এ-বছর ৫ ফেব্রুয়ারি শঙ্খ ঘোষ স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন হিন্দি ভাষার বিখ্যাত লেখক, অনুবাদক ও শিল্প-সমালোচক প্রয়াগ শুক্ল। তার পরেরদিন, অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ তাঁর ৫৫ বি হিন্দুস্তান রোডের গেস্টহাউসে ডাকবাংলা.কম পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন পৃথ্বী বসু এবং সন্দীপন চক্রবর্তী।
… অজ্ঞেয়-র ৭৫তম জন্মদিনে একটা বড় অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমি তখন ‘নবভারত টাইমস’-এ। আগের দিন আমায় অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর কী করা যায় জিজ্ঞাসা করাতে, আমি ঠিক করলাম ফোন করে চলে যাব কিন্তু ইন্টারভিউর কথা বলব না। হয়তো জন্মদিনের ব্যস্ততার মধ্যে সেদিন ইন্টারভিউ দিতে চাইবেন না। পরে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথা বলবেন। তো, আমি চলে গেলাম। উনি চা খাচ্ছেন আর নিজেই সবাইকে টোস্ট দিচ্ছেন। আমিও চা খেতে-খেতে ওঁর সঙ্গে নানা গল্প করছি, বলছি যে আপনিও তো এক সময়ে কলকাতায় ছিলেন, ‘মডার্ন রিভিউ’-এর হিন্দি ‘বিশাল ভারত’-এর জন্য। আমি ঠিক করেছিলাম যে পেন-কাগজ কিছুই বার করব না। কথাগুলো মনে রাখব আর অফিসে গিয়ে সেটা লিখে ফেলব। পরেরদিন কাগজে সেই ইন্টারভিউ দেখে উনি বেশ খুশি এবং তখন আমাকে বলছেন যে, আরে তুমি আগে থেকে বললে আমরা আরও গুছিয়ে বসতাম, আরও ভাল ইন্টারভিউ হত। কিন্তু আমি জানি যে, বললে আর ইন্টারভিউটা হত না সেদিন!
এটা শুনে অন্য একটা ঘটনা মনে পড়ছে। বরুণ চন্দ সত্যজিৎ রায়ের ইন্টারভিউ নিতে গেছেন। হাতে আধ ঘণ্টা সময়। এদিকে যে দামি টেপরেকর্ডার বরুণ চন্দ নিয়ে গেছেন সত্যজিতের বাড়ি, গিয়ে দেখছেন যে সেটি চলছে না। এদিকে টেপরেকর্ডার আছে বলে খাতা-পেনও নিয়ে যাননি। গলদঘর্ম অবস্থা। বার বার রেকর্ডার চালাবার চেষ্টা করছেন। এদিকে সত্যজিৎ বলছেন, ‘কী হল! তোমার তো আধ ঘণ্টার মধ্যে ১৫ মিনিট হয়ে গেল। ইন্টারভিউ নেবে না?’ তখন বাধ্য হয়েই বরুণ চন্দ মিথ্যে বললেন যে, টেপরেকর্ডারটা ঠিক হয়ে গেছে। বাকি ১৫ মিনিটই ইন্টারভিউ হল সত্যজিতের। বরুণ চন্দ যে চালাকি করছেন, সত্যজিৎ বুঝতে পেরেছিলেন। তবু তিনি ইন্টারভিউ দিলেন। এবং গোটাটা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরলেন বরুণ চন্দ। পরের দিন সে-ইন্টারভিউ বেরোলে, দেখা গেল একেবারে হুবহু ছাপা হয়েছে। সত্যজিৎ ভীষণ খুশি। পরে যখন বরুণ চন্দ সত্যজিতের ছবিতে অভিনয় করেন, তখন এই প্রবল স্মৃতিশক্তির কারণেই তাঁকে সত্যজিৎ কোনও স্ক্রিপ্ট দিতেন না। শুধু আগের দিন ডেকে বলে দিতেন যে, আগামীকাল এই এই ডায়লগ আছে…
সত্যজিৎ রায়কে আমি দেখেছি। আমাদের একটা বড় দোকান ছিল নিউ মার্কেটে— কালীচরণ অ্যান্ড কোম্পানি। সেখানে আমি দেখতাম, উনি আসতেন। বই কিনতেন। বাবার সঙ্গে কথা বলতেন। ছুটির সময়ে আমরাও চলে যেতাম ওই বইয়ের দোকানে। দাঁড়িয়ে বা একটা টুলে বসে থাকতাম। তখন তো চিনতাম না, তখন সবাই অবাক হয়ে দেখত বিরাট লম্বা একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন। পরে ছবি দেখে চিনেছি যে তিনিই সত্যজিৎ রায়।
আপনি কত বছর পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন?
আমার প্রায় ২২ বছর বয়স পর্যন্ত। এখানেই তো জন্ম আমার! যখন ছ-বছর বয়স, তখন এখানে রায়ট শুরু হল। ১৯৪৬ সাল। বাবা ঠিক করলেন যে আমাদের— ছোট ভাইবোনদের— গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। বড়রা হয়তো নিজেদের সামলাতে পারবে; কিন্তু আমরা স্কুলে যাই, পথে বিপদ হতে পারে। আমাদের গ্রাম ছিল উত্তরপ্রদেশের কানপুর আর এলাহবাদের মাঝখানে ছোট্ট একটা জেলা ফতেপুর-এ। ওখানে যদি আমার বাবা আমাকে না পাঠাতেন, তাহলে আমি জানি না যে আমি কিছু লিখতে পারতাম কি না। সেখানে প্রকৃতির খুব ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে কাটিয়েছিলাম। বাবা এখানে থাকতেন। ওখানে মা আর যৌথ পরিবারের বাকি সবাই। খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাইবোনদের সঙ্গে থাকতাম আমরা। স্বাভাবিক ভাবেই এত ছেলেমেয়েদের সবার ওপর সারাক্ষণ নজর রাখা সম্ভব হত না। আমি বেরিয়ে যেতাম। হয়তো আমবাগানে ঘুরছি, সাঁতার কাটছি, ছোট সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ছিলেন তখন ওখানে। কিছুদিন আগে মারা গেলেন— ত্রিলোকীরমণ দ্বিবেদী। আমার থেকে চার বছরের বড়ো ছিলেন। সেইসব দিনগুলো আমি কখনও ভুলতে পারব না। আমরা দুজনে বেরিয়ে যেতাম। ওখানে একটা লেক ছিল— মতিঝিল। সেখানে ঘুরতাম দুজনে। এভাবে চার বছর ওখানে কাটিয়েছি— ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০।
তারপর আবার চলে আসলেন কলকাতায়?
হ্যাঁ। ফিরে এলাম। কিন্তু ওখান থেকে ফিরে আমার মনে হত— এ কোন জায়গায় চলে এসেছি রে বাবা! আমার ভাল লাগত না। গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে আমাদের একটা ছোট স্টল ছিল। সেখানে যখন যেতাম, তখনও মনে হত— এ যেন পুরো অন্য কোনও দেশ!
এসে কি তখন রাণী রাসমণি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
তারপরে বিদ্যাসাগর কলেজে?
হ্যাঁ, বিদ্যাসাগর কলেজে ইভনিং-এ।
তারপরে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সেই সময়ে হয়েছিল কী… ১৯৫৮ সাল, আমি তখন সবে ১৮ বছরের… কিন্তু কপালজোরে সে-সময়ের নামীদামি পত্রিকার প্রায় সবগুলোতেই আমার লেখা বেরিয়ে গেছে। কিন্তু ওই সময়েই, বেশ সচ্ছল অবস্থা থেকে আমরা আচমকা একদিনে পুরো সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। আমার বাবার বড় ভাই বলেছিলেন যে, সমস্ত উনি শেয়ার মার্কেটে হারিয়ে ফেলেছেন। যার ফলে সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হল। ৪৩/১ এস.এন.ব্যানার্জি রোডে ছিল আমাদের বাড়ি। মনে আছে, আমরা বাইরে বসে আছি আর বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র বের করে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। একদিনে আমাদের বাড়ি চলে গেল, দোকান চলে গেল। একইরকম নাকি হয়েছিল আমার ঠাকুরদার ক্ষেত্রেও। চাঁদনি মার্কেটে ওঁর নাকি ১৪টা দোকান ছিল। জাহাজে করে মাল আসত সেসব দোকানে। জাহাজের কোনও একটা গোলমালে তিনিও আচমকা একদিন সর্বস্বান্ত হয়ে গেছিলেন। তখন তাঁদের পরিবার ফিরে যায় ফতেপুরে। আবার আমার বাবা ব্যবসা করতে আসেন কলকাতায়। তো, ওই অবস্থায় আমার বাবা তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন কোনও একটা ব্যবস্থা করে দিতে। তিনি পারেননি। বাবারা তখন সবাইকে নিয়ে গেলেন বেলুড় মঠে। পিকনিকের মতো লাগছিল। বাড়ি থেকে নিয়ে গেছে, ওখানে বসে খাচ্ছি, সামনে গঙ্গা…। যাই হোক, এরপর বাবা-মা ছোট বোনকে নিয়ে চলে গেলেন ফতেপুরে। আমি গেলাম না। আমার বড় বোন এখানে থাকতেন তারক প্রামাণিক রোডে। সে-সময়ে ১৭ তারক প্রামাণিক রোড আমার অফিসিয়াল ঠিকানা হয়ে উঠল। তবে আমি সে-বোনের বাড়িতেও থাকতাম না। আমি টিউশন করে যা পাই, তাই দিয়ে নানা বন্ধুদের সঙ্গে নানা সময়ে থাকতাম। কিন্তু আমার জন্য চিঠি বা নানা পত্রিকা আসার জন্য ওই তারক প্রামাণিক রোডের ঠিকানাটাই দেওয়া ছিল।
বাবা আমাকে গ্রামে চলে যেতে বলেছিলেন। আমি বললাম, আমি গ্রামে গিয়ে কী করব! তাছাড়া কনফিডেন্স এসেছিল খানিকটা। আমার বয়স ১৮। অল্পস্বল্প টাকাও আয় করি লিখে আর টিউশনি করে। আমি বাবাকে বললাম, আমি পারব। কলকাতায় থাকি। আমার তখন এখানে হঠাৎ করে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল লর্ড সিনহা রোডের অশোক সাক্সেরিয়ার সঙ্গে। ওঁর বাবা সীতারাম সাক্সেরিয়া ছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর গান্ধীজি দুজনেরই ঘনিষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে হিন্দি ভবন করার ইচ্ছে প্রকাশ করলে উনিই তার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে শ্রীশিক্ষায়তন স্কুল-কলেজ, এগুলো ওঁর করা। তারও আগে উনি শুরু করেছিলেন কন্যাশিক্ষা, মাড়োয়ারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে। অশোক সাক্সেরিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বটা হঠাৎ করেই। আসলে, আমার থেকে আড়াই বছরের বড় আমার দাদা ছিলেন ছোটগল্পকার রামনারায়ণ শুক্ল। অল্পবয়সে হঠাৎ করেই ম্যানেনজাইটিসে মারা যান তিনি। আমার যখন ১৫-১৬-১৭ বছর বয়স… তখনও আমাদের বাড়ি আর দোকান এসব ছিল। হিন্দিতে তখন শব্দছকের একটা প্রতিযোগিতা হত। আমার দাদার তখন একটু পরিচিতি হয়েছে ছোটগল্পকার হিসেবে। তো, দাদা সেই শব্দছক পুরো সমাধান করে, আমার ছোট ভাইয়ের নামে পাঠিয়ে দিয়েছিল পত্রিকাদপ্তরে। একদিন আমি বাবার জন্য চা নিয়ে দোকানে গেছি, সেই সময়ে দেখি সেখানে হাজির অশোক সাক্সেরিয়া। কী আশ্চর্য কাকতালীয় ঘটনা! আমার ভাইয়ের নাম করে জিজ্ঞাসা করলেন যে, এ কে হয়? এর সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমি তো অবাক! হঠাৎ আমার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চায় কেন? ও নিশ্চয়ই কোনও গোলমাল করেছে। তখন উনি শব্দছকের ব্যাপারটা দেখালেন আমায়। পরিচয় হল। জানতে পারলেন যে আমিও লিখি। ঠিক হল যে, আমরা আবার দেখা করব। সেই থেকে সাত-আট বছর আগে তাঁর মারা যাওয়া পর্যন্ত আমাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। আমরা একসঙ্গে ন্যাশনাল লাইব্রেরি যেতাম, থিয়েটার রোডে ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিতে যেতাম। কলকাতায় যত হিন্দি লাইব্রেরি আছে— বড়বাজার পুস্তকালয়, কুমারসভা পুস্তকালয়, শেঠ সুরজমল জালান পুস্তকালয়— এগুলোয় সব যেতাম আমরা হেঁটে-হেঁটে। উনি আমাকে কিছু-কিছু জিনিস পড়তে বলতেন। নিজেও পড়তেন। ২০ বছর বয়সে আমি সার্ত্রে পড়ছি। উনি আমার চেয়ে ছ-বছরের বড় ছিলেন। এরপর উনি চলে যান দিল্লি। আমার যখন ২০ বছর বয়স, তখন আমি ওঁর সঙ্গে দিল্লিতে দেখা করতে গেছি। এক মাস মতো ছিলাম।
যখন আমার ২৩ বছর বয়স আর ভাবছি যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশে এম.এ. করব, তখন আমার মনে হল যে এর চেয়ে বরং স্থির হয়ে কিছু করা ভাল। হিন্দিতে তখন খুব জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল ‘কল্পনা’। আমার যখন ১৮ বছর বয়স, তখন সেখানে আমার একটা কবিতা আর একটা ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছিল। ফলে ওরা আমাকে চিনত। আর দিল্লি গিয়ে আলাপ হয়েছিল শ্রীকান্ত বর্মার সঙ্গে। পরে উনিই আমাকে প্রথম শঙ্খ ঘোষের কথা বলেন। তো, দিল্লি থেকে শ্রীকান্ত বর্মা আমায় জানালেন যে, ‘কল্পনা’ পত্রিকায় একটা জায়গা ফাঁকা হয়েছে। আমি যেহেতু ওখানে লিখেছি আগে, একটা চিঠি লিখে ওদের মালিক বদ্রীবিশাল পৃথ্বীকে জানাতে বললাম। লিখলাম। উনি জবাব দিলেন যে, চলে এসো, দেখি। ১৯৬৩ সাল। ওঁর অফিসে গিয়ে দেখা করলাম। উনি চারবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপ প্রয়াগ শুক্ল হো?’ ওঁর বোধহয় ধারণা ছিল যে বছর চল্লিশের কোনও একটা লোক হবে এই প্রয়াগ শুক্ল। যাই হোক, তারপর খানিক কথা হল। উনি বললেন যে, আমি আগামীকাল আপনাকে জানাব। সেই রাতটা আমি কখনও ভুলব না। আমার শুধু মনে হতে থাকল যে, এখানে এসে এবার এত বড় জায়গা থেকে যদি আমাকে চলে যেতে বলে, তখন আমার কী হবে! যাই হোক, পরের দিন উনি আমাকে বললেন যে, ঠিক আছে, আমরা তোমাকে নিচ্ছি। আর হেসে বললেন যে, তোমায় নিলাম কেন জানো? তোমাকে নিলে, আমাদের এই এডিটোরিয়াল বোর্ডের গড় বয়সটা খানিক কমে যাবে।
ওখান থেকে আমার জীবনটা অনেক পালটে গেছে। ওখানে কাজ করতে-করতেই অল্পবয়সে হঠাৎ একদিন আমার দেখা হয় হুসেনের সঙ্গে— মকবুল ফিদা হুসেন। বদ্রীবিশাল পৃথ্বীদের হায়দ্রাবাদের রাজা বলতেন সবাই। রাজা পান্নালাল পৃথ্বীর বড়ো ছেলে ছিলেন এই বদ্রীবিশাল পৃথ্বী। ২০ বছর বয়সে উনি হুসেনের গোটা এগজিবিশন কিনে নিয়েছিলেন বম্বেতে। ওঁর বাবা বেশ চিন্তায় পড়ে গেছিলেন যে, ছেলেটা সব শেষ করে দিল! কিন্তু মাড়োয়ারিদের একটা রেওয়াজ আছে যে, বড় ছেলে কিছু বললে সেটা মানতেই হবে। একদিন দেখি ওঁর বাবা আমাদের কেবিনে চলে এসেছেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, এই পত্রিকা করতে কীরকম খরচা হয়? পত্রিকায় অবশ্য খুব বিরাট খরচা হত না। একদিন দেখি হুসেন আমার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আর জিজ্ঞাসা করছেন যে, বদ্রীবিশালজি কখন আসবেন? আমি ওঁকে বললাম— বসুন, উনি এসে পড়বেন হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই। বসলেন। কিন্তু আমার সঙ্গে তো হুসেনের পরিচয় নেই। ফলে উনিও চুপ, আমিও চুপ। তারপর টুকটাক কিছু কথা বলতে লাগলেন। যেমন, ধরা যাক একটা বই পড়ে আছে। উনি হাতে নিয়ে বলছেন, কী সুন্দর এই কাগজটা নীল রঙের! আর এর উপর এই হালকা যে-রোদ্দুরটা আসছে, তাতে এটাকে আরও চমৎকার লাগছে। আর আমি মনে-মনে ভাবছি যে, এখন ভাল হয় যদি উনি চলে যান। কারণ ওঁর ওই কথায় আমি কীভাবে রিঅ্যাক্ট করব, সেটাও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমি তো তিন মাস ধরে এই ঘরে, এই বইয়ের সামনে এভাবে বসে আছি; অথচ আমি তো এভাবে এটা লক্ষ করিনি। তারপর উনি চলে গেলেন। আমি দেখতে আরম্ভ করলাম। হ্যাঁ, সত্যিই তো, আশ্চর্য সুন্দর লাগছে ওখানে ওই বইটাকে! বদ্রীবিশাল পৃথ্বীদের প্যালেস মতিভবনে হুসেনের জন্য একটা আলাদা ঘর ছিল। বদ্রীবিশালজিকে ট্রিবিউট দেবার জন্য আমি একটা বই লিখেছি। তার প্রচ্ছদে আছে হুসেনের করা বদ্রীবিশালজির একটা পোর্ট্রেট। আমার আস্তে-আস্তে মনে হতে লাগল যে, সাহিত্য তো ঠিক আছে, কিন্তু এই শিল্পের দুনিয়াটাও চেনা দরকার। আমাদের বোর্ডের মধ্যে ছিলেন জগদীশ মিত্তাল। শান্তিনিকেতনে পড়েছিলেন। পরে কোনও সূত্রে হায়দ্রাবাদে চলে যান। ওখানে উনি ছিলেন ‘কল্পনা’ পত্রিকার আর্ট এডিটর। আর উনি সংগ্রহ করতে আরম্ভ করেছিলেন মিনিয়েচার পেইন্টিং। এখন এতটাই বড় হয়ে উঠেছে ওঁর সংগ্রহটা যে, ‘জগদীশ মিত্তাল কালেকশন অফ মিনিয়েচার আর্ট’-এর নাম এখন সারা দুনিয়ার লোক জানে আর্ট সার্কেলে। তো, ওঁর সঙ্গে বসেই আমি তখন দেখতাম মিনিয়েচার পেইন্টিং। তাছাড়া কিছু সমসাময়িক আর্টিস্টদেরও ছবি, বেঙ্গল স্কুলের ছবি— এসবও সংগ্রহে ছিল ওঁর। দেখতে-দেখতে আমার ভাল লেগে গেল এই দুনিয়াটা।
হায়দ্রাবাদে যখন থাকতাম— আমি এক বছর ছিলাম— তখন তো কারো সঙ্গে দেখা বেশি হত না। এমনকী তেলেগু সাহিত্যিকদের সঙ্গেও না। ওখানে ‘ওরিয়েন্ট’ নামে একটা রেস্তোরাঁয় কিছু উর্দু কবিদের সঙ্গে শুধু আড্ডা হত। এভাবে এক বছর হয়ে গেল… আসলে আমাদের একটা ছোট মণ্ডলী ছিল— আমি, মহেন্দ্র ভাল্লা, অশোক সাক্সেরিয়া, অশোক বাজপেয়ী, কমলেশ এরকম কয়েকজন। তো, মহেন্দ্র ভাল্লা আমাকে চিঠিতে লিখতেন নানা কথা— গতকাল আমরা রবিশঙ্করের বাজনা শুনেছি, নির্মল বর্মার সঙ্গে কথা হয়েছে, কৃষ্ণা সবতির বাড়িতে গিয়েছিলাম, যামিনী কৃষ্ণমূর্তির নাচ দেখেছি, বেগম আখতার এসেছিলেন ওঁর গান শুনেছি, ইব্রাহিম আলকাজির নাটক দেখেছি। আমি এসব পড়তাম আর ভাবতাম যে, আমি এখানে বসে-বসে কী করছি! শুধু একটা পত্রিকার কাজ আর সারাদিন বসে থাকা। মাঝে মাঝে হয়তো হুসেন আসতেন। একটু চেঞ্জ হত। তারপর একদিন আমি ঠিক করলাম, আমি চলে যাব। থাকব না এখানে। যা কিছু সব দিল্লিতে আছে। সামান্য কিছু টাকা জমেছিল আমার। তাই নিয়েই বদ্রীবিশালজিকে একদিন বললাম যে, আমি এখানে থাকতে পারব না। ওঁর বাড়িতে তখন বিশাল বড়ো-বড়ো পাঁচ-ছ’টা গাড়ি ছিল। উনি সেসব ছেড়ে, ওঁর সবচেয়ে ছোট গাড়ি ফিয়েট বার করলেন নিজে আমাকে স্টেশনে ছেড়ে আসার জন্য। আর সারা রাস্তা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যাতে আমি ফিরে আসি। আমি তখন বুঝিয়ে বললাম যে কেন ছাড়তে চাইছি। তখন উনি খানিক বুঝতে পারলেন আমার যুক্তিটা। শেষ পর্যন্ত বললেন যে, ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের যোগাযোগটা যেন সবসময়ে থাকে। এবং সত্যিই সবসময়ে সেটা থেকেওছে। পরে তিনিই আমাকে ড. রামমনোহর লোহিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ওঁদের সোশ্যালিস্ট ম্যাগাজিনে আমি লিখতাম। ওঁর সঙ্গেও আমার খুবই ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
আপনি তাহলে ১৯৬৪-তে হায়দ্রাবাদের ওই চাকরি ছেড়ে দিল্লিতে চলে এলেন?
হ্যাঁ। আবার আমার জীবনের আরেকটা টার্নিং পয়েন্ট। খুব নামকরা একজন পেইন্টার ছিলেন রামকুমার। আমরা অবশ্য আগেই ওঁকে চিনতাম একজন ছোটগল্পকার হিসেবে। আমার যখন ২১-২২ বছর বয়স, তখন উনি একবার এসেছিলেন কলকাতায়। তার আগে আমার একটা ছোটগল্প পড়ে আমায় একটা পোস্টকার্ড লিখেছিলেন যে, আমি এই সময়ে কলকাতায় আসছি, তোমার সঙ্গে দেখা হলে ভাল হয়। আরও একটা চিঠি এখন প্রকাশিত হয়েছে— উনি ওঁর ছোট ভাই নির্মল বর্মাকে লিখছেন যে, তুমি বোধহয় প্রয়াগ নারায়ণ শুক্লর নাম শুনেছ। এবার কলকাতা এসে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তুমি সম্ভবত ওর লেখা পড়েছ। তখন আমি নারায়ণ লিখতাম। পরে এত লম্বা নাম থেকে নারায়ণটা ছেঁটে দিয়ে, প্রয়াগ শুক্ল নামেই লিখি। তো, পরে যখন দিল্লিতে যাই, রামকুমারজির সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। উনি আমায় একদিন জিজ্ঞাসা করলেন যে, তুমি কোথায় উঠেছ? আমি বললাম, তেমন কোনও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। দু-চারজন বন্ধু আছে এখানে। তাদেরই এর বাড়িতে দু’দিন, ওর বাড়িতে চারদিন— এভাবে থাকছি। সব শুনে উনি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন যে, আমার স্টুডিও আছে এখানে গোলমার্কেটে, কনট প্লেস থেকে কাছে। তুমি তো এখন ফ্রিল্যান্স। আকাশবাণী, খবরের কাগজের অফিস— এসব জায়গায় তোমায় যেতে হয়। তুমি এখানে থাকতে পারো। একটা চাবি তোমাকে দিয়ে দেব! আমি এখান থেকে একটা সময়ে চলে যাব। তখন তো আমার কাছে কিছুই ছিল না! ফলে আমি ওখানে থাকতে আরম্ভ করলাম। ওখানে তখন যারা রামকুমারের সঙ্গে দেখা করতে বা আড্ডা মারতে আসত, তারা পরে বিরাট-বিরাট সব খ্যাতিমান শিল্পী হয়েছে— বাসুদেব গাইতোণ্ডে, তায়েব মেহতা, কৃষণ খান্না— এরা সব। তো, অল্পবয়সেই আমার এদের সঙ্গে আলাপ জমে গেল। রামকুমারজি আমায় একবার সাজেস্ট করলেন যে, তুমি আর্টের ওপর লেখো না কেন? সেটা লিখলে তো তুমি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কিছু টাকা আয় করতে পারো। এরকম সময়ে ধর্মবীর ভারতী রামকুমারজিকে লিখলেন যে, দিল্লি থেকে কোনও তরুণ সাংবাদিক চাই, যে আর্টের উপর, নাটকের উপর ছবি-সহ ছোট-ছোট কিছু নোট পাঠাবে। তো, উনি আমাকে বললেন। দুটো ছোট-ছোট এরকম নোট আমাকে লিখতে হল— কে.এস.কুলকার্নির উপরে আর সতীশ গুজরালের উপরে। তারপর তখন আমি ‘দিনমান’-এ ফ্রিল্যান্স কাজ করি, তার সম্পাদক ছিলেন অজ্ঞেয়। কিন্তু সেখানেও আমি আর্টের উপর লিখতাম না। শ্রীকান্ত বর্মা ছিলেন তখন ওখানে সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট। উনি লিখতেন আর্টের উপরে। একবার ওঁকে রাজ্যসভা কভার করতে হবে। তখন উনি কিছুদিন থাকবেন না। সেই সময়ে একদিন আমাকে বললেন যে, পরের সপ্তাহে তোমাকে আর্টের উপর কিছু লিখতে হবে। আমি বললাম যে, আমি তো কখনও আর্টের উপর কিছু লিখিনি। উনি বললেন, না না আমি দেখেছি, তুমি তো আর্টের উপর লেখো। বলে, ওই ছোট দুটো রিপোর্টের কথা উল্লেখ করলেন। তখন মুকুল দে-র একটা প্রদর্শনী হচ্ছে দিল্লিতে। তার কার্ড আমাকে দিয়ে বললেন, তুমি দ্যাখো। আমি তো তখন মুকুল দে-র নামও শুনিনি। ফলে ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি! কী করে এটা হবে! চুপ করে বসে আছি দু-মিনিট। উনি কার্ডটা সরিয়ে দিয়ে বললেন— যাও, দ্যাখো, হয়তো তোমার ভালো লাগবে, কিছু তো লিখতে পারবে তুমি। কভার করো এটা। আমার তো ওই অবস্থায় আর কিছু বলার ছিল না। তখন ললিতকলার লাইব্রেরিতে গিয়ে, আর্টিস্ট বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করে মুকুল দে-র উপর কিছু তথ্য জোগাড় করলাম। সেই সময়ে আমায় খুব সাহায্য করতেন হিন্দি লেখক মনোহর শ্যাম জোশি। উনি তখন ‘দিনমান’-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর। ওঁকে গিয়ে বললাম যে, দেখুন অজ্ঞেয় (তাঁকে আমরা বলতাম বাৎস্যায়নজি) আমায় বলছেন এরকম একটা লেখা লিখতে। আমার তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। রিপোর্ট লেখা আলাদা জিনিস কিন্তু এভাবে একটা প্রদর্শনীর রিভিউ লেখা তো পুরো আলাদা! আমি কখনোই লিখিনি আগে। তিনি আমায় বললেন, তোমার জীবনে কিস্যু হবে না। তারপর উঠে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন আর মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে থাকলেন। তারপর বললেন, আরে বাবা, জীবনে সব মানুষই সব কাজ কখনও-না-কখনও প্রথমবারই করে। আমি তো আছি! তুমি যাও, গিয়ে লিখে নিয়ে এসো। দু-তিনবার সেই প্রদর্শনী দেখে, সবার সঙ্গে কথা বলে, কিছু পড়ে, আমি একটা লেখা খাড়া করলাম। তারপর ওঁকে দেখালাম। উনি বললেন— আচ্ছা, ঠিক আছে, এটা বাৎস্যায়নজির কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি বললাম— আরে, একবার দেখে তো নিন, যা ঠিকঠাক করার সেসব করে দিন, তারপর পাঠান। উনি বললেন— না না, এটা সোজা বাৎস্যায়নজির কাছে যাক। দেখি না, এর কী কী বদলান উনি। তারপর দুজনেই বসে আছি। আমি তো ধরেই নিয়েছি যে, এ-লেখা পাশ হবে না। ২০-২৫ মিনিট পরে সে-লেখা এল বাৎস্যায়নজির ঘর থেকে। উনি কিছু-কিছু জায়গা একটু পালটে দিয়েছেন। আর সই করে দিয়েছেন যে, লেখাটা প্রকাশ করা হবে। জোশিজি আমায় বললেন— দেখে নাও, হলো তো? আর আমি ভাবছিলাম, কী আশ্চর্য! কী করে হল! ‘দিনমান’-এর মতো পত্রিকায় আমার প্রথম আর্ট রিভিউ ছাপা হবে! তারপরে তো আরও দশ বছর লিখেছি। আমার লাইফ চেঞ্জ হয়ে গেল। হুসেন থেকে শুরু করে সুজা, এমনকী গাইতোণ্ডে, তায়েব মেহতা, স্বামীনাথন, অম্বাদাস, মনজিৎ বাওয়া, যোগেন চৌধুরী, গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য এদের নিয়ে লিখেছি, এদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে উঠেছে। যোগেন চৌধুরী যখন প্রেসিডেন্ট হাউসের কিউরেটর ছিলেন, ওর ছেলে তখন ছোট। আমরা পরিবারের সবাই মিলে ওর ওখানেই আড্ডা মারতে চলে যেতাম মাসে তিন-চারবার। বিকাশের সঙ্গেও তো ভাল বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে উঠল, আর গণেশ পাইনের সঙ্গে তো খুবই বন্ধুত্ব। ও তখন কলেজ রো-তে থাকত। সে এক আলাদা কাহিনি…
(চলবে)