকবি, আমার কাছে এসে দাঁড়াবে! মাথাটা কেমন যেন পাক দিচ্ছে; দেহেও বল পাচ্ছি না; যদি পড়েটড়ে যাই!’
‘সে ঘরে নেই; ইস্কুল গেছে। আমি এখান থেকেই দেখছি; পড়বে কেন?’
‘দেখি, এদিক-ওদিক ধরে ধরে সেরে নিতে পারি কি না!’
‘গোসলের নিয়ম জানো তো! আগে, মগ-ভরা পানি নিয়ে তিনবার মাথায় ঢেলে ঢেলে চুল ভেজাবে; তারপর বাঁ-হাতে নোংরা জায়গা সব; তার পরে ডান হাতে মুখ হাত পা।’
‘আচ্ছা; আগে তো পানিটা মাথায় ঢালি!’
দাওয়ার বাইরে রোদটা এখনও ঝাঁ-ঝাঁ করলেও, গোয়ালঘরের পাশটায় কিন্তু ঝাঁপালো জাম গাছটার ছায়া। এখানটায় সব সময়তেই তাই আলো-আঁধারি এবং ঠান্ডা ভাব; আলোবিহীন ভারী রাতে গরুগুলোর ওই দিঘল চোখ আবার নীল টুনির মতো জ্বলজ্বল করে; অদ্ভুত একটা অন্য রকম গন্ধও আছে এর চারপাশে। গোবর, চোনা, খড়, দুধ আর গরুগুলোর গায়ের গন্ধ— সব মিলেমিশে একেবারে অন্যরকম। কপ্পুর-দীপ জ্বালিয়েও যা তাড়ানো যায় না; তালতলার ফুটপাথের সবজির গন্ধ, বাবার স্টুডিয়োতে রং আর আঠার গন্ধের মতোই, গোয়ালঘরের এই গন্ধটাও তার বড় আপন মনে হয়; এই গন্ধটা নাকে যাওয়া মাত্র, তাই সুস্থ বোধ করল শাফিকা। টলমল করতে করতে নিজের ঘরের সামনে ওই দাওয়ায় গিয়ে, বালতির কাছ অবধি নিজেকে কোনও রকমে টেনেহিঁচড়ে নিয়েই, নেতিয়ে বসে পড়ল শাফিকা। এ-কদিন তাকে দেখতে পায়নি গরুগুলো; আজ কি তাই লম্বা করে হাম্বা পাড়ল? এরাই তো ওর গোবর-ঘুঁটের ভরসা; কাঁচামাল কেনার খরচ নেই, অথচ বেচলেই পয়সা! হোকই বা যৎসামান্য, তবু ক্ষুদটুকুও তো কেনা যায়! এরাই তার বড় আদরের বন্ধু। ওদের প্রসবের পর, ওরাও তো যন্ত্রণা ভুলে বাছুরটাকে চেটে চেটে গা পরিষ্কার করে! ধীরে ধীরে কেমন শুকনো করে নেয়, নিজেদের বাচ্চা হওয়ার ক্ষতমুখও; আর তা ওই একটাই জিভ দিয়ে! ডান-বাঁ এমন সব বিচার ছাড়াই, প্রকৃতিই ওদের শিখিয়ে দিয়েছে ‘গোসল’-এর নিয়ম। ওদের থেকে কী আর এমন তফাত শাফিকার শরীরে! রয়ে-বসে শাফিকাও ‘গোসল’ সারল। ছাড়া কাপড়টা কী হবে জানে না! বালতির একপাশে রেখে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল যে, ঘরের দরজা ধরে তানি দাঁড়িয়ে আছে, ধরে ধরে তাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কোনও সাহায্য ছাড়াই ঘরে এসে, চৌকিতে শুয়ে পড়ল শাফিকা; চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এল তার, বেজায় ক্লান্তিতে।
কিছু পরে মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বড়বিবিও তার ঘরে এল। দিনের বেলা হলেও, টিমটিমে বাল্বটা জ্বালিয়ে দিয়ে বড়বিবি দেখে নিল যে, শাফিকার ‘গোসল’ হয়ে গেছে কি না। তানির দিকে তাকিয়েই যে ভরসা পেল এমন নয়; গোয়ালপাড়ের খোলা চাতালটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে, চারিদিকে সতর্ক চোখ বোলাতে লাগল বড়বিবি। ঘরে ঢুকে, খোকাকে কোলে নিয়ে বড়বিবি এসে বসতেই, চমকে তাকাল শাফিকা; মিয়াকে দেখেই, গা-গতর তুলে, বেঁকেচুরে উঠে দাঁড়াল নিজের বিছানা ছেড়ে। বগলে করে আনা নতুন মাদুরখানা মিয়া নিজেই পেতে দিল, তার সেই মলিন চৌকিটাতে। একলাফে বেরিয়ে গিয়ে, গরমজল ভর্তি একটা অ্যালুমিনিয়াম কেটলি, ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের গামলা এবং ধুয়ে ভাঁজ করা নতুন একখানা গামছা নিয়ে আবার ঘরে ঢুকল তানি। তার মিয়া ইসমাইল টিউবওয়েল টিপে আধা বালতি পানি এনে উঠোনে রাখল; তার জন্য রাখা, চানের জলের সেই খালি বালতিটাতেই। শাফিকা বুঝতে পারল যে, ওই গামছার ভাঁজে খোকার জন্য নতুন জামাও এসেছে। তার ‘গোসল’এর পর, গরম জলে খোকার গা-হাত-পা মুছিয়ে, নতুন জামা পরানো হবে; আজ এ ভাবেই একে একে সারা হবে তার ‘আধান’ ‘ইকামাহ’ এবং ‘তাহনিক’— এমন সব যত নিয়ম। এ কারণেই ইসমাইল নিজেও স্নান করে কাচা কাপড় পরে, সুর্মা লাগিয়ে, মাথা আঁচড়ে একেবারে তৈরি হয়েই এসেছে। বড়বউ আর তানি, গা-মোছানোর সবকিছু গুছিয়ে, খোকাকে নিয়ে উঠোনে বেরিয়ে যেতেই, ইসমাইল গভীর চোখে তাকাল শাফিকার দিকে। কিন্তু শাফিকা কি সেটা লক্ষ করল! কারণ, তার দৃষ্টি তো এখন ঘর পেরিয়ে ওই উঠোনের দিকে, যেখানে খোকাকে গা মোছাচ্ছে তানি আর বড়বিবি দুজনে মিলে। অপলক দৃষ্টিতে শাফিকা দেখছে, মায়ের কাছ ছাড়া করতেই, খোকা কেমন কাঁদছে, তার কচি-কচি হাত-পা ছুঁড়ে!
২.
রোদের তেজ কমে গেছে; ঘরের ফাঁক দিয়ে পিছনের বাগানে বিকেল বেলার কমলা আলো। নতুন মাদুর-পাতা চৌকির ওপর বাবু হয়ে বসে, নতুন জামা পরানো খোকাকে বড়বিবির কোল থেকে হাত বাড়িয়ে তুলে, নিজের দু-হাতে নিয়ে নিল ইসমাইল। বড়বিবি আর তানি, যে যার মতো কাপড় দিয়ে নিজেদের মাথা ঢেকে, মাটিতে বসল নমাজের ভঙ্গিতে, দু-পা পিছনে মুড়ে; চৌকিরই একপাশে, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কোনও রকমে উঠে বসেছে শাফিকা; সন্তান-প্রাপ্তির আনন্দে, খোকার ডান কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রথামতো বিড়বিড় করে, সে ধন্যবাদ দিতে লাগল আল্লাহকে; কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করল তাঁর দোয়া— যা না পেলে খোকা আর তার আম্মা, এমন সুস্থ শরীরে ঘরে ফিরত না। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এই পবিত্র শিশু প্রথম নমাজ শুনল, তার আব্বার কাছ থেকেই। এভাবেই তার জীবনে শুরু হল একজন সাচ্চা মুসলমান হয়ে ওঠার শুরুয়াত। এই ‘আধান’ পর্ব শেষে একটু দম ছাড়ল ইসমাইল। কী যেন ভাবল, কিছু ক্ষণ; তারপর খোকার বাঁ-কানের কাছে মুখ ডুবিয়ে শুরু করল ‘ইকামাহ’ বা নামকরণ। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করতে লাগল— ‘আল-লতিফ’… ‘আল-লতিফ’… ‘আল-লতিফ’— স্নিগ্ধ, কোমলপ্রাণ আর অনুভবী; ক্লান্তিতে চোখ বুজে এল শাফিকার। চোখ-বন্ধ বড়বিবির দু-গাল বেয়েও গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু; সেই অশ্রুবিন্দু ইসমাইলের চোখেও। ভাইকে কোলে নিয়ে তানিই শুধু উচ্ছ্বল হাসছে।
সবাই একটু ধাতস্থ হলে, শুরু হল ‘তাহনিক’; বড়বিবি এ ঘরে ঢুকেই ধাপির ওপর ঢাকা-চাপা দেওয়া যে একটা ছোট বাটি রেখেছিল, নমাজ শেষে, এবার সেটাই সে নিয়ে এল হাতে করে; তাতে রাখা খেজুর আর মধুর ক্বাথ; ডানহাতের আঙুলে করে বাটি থেকে সেই ক্বাথ একটু নিয়ে, তার সেই আঙুলটা আদর করে পুরে দিল খোকার ছোট্ট হাঁ-মুখে; ঘুমন্ত খোকা চুষে চুষে নিতে লাগল সেই স্বাদ; ঘাড় কাত করে দেখতে দেখতে শাফিকা ভাবল, জীবনের স্বাদ কি এতই মধুর!
৩.
চোদ্দোদিন পার করে খোকাকে নিয়ে আজ আবার আর এক ধর্মীয় পর্ব— ‘আকিকহ’। এটা সাতদিনেও করা যায়; না হলে চোদ্দো বা একুশ দিনে। শাফিকা ভালই জানে যে, এই পর্বটা সারতে কী পরিমাণ পয়সা লাগে। তাই এটাই হল সবচাইতে মুশকিল, কারণ তার মিয়ার মনটা দরাজ হলেও, ট্যাঁকের জোর তো একেবারেই নেই। একটা পাঁঠা বা ভেড়া জ্যান্ত কিনে, তাকে কুরবানি করে, সেই কাঁচা-মাংস আত্মীয়স্বজন, মেহমান, প্রতিবেশী এবং দরিদ্রদের সঙ্গে ভাগ করে খেতে হয়। সন্তানপ্রাপ্তিতে দান এবং বিতরণ; তার ওপর ছেলে হলে আবার জোড়া পাঁঠা। যত কচিই হোক না কেন, জোড়া পাঁঠার দাম তো সবসময়েই তার মিয়ার সাধ্যের বাইরে! নিশ্চয় কোনও অসুবিধে ছিল; সাতদিনের বার-টা পার করে তাই তার খোকার ‘তাহনিক’ পালন হচ্ছে চোদ্দোদিনে। টাকা যোগাড় না হলে একুশ দিনে হত; টাকাটা যে কোথা থেকে যোগাড় হল, সেটা একেবারে আকস্মিক ভাবে বুঝতে পারল শাফিকা। খোকার ‘তাহনিক’ মানাতে লোকজন নিয়ে শোরগোল করে সুর্মাবিবিকে আসতে দেখে। ট্রেন থেকে নেমে সে আর হেঁটে আসেনি। দুটো কচি কচি ভেড়ার বাচ্চা এবং অন্যান্য পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে সে এসেছে অটোতে চেপে। শাফিকার বড় এক ভাই ছাড়াও, ওদের সঙ্গে এসেছে আরও তিনজন অচেনা মানুষও। এরা নাকি তার দুই চাচা এবং এক বুয়া; এত দিন যে এরা কোথায় ছিল, কে জানে! সত্যিই এরা তার আসল চাচা-বুয়া কি না তা-ও তো জানে না শাফিকা! তার আম্মা এই সুর্মাবিবি, ইচ্ছে করলে পারে না এমন কাজ নেই। কাছে এসে দাঁড়াতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল শাফিকা; অভিমানে থরথর করে কাঁপতে লাগল সুর্মাবিবিও। আজ তার চোখেমুখে রাগ নেই। বড়বিবি আর তানি-বানির সামনে, শফিকার মান-ইজ্জত এখন যেন তার নিজেরও ইজ্জতের লড়াই। এই প্রথম আম্মা আর মেয়ে এক হয়ে জুড়ে দাঁড়াল।
ইসমাইল বেরিয়ে গেল ভেড়া দুটোকে নিয়ে, কুরবানি করিয়ে আনতে। বড়বিবির দেওয়া চিনির পানায় দেহ জুড়িয়ে দুই চাচা গেল এলাকাটাকে একটু ঘুরে দেখতে; আম্মা আর বুয়া নিজেদের ব্যাগ থেকে কাপড় বার করে, রাস্তার জামাকাপড় তার ঘরেই ছেড়ে, সদর্পে গিয়ে ঢুকল বড়বিবির হেঁশেলে। আম্মার সঙ্গে বুয়াকে দেখে যেন একেবারে কেঁচোটি বনে গেছে সেই দাপুটে বড়বিবি; ‘কচি’ ভাইকে দেখার ছুতোয়, তানি-বানি তো আগে থেকেই ঠায় পাহারা দিয়ে বসে আছে শাফিকাকে। তাদের চোখমুখেও কোনও উচ্ছ্বাস নেই। বড়বিবির ছোট্ট খোকাটাও আজ এই ঘরেই খেলে বেড়াচ্ছে তার দুই দিদির চোখের ওপর। খানিক নিশ্চিন্ত বোধ হওয়ায় চোখ বন্ধ করে, ঝিম মেরে শুয়ে থাকল শাফিকা। কিছু পরে মিয়া এই ঘরে এলে, তার গলা খাঁকারি শুনে চোখ খুলল সে। ইসমাইল ইশারায় বলল উঠোনে গিয়ে ‘গোসল’ করে, আম্মার আনা নতুন কাপড়খানা গায়ে চড়াতে। চৌকি থেকে ধীরে ধীরে নেমে, গোয়ালপাড়ের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই শাফিকা দেখল যে, গোয়ালটা শুধু যে সাফসুতরো তা-ই নয়, তার গোসলের জন্য রাখা একটা ছোট বালতির পানি থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে। গোসলের জন্য তাতানো পানি এই প্রথম পেল শাফিকা; বুঝতে পারল যে আব্বু-আম্মা আর ভাইদের জোর যে কী জিনিস! এই জন্যই বড়বিবি এত দেমাক দেখায়। তার চলা-বলার একদিকের জোর যেমন ইসমাইল, অন্যদিকের জোর তেমন তার ওই জাঁকালো আব্বু-ঘরটাও।
জোড়া ভেড়ার মাংস আপ্যায়ন ও বিতরণ পর্বের আগে, বড়বিবি এক ফাঁকে এসে খোকাকে নতুন জামা পরিয়ে গেছে। ইসমাইলের পরিবারের জনাকয়েক লোকজন ছাড়াও নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছে বড়বিবির আম্মা, আব্বু আর ভাই-বৌ; আর এসেছে পাড়াঘরের দু-একজন নিকট প্রতিবেশী। নতুন কাপড় পরে, খোকাকে কোলে নিয়ে, চৌকিতে পাতা সেই নতুন মাদুরখানি আবার বিছিয়ে তারই ওপর পা ঝুলিয়ে বসেছে শাফিকা। সদ্য চেনা তার সেই একজোড়া চাচা, বুয়া, আম্মা-সুর্মাবিবি সহ বাকি সকলে মিলে চারিদিক থেকে ঘিরে দাঁড়াল তাকে; শুরু হল একসঙ্গে গলা মিলিয়ে মৃদু স্বরে এক গান, যা সকলে মিলে গাইতে গাইতে ধন্যবাদ জানানো হয় আল্লাহ’কে। জল-টলটলে একটা ডাবের মুখ কেটে, সেই পবিত্র জলে, উঠোনেই আপনা-আপনি ফুটে থাকা কয়েকটা নয়নতারা ফুল তাতে ফেলে, দু-হাতের আঁজলায় ধরে বানি সেটা নিয়ে এসেছে; আর ওটা হাতে নিয়েই, ঠায় সে দাঁড়িয়ে থাকল খোকার মাথার কাছেই। এক একজন নিমন্ত্রিত খোকার কাছে এগিয়ে আসছে, আর ক্ষুর দিয়ে খোকার মাথা চেঁচে সেই চুলগাছি ফেলছে ওই জলে। সকলে মিলে একে একে ক্ষুর চালানোতেই, ছেলের মাথা থেকে সাফ হয়ে গেল গর্ভে থাকার সময় খোকার মাথার ‘নোংরা-চুল’। শাফিকার কোল থেকে নিয়ে খোকাকে স্নান করিয়ে, তার ন্যাড়া মাথায় কাঁচা হলুদ-বাটা লাগিয়ে দিল বড়বিবি; কান্না থামিয়ে হাসতে লাগল খোকা। তাকে আরাম পেতে দেখে, শাফিকার দু-চোখেই যেন ঝেঁপে আসতে লাগল রাজ্যের ঘুম।
শুরু হল সে দিনের সেই শেষ পর্ব— যা হল ‘সাদাকা’, মানে ভালবেসে দান। এই নিয়মে এবার খোকার মাথা-কামানো ওই ভিজে চুলগুলো ডাবের খোলা থেকে তুলে, নিক্তিতে ওজন করে, সেই মাপে সোনা বা চাঁদি দান করতে হবে— এই হল ‘সাদাকা’র আসল নিয়ম। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল শাফিকা; কে দেবে সোনা বা চাঁদি! কোথায় পাবে তার আম্মা! আল্লাহ’র দোয়া চেয়ে, নিচু স্বরে যে গান এত ক্ষণ সকলে মিলে গাইছিল, সেটাও থেমে গেল। ঘরটা কেমন থমথমে হয়ে গেছে; শাফিকার দিকে তাকিয়ে থাকা বড়বিবির সেই দৃষ্টি থেকে চোখ নামিয়ে নিল শাফিকা, নিজেরই শরীরের মধ্যে যেন জড়ো হয়ে লুকিয়ে পড়তে চাইল কোনও রকমে। ইসমাইল কিন্তু ঠিক এ-সময়েই এগিয়ে এসে বলল যে, একরতি আন্দাজ চাঁদি কেনার টাকা তাকে নাকি আগেই দিয়ে দিয়েছিল ছোটবিবির মা— এই সুর্মাবিবি। কিন্তু ওই টাকায় সামান্য চাঁদি না কিনে গরিব-আতুরদের মধ্যে মিষ্টি বিলিয়ে এই ‘সাদাকা’ করতে চায় সে; মাথা তুলে তাকাতে পারল শাফিকা, কিছুটা অবাক হয়ে গেল সুর্মাবিবিও; কারণ সে তো ভাল করেই জানে যে, এমন কিছু ঘটেনি তার দিক থেকে। শাফিকার দুই চাচা এগিয়ে এসে বলল, ইসমাইলের সঙ্গে পাড়ার মাজারে গিয়ে, তারা দুজন ওই মিষ্টি বিলিয়ে দিয়ে আসবে গরিবদের। নিজের ব্লাউজের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা ছোট্ট একটা কাপড়ের থলে বার করল সুর্মাবিবি; কালো কারের থেকে ঝোলানো চাঁদিতে গড়ানো, অর্ধেক চাঁদ লাগানো লকেটটা বার করে পরিয়ে দিল খোকার গলায়। শাফিকা বুঝে পেল না যে, কৃতজ্ঞতায় এখন কার মুখের দিকে চেয়ে থাকবে সে— তার আম্মা ওই সুর্মাবিবি, নাকি ইসমাইলের ছেলে এই লতিফ!
‘স্নিগ্ধ… কোমল-প্রাণ… অনুভবী’!
আমি শাফিকা— প্রসব হওয়ার পর থেকেই, কী যেন এক ঘোরের মধ্যে কেটে গেল চল্লিশটা দিন; সব কাজ থেকে এমন ছুটকারা কে আর কবে দিয়েছে আমাকে! এমনকী মিয়ার কাছ থেকেও বেমালুম ছুটি; দিন বা রাত— সমস্ত সময়টা জুড়ে শুধু আমি আর ওই তুলতুলে খোকা! খোকাকে কোলে পেয়ে সময় যেন লাগামহারা হয়ে গেছে; খোকা যখন বুকের দুধ টানে, মনে হয় না যে এটা আমারই শরীর। একই সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি দুজনেই; খেয়ে এবং খাইয়ে দুজনেরই কেমন পেট ভরে যায়! টুকরো-টুকরো কানি জুড়ে কাঁথা পাতি; কয়লার ঢেলা দিয়ে যা ইচ্ছে ‘ড্রইং’ করে নিয়ে, সুচের ফোঁড় তুলে তুলে কাঁথা বানাই, যেমন করে ঘুঁটে দিতাম ঠিক সেইভাবে; ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোথা দিয়ে যেন কেটে যায়। এ ঘরে এলেই, সেসব চেয়ে নিয়ে, চৌকিতে বিছিয়ে, নেড়েচেড়ে বেশ মন দিয়েই দেখে মিয়া আমার। অবাক হয়, তারিফ করে। তালতলার চেনা দর্জিদের কাছে বলে-কয়ে, নানা রঙের কাঠিম সুতোও এনে দেয় সস্তায়। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি যে একই লাল-সবুজ বা নীল-হলুদের কত আলাদা আলাদা রং; মনে পড়ে ‘বাবা’ বলতেন ‘শেড’। কাগজের টুকরো আর আঠার বদলে এখন আমায় ‘খোকায়’ পেয়েছে। তাই তার জন্যই কাঁথা জুড়ে এমন সব রংবাহারি ছবি। তবে নকশার বেশিটাই ফুটে ওঠে, এখানকার বনেবাদাড়ে ছড়িয়ে থাকা, ঘন রঙের শ্যাওলা-সবুজ আলো।
সমস্ত নিয়ম মেনে, ঠিক চল্লিশ দিন পর খোকাকে কোলে নিয়ে ওই একটেরে ঘর থেকে বেরিয়ে, আবার সংসারে ফিরলাম আমি। ইতিমধ্যেই খোকার ‘খাটনা’ও হয়ে গেছে; বড় হয়ে আর কাটা-ছেঁড়ার জ্বালা থাকল না কোনও। সেইসঙ্গে শেষ হয়ে গেল নকশার ‘ড্রইং’ করে নিয়ে, একের পর এক কাঁথা বোনার ফুরসতটুকুও। আবার সেই ঘুঁটের বেসাতি আর হাড়মাস কালি করা ফরমায়েশি খাটুনি; শুনশান একা ঘরে বসে, নিজের মনে কাঁথা জুড়ে ছবি বানাতে পেয়ে, আমার সেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুঁটে সাজানোর নেশাটাও কেমন একেবারেই ছুটে গেছে; খোকা আর নকশা বোনা— এ ছাড়া আর কিছুই তো মন টানে না আমার! মিয়া-বড়বিবি-তানি-বানি-বড়খোকা বা পাড়াঘর— এ সবই কেমন গা-সওয়া হয়ে গেছে এখন; ওদের ঘিরে, মন আর জাগে কই!
তবে মাস ছয়েক যেতে না যেতেই আবার গর্ভবতী হলাম আমি। জানতে পেরে আমার ঘরে বসে নমাজ পড়ে, দোয়া মাগল ইসমাইল; চোখ বন্ধ করেই বলল, ‘খুকি নয়, খোকা আসুক। সংসার বাড়ছে, কামাবার ‘মরদ’ চাই তো!’
বার বার মনে পড়তে লাগল, খোকার জন্মের পর হেল্থ সেন্টার থেকে বেরোবার আগে, আমাকে একা পেয়ে বড়বিবির সেই চাপা স্বরে শাসন, ‘প্রথমেই খোকা পেয়ে গেছিস, ব্যাস! এবার ‘কপাটি’ লাগিয়ে নে; এতগুলো হাঁ-মুখ মিয়া আর কত টানবে রে!’
আজ এই অন্ধকারে থম মেরে বসে থাকতে থাকতে, খোকাকেই বা কী করে ভুলে গেলাম আমি! ভুলে গেলাম যে, এখন আমার কাজ চুল বেঁধে, কাপড় ছেড়ে, ঘরে-দোরে আলো দেখানো! কেনই বা মনে হচ্ছে আমার যে, হাজার বাতি জ্বালালেও এই সংসারের পয় নেই! শুধুই হাঁ-মুখ আর একে অন্যকে গিলে গিলে খাওয়া!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র