সমালোচনা— চলচ্চিত্র, ‘পার্কিং’
সাল— ২০২৩
মুখ্যভূমিকায়— হরিশ কল্যাণ, এম এস ভাস্কর, ইন্দুজা রবিচন্দ্রন প্রমুখ
পরিচালনা— রামকুমার বালাকৃষ্ণন
তোর লজ্জা করল না! এ রকম মিথ্যে অপবাদ দিতে…’ গলার শির ফুলিয়ে চেঁচাতে থাকেন মহিলা নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে; বিশ্বাসই হচ্ছে না তার নিষ্পাপ, কলেজপড়ুয়া মেয়েটা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। কিছুক্ষণ আগেই মেয়ে তাদের ঘরের ওপরে থাকা ভাড়াটে ছেলেটার বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছে। সমস্যা এই যে, অভিযোগটা মনগড়া মিথ্যাই নয়, রীতিমতো প্যাঁচ-পয়জার কষে করা— ভাড়াটে ছেলেটার হাতে মেয়েটির বাবার অতীত-অপমানের বদলা নেওয়ার জন্য। মা এটাও জানেন যে মেয়ে কেন এমন কাজ করল— তার স্বামী ও তার ভাই মানে মেয়েটির মামার প্ররোচনায়! পুলিশও দেরি না করে ছেলেটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে লকআপে পুরেছে। যদিও এ ক্ষেত্রে অভিযোগ মিথ্যে, কিন্তু এর পূর্বে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে অনেক কিছুই ঘটেছে যার নিটফল শ্লীলতাহানির অভিযোগ।
মা, মেয়ে ও প্রবীণ সরকারি চাকুরে বাবা, অফিসে যিনি অত্যন্ত সৎ, ব্যক্তিগত জীবনেও অমায়িক; এই পরিবারের ওপরতলায় ভাড়াটে এক নবীন দম্পতি— ছেলেটি আই টি কর্মী, স্ত্রী আপাতত মেটার্নিটি লিভ-এ। প্রবীণ মানুষটির পাড়ায় বছর দশেকের বেশি বাস, তিনিও একতলায় ভাড়া-ই থাকেন; সামনের এক চিলতে উঠোনে তার বাহনটি থাকে— পুরনো একটি মোটরবাইক। নিজেদের ফ্ল্যাট বা গাড়ি কেনার ক্ষমতা থাকলেও, টাকাপয়সার অনাবশ্যক খরচ তার একেবারেই না-পসন্দ। মিতব্যয়ী মানুষটি জমাচ্ছেন— মেয়ের উচ্চশিক্ষা, তার ধুমধাম করে বিয়ে আর হয়তো শেষ বয়সে একটা বাড়ির জন্য। ওপরের ভাড়াটে ছেলেটি তার জীবনদর্শনের বিপরীতে থাকে— তার সবকিছুই বর্তমান ও ইএমআই সর্বস্ব; পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার জন্য পরিবার যোগাযোগ না রাখলেও, স্বামী-স্ত্রী কিন্তু সুখেই আছে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর যাতায়াতের জন্য লাখ দশেকের নতুন একটা গাড়িও কিনে ফেলে সে; অবশ্যই ইএমআই-তে! তবে ভাড়া বাড়িতে জায়গা কম, ছোট জায়গায় ‘নতুন গাড়ি’ আর ‘পুরনো মোটরবাইকের’ সহাবস্থান থেকেই সব সমস্যার সূত্রপাত!
একটা ছোট ঘটনা যা দু’পক্ষই কিছুটা মানিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী হলে বেশিদূর গড়াত না, সেটাই হাতাহাতি থেকে দ্রুত পর্যবসিত হয় মামলা-মোকদ্দমা ও পুরোদস্তুর রোড রেজ-এ। প্রতিশোধস্পৃহায় সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে একলা ফেলে, অফিসে যাওয়া জলাঞ্জলি দিয়ে ছেলেটি সারাদিন সেই প্রৌঢ়ের দপ্তরের অনতিদূরে বসে থাকে; তাকে অনুসরণ করে আর মতলব ভাঁজে কী ভাবে জনসমক্ষে অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া যায়। আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে গাঁজাখুরি কেস খুবই কাজে দেয়; জনসংখ্যা এবং দায়ের হওয়া এফআইআর-এর তুলনায় যেখানে পুলিশকর্মীদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। তবে সংখ্যা পর্যাপ্ত হলেও নিরপেক্ষ ও পরিশ্রমসাপেক্ষ তদন্তে এ দেশের পুলিশের অনীহা নতুন খবর নয়।
বাস্তবিকই এ দেশের রাস্তায় চালক থেকে পথচারী, এমনকী ফুটপাথে সম্বলহীন ঘুমন্ত মানুষেরও দিনের শেষে অক্ষত শরীরে পরের দিনের আলো দেখা মির্যাকল ছাড়া কিছু নয়। সরকারি সমীক্ষা বলছে ২০১৮ – ২০২২-এর মধ্যে পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ; পশ্চিমবঙ্গ একাদশতম স্থানে, শীর্ষে তামিলনাড়ু। ঘটনাচক্রে এই ছবিও তামিল ভাষার, তবে চরিত্ররা সর্বভারতীয়। বহুমূল্য মুঠোফোন থেকে চারচাকা— প্রয়োজন থাকুক কি না থাকুক, এ দেশে সবই স্টেটাস-এর লক্ষণ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সবসময় আতঙ্কিত— এই বুঝি ও আমার থেকে এগিয়ে গেল! এই ইঁদুরদৌড় জন্ম দেয় অসহিষ্ণুতার— যার বিস্ফোরণের কখনও সাক্ষী, কখনও বা নিজেরাই কুশীলব হয়ে উঠি। তুচ্ছ ঘটনায় নিপাট ভদ্রলোকরাও যে বিষাক্ত পৌরুষের ধারক ও বাহক হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ এই ছবি। প্রমাণ যে বয়সের ফারাক বা পরিণতমনস্কতা হিংসার ব্যাটনটি বয়ে নিয়ে চলার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নয়।
থ্রিলারের তালে চলা ছবিতে আমাদের সামাজিক অসুখগুলো গা-জোয়ারি উপদেশ না হয়ে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনেই আসে। চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক রামকুমার বালাকৃষ্ণন-এর প্রথম উদ্যোগ হওয়া সত্ত্বেও এ ছবি সচরাচর বেলাইন হয়নি। ফিলোমিন রাজ-এর সম্পাদনাও যথাযথ। অভিনয়ে হরিশ কল্যাণ ও এম এস ভাস্কর পাল্লা দিয়েছেন একে অপরের সঙ্গে। দুই পুরুষের গল্প ঠিকই, তবে নারীচরিত্ররাও প্রান্তিক নন এখানে। ছবির পুরুষদের বিপরীত বিন্দুতে বাস তাদের— যেখানে এখনও যুক্তি, সহমর্মিতা, মানবিকতার অভাব নেই। তাদের মধ্যস্থতাতেই ফেরে স্থিতাবস্থা। তবে বাস্তবের প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকা সমাজ কিন্তু অন্য ছবি আঁকছে।
সমানাধিকার আদৌ হবে কি না তা সময় বলবে, তবে হিংসার ব্যাপারে আজকের মহিলারা যে পুরুষদের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করতে পারেন, তার প্রমাণ রোজকার জীবনদৃশ্য, খবর, সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিয়ো। রাজধানী দিল্লিতে গাড়ি পার্কিং করা নিয়ে বিবাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, একপক্ষ সাঙ্গোপাঙ্গ ও লাঠিসোঁটা সমেত অন্যপক্ষের বাড়িতে আবির্ভূত হল, শারীরিক নিগ্রহের হাত থেকে বাদ গেলেন না মহিলারাও। আশ্চর্যের ব্যাপার যে নিগ্রহকারীরাও অধিকাংশই মহিলা!
ট্রাফিকের সম্পূর্ণ উলটো দিক থেকে আগত স্কুটিতে সওয়ার হেলমেটহীন তিন কিশোর-কিশোরী; নিশ্চিত দুর্ঘটনা এড়াতে এক ভদ্রলোক গাড়ি থামিয়ে তাদের সতর্ক করেছিলেন। লাইসেন্স পাওয়ার বয়স হয়েছে কি না, এরকম বেয়াড়া প্রশ্নও করে থাকতে পারেন। মুহূর্তেই আরও সঙ্গী জুটিয়ে, ভদ্রলোকের গাড়ি ধাওয়া করে, বাবার বয়সী লোকটিকে রাস্তায় ফেলে দমদম দাওয়াই প্রয়োগ করা হল। সবই ঘটল সিসিটিভি-র নজরদারি আর কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ-এর উপস্থিতিতে, খাস কলকাতায়।
এ তো একটা-দুটো ঘটনা, নিত্যদিন এরকম রোড রেজ-এর সাক্ষী থাকি আমরা; ‘পার্কিং’ সেই ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার কথা বলে যেখানে আক্রমণকারী ও আক্রান্ত দু’পক্ষই হেরে যায়। রোজকার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত বটে কিন্তু মূলধারার ছবি বলেই হয়তো এখানে সব ভাল যার শেষ ভাল; যুযুধান দু’পক্ষেরই অনুশোচনা, বোধোদয় হয়। তবে রিল ছেড়ে রিয়েল লাইফ-এর দিকে তাকালেই দেখা যাবে যে, পয়সা ও প্রতিপত্তি থাকলে, এ অভাগা দেশে নির্দ্বিধায় বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে অন্যের প্রাণ কেড়ে নিয়েও, নিশ্চিন্তে পায়ের উপর পা তুলে বিরিয়ানি উপভোগ করা যায়।