ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ৬

    মন্দার মুখোপাধ্যায় (January 13, 2024)
     

    তরঙ্গনাথ

    ১.

    এ কথাটা জানতে প্রায় সকলেই উৎসুক যে, এই সাবেক জজ-পণ্ডিতদের বাড়িতে জন্মে, উপবীতধারী বামুন হয়ে আমি কী করে পুলিশ হলাম! আমার কাছে এর উত্তর খুবই সহজ; মানে ‘নরাণাং মাতুল ক্রম’, আর কী! দাদামশাই ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং আমার সেজো জ্যাঠামশাইয়ের বন্ধু; সেই সূত্রে আমার মায়ের সঙ্গে বাবার বিয়ে হয়। বাবা যখন মায়ের গর্ভে সে সময়ে তাঁর বাবা মারা যান; আমাদের এই মস্ত বাড়িখানা ঠাকুরদারই করা। বাবার বড় ভাইরা তাঁকে বড় করেন এবং উপযুক্ত বয়সে সম্পত্তির অংশও দেন। বাবা ছিলেন কৌতুকপ্রিয়, দাদাদের আদরে বড় হওয়া এক সহজসরল মানুষ। যতবার চাকরি পেয়েছেন, ততবারই চাকরি ছেড়েছেন। ফলে আমাদের বেড়ে ওঠার সময় মায়ের সিদ্ধান্তই ছিল শেষ কথা। শিক্ষা ও বৈভবে বড় হয়ে ওঠা আমার মায়ের খুব অসুবিধে হয়েছিল উচ্চাশাহীন আমার বাবার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায়। দাদামশায়ের অকাল মৃত্যুতে বিপর্যয় নেমে আসে মায়ের বাপের বাড়ি আনুলিয়ার সংসারে। দিদিমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাশীতে। বড়মামা সবাইকে ঠকিয়ে বাড়ি বেচে দেন। মায়ের মেজোবোনও ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বউ এবং যথেষ্ট সম্পন্ন। সেজোবোনের বিয়ে হয়েছিল আমাদের পাড়াতেই আর এক সম্পন্ন ঘরে, স্বামী সরকারি চাকুরে। আর এক বোনের বিয়ে হয় কলকাতায় কালীঘাটের কাছে; তাঁর স্বামী ছিলেন পুলিশের বড়কর্তা। সেই সূত্রেই পুলিশ-সংযোগ ঘটল আমাদের সংসারে। প্রথমে চাকরি পেলেন ছোটমামা। রিভলবারের এক টিপে ডাব পেড়ে সাহেবদের একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই এক টিপেই তাঁর চাকরিও হয়ে গেল। কিন্তু নানা কারণে মামার ভাল লাগল না সে চাকরি। কিন্তু তাঁরই অনুরোধে আমাকে সুযোগ দিলেন তাঁরা। মনে হয় সেই আঠারো বছর বয়সেই ছ’ফুট ছাড়ানো আমার ওই পেটানো চেহারা দেখেই চাকরি হয়ে গেল।

    সবে ম্যাট্রিক পাশ দিয়ে অন্যান্য ভাইদের মতোই স্বপ্ন দেখছি বি. এ পড়ার; মায়ের স্বপ্ন সেজো জ্যাঠামশাইয়ের মতো প্রেসিডেন্সি কলেজ। বাবার উচ্চাশা, পারিবারিক গৌরবে জজ-পণ্ডিতের বংশের ছেলেকে আইন পড়িয়ে কোর্টে ওকালতি করাবার। এরকম একসময়ে, অবনিবনার কারণে ডিস্টিলারি ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে করতেই বাবা আবার চাকরি ছেড়ে দিলেন; সে বয়সে আর কোথায় চাকরি পাবেন! ছোট মামার প্রস্তাবে মা আর আপত্তি করলেন না। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে ব্যাগ গোছাতে বসলেন। পরীক্ষায় ভাল ফল করেও, সহপাঠীরা সকলে যখন কলেজ যাচ্ছে আমি তখন বাড়ি ছেড়ে, ব্যারাকপুরের পুলিশ ব্যারাকে থেকে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শিখে চলেছি— কুচকাওয়াজ, ঘোড়ায় চড়া, দ্রুত সাঁতার, বন্দুক চালানো, ভয় না পাওয়া এইসব; আর সেই সঙ্গেই গড়ে তুলছি একই খাবার দিনের পর দিন খেয়ে যাওয়ার অভ্যাসও।

    ২.
    বাড়ির কাছের সেই গঙ্গা নদীটাই এখানেও বয়ে চলেছে। এখান থেকে দু’কিলোমিটারের হাঁটা পথেই আমাদের সেই মস্ত দোতলা বাড়ি। অথচ এই সামান্য দূরত্বেই সব কিছু কত আলাদা। বড়লাটের বাগান ভর্তি টিয়ার ঝাঁক; ফুল আর ফলের সুগন্ধে ম-ম করছে বাতাস। কিন্তু প্রবেশাধিকার নেই। এ বাগান তাই আমাদের বাড়ির বাগান বা পাড়াপড়শির বাগান নয়। যে গঙ্গায় বান ডাকলেই ঝাঁপ মেরে ঢেউ যুঝেছি, দল বেঁধে সাঁতরে পারাপার করেছি অনায়াসে, সে সবও এখানে আইন বিরুদ্ধ। সাহেবরা এই নদী আর এখানকার নৌকোগুলোকেই সবচেয়ে ভয় পায়; কারণ ডাকাতরা তো নৌকো করে এসেই এলাকায় হানা দেয়। তার সঙ্গে আছে দামাল ‘স্বদেশী-ডাকাত’দের আক্রমণ। সাহেবদের চোখে সবাই তাই ঠগি এবং ডাকাত। বড়সাহেবের বাড়িটা প্রাসাদোপম হলেও আমাদের থাকার ব্যবস্থা লোহার ‘ডোমে’— এক-মানুষ উঁচু, লম্বা একখান লোহার ঘর যার চালাটা ছবিতে দেখা ইগলুর মতো। খড়ের বিছানায় ত্রিপল বিছিয়ে বালিশের নীচে লাঠিটা রেখে ঘুমনো; সিটি বাজলেই যাতে তড়াক করে উঠে আক্রমণ ঠেকাতে পারি। এসবে এমন অভ্যেস হল যে, কায়িক পরিশ্রমের ক্লান্তিতে আমার হাত-পা-দেহ ঘুমিয়ে পড়লেও মাথাটা সব সময় জেগে থাকত সজাগ হয়ে। অনায়াসে বুঝতে শিখলাম কোনটা বুনো খরগোশ বা খটাশ বা শেয়ালের দৌড় আর কোনগুলো মানুষের পায়ের ধুপধাপ।

    কায়িক অনুশীলনের সমস্ত পরীক্ষাতেই ভাল নম্বর পেলাম। আর কাজে এল, বাবার কাছে শেখা ইংরেজদের আনা ‘কুইনস্-ইংরেজি’ এবং মায়ের মতো চমৎকার হাতের লেখা ও সহবৎ। বাংলার মতোই ইংরেজিটাও বেশ তুখোড়ভাবেই বলতে এবং লিখতে পারতাম বলে তিন মাস পর, প্রথম পোস্টিং হল একেবারে পাটনা সদরে; যেখানে ইংরেজি বা বাংলার বদলে লাগবে শুধুই হিন্দি। মায়ের মনোকষ্ট না বাড়াতে হাসিমুখে মেনে নিলাম সব। তিনদিনের ছুটিতে, কয়েক মাস পরে বাড়ি এলাম আমি। পোস্টিংয়ের পর আবার কবে ছুটি পাব জানা নেই। ইতিমধ্যেই আমার একমাথা ঘন কোঁকড়া চুল ক্ষুর চালিয়ে উড়িয়ে দিয়ে, সে জায়গায় পড়েছে পুলিশদের ব্যারাকি ছাঁট; আর পোশাক দাঁড়িয়েছে বেশির ভাগ সময়েই উর্দি— বেল্ট-বাঁধা খাকি প্যান্ট, সাদা শার্ট, লম্বা মোজা আর কালো বুট। তবু ঘরে পরবার জন্য মা গুছিয়ে দিলেন কয়েকটা ধুতি আর সাদা পিরান। মায়ের নজর বোধহয় এড়াল না, যখন বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে আমার গানের খাতা আর ছড়টানা এসরাজটাও ট্রাঙ্কে ঢোকালাম। হাতব্যাগে বাবা বিশেষ করে গুছিয়ে দিলেন, খাম পোস্টকার্ড আর ঠিকানা লেখার নোটবুক। প্রণাম-পর্ব সেরে, আমার ছোট দুই ভাই–বোন রাণী আর বদুকে আদর করে, আত্মীয়স্বজন সকলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলাম; ব্যারাকের জিপ এসে মোড়ের মাথা থেকে তুলে নিল আমাকে। একই সঙ্গে স্বস্তি এবং উদ্বেগ দুই-ই ভেসে থাকল সেই মুহূর্তে, মায়ের সেই অপলক চেয়ে থাকায়। আর আমি বুঝলাম যে, এই চাকরি আর কোনও দিনও ছাড়তে পারব না; আমাদের সংসার ভেসে যাবে। বুঝলাম যে ইংরেজ আমলে ‘কোম্পানি’র পুলিশ হওয়াই আমার নিয়তি।

    মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার লোভে ভারতীয় হত্যা বা গ্রেফতার কখনও করব না। বুঝলাম যে আপোষহীন বাঁচা কতখানি কঠিন। কিন্তু তার থেকেও কঠিন চাকরি ছেড়ে দেওয়া।


    ৩.
    সাঁকো পার হয়ে, হাওড়া থেকে ট্রেনে এসে নামলাম পাটনায়। এখানেও কিছুদিন ট্রেনিং এবং একদফা ঝাড়াই-বাছাই। একই সঙ্গে আসা বেশির ভাগ ছেলেরা যখন কনস্টেবল হিসেবে চাকরি পেল, ভাল ইংরেজি বলা এবং লেখার কারণে আমার একটু উচ্চপদ লাভ হল— Assistant Sub-Inspector of Police। পদ যেমন উচ্চ, দায়িত্বও তেমন গুরুতর। বাবাকে লিখে জানালাম,

    শ্রীচরণেষু বাবা, তাং ২০ জানুয়ারী ১৯০৩

    অবশেষে Bengal Presidency-র অধীনে, Assistant Sub-Inspector of Police— এই পদ পাইয়াছি। সদর দপ্তরে আজই নোটিশ টাঙাইয়া জানানো হইয়াছে। কোন অঞ্চলে পাঠানো হইবে সেটি এখনও জানি নাই। এক সপ্তাহের মধ্যেই ট্রেনিং-সেন্টার ছাড়িয়া সেই স্থানে চলিয়া যাইতে হইবে। তথায় ডাক ব্যবস্থা কেমন জানা নাই। আপাতত এই সদর আপিসেই পত্র পাঠাইবেন। আমার শরীর ভাল আছে। আশা করি বাড়িতে সব কুশল। মা, বদু এবং রাণী সকলেই আশানুরূপ তো! দিদিমার সংবাদও জানিতে ইচ্ছে করে। 

    ইতি
    আপনার সেবক
    তনু

    আগের অভ্যেসে নিজে গিয়ে ডাকবাক্সে চিঠি ফেলার দস্তুর এখানে নেই; চিঠি ডাকে দেওয়ার আগে আপিসের টেবিলে রেখে এসেছি। সপ্তম এডওয়ার্ডের মুখের ছবি ছাপানো পোস্টকার্ড। প্রতিটি ব্যক্তিগত চিঠিও পড়ে দেখা হয়। আপত্তিজনক মনে হলে ঘন কালি দিয়ে কেটেও দেওয়া হয় কিছু কথা। এমনকী বাতিলও হয়ে যেতে পারে সে চিঠি। প্রথম থেকেই তাই বুঝেছি যে পাহারা দেওয়ার কাজে আমাদের নিয়োগ করা হলেও, আমাদেরও পাহারা দিয়ে রাখবে ইংরেজ সরকার। Indian Imperial Police-এ ভারতীয়রা তাই সুযোগই পাবে না। ইংরেজদের একছত্র অধিকার সেখানে। আমাদের জন্য যে Indian Police, তার ওপরও সর্বোচ্চ পদে কিন্তু সেই সাহেবরা। কয়েকটা বিদ্রোহ এবং সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলে সাহেবরা ভীষণ সাবধান হয়ে গেছে। কাউকে বিশ্বাস তো করেই না, উল্টে চরম শাস্তি দিতেও দ্বিধাহীন। ফলে অচিরেই বুঝে গেলাম যে, ট্রেনিংয়ের সময় পাখিপড়া করে ‘The Peace Keepers’ বলে আমাদের চিহ্নিত করে যে সম্মান-সূচক সম্ভাষণ তা আসলে নির্মমভাবে ভারতীয়-দমনের নীতি; আর এই ভারতবর্ষ থেকে বার্মা অবধি তাঁদের অধিকারে। পুলিশ হিসেবে আমার ওপর যে দায়িত্ব বর্তাল, তা আদপে ‘VIP Security’ এবং ‘Counter Terrorism’ । মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার লোভে ভারতীয় হত্যা বা গ্রেফতার কখনও করব না। বুঝলাম যে আপোষহীন বাঁচা কতখানি কঠিন। কিন্তু তার থেকেও কঠিন চাকরি ছেড়ে দেওয়া। অন্যদিকে, যতক্ষণ এই উর্দি গায়ে থাকবে, স্বদেশীরাও আক্রমণ শানাবে নির্বিচারে। অনুমান করতে অসুবিধে হল না যে, এক পাকাপোক্ত হত্যালীলার অংশীদার হতে চলেছে আমি। এটাই আমার চাকরি।

    ৪.
    একজন মেসোমশাই পুলিশ এবং অন্যজন এই বিহারেই গিরিডি অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তাই আমার ওপর নজরদারি একটু নরম। বাকিটা আমার সুভদ্র আচরণের মোড়কে দুর্জয় সাবধানতা। হাত-পা এবং সময় ব্যবহারের ট্রেনিং কমে এবার শুরু হল অস্ত্র-ধারণ শিক্ষা। কাকে শায়েস্তা করতে হবে জানি না, কিন্তু পদ অনুযায়ী অস্ত্র বরাদ্দ হবে আমার নামে। লাঠি-ব্যাটন ছেড়ে আমার জন্য এবার বরাদ্দ হল রাইফেল। ‘টার্গেট’ শব্দটার ব্যবহার বদলে হয়ে গেল অব্যর্থ-নিধন। টোটা এবং গুলিও গুণে গুণে বরাদ্দ— হিসেবের বাইরে এলোমেলো খরচ করলেই চাকরিতে অবনতি; প্রোমোশন স্থগিত; কয়েক মাস সবেতন সাসপেন্ড; এমনকী বরখাস্ত অবধিও যেতে পারে। যাই হোক আমার ওপর কোনও রুলজারির সুযোগ ঘটেনি বলেই হয়তো, আমার পদোন্নতিতে বিঘ্ন ঘটেনি। পোস্টিং হল বিহারের কাটিহার বলে এক অঞ্চলে, যেটা মূলত গ্রাম।

    আমার Releasing officer এবং এখানকার দণ্ডমুণ্ডের কত্তা Mr. Robert ওঁর ঘরে ডেকে পাঠালেন। ভাল বাংলা এবং হিন্দি বলেন। স্বগোত্রীয় ছাড়া পারতপক্ষে ইংরেজি বলেন না।
    — জানতে চাইলেন, পদোন্নতিতে খুশি তো!
    — ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে, পুলিশের মতোই পায়ে তাল ঠুকে বললাম, ‘হ্যাঁ স্যার।’
    — ‘কবে যেতে পারবে?’
    — ‘স্যর, আপনি যেদিন বলবেন!’
    — ‘কালকেই রওনা দাও। ট্রেনে ছ’ থেকে সাত ঘণ্টার পথ। তোমাকে রিসিভ করার লোক থাকবে।’
    — ‘Duty specification কি ওখানে গিয়ে পাব স্যর?’
    — ‘যার কাছে জয়েন করবে সেই Mr. August সব বুঝিয়ে দেবেন।’
    — ‘ঠিক আছে স্যর। আশা করি তিনিও আপনার মতোই সঠিক নির্দেশ দেবেন, যাতে কাজ করতে পারি।’
    কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দ্রুত জরিপ করে নিয়ে বললেন, ‘তুমি বুদ্ধিমান এবং পরিশ্রমী, তাই নিজেও অনেকটাই বুঝে নিতে পারবে।’

    জয়েনিং লেটার হাতে নিয়ে ঘরে এসে, আগে খানিক জল খেলাম। আজ ডিউটি অফ। ধড়াচুড়ো ছেড়ে পিরান আর ধুতি পরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম একানে খাটখানায়। মায়ের মুখটাই মনে এল। দাদামশাইয়ের বদলি চাকরি সূত্রে তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে টাঙ্গাইল, যশোর, কুষ্ঠিয়া, খুলনা— এই সব অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে। কত কবিতা লিখেছেন দিদিমা ওই সব অঞ্চলের নদী, গাছপালা আর মানুষজনদের নিয়ে; শিখেছেন কতরকম আঞ্চলিক ভাষা, রান্না এবং হাতের কাজ। কিন্তু আমার কাজ যে মূলত শায়েস্তা করা! জলদি উঠে পড়ে গোছগাছ করে নিলাম। বার বার নেড়ে চেড়ে দেখলাম সদ্য পাওয়া পিস্তলটা। এখন থেকে একজন রাইফেলধারী আমার নিত্যসঙ্গী হবে। আমার পকেটে থাকবে লুকনো পিস্তল। উর্দির মধ্যে ফুলপ্যান্ট এবং হাফপ্যান্ট দুটোই পরা চলবে। এসরাজটা নেওয়ার জন্যই একটা বড় ট্রাংক সঙ্গে নিতে হচ্ছে।

    আনুষ্ঠানিক বিদায় নিয়ে জিপে উঠতেই মনে হল, এখানেই আবার ফিরে আসব; অবশ্য তার আগে নিধন হয়ে গেলে অন্য কথা! ট্রেনের জানলায় চোখ রেখে মনে হল, বাবার সঙ্গে বেড়াতে চলেছি কোথাও। দু’একটা পাকা ঘর ছাড়াতেই সবুজ খেত আর সরু সরু জলরেখা। কোথাও কোথাও আদিবাসীরা লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক হয়ে রেল দেখছে। বড় সুন্দর নীল আকাশ। মন যেন গান হয়ে গুনগুনিয়ে উঠছে। খুব ইচ্ছে হল, আয়নায় গিয়ে নিজের মুখটা একবার দেখে নিতে। সঙ্গের অডার্লিকে ইশারা করতেই ফ্লাস্ক থেকে চা এবং লাঞ্চবক্স থেকে পুরি-তরকারি বার করে দিল; সঙ্গে একটু মিষ্টিও। ওকেও খেয়ে নিতে বললাম। হাতব্যাগটা থেকে ইংরেজিতে লেখা একটা বই বার করে পড়তে থাকলাম; যেটা প্রায়ই পড়ি; বেঙ্গল-পুলিশি কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট ও বিভিন্ন কমিশনের নির্দেশিকা। জেদ আর বেদনা দুই-ই টের পাই।

    ৫.
    বেলা গড়িয়ে ট্রেন পৌঁছল কাটিহার স্টেশনে; শুরু হল খাতির ও আপ্যায়ন। সবুজে ছেয়ে আছে চারপাশ। পুরনো অডার্লির সঙ্গে যোগ হল নতুন আরও একজন। এল রাইফেলধারীও। জিপের বদলে ঘোড়ার গাড়ি চেপে চললাম গন্তব্যে। ঘোড়ার গাড়ির পিছনে বসা সেই দুজন অডার্লিদের হিশহাসে বুঝলাম যে আমার অল্প বয়স এবং অনভিজ্ঞতা নিয়ে চর্চা চলছে। বড়সড় চেহারার জন্য আমার কম বয়েসটা ইংরেজ অফিসাররাও আর ধর্তব্যে আনলেন না। সাবধান হতে হতে আমি অবশ্য বয়স ছাড়া বড় হয়ে গেলাম।

    বাউন্ডারি ঘেরা একতলা একটা পাকা বাড়ির সামনে ঘোড়া থামল; চৌকিদার ছুটে এসে নমস্কার জানাল। খোলা বারান্দার কেঠো চেয়ার টেবিলের ওপর আগে থাকতেই খাবার জলের হাত কুঁজো এবং চায়ের ভাঁড় রাখা। জানতে চাইল, স্নান করব কি না; তাহলে দুপুরের খাবার ‘সার্ভ’ করবে।
    অডার্লিদের বললাম, ‘তোমরা খেয়ে নাও; বেরবো।’ সন্ধের আগে আশপাশটা একটু দেখে নিতে চাই।
    — ‘জী সাহাব! রাতের খাবার কী খাবেন? ভাত, রুটি, সবজি, চিকেন, দুধ…’
    — ‘ফিরে এসে বলে দেব; চিকেন আর ভাত রাতে খাব না।’
    — ‘আর কিছু লাগলে বলবেন; সব-ই পাবেন।’

    ইঙ্গিতটা বুঝেই বললাম আর কিছু লাগবে না; আন্দাজ হল যে আগের অফিসাররা বোধহয় মদ এবং মেয়েমানুষ দুই-ই চাইতেন। বাইরে এসে দেখি, ঘোড়ার গাড়িটা আর নেই; তার বদলে একটা বড় ঘোড়া সহিস সমেত দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে পিঠে নেবে বলে। আর সেই দুজন অডার্লির জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে উর্দি পরা এবং রাইফেলধারী দুজন কনস্টেবল। দুজনের জন্য দুটো সাইকেল দেখে বুঝলাম যে ওরা ওতে-ই যাবে। সুরক্ষার মোড়কে সরকারি নির্দেশে আমাকে পাহারা দেওয়াও হবে।

    ঘোড়ার কাছে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত বোলাতেই, অচেনা স্পর্শে সে ঝেঁকে উঠল; সহিসকে হাত নেড়ে সরে যেতে বলে, ঘোড়ার পিঠে একলাফে উঠে বসে, লাগাম ধরলাম; দুদ্দাড়িয়ে ছুটতে লাগল সেই ঘোড়া; আমিও তার পিঠে চেপে চলেছি অচেনা এক পথে— মাঠের রাস্তা পেরিয়ে, নুয়ে পড়া গাছের ডাল থেকে মাথা বাঁচিয়ে দুরন্ত উন্মাদনায়। পড়ন্ত আলোয় সে এক অদ্ভুত বিকেল।

    চিঁহি ডাক ছেড়ে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়েও যখন সেই ঘোড়া তার পিঠ থেকে কোনও মতেই ফেলে দিতে পারল না, হঠাৎই ঝপ করে থেমে গেল; আলো তখনও পড়েনি; সামনের পথে গাছপালা কম; মাটির সঙ্গে যেন বালিও মিশে আছে। ঘোড়া থেকে নেমে, বড় একটা গাছের সঙ্গে তাকে বেঁধে, একটু এগোতেই দেখি এক নির্জন নদী; বেশ চওড়া। নৌকো চলাচল হয় কি না বুঝতে পারলাম না। দু’চোখ ভরে দেখে, নদীর বাতাস গায়ে মেখে মনটা বেশ শান্ত হয়ে এল। ঘোড়াটার কাছে পায়ে-পায়ে ফিরে এসে, তার পিঠে চড়ে বসতে গেলে, তাল ঠুকে অভিবাদন জানাল সে। সামনের দু’পা সামান্য মুড়ে নিচু হয়ে অনুমতি দিল তার পিঠে চড়তে। পথ হারানো নতুন অফিসারকে এবার সে নিজেই ফিরিয়ে আনল কোয়ার্টারে। শান্ত হয়ে আমাকে ঢুকতে দেখে, সকলের শুধু যে উদ্‌বেগের অবসান হল তা-ই নয়, তারা বুঝল যে এই আমি অফিসারটি নতুন এবং অল্পবয়সী হলেও মানুষটা আসলে বড়ই কঠিন ঠাঁই; সেই সঙ্গে দেখল যে, নতুন ঘোড়াকে কী ভাবে বশও মানালাম একেবারে অক্ষত শরীরে!

    ৬.
    আগামীকাল আমার জয়েনিং। Mr. August-কে স্থানীয় লোকেরা তাদের মতো করে ‘অগস্ত্য’ সাহেব বলেই ডাকে। অগাস্ট যে একটা মাসের নাম সেটাই বা ক’জন জানে— এখানকার এই আদিবাসী, অভুক্ত, নিরক্ষর, অসহায় নেটিভরা!

    তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম— কোমরে ছোরা ঝুলিয়ে, ওই যে ‘কালপুরুষ’!

    • আমি তরঙ্গনাথ। কুলীন মুখোপাধ্যায় বাড়ির ছেলে। আধুনিকতার হাওয়া আমাদের পরিবারে কয়েক পুরুষ আগে তখনই বইতে শুরু করেছে, যখন আমার বাবার ঠাকুরদা এবং তাঁর ভাই সাহেবদের সংস্কৃত পড়াতে লালদিঘির ফোর্ট উইলিয়ামে চাকরি নিয়েছিলেন। পানিহাটি ঘাট থেকে ‘কুঠির-পান্সি’ করে তাঁরা যাতায়াত করতেন প্রতিদিন।
      আর কাটিহারে নেটিভ-পুলিশ অফিসার পদে যোগ দিয়ে দেখলাম যে সরকারি কাজে জিপ, ঘোড়ার সঙ্গে সাইকেলও। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন আমদানি। বিলিতি সাহেব-মেম আর পার্সিরা শখ করে চড়ছেন। তাঁদের সেই বাতাস-বিলাস এখন নিচুতলার কনস্টেবল আর চৌকিদারদের জন্য সবে আমদানি হচ্ছে। মনে মনে খুব ইচ্ছে ছিল, এমন একখানা সাইকেলের। কিন্তু দামি ওই বিলিতি জিনিসের আবদার কার কাছে করব! আজ ভাবলাম যে অফিসার হিসেবে যে একমাত্র জিনিসের আর্জি জানাব, তা হল নিজের জন্য একটা নতুন সাইকেল। ঘোড়া এবং সাইকেল— প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনেও দুটোই বেশ চড়া যাবে। এই প্রথম মনে হল যে, আমি একজন পদাধিকারী। প্রাপ্তির অপেক্ষায় না থেকে প্রাপ্যটুকু বুঝে নেওয়াও আমার অধিকারে বর্তায়।
      চারিদিক নিশুতি; এসরাজ টেনে বারান্দায় বসে একা গাইতে লাগলাম— ‘প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর…

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook