দোল, সুনীলদা ও শান্তিনিকেতন
সেই একবার ঠিক হল, দোলে শান্তিনিকেতন যাওয়া হবে। ঠিক হল মানে, স্বাতীদি আর সুনীলদাই স্থির করলেন। সুনীলদা, মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আর স্বাতীদি, মানে স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, প্রায়শই শান্তিনিকেতন গিয়ে দিনকতক কাটিয়ে আসতেন। শান্তিনিকেতনে ওঁদের বাড়িও কারও অচেনা নয়। বাগান আর পুকুরঘেরা দোতলা সেই বড় বাড়ির নামও আমাদের চেনা ছোটবেলা থেকেই, ‘একা এবং কয়েকজন’। প্রথমবার যখন জেনেছিলাম ওঁদের বাড়ির এই নাম, তখন কবিতার বই আর বাড়ির নাম মিলে যাওয়ায় পাঠক হিসেবে কী যে এক আনন্দ পেয়েছিলাম, সে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
আমি যে তার আগে শান্তিনিকেতন যাইনি, তা যদিও নয়। কোনও এক অনুষ্ঠানেই কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম, থেকেছিলাম সম্ভবত টুরিস্ট লজে। সেবারও সুনীলদা স্বাতীদি ওখানেই আছেন, পরদিন সকালে সাহস করে একবার দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন জলখাবারের পর্ব চলছে। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী চত্বর পেরিয়ে, ছোট্ট একখানা পাকা সাঁকো পেরিয়ে, প্রান্তিকে ঢুকে বেশ খানিকটা গিয়ে একখানা লাল মাটির কাঁচা রাস্তার ওপর ওঁদের সেই বিরাট বাড়ি। দরজায় বোগনভেলিয়া লতিয়ে আছে, ভিতরে ঢুকলে কত-না ফুলের গাছ দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। বাড়ির পিছন দিকে বেশ বড় বহরের পুকুর একখানা, তাতে মাছের চাষও হয়। একতলায় দিব্যি টানা এক বারান্দা, তাতে অনেকে বসতে পারে, এমনই জায়গা করা। এসব সেই প্রথম সফরেই দেখে এসেছিলাম। তারপর আর যাওয়া হয়নি শান্তিনিকেতন।
তবে দেখতাম, সুনীলদা আর স্বাতীদি মাঝেমধ্যেই চলে যেতেন। সে খুব স্বাভাবিকও। কলকাতার কোলাহল আর ভিড় থেকে দূরে, কিছুদিন নির্জন আর নিস্তব্ধ সময় কাটাতে কে না চায়। স্বাতীদি মানুষটাই বড্ড নিরিবিলি গোছের। আর সুনীলদা বাইরে বেশ হুল্লোড়ে মানুষ হলেও, ভিতরটা তো শিল্পী’র, মাঝেমধ্যেই নিরবচ্ছিন্ন লিখে যাবার জন্য তাঁর প্রয়োজন নিঃসঙ্গতা। তাই কলকাতায় যখনই হাঁপিয়ে উঠতেন, পাততাড়ি তুলে পাড়ি দিতেন শান্তিনিকেতনের বাড়ি। কলকাতায় থাকলে তো রোজ বাড়িভর্তি লোকজনের মেলা আর সন্ধে হলেই কোনও না কোনও সভা বা আড্ডায় আমন্ত্রণ। তাই বোধহয় একরকম পালিয়ে গিয়েই শান্তিনিকেতনের বাড়িতে লেখালিখি সারতেন সুনীলদা।
তা সেবার ঠিক হল যে, দোলে আমরাও ওঁদের সঙ্গে শান্তিনিকেতন যাব। তখনও শান্তিনিকেতনের দোল ব্যাপারটা এইরকম ট্যুরিস্টি হয়ে ওঠেনি। আর সত্যি বলতে কী, কলকাতার বাইরে দোল কেমন, সে-জিনিস আমারও তার আগে দেখা হয়নি। এক রোববারের আড্ডায় সুনীলদাই কথাটা পাড়লেন। ‘চলো না, এবার দোলে সকলে মিলে শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে আসি’। সেটা, মনে আছে আমার, ২০০৬ সাল। মনে আছে, কেননা তার ঠিক আগের বছর আমি আর দূর্বা বিয়ে করেছি। আমাদের নতুন সংসার শুরু হয়েছে। সুনীলদা কথাটা ফেলামাত্র সকলে লুফে নিল। রোববারের আড্ডার প্রায় সকলেই তরুণ এবং প্রায় সকলেই কবিতা লেখেন। এহেন প্রস্তাবে তাঁদের দ্বিমত হবার কথাই নয়। কেবল আমি একটু থতমত ভাবে তাকিয়ে আছি দেখে সুনীলদা জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, তুমি যাবে না?’ উত্তরে বলতেই হল, থাকব কোথায়, এই নিয়েই ভাবছি। কেননা দোলে তো লজ বা হোটেল সব আগে থেকে ঠিক করতে হয়, এত দেরিতে কি কিছু আর পাওয়া যাবে? সত্যিই, দোলের তখন আর হপ্তাখানেক বাকি মোটে। শুনে সুনীলদা হাসলেন একটু। পাশ থেকে স্বাতীদি বললেন, ‘শোনো, তুমি আর দূর্বা নতুন বিয়ে করেছ, তোমরা আমাদের বাড়ির অতিথি। থাকা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। বাকিরা যার যার থাকার বন্দোবস্ত করে নিও’। এর পর আর কথা চলে না। খোদ স্বাতীদি নিজেদের ঘরের দরজা খুলে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, আর সুনীলদা জানাচ্ছেন দোলের আহ্বান, এসবে কি না করতে আছে?
দোলের আগের দিন ট্রেনেই যাওয়া হল শান্তিনিকেতন। চমৎকার আবহাওয়া। পায়ের নীচে মাটির লাল আর মাথার উপরে পলাশের গনগনে আগুন ছেয়ে থাকা সেবারের শান্তিনিকেতন আজও চোখ থেকে মোছেনি। স্টেশন থেকে রিকশা করে যত সুনীলদা’র বাড়ির দিকে এগোচ্ছি, ফুলের আগুন বাড়তে থাকছে। গরম টের পাচ্ছি, কিন্তু জানি, সন্ধের পর বসন্তের বাতাস এসে সব ভুলিয়ে দিয়ে যাবে। আর রিকশায় বসেই আমি আর দূর্বা দেখতে পাচ্ছি, কলকাতার চেনা লোকজন এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের অনেকেই সুনীলদা আর স্বাতীদিকে দেখে হাত নাড়ছেন। বুঝলাম, অন্তত দোলের সময়ে নির্জনতা এই দম্পতির কপালে নেই।
‘একা এবং কয়েকজন’-এর একতলার শোবার ঘরটি ছেড়ে দেওয়া হল আমাদের জন্য। সুনীলদা-স্বাতীদি ওপরের ঘরে। কিন্তু সে তো কেবল সামান্য সময়। দিনভর আর সন্ধে পেরিয়ে গভীর রাত অবধি তো আড্ডাই চলল। বারান্দার এদিক-ওদিক মিলিয়ে মিশিয়ে সকলে বসে আমরা। কেউ চেয়ারে, কেউ বেতের মোড়ায়, কেউ মাটিতে, কেউ বা সিঁড়িতে। দেদার আড্ডার শেষে শুরু হল অপেক্ষা। কাল আমাদের দোল।
এখানে বলে রাখি, রাতে আমাদের প্রায় ঘুমই হল না; কেবল এই কথা ভেবে যে, আমরা স্বাতীদি-সুনীলদা’র বাড়িতে আছি। এঁরা আমাদের কাছে নক্ষত্রের চাইতে কম কিছু নন। স্বাতীদিকে চিনেছি অনেক পরে। কিন্তু আমাদের দুজনেরই স্কুল-কলেজের এমন সব দিন কেটেছে যেখানে ব্যাগের মধ্যে বা বালিশের পাশে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই ছিল নিয়মের মতোই। তাঁর কবিতা আমাদের প্রেমে পড়িয়েছে, আমাদের মনখারাপ করিয়ে দিয়েছে, আবার আমাদের স্বপ্নও দেখিয়েছে। ‘বন্দী জেগে আছো’-র কবি সুনীল, ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’-র সুনীল, ‘স্মৃতির শহর’-এর সুনীল যেমন আছেন, তেমনই আছেন ‘আত্মপ্রকাশ’, ‘যুবক যুবতীরা’, বা ‘প্রথম আলো’-র সুনীল। মধ্যবয়সে যিনি বাংলা ভাষার প্রবাদ হয়ে গেছেন, খোদ তাঁরই বাড়িতে, তাঁর উপস্থিতিতে রাত কাটাচ্ছি, এটাই যথেষ্ট ছিল আমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেবার জন্য।
পরদিন যা-যা হল, তা এ-জীবনে ভুলে যাবার মতো নয়। সকালের জলখাবার সেরে আমরা সদলবলে চললাম বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণের আম্রকুঞ্জের দিকে। সেখানেই জমজমাট করে দোল খেলা হয়। সঙ্গে গান আর নাচ তো আছেই। আমাদের কবিবন্ধুরা যে যার আস্তানা থেকে এসে জড়ো হলেন ‘একা এবং কয়েকজন’-এর বাগানে, তারপর সে প্রায় এক মিছিল তৈরি করে হাঁটা দেওয়া হল আম্রকুঞ্জকে উদ্দেশ্য করে।
পৌঁছতেই অনেকখানি সময় লেগে গেল, কেননা এক-পা দু-পা অন্তর মানুষজন সুনীলদাকে থামিয়ে তাঁর পায়ে, কপালে, গালে আবির মাখিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই সুনীলদা’র অচেনা। কিন্তু তিনি তো সকলের কাছেই চেনা। তাই দিব্যি ইস্কুলের বাধ্য ছেলের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে সক্কলের কাছ থেকে হাসিমুখে রং গ্রহণ করছিলেন তিনি। তাই যতক্ষণে আমাদের মিছিল আম্রকুঞ্জে পৌঁছল, ততক্ষণে সুনীলদা’র পায়ে বা মুখে আর খালি জায়গা বাকি নেই। সবটাই রঙে ভরে গেছে। আম্রকুঞ্জে তখন সকালবেলার রোদে মিশে আছে আবিরের ধূম। রবীন্দ্রনাথের বসন্তের গানে জেগে উঠছে পথ আর প্রান্তর, পলাশের গয়না পরা ছেলেমেয়েরা নেচে উঠছে তারই তালে। আর এসবের মধ্যেই, আম্রকুঞ্জের একপাশে চুপটি করে বসে থাকা সুনীলদাকে এসে আবির দিয়ে যাচ্ছে সকলে। সে এক দেখবার মতো দৃশ্য। স্বাতীদি আনন্দিত হরিণীর মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছেন এদিক-ওদিক। আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছি স্ফুলিঙ্গের মতো, নকশার মতো। যেন বসন্ত তার আয়না নিয়ে এসেছে দূর দেশ থেকে আর আমরা যে যার চেহারা মিলিয়ে নিচ্ছি রং থেকে রঙে, এমনই এক সকাল ছিল সে।
দুপুরে সুনীলদা স্বাতীদির বাড়িতে বেশ খানিক জিরিয়ে সন্ধে নামিয়ে নেওয়া হল। সে-সন্ধের চেহারা একেবারে আলাদা। সকালে যে রোদ্দুর ছিল অত চড়া, তা বোঝার আর কোনও উপায়ই নেই। বরং গায়ে একখানা পাতলা চাদর চাপালে আরাম হচ্ছে বেশ, এমনই সুশীতল বাতাস। ওঁদের চওড়া বারান্দায় জম্পেশ করে আড্ডায় বসা হল সন্ধে নামার পর থেকেই। কাল ফিরে যাওয়া, যেটুকু উসুল করার সব আজই করে নিতে হবে, এমন একখানা ভাব ছিল আমাদের।
সে-উসুল অবশ্য হলও, যখন প্রায় মাঝরাতের কাছাকাছি এসে সুনীলদা হঠাৎ বললেন, ‘নদীর ধারে যাবে নাকি একবার?’
বলা বাহুল্য, আমরা সকলেই তখন তিন-চার পাত্রের ওইপারে দাঁড়িয়ে। এ-প্রস্তাবে ‘না’ করবার মতো যুক্তি তখন আর কারও কাছে নেই। স্বাতীদি, যিনি সাধারণত একটু নিয়ম মেনে চলতেই পছন্দ করেন, তিনিও রাজি। আমরা হইহই করে উঠলাম। এমন জ্যোৎস্নার রাত্তিরে কোপাই-এর ধার, এ-জিনিস তো আগে কখনও দেখিনি! দু’তিনখানা গাড়ি মজুতই ছিল, তাতে চেপে বেশ কিছুদূর যাওয়া হল। একটা জায়গায় এসে সুনীলদা বললেন, ‘এবার কিন্তু হেঁটে যেতে হবে’। নামলাম সকলেই। দু’পাশে পলাশ আর শালগাছের সারি, তাদের পাতায় পাতায় জ্যোৎস্না চিকচিক করছে, একটু দূরেই কোপাই। পায়ের তলার লাল মাটিতে রুপোলি মিশে কেমন একটা আশ্চর্য রং তৈরি হয়েছে। প্রকৃতি বোধহয় এভাবেই আবির বানায়।
সুনীলদা আর স্বাতীদি সামনে, আমরা পাশেপাশে আর পিছনে হেঁটে চলেছি। হঠাৎ উদাত্ত গলায় সুনীলদা গান ধরলেন, ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে/ বসন্তের এই মাতাল সমীরণে’। চারপাশটা এক লহমায় বদলে গেল। মনে হল, এমনই কোনও মুহূর্তে হয়তো এ-গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আজ আমাদের সামনে সেই কবেকার মুহূর্ত আবার জ্যান্ত করে তুললেন সুনীল, আজকের কবি! এ-গান জানে না এমন বাঙালি কমই আছে। আমরা সকলে গলা আর পা মেলালাম সুনীলদা’র সঙ্গে। তারপর অনেকক্ষণ বসেও ছিলাম নদীর পাড়ে। নেহাত যখন না-ফিরলেই নয়, তখন বাড়ি ফেরা হল। কিন্তু আজ, এই এত বছর পরও যখনই দোল আসে, আমি বুঝতে পারি, আমাদের অনেকখানি থেকে গেছে ওই অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া নদীর পাড়ে। যা আর কোনওদিন বাড়ি ফিরবে না। সুনীলদা’র মতোই।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র