তরঙ্গনাথ-চার
দপ্তরে ঢুকতে না ঢুকতেই ডাক পড়ল মি. অগাস্টের ঘরে। দু’দিন আগেই ডাকে আসা মায়ের চিঠি এবং তাঁর এই তড়িঘড়ি তলবের মধ্যে কোথায় যেন একটা যোগসাজশ রয়েছে। কোনও রকম ভণিতা না করেই বললেন,
‘তোমার যে কাকা গিরিডিতে পোস্টেড, বিকেলের গাড়িতেই আজ এখানে আসছেন।’
‘স্যর উনি আমার কাকা নয়, মেসোমশাই। আমার কাছে কোনও চিঠি আসেনি।’
‘ঠিকই। লোক মারফৎ আমাকে জানিয়েছেন; দু-একদিন থাকতেও চান।’
‘আমার কোয়ার্টারে থাকলেও অসুবিধে নেই।’
‘তুমি তো পাশের ঘরখানি বন্ধই রাখো; ওখানেই বন্দোবস্ত করে দিতে বলি!’
‘আপনি যা ভাল বুঝবেন স্যর…’
‘তোমার বউ এসে গেলে আর কিছুদিন পরেই তো ওই ঘরটাও ব্যবহারে আসবে; তোমার
মায়ের চিঠি তো তাই বলছে।’
‘বিয়ে হয়ে গেলেও বউ এখন আসবে না স্যর; বাবা-মায়ের কাছে থাকবে।’
‘তুমি কি মেয়েটিকে দেখেছ?’
‘না স্যর; ওই চিঠিতেই যা জেনেছি।’
‘আমরা এরকম ভাবে বিয়ের কথা ভাবতেও পারি না।’
মাথা নিচু করে আছি দেখে আর কথা না বাড়িয়ে, তাঁর সেই নিজস্ব ভঙ্গিতে হাসলেন। মনে হল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ‘আঙ্কেল’-এর এখানে আসা নিয়ে উনিও কিছু প্রোগ্রাম সাজাচ্ছেন। দেখা যাক।
২.
মি. অগাস্ট তাঁর গাড়িটায় একজন ড্রাইভার দিয়ে, স্টেশনে পৌঁছে যাবার নির্দেশ আমাকে আগাম দিয়ে রেখেছিলেন। এই ড্রাইভারটির কাছেই আমার ড্রাইভিং ট্রেনিং হবে। গাড়ির সামনের সিটে বসামাত্র আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি, আমার লেগ-স্পেস নিয়ে; এত লম্বা ঠ্যাং! তিন ভাঁজ করতে পারলেই যেন ভাল হত; উচ্চতা প্রশ্নে মনে পড়ল, আমার বউ লম্বা না খাটো? কেমন হবে কে জানে! এসব কথা কি বাবা মাকে জিজ্ঞাসা করা যায়! মেসোমশাই নিজে থেকে বললে ভাল, না হলে আর জানার উপায় কী! এ ছাড়া আর কিছু নিয়েই আপাতত ভাবছি না। ছুটিতে বাড়ি যেতে পারব, এটাতেই সব থেকে আনন্দ হচ্ছে। বার কয়েক যাতায়াত করাতেই পুলিশ-কোয়ার্টার থেকে রেলস্টেশন যাবার পথটা এখন বেশ সড়গড় হয়ে এসেছে। দু-পাশে শস্যখেত, দূরে দূরে মাটির বাড়ি আর মেঠো রাস্তার দু-ধারেই সার দিয়ে বেশ কিছু বড় বড় গাছ। লোক চলাচল নেই বললেই চলে; সন্ধেবেলা মাঝে-মাঝে রাস্তার ওপর শেয়াল চলে আসে, আর দিনের বেলায় পেল্লায় সাইজের মহিষ বা কাঁড়া। কী মোটা তাদের সেই বাঁকানো শিংজোড়া! রেল স্টেশনে ঢোকার মুখ থেকেই কিছুটা চত্বর সিমেন্ট বাঁধানো; তা বাদে বেশ কয়েকটা ঝাঁকালো সজনে গাছ; সবসময় ছায়া পেতে রাখে। পুলিশের জিপ এসে দাঁড়াতেই কয়েকজন নেটিভ চাকুরে ছুটে এসে দাঁড়িয়েই সেলাম ঠুকল গাড়িটাকেই; স্টেশন মাস্টারের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাতেই বুঝলাম যে এঁদের কাছেও আগাম খবর আছে সরকারি অতিথি আসবার। মিনিট কুড়ি লেটে গাড়ি ঢুকতেই ঘর থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালাম; মেসোমশাই একজন আর্দালি-সহ রিজার্ভড কামরা থেকে নামলেন। আমার এই সেজোমেসো খুব একটা রসিক বা উচ্ছ্বাসপরায়ণ নন। কী এক দুশ্চিন্তায় সব সময় যেন ডুবে থাকেন। উর্দিপরা আমাকে একবার ভাল করে দেখে নিয়েই, আমার সঙ্গেই পা মিলিয়ে বেরিয়ে এলেন স্টেশন চত্বরে, জিপটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এবার নেটিভ স্টেশন মাস্টার নিজে এসে সেলাম ঠুকে বিদায় দিলেন আমাদের। মেসোমশাইকে পিছনের দরজা খুলে দিয়ে আগের মতোই সামনের সিটে এসে বসলাম আমি। ঘণ্টা আধেকের পথ, দুজনেই একেবারে নিঃশব্দ বোবার মতো থেকে, দ্রুত পার হয়ে এলাম আমরা; একটাও কথা বললেন না মেসোমশাই। এমন সব চাকরির এটাই দস্তুর। অন্য দিকে প্রকৃতির নিয়ম মেনে গোধূলির আলো নিভিয়ে মোহময় সন্ধে নামছে প্রান্তরের দিগন্ত রেখায়।
৩.
কোয়ার্টারের বারান্দায় রাখা বেতের একটা গোল টেবিলে চা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোটেলাল; সঙ্গে ঢাকা দেওয়া চুবড়িতে রাখা খাস্তা নিমকি। সেখানে না বসে পাশে রাখা কাঠের একটা বড় চেয়ারে বসে বুট এবং মোজা খুলতে খুলতে মেসোমশাই বললেন,
‘তনু, আগে সন্ধ্যাহ্নিক সেরে নেব। তারপরে খাস্তা দিয়ে চা।’
‘আপনার জন্য এই পাশের ঘরটিই বন্দোবস্ত করেছেন স্যর।’
‘কোনও অসুবিধে নেই। আমার সবেতেই চলে যায়।’
‘তাহলে আমিও একটু ছেড়েছুড়ে নিয়ে বসি?’
‘যাও বাবা! কিছু দরকার হলে ছোটেলাল তো রইল।’
ঘণ্টা খানেক পরে মেসোমশাই বারান্দায় এসে বসলেন বটে, কিন্তু কথা প্রায় বললেনই না; বুঝলাম যে নজরদারি সম্পর্কে তিনিও বেশ সজাগ। ছোটেলাল চা দিয়ে ফিরে যাবার সময়ে একবার শুধু তাকে ডেকে বললেন, আশেপাশে নিশিন্দে পাতার গাছ থাকলে সেই কাঁচা পাতাসমেত দু-একটা ডাল একটা মাটির পাত্রে রেখে বারান্দার কোনে জ্বালিয়ে দিতে। আর আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে, ছোটেলাল সে ব্যবস্থা করে দিতেই মশার ঝাঁক আর এ-মুখো হল না। আমার দুই ছোট ভাই-বোন, রাণী, বদু ছাড়াও তাঁর নিজের তিন মেয়ে— চুনী, পান্না, মোতি এবং সেজোমাসিমার খবরাখবর দিয়েই সান্ধ্যআলাপ শেষ করে ঘরে চলে গেলেন। আমিও গুটিগুটি নিজের ঘরে এসে দপ্তর থেকে নিয়ে আসা কয়েকটা ইংলিশ বুলেটিনে চোখ বোলাতে লাগলাম। সে রাতে গরম ফেনা ভাতের সঙ্গে আলুচোখা আর সেঁকা পাঁপড় দিয়েই খাওয়া হয়ে গেল। এটাও মেসোমশাইয়ের নির্দেশেই।
দুজনে পাশাপাশি থেকেও মন খুলে কথাবার্তা না হওয়ায় যে গুমোট বাঁধছিল, সেটা যেন একেবারে কেটে গেল ভোর না হতেই মেসোমশাইয়ের গলায় মন্ত্রপাঠ শুনে। নিজের ঘর থেকে বেরিয়েই বারান্দায় রাখা, কালি মাখা মাটির সেই খালি হাঁড়িটা দেখেই বুঝলাম যে, গরম জল আনিয়ে তাঁর স্নান হয়ে গেছে। বুঝলাম যে ভোর না হতেই গরম জল দেবার নির্দেশও তিনি দিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর ঘরে উঁকি মারতেই দেখলাম, মেঝের ওপর একটা হরিণের চামড়ার আসন পেতে, পদ্মাসনে বসে জপ করছেন। বিছানাটায় রাতে শোয়ার চিহ্নই নেই; এতটাই টানটান করে ঝেড়েঝুড়ে পাতা। পুব দিকের খোলা জানলা দিয়ে আলো এসে পড়ছে, তাঁর পুজোর আসনের সামনে, শালপাতায় সাজানো একমুঠো ফুলের ওপর; বেড়ার ধারে ফুটে থাকা শ্বেত-টগর, হলুদ-কল্কে আর কমলা রঙের লঙ্কা-জবার সঙ্গে দু একটা বন তুলসীও নিয়েছেন। এসবও কি ছোটেলাল তুলে এনে দিল? নাকি তিনি নিজেই গুছিয়ে নিয়ে বসেছেন! সামনে রাখা ঘটটা দেখে বুঝলাম যে তামার ওই জলঘট আর হরিণের ছালটা সব সময় তাঁর সঙ্গেই থাকে; বাকিটা উনিই নিজের মতো করে ব্যবস্থা করে নেন। চায়ের সঙ্গে গরম জিলিপি আর সবজি-পুরি দিয়ে ‘নাস্তা’ শেষ করে মেসোমশাই তাঁর খাতাপত্র নিয়ে বসে গেলেন। বুঝলাম যে মি. অগাস্টের সঙ্গে দেখা না করে তিনি আর এখান থেকে এখন মোটেই নড়বেন না।
আমিও আমার মতো একটু হেঁটে বেড়িয়ে, নিজের ঘোড়া সেই ‘বুনো’র খবর নিয়ে, ঘরে এসে স্নান সেরে একেবারে তৈরি হয়ে নিলাম। দশটা বাজতেই দুজনে একসঙ্গে দপ্তরে এসে দেখি যে মি. অগাস্টও এসে গেছেন। আমাকে আমার জায়গায় যেতে বলে, মেসোমশাই গেস্টরুমে স্পেশাল ভিজিটারদের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। মি. অগাস্ট ডেকে পাঠালে, ভেতরে গিয়ে দেখি মেসোমশাইও বসে আছেন সাহেবের মুখোমুখি। আমিও গিয়ে দস্তুর মতো সেই উল্টো দিকটাতেই দাঁড়ালাম, যেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর নির্দেশ শুনি এবং তিনি না বলা পর্যন্ত তাঁর ঘরের কোনও চেয়ারেই কখনও বসি না। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মি. অগাস্ট বললেন,
‘তোমার বিয়ের জন্য তো ছুটি মঞ্জুর করতে হবে। আমি তো আগামী মাস থেকেই তোমার ড্রাইভিং ট্রেনিঙের বন্দোবস্ত করে ফেলেছি; ঠিক আছে সেটা না হয় আপাতত মুলতুবি থাক।’
‘না স্যর, মুলতুবি করবেন না। যেমন আছে তা-ই থাক।’
‘বিয়েতে সম্মত নয়?’
‘তা নয় স্যর। আপাতত ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে বিয়ের দিনটা একটু পিছনো তো যেতেই পারে।’
‘ভেরি গুড ডিসিশন। দেখো পারো কি না! টু-উইকসের ছুটি নিয়ে বাড়ি ঘুরে এস।’
‘থ্যাংক ইয়্যু স্যর; দশ দিন হলেই চলবে।’
‘আজকেই রওয়ানা দাও। এ মাসটা শেষ হবার আগেই ফিরে এস ইয়ং ম্যান।’
আর একটিও বাক্যব্যয় না করে মেসোমশাইও বেরিয়ে এলেন সাহেবের ঘর থেকে, অবশ্যই দস্তুর মতো হ্যান্ডশেকের পর। অফিসে আমার ঘরে না এসে, সোজা কোয়ার্টারে চলে গেলেন মেসোমশাই। কিছুক্ষণ পরেই সাহেবের আর্দালি আমার ঘরে এসে তাঁর সই করা একখানি কাগজ দিল; তাতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম যে ওই দিনই বেলা দুটোর গাড়িতে হাওড়া যাবার অনুমতি-পত্র এবং সঙ্গের চিরকুটে লেখা এখনই কোয়ার্টারে ফিরে তৈরি হয়ে নেবার নির্দেশ। বুঝলাম যে স্টেশনে আমাদের পৌঁছে দিতে সাহেবের গাড়িই আবার যাবে।
৪.
কোয়ার্টারে এসে দেখি মেসোমশাই একেবারে তৈরি হয়ে বাইরে বসে আছেন। ছোটেলাল দুপুরের খাবার সাজিয়ে দিল। মেসোমশাইয়ের নির্দেশে নতুন মেনু— শাক ফেলা অড়হর ডাল, বেগুন পোড়া আর আদার চাটনি; তার সঙ্গে অবশ্য নদী থেকে জাল ফেলে ধরা আমার পছন্দের সেই পাথুরে মৌরলা আর নুন-গোলমরিচ ছড়ানো টমেটো-পেয়াজের এক প্লেট কাঁচা স্যালাড; স্যালাড যদিও সাহেবি কেতা, তবে আমাদের বাড়িতে রোজই প্রায় মা এটা নিজে হাতে করেন। আমার একটু সময় লাগল, কাপড়-জামা ভাঁজ করতে; এসরাজটা নিয়ে যাচ্ছি দেখে উনি মাথা নেড়ে মানা করে বললেন,
‘সুরসাধনায় তো অসুবিধে নেই; কথা না বসালেই হল। সতর্ক হওয়া মানে কিন্তু ভয় পাওয়া নয়।’
‘বুঝতে পেরেছি। আপনার সঙ্গে দিনে-রাতে থেকে, আপনাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করে বুঝেছি যে, অস্ত্র ছাড়াও কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত করা যায়।’
‘তুমি তোমার মতো করে নিত্য-নৈমিত্তিকের একটা ধাঁচা করে নাও; যেগুলো তোমার প্রেডিক্টেবল সিগনেচার, তাতেই অনেকটা কাজ হবে।’
‘তাই করব মেসোমশাই।’
স্টেশনে আমাকে নামিয়ে দিয়ে মেসোমশাইকে নিয়ে গাড়ি বেরিয়ে গেল তাঁর গন্তব্যের দিকে। হতবাক হয়ে দেখলাম তাঁর নীরব থাকার ক্ষমতা। মনে পড়ল, কাজে যোগ দেবার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘ডান হাতের কথা বাঁ হাত জানবে না।’ শিখিয়ে গেলেন আপাত প্রেডিক্টেবল হওয়া এবং নিরাপদ দূরত্ব রাখার এক চরম কৌশল।
রাতের গাড়ি ঢিকি-ঢিকি করেই চলে; যে সব অঞ্চল এবং দেহাতি নামের প্ল্যাটফর্ম পার হতে লাগলাম বিকেলের আলোয়, আমি সেই সব না-চেনা অঞ্চলেরও ‘ব্রাহ্মণ-বাবু অফিসার’। এসব অঞ্চলও আমার অব্যর্থ নিশানায়; সে সাপই হোক বা মানুষ। ঝুপ করে আলো নিভে গেলে অন্ধকার ভেদ করে জেগে উঠল ঘন নীল আকাশ জুড়ে, রাশি রাশি তারার প্রদীপ; প্রান্তরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা তাল-খেজুর গাছগুলোয় মোমের মতো আলো জ্বালিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি। একই অন্ধকারে সোনা-রুপোর এমন বর্ণময় বাহার দেখে, একেবারে যেন বিমোহিত হয়ে গেলাম।
অন্যান্য বার্থের সরকারি যাত্রীরা নড়েচড়ে আড়ামোড়া ভাঙছে দেখে, খেয়াল হল রাতের খাবার বের করে খেয়ে নেওয়ার কথা। বেতের ঝুড়িটা থেকে পেতলের লাঞ্চবক্স বার করতে গিয়ে দেখি, তার ওপরে রাখা একটা নতুন হাতগামছায় মোড়া আর একটা কিছু— মুখ বন্ধ ছোট্ট একটা কাচের বয়াম ভর্তি করে বাড়িতে বানানো দু-রকমের নারকেল নাড়ু; চিনি আর গুড়ের পাকে সাদা ও মরচে রঙের। দেখেই বুঝলাম যে সেজোমাসিমার বানানো। সঙ্গে করে আনা এই একমাত্র উপহারটুকুও আমার হাতে সরাসরি না দিয়ে, মেসোমশাই সেটাও দিয়ে গেছেন ছোটেলালের হাতে। একেই বোধহয় বলে ভিজিলেন্সকে আঙুল দেখানোর স্পর্ধা; একই সঙ্গে আপাত বিশ্বাস অর্জনের পথও।
৫.
ভোরবেলা হাওড়ায় নামতেই, লোকাল পুলিশের অভ্যর্থনা এবং গঙ্গার সাঁকো পার হবার নিখুঁত আয়োজন। এপারেও জিপ দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে একেবারে বাড়ি নিয়ে গিয়ে তুলবে বলে। মনে মনে ভাবলাম, লাটসাহেব না হওয়াতে আর কী কী সুবিধে পাওয়া থেকে বাদ পড়লাম তাহলে! যে সব রাস্তা পায়ে হেঁটে পার হয়েছি এতকাল, এখন সে সব সড়ক পার হচ্ছি সরকারি জিপে; একেই বলে পদাধিকার বল যা আমার সবল পা-জোড়ার থেকেও শক্তিশালী। পুলিশের উর্দি গায়ে পাড়ায় ঢুকতে একটু সঙ্কোচও তো হচ্ছে! বাড়ির রোয়াক থেকে একটু এগিয়ে, জিপটা দাঁড়াতেই ধীর পায়েই নামলাম। আমার জিনিসপত্র নিয়ে আর্দালিও এগিয়ে এল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আসতেই ছুটে এল বদু আর রাণী; বারান্দার চেয়ারে বসা বাবা-মাকেও দেখতে পেলাম। চা-পর্ব শেষ করেও দুজনেই বসে আছেন; মনে হয় কোন ট্রেনে আসছি সে খবর পেয়েই যেন অপেক্ষা করছেন তাঁরা। জিনিসপত্রগুলো বারান্দার একধারে নামিয়েই মস্ত এক সেলাম ঠুকে আর্দালি বেরিয়ে গেলেই, বাবা-মাকে প্রণাম করে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালাম। বাবার মুখে প্রসন্ন হাসি আর মায়ের চোখে অশ্রুবন্যা। মাকে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরতেই বুঝলাম, তাঁর যে কী নিখাদ নির্ভরতা আমার ওপর। বদু আর রাণীর কলরবে সবাই আবার স্বাভাবিক হল। আমার টুপিটা মাথায় পরে, পেতলে বাঁধানো বেটনটা হাতে নিয়ে পুলিশ সেজে রাণী তো ছুটে বেড়াতে লাগল সেই ভেতর বারান্দায়; বদু সোরগোল তুলল আমার সেই ‘তা’ দিয়ে পাকানো ইয়া বড় গোঁপজোড়াটা নিয়ে। মা চলে গেলেন নীচের হেঁশেলে আমার জন্য জলখাবারের ব্যবস্থায়। বদু আর রাণীকে শান্ত করতে বাক্সটা টেনে উপহারগুলো বার করতে বসলাম। দু-ভাইবোনে আমার পিঠের ওপর লেপটে হাঁ করে দেখতে লাগল বাক্সটা তালাচাবি ছাড়াই লক করা যায়; তবে সে লক খুলতে ট্রেনিং এবং কব্জির জোর দুই-ই চাই। পুলিশ অফিসারদের জন্য বিশেষ ভাবে বানানো; ভারী পেতলে তৈরি। সোনার মতো ঝকঝক করছে। ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, এই ডাকাতে ট্রাঙ্কের নাম ‘জংলিশা’।
এখন আমি আর শুধু তনু বা তরঙ্গনাথই নয়। উর্দি পরা কী ছাড়া, এখন পুরো দস্তুর সেই ‘ব্রাহ্মণ-দারোগা’। মাথার চুলে কদম ছাঁট তো কী! সে ক্ষতিটুকু পুষিয়ে নিয়েছি খান দুই উড়ন্ত ভ্রমরের মতো এই ঘন গোঁপজোড়াটি দিয়ে। আর অর্জন বা উপার্জনে পেয়েছি ওই জংলিশা ট্রাংক। জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি এ দুটোর কোনওটাকেই ছাড়িনি। আরও কয়েক বছর পরে আমার বউ তরু আদর করে সকলের আড়ালে আমাকে ডাকবে— এই যে আমার ‘জংলিশাবাবু’! মুখের মধ্যে এক খিলি পান ঠুসে দিয়ে বলবে ‘ঠিক যেন, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা গোঁপজোড়াটি’! আর আমি বলব, ‘ঠিকঠাক চিনে নিয়েছ, বাঁশবনের সেই ভুঁড়ো শেয়ালটা নয় তো’!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র