নিঃসঙ্গ মৃত্যুর পথে
১৯৯১ সাল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো-টুকরো হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব জুড়ে হাহাকার, জর্জ বুশ সিনিয়র এবং অন্যান্য পশ্চিমি নেতাদের মুখে চওড়া হাসি। এই সময়ে সোভিয়েত সিক্রেট সার্ভিস কেজিবি-র বড় দরের কর্তা ভাসিলি নিকিতিচ মিত্রোখিন এলেন লাটভিয়ার বৃহত্তম শহর রিগায়। বাল্টিক দেশগুলির মধ্যে লিথুয়ানিয়া ততদিনে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছে, সেই একই পথে এগোচ্ছে লাটভিয়াও। সোভিয়েত সেনা এবং গোয়েন্দা পুলিশ শেষ চেষ্টা চালাচ্ছে লাটভিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ করে রেখে দিতে। কিন্তু মিত্রোখিন রিগা গেছেন সম্পূর্ণ অন্য কাজে। তাঁকে ঢুকতে হবে মার্কিনি দূতাবাসে। কেজিবি-র মহাফেজখানার দায়িত্বে ছিলেন মিত্রোখিন। অফুরন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের অনুলিপি রয়েছে তাঁর কাছে। সে সবই তিনি তুলে দিতে চান আমেরিকানদের হাতে, বদলে তাঁর চাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হওয়ার অনুমতি। কিন্তু দুর্ভাগ্য মিত্রোখিনের, মার্কিনি দূতাবাসের অফিসাররা তাঁর কথা বিশ্বাস করলেন না, তাঁদের মনে হল মিত্রোখিন যেসব অনুলিপি দেখাচ্ছেন তা বানানোই হয়েছে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। মার্কিনি দূতাবাস থেকে মিত্রোখিনকে খালি হাতে ফিরতে হল। পরের গন্তব্য ব্রিটিশ দূতাবাস। সেখানেও তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল প্রায় একই পরিণতি কিন্তু এক জুনিয়র অফিসার মিত্রোখিনকে অত সহজে ছেড়ে দিতে চাইলেন না। চলল বৈঠকের পর বৈঠক, শেষমেশ ব্রিটিশরা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন মিত্রোখিন আদতেই তুলে দিতে চাইছেন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি। তারপর তো ইতিহাস! কীভাবে মিত্রোখিনের বাড়ি থেকে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস তুলে আনল সমস্ত নথিপত্র, তার আখ্যান বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা যে-কোনও গোয়েন্দাকাহিনিকে হার মানাবে।
কিন্তু সে-গল্প তোলা থাক অন্য কোনওদিনের জন্য।
মিত্রোখিনের তুলে দেওয়া সমস্ত কাগজপত্রের নামই হয়ে গেল ‘মিত্রোখিন আর্কাইভ’— সোভিয়েত কূটনীতিবিদ তথা কেজিবি-র গুপ্তচররা কীভাবে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তৈরি করেছিলেন এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক জাল, তারই এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস।
মিত্রোখিনের তুলে দেওয়া কাগজপত্র থেকেই জানা যাচ্ছে, স্টালিনের মৃত্যুর পর, ক্রুশ্চেভের সময় থেকেই ভারতবর্ষের শীর্ষ রাজনৈতিক মহল অবধি পৌঁছে গেছিলেন কেজিবি-র অফিসাররা। এহেন সোভিয়েত সাফল্য কিন্তু ভারতবর্ষকে নিয়ে যাবে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে, যার দরুন উদ্ভূত হবে একাধিক কন্সপিরেসি থিয়োরি।
চল্লিশের শুরুতে যখন আটলান্টিকের দু’পার জুড়ে যুদ্ধের দামামা বাজছে, তখন বম্বেতে একাধিক পার্সি যুবক মন দিয়েছেন দেশ গড়ে তোলার কাজে। ভারত তখনও স্বাধীন হয়নি কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই জানতেন ব্রিটেনের হাত থেকে রাজনৈতিক মুক্তি পাওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তখনই অর্থনৈতিক ভাঙন ধরেছে, তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে ভারতের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করবে সে নিয়ে কারোরই সন্দেহ ছিল না। টাটা সংস্থার কর্ণধার জে-আর-ডি টাটা চাইছিলেন ভারতে বিজ্ঞানের উন্নতিকল্পে একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। এই লক্ষ্য নিয়েই টাটারা তখনই তৈরি করে ফেলেছেন স্যার দোরাবজি টাটা ট্রাস্ট। সে-ট্রাস্টের দায়িত্বে আছেন আর এক পার্সি— রুস্তম চোকসি, বম্বের উইলসন কলেজে লাটিন এবং ইংরেজির অধ্যাপক। দোরাবজি টাটা ট্রাস্ট বেশ কয়েকবছর তৈরি হলেও জে-আর-ডি এবং রুস্তম এমন কোনও বিজ্ঞানীকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না যিনি এই আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা নেবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘনিয়ে আসতেই টাটারা তাঁদের পছন্দের মানুষটিকে খুঁজে পেলেন, তাঁর নাম হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। বিশিষ্ট পদার্থবিদ হিসাবে হোমি ভাবার নাম ভারতের বহু মানুষই জানতেন কিন্তু তিরিশের অধিকাংশ সময়টাই ভাবা কাটিয়েছেন ইয়োরোপে; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু না হলে ফিরতেন কি না, সে নিয়েও সন্দেহ ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ামাত্র কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরি থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হল। ভাবার একাধিক সহকর্মী ততদিনে আমেরিকাতে প্রতিষ্ঠিত। তাঁরাও অর্থাভাবে ভাবাকে প্রিন্সটন বা শিকাগোর মতন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যেতে পারলেন না। আর এই সুযোগটাই নিলেন জে-আর-ডি এবং রুস্তম। তাঁরা ভাবাকে বোঝালেন ভারতে থেকে কাজ করলে তিনি শুধু বিজ্ঞানের সাধনাই করবেন না, সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশকে গড়ে তোলার কাজে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে ইতিহাসও তৈরি করবেন। ভাবার অক্লান্ত পরিশ্রম, রুস্তমের উৎসাহ এবং জে-আর-ডির নেতৃত্বে তৈরি হল ‘টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ’। ততদিনে আমেরিকায় ‘ম্যানহাটন প্রোজেক্ট’ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে, আমেরিকার হাতে পারমাণবিক বোমা তুলে দেওয়ার জন্য যাঁরা নেভাদার মরুভূমিতে অপরিসীম খাটছিলেন তাঁদের অনেককেই ভাবা ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন। ভাবা নিজে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, নিউক্লিয়র ফিজিক্স নিয়ে তাঁর আগ্রহ প্রবল। কিন্তু তিনি এটাও বুঝছিলেন যে পরমাণুচর্চাকে শুধু বোমা বানানোর কাজে আটকে রাখলে মস্ত ভুল হবে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের বিদ্যুৎশক্তিকে ঢেলে সাজানোর জন্য নিউক্লিয়র ফিজিক্স এক মস্ত ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু সে-কাজে পুরোদস্তুর নামার জন্য শুধু টাটার মতন সংস্থাকে পাশে পেলে চলবে না, পাশে চাই শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের। সৌভাগ্যবশত, হোমি ভাবা এরকমই এক মানুষকে তিরিশের দশক থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন। শুধু চিনতেন না, সেই মানুষটির দেওয়া প্রশ্রয়ের কারণে তাঁকে সম্বোধন করতেন ‘ভাই’ বলে, যদিও মানুষটি ভাবার থেকে প্রায় কুড়ি বছরের বড়। আপনারা হয়তো অনেকেই আন্দাজ করতে পারছেন, ইনি স্বয়ং জওহরলাল নেহরু।
চল্লিশের দশকে টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ যদি ভাবাকে তাত্ত্বিক গবেষণার বিশেষ সুযোগ দিয়ে থাকে, তাহলে সেই গবেষণাকে এক ব্যবহারিক রূপ দেওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছিল পঞ্চাশের দশকে তৈরি হওয়া ‘অ্যাটমিক এনার্জি এস্ট্যাবলিশমেন্ট’ যার বর্তমান নাম ‘ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার’। ১৯৫৪ সালে তৈরি হওয়া ‘অ্যাটমিক এনার্জি এস্ট্যাবলিশমেন্ট’-এর তদারকির ভার সঁপে দেওয়া হয়েছিল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ওপর, সাত বছর ধরে যে-কাজ করে যাচ্ছিলেন সেই নেহরু।
‘অ্যাটমিক এনার্জি এস্ট্যাবলিশমেন্ট’ তৈরি হওয়ার এক বছর পর, ১৯৫৫ সাল দুটি ভিন্ন কারণে নেহরু এবং ভাবার জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য বছর হয়ে দাঁড়াল। রাষ্ট্রসংঘের ডাকা পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ওপর একটি বিশেষ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সারা পৃথিবীর নজরে পড়লেন ভাবা। আর নেহরু, মিশরের কামাল নাসের এবং যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোকে নিয়ে সেই বছরেই ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে এক সম্মেলনের মাধ্যমে শুরু করলেন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন। নেহরুকে চরম প্রতিক্রিয়াশীল বলে যিনি গণ্য করতেন সেই স্টালিন মারা গেছেন তিপ্পান্ন সালে, ক্রুশ্চেভের হাতে তখন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব বুঝে সোভিয়েত ইউনিয়ন সবার আগে ঝাঁপাল, নেহরুর মন পেতেই হবে। ক্রুশ্চেভ পঞ্চান্ন সালেই ভারত ঘুরে গিয়ে পলিটবুরোর মিটিং-এ জানালেন নেহরুর নেতৃত্বে ভারত দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, আগ বাড়িয়ে নিজেই সোভিয়েত পত্রপত্রিকাকে তুলোধোনা করলেন ভারতকে তখনও সাপুড়ে আর রাজারাজড়াদের দেশ বলে জনমানসে তুলে ধরার জন্য। বছরখানেক পর নেহরু সেই সৌজন্য ফিরিয়ে দিলেন— ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের কড়া সমালোচনা করলেন মিশরের সুয়েজ খাল দখল করার জন্য কিন্তু হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আগ্রাসন নিয়ে টুঁ শব্দ করলেন না।
সোভিয়েত অর্থ ঢুকতে শুরু করল ভারতে। মধ্যপ্রদেশের ভিলাইয়ে সোভিয়েত সহায়তায় তৈরি হল ইস্পাত উৎপাদন কেন্দ্র। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক জুড়ে আমেরিকাও ভারতকে সহায়তা করছিল বটে, কিন্তু সে-সহায়তা আসছিল কখনও সস্তার গম হয়ে, কখনও-বা মার্কিনি প্রযুক্তিবিদদের সফরের মাধ্যমে। বিদেশি ভাষায় যাকে বলে ‘কোল্ড ক্যাশ’ তার চিহ্ণমাত্র ছিল না। নেহরু-ক্রুশ্চেভ সখ্য কিন্তু সমীকরণটিকে বদলে দিল, সোভিয়েত আর্থিক সহায়তার পাশে স্বাভাবিকভাবেই মার্কিনি PL480 গম পাত্তা পেল না, হাসিঠাট্টা শুরু হল সারা দেশ জুড়ে।
হোমি ভাবা বা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের মতন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদরা স্বাধীনতার পর থেকেই আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটি দেশের সঙ্গেই যথেষ্ট যোগাযোগ রেখে চলতেন। টাটা ইন্সটিটিউট বা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউট-এর মতন নামজাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে দু-দেশের অধ্যাপক, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী, বা নীতিনির্ধারকরাই আসতেন। কিন্তু প্ল্যানিং কমিশন (যেখানে প্রশান্তচন্দ্রর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল) বা অ্যাটমিক এনার্জি এস্ট্যাবলিশমেন্টের মতন জায়গায় ক্রমেই দেখা যেতে লাগল সোভিয়েত প্রভাবের আধিক্য। মিত্রোখিন আর্কাইভ জানায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ওপর সরাসরি প্রভাববিস্তার তো প্রথম থেকেই ছিল, পঞ্চাশের দশক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে যারা কট্টর সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন তাঁদেরকেও প্রভাবিত করতে শুরু করে। আর এই দলের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য নামটি ছিল কৃষ্ণ মেনন, যিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলিয়েছেন। কৃষ্ণ মেননের সময়েই ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহুল পরিমাণে সামরিক অস্ত্র, যুদ্ধবিমান ইত্যাদি কিনতে শুরু করে। সোভিয়েত মিগ বিমান কেনার বরাত দেওয়া হয় কৃষ্ণ মেননের আমলেই। কৃষ্ণ মেনন নিজে বহু বছর বিলেতে কাটিয়েছেন, ইয়োরোপের মাটিতে কূটনীতি থেকে রাজনীতি সবেতে উল্লেখযোগ্য অবদানও রেখেছেন, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন এবং ধনতান্ত্রিক আমেরিকার প্রতি তাঁর প্রবল বিতৃষ্ণা সোভিয়েত নেতাদের অনুধাবন করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। কৃষ্ণ মেননের আমলে ভারতে যতই সোভিয়েত প্রভাব জেঁকে বসেছে, কূটনৈতিক ভাবে ততই দূরে সরে গেছে আমেরিকা এবং ব্রিটেন।
কিন্তু কৃষ্ণ মেনন একটি দেশকে হিসেবের মধ্যে রাখেননি। সে-দেশ হল চিন। কমিউনিস্ট দেশের প্রতি ভরসার কারণেই হোক অথবা দুই সুপ্রাচীন প্রাচ্য সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা ক্ষীণ, নেহরুর সেই দৃঢ় বিশ্বাসে আস্থা রাখার জন্যই হোক, কৃষ্ণ মেননের আমলে চিনসীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নামমাত্র অস্তিত্ব ছিল। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে কিন্তু পঞ্চাশের দশক থেকেই জল্পনা শুরু হয়েছে চিন কবে পারমাণবিক শক্তি হয়ে উঠবে। সোভিয়েত নেতারা এ-কথাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে পারমাণবিক যুদ্ধের বীভৎসতা নিয়ে মাও-এর বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই, দরকার পড়লে তাইপে বা দিল্লিতে বোমা ফেলতে তাঁর আদৌ হাত কাঁপবে না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে আলোচনা যাই হোক না কেন, চিন নেহরুর বান্দুং সম্মেলনে যোগ দিয়েছে, যোগ দিয়েছে ভাবার সঙ্গে রাষ্ট্রসংঘের জেনিভা সম্মেলনে। অতএব, খুব স্বচ্ছন্দেই বিপদবার্তা উপেক্ষা করা গেল।
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চিনের কাছে ভারত যখন এক তরফা পর্যদুস্ত হল, সবার প্রথমে চাকরি গেল কৃষ্ণ মেননের। কিন্তু শুধু বলির পাঁঠা বার করলেই তো হবে না, আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য চাই যোগ্য নেতৃত্বেরও। নেহরুর অনুরোধেই এই সময়ে সুরক্ষার ব্যাপারে হাল ধরতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং হোমি ভাবা। এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সুরক্ষার আরেক অর্থ পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন। এদিকে কংগ্রেসের মধ্যেই বিরোধ চরমে উঠেছে। কৃষ্ণ মেনন বা কেশব মালব্যর মতন বামঘেঁষা নেতাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে মোরারজি দেশাই এর মতন কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতারা নেহরুর ক্ষমতা হ্রাস করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। চিন-ভারত যুদ্ধের পর নেহরু মানসিক ভাবে তো বটেই, শারীরিক ভাবেও ভেঙে পড়ছিলেন। চৌষট্টি সালের সাতাশে মে নেহরু মারা গেলেন, আর তার প্রায় পাঁচ মাস পর ষোলই অক্টোবর চিন প্রথমবারের জন্য পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। যে-প্রযুক্তির দৌলতে এই বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব হল তার অনেকটাই কিন্তু পাওয়া গেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বদান্যতায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পঞ্চাশের দশক অবধি ভারতকে পারমাণবিক শক্তি হিসাবে দেখতে না চাইলেও ষাটের শুরুতে এসে মত বদলাল। বা বলা যায় মত বদলাতে বাধ্য হল। কারণ ততদিনে চিনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের তাত্ত্বিক ও রিয়ালপলিটিক দ্বন্দ্ব সামনে চলে এসেছে। চিন যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের ঘনিষ্ঠতা একেবারেই পছন্দ করছিল না, সোভিয়েত ইউনিয়নও ভয় পাচ্ছিল প্রধান সমাজতান্ত্রিক দেশের মর্যাদাটি শেষমেশ না চিনের হাতেই চলে যায়! ভূ-রাজনীতিতে সমতা রক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত-চিন যুদ্ধের পর থেকেই পরোক্ষ ভাবে সমর্থন দিতে থাকে ভারতকে, চায় চিনের পাশাপাশি ভারতও এশিয়ার অন্যতম পারমাণবিক শক্তি হয়ে উঠুক।
মজার ব্যাপার এই যে, ‘কমিউনিস্ট বোমা’ আটকানোর জন্য আমেরিকাও খতিয়ে দেখতে চাইছিল ভারতকে পারমাণবিক শক্তি করে তোলা যায় কি না। কিন্তু ভারত একা নয়, আমেরিকান কূটনীতিবিদদের তৈরি করা এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ষাটের দশকে ভারতের সঙ্গেই জাপান, তাইওয়ান, পাকিস্তানকেও পারমাণবিক শক্তি করে তোলা যায় কি না সে নিয়ে আলোচনা চলছে। পঁয়ষট্টি সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসনের বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা জেরোম ওয়াইসনার, যিনি তখন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির প্রেসিডেন্টও বটে, ভাবার সঙ্গে দেখা করে পরিষ্কার জানালেন আমেরিকা যদি এ-ব্যাপারে ভারতেকে সহায়তা করে তাহলে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কর্তৃত্বের পুরো রাশটাই থাকবে মার্কিনিদের হাতে। চিনের কাছে যুদ্ধে হারার পর থেকেই ভাবা চাইছিলেন আমেরিকার সাহায্য নিয়ে পারমাণবিক বোমা বানাতে, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে আমেরিকার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকাটাও আদপেই কাম্য ছিল না। এর মধ্যেই আবার আমেরিকা জুড়ে আন্দোলন শুরু হল, যার মূল মন্ত্র হল পারমাণবিক বোমা বানানোয় মার্কিন মুলুক যেন কোনও দেশকেই সাহায্য না করে। হিরোশিমা-নাগাসাকির স্মৃতি তখনও মার্কিনিদের মনে তাজা, তাঁদের অনেকেই চাইছিলেন পরমাণু যুদ্ধে পাকাপাকি ভাবে ইতি টানতে।
ভাবা যখন ভারত সরকারকে প্রায় অন্ধকারে রেখে মার্কিনি সাহায্য চাইছিলেন, মিত্রোখিন আর্কাইভ দেখাচ্ছে ঠিক সেই সময়েই কেজিবি-র হাত পৌঁছে গেছে দিল্লি রাজনীতির একেবারে অন্দরমহলে। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছিল সোভিয়েত চাপেই জাতীয়তাবাদী নেতা মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন, এবং কংগ্রেসের আগাগোড়া সমর্থন যায় লালবাহাদুর শাস্ত্রীর প্রতি। সেই লালবাহাদুর, যিনি নিজে নেহরুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন, এবং নেহরুর মৃত্যুর পরেও ‘জয় জওয়ান, জয় কিষান’ স্লোগান দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক কোন ধরনের সমাজ গড়ে তোলার পক্ষে তিনি। লালবাহাদুর প্রথম থেকেই পারমাণবিক বোমা বানানোর বিরোধিতা করে এসেছেন, হোমি ভাবা বহু চেষ্টা করেও লালবাহাদুরের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেননি। খানিক সে-কারণে বাধ্য হয়েই ভাবা একা-একাই চেষ্টা চালিয়ে গেছেন মার্কিনি সাহায্য পাওয়ার। কিন্তু সোভিয়েত চাপ আসার পরে দেখা গেল লালবাহাদুর নিজেই চাইছেন পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে, মুখে যদিও বলা হচ্ছে বিস্ফোরণ ঘটালেও তার ব্যবহারটি পুরোপুরিভাবেই শান্তিপূর্ণ হবে।
আমেরিকাও এই সময়ে ভারতের ওপর উত্তরোত্তর চাপ বাড়াচ্ছে, কিন্তু অন্য কারণে। পারমাণবিক বোমা না তৈরি করার জন্য। মার্কিন মুলুক জুড়ে আন্দোলন তো ছিলই, কিন্তু তার মধ্যেই ঘটে গেছে পঁয়ষট্টি সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধও। আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় সে-যুদ্ধ সতেরো সপ্তাহ পর শেষ হলেও ভারতের আধিপত্য ছিল প্রশ্নাতীত। যে-কারণে পাকিস্তান আমেরিকার বিরাগভাজন হতে পারে জেনেও চিনের সঙ্গে ক্রমেই ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে, আমেরিকাও বুঝেছে ভারতের তুলনায় পাকিস্তান পরমাণু দৌড়ে বহু পিছিয়ে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শেষ হল পঁয়ষট্টির সেপ্টেম্বর মাসে। আর জানুয়ারির এগারো তারিখে উজবেকিস্তানের তাসখন্দ শহরে লালবাহাদুর শাস্ত্রী মারা গেলেন, যুদ্ধপরবর্তী শান্তিচুক্তি সই করতে গিয়ে। তেরো দিন পর, চব্বিশে জানুয়ারি বম্বে থেকে জেনিভা হয়ে লন্ডন পৌঁছনোর আগেই মঁ ব্লাঁ পাহাড়ে প্লেন ভেঙে মারা যান হোমি ভাবা।
যুদ্ধ এবং পরমাণু দৌড়ের মধ্যে, মাত্র দু-সপ্তাহের ব্যবধানে একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা দুর্ঘটনায় মারা গেলে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের অভাব ঘটার কথা নয়। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। একাধিক ষড়যন্ত্রতত্ত্বের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য তত্ত্বটি হল মার্কিন সিক্রেট সার্ভিস সি-আই-এ’র যোগসাজশেই লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং হোমি ভাবাকে খুন হতে হয়। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব তত্ত্বই, তার বাইরে বেরোনোর সাধ্য নেই। কিন্তু এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে রাজনৈতিক প্রেক্ষিত এ-তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে তার থেকে রোমাঞ্চকর পটভূমিকা বাছতে সেরা থ্রিলার লিখিয়েদেরও কালঘাম ছুটে যাবে। চিন-ভারত যুদ্ধের পর নেহরু এবং ভাবা বলেছিলেন শুধুমাত্র ভারতীয় উদ্যোগে আর আঠারো মাসের মধ্যেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করা যাবে। ঘনিষ্ঠমহলে ভাবা এও বলেছিলেন যে মার্কিনি সাহায্য পেলে তিনি ছ-মাসের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হাতে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দিতে পারেন। ভাবার মৃত্যুর আরও আট বছর পর ভারত প্রথমবারের জন্য পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। দেরি হলেও ভারতের পারমাণবিক সাফল্যের পেছনে ভাবার অবদানের কথা বিজ্ঞানী থেকে রাজনীতিবিদ সবাই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। স্বীকার করেছেন খোদ ইন্দিরা গান্ধী।
সেই ভাবা, যাকে সারা দুনিয়া একদিন চিনেছিল শান্তিপূর্ণ পরমাণু গবেষণার সোচ্চার সমর্থক হিসাবে! দশচক্রে ভগবান ভূত না কি রিয়ালপলিটিক, কী বলবেন?