পৃথিবীটা ছোট হতে হতে স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে ড্রয়িংরুমে রাখা বোকাবাক্সতে আর এখন বন্দি নয়। সেই কবেকার ‘পড়শির ঈর্ষা, আপনার গর্ব’ ওনিডা থেকে আজকের স্মার্ট-অ্যানড্রয়েড এল ই ডি; সেই বোকাবাক্সটি থাকত আমাদের চোখের সামনেই, সেটিকে ধরাছোঁয়া যেত। কিন্তু যে অদৃশ্য সুতোর টানে আমরা নিজেদের স্মার্টফোনকে চোখে হারাই, সামাজিক মাধ্যম থেকে একটু বেশি সময় সরিয়ে রাখলেই যে কারণে মন আনচান করে ওঠে, তা সহজে বোঝা যায় না। সানন্দে মানুষকে ডিজিটাল বন্দিদশায় প্রবেশ করানোর এই কারিগরটির নাম অ্যালগরিদম।
সারা পৃথিবীতে আজ দুশো কোটি ইউটিউব-ইনস্টাগ্রাম ইউজার, তিনশো কোটিরও বেশি ফেসবুক ইউজারকে স্মার্টফোনে ব্যস্ত রাখার যে অতিকায় পরিসরটি নির্মাণ করা হয়েছে, পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে তার অভিশাপের ব্যাপ্তিও অতএব হয়ে ওঠে অতিশয় গভীর। কত পুরনো পাড়ার বন্ধুকে আমরা খুঁজে পেয়েছি কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় বিশ বছর পর ফেসবুকের দৌলতে, বেটোফেন-বিটলস শুনে ফেলা, ঋত্বিক-কুরোসাওয়া-বার্গম্যান দেখে নেওয়া ইউটিউবে কত সহজ এখন।
টিনএজার থেকে সদ্য একুশে পা দেওয়া যুবক-যুবতীরা কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপ বা ইসরাইল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের হাড় হিম করা বাস্তবতা সম্পর্কে একেবারেই চিন্তিত নয়। অধার্মিক নতুন আফিম টিকটক-ইনস্টা-স্ন্যাপচ্যাটেই তারা হামেশা বুঁদ। নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ফিল্টার-সেলফির সাহায্যে কেবলমাত্র কৃত্রিম সৌন্দর্য ছড়ানো ছবি ফেসবুকে তারা পোস্ট-ই করছেন না, কস্মেটিক সার্জারির মাধ্যমে সেই সেলফি-সৌন্দর্যকে রক্তমাংসের সৌন্দর্যে বাস্তবায়িত করতে চাইছেন। নতুন এই সিনড্রোমের নাম ‘স্ন্যাপচ্যাট ডিজমর্ফিয়া’। স্বভাবতই একে প্রযুক্তির আশীর্বাদ বলা যায় না, বরং অভিশাপের বিস্তার এতটাই বেশি যে কেবলমাত্র শৈশবের অবসাদ এবং আত্মহত্যা প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলতেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যাপক ভূমিকা নেয়নি; প্রভাব খাটিয়ে গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, হিন্দুত্ববাদ, জায়নবাদ, হোয়াইট সুপ্রিমেসি, অতিমারি থেকে অমানবীয় জিও-পলিটিক্স, সবকিছুকেই উসকে দিয়েছে অ্যালগরিদমের সুইচটিকে ইচ্ছেমতো ঘুরিয়ে। খালি চোখে এই খেলা ধরা পড়ে না, দরকারি আনুবীক্ষণিক দূরদর্শিতাও ক্রমে ভোঁতা হয়ে যায় ফেসবুক রিলসের সুদর্শন আবর্জনার অনন্ত অভিঘাতে।
ফেক নিউজ, ডিপফেক, পোস্ট-ট্রুথের যে দুনিয়ায় আমাদেরকে ক্রমশ অভ্যস্ত করে তোলা হচ্ছে তার বাসিন্দা হিসেবে ন্যূনতম সুস্থতা, সমাজসচেতনতার অধিকারী একজন মানুষের মনে প্রশ্ন আসা উচিত— যা কিছু ঘটছে আকছার চারপাশে তা কি এতই স্বাভাবিক! এর শুরু কোথায়, শেষই বা কোথায়? শেষ কি আদৌ আছে?
একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, অদম্য এক অভ্যাসে ঘুম থেকে উঠেই আমাদের মন হাতড়ে বেড়ায় স্মার্টফোনটিকে। গতকালের পোস্টে নতুন লাইক, কমেন্ট দেখতে না পেয়ে সামান্য উদাস মনে আমরা স্মার্টফোনটিকে অবজ্ঞায় কিন্তু ছেড়ে যাই না, মজে যাই ভিডিয়ো রিলস স্ক্রোল করায়। হঠাৎ খেয়াল হয়, কীভাবে যেন কেটে গিয়েছে এই নশ্বর জীবনের অতি মূল্যবান কুড়িটা মিনিট। আপাত ভাবনায় যে হেতু মনে হবে দোষ তো আমারই, তাই ঘুণাক্ষরেও আমরা জানতে পারব না— সিলিকন ভ্যালির হাতেগোনা ধুরন্ধর কয়েকজনের তৈরি করা অ্যালগরিদমের কারুকাজে দুশো কোটি মানুষের ভাবনাচিন্তা প্রভাবিত হচ্ছে, ডোপামিন-অ্যালগরিদম নেক্সাসে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীর মস্তিষ্কটি কিছুটা হলেও বদলে গিয়েছে; বদলে গিয়ে এমন কিছু চর্চায় মানুষগুলি প্রত্যেকদিন মেতে উঠছে, কয়েক দশক আগেও যা ছিল চূড়ান্ত অনভিপ্রেত। ডিজিটাল চক্রব্যূহে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে বিচিত্র এই পুতুলনাচ মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথম।
ফেসবুকের প্রথম প্রেসিডেন্ট শন পার্কার প্রসঙ্গত বলেছেন:
‘We need to sort of give you a little dopamine hit every once in a while, because someone liked or commented on a photo or a post or whatever… It’s a social-validation feedback loop… exactly the kind of thing that a hacker like myself would come up with, because you’re exploiting a vulnerability in human psychology… The inventors, creators— it’s me, it’s Mark [Zuckerberg], it’s Kevin Systrom on Instagram, it’s all of these people—understood this consciously. And we did it anyway… it literally changes your relationship with society, with each other… It interferes with productivity in weird ways. God only knows what it’s doing to our children’s brains.’ (১)
যে কোনও পুঁজিবাদী সংস্থার একমাত্র লক্ষ্য যেহেতু মুনাফা, এ ক্ষেত্রে তাই এই পুতুলনাচও কোনও ব্যতিক্রম নয়। মুনাফার জন্য প্রয়োজন বাজার যেখানে বস্তু কেনাবেচা হয়। গত পঞ্চাশ বছর ধরে সিলিকন-ভ্যালির প্রযুক্তি সংস্থাগুলি এই কাজই করে এসেছে। ইন্টেল-পেন্টিয়াম প্রসেসর বা মাইক্রোসফট উইন্ডোজ, প্রযুক্তির বাজারে এই সফটওয়্যার, হার্ডওয়ার কেনাবেচার প্রক্রিয়ায় উদ্বৃত্ত শ্রমকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা শুষে নেওয়ার খেলাটি ছিল চিরাচরিত। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাদের সবচেয়ে বিকশিত আজকের কাঠামোতে মুনাফার সমীকরণটি কিন্তু অনেকটাই আলাদা। প্রযুক্তির আঁতুড়ঘর ফেসবুক-গুগল-স্ন্যাপচ্যাট যদি বিক্রেতা হয়, ক্রেতা সেখানে অবশ্যই বিজ্ঞাপন সংস্থা এবং ডিজিটাল ল্যাবরেটরির গিনিপিগ হিসেবে পোস্ট, ফোটো আপলোড, লাইক, কমেন্ট, টুইটের মধ্যে দিয়ে দিনরাত বিক্রি হয়ে যাওয়া আমরা-ই।
এই কথা বুঝে ওঠার কোনও উপায় নেই কারণ গুগলের স্নিগ্ধ সাদা ওয়েবপেজে যা কিছু খুঁজে পেতে চাই, আঙুলের ছোঁয়ায় নিমেষে তা হাতের কাছে পাই। আর ফেসবুক তো আমাদের একাকিত্বের বহুদিনের সঙ্গী। আমাদের বন্ধু, প্রিয়জনের সুখ-দুঃখের খবর, বইমেলার নতুন বই, রেস্টুরেন্টে নতুন খাবার, বিবাহবার্ষিকী, ডিভোর্স থেকে কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির সমস্ত খবর তো ফেসবুকেই পাওয়া যায়। অতএব সোশ্যাল মিডিয়ার এই রোমাঞ্চকর ইকো-সিস্টেমে আমাদের কখনোই মনে হয় না বিশ্বের সবচেয়ে ধনী প্রযুক্তি সংস্থাগুলি আসলে নিজেদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতায় নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র আমাদের মনোযোগ ছিনিয়ে নেওয়ার একমাত্রিক লক্ষ্যে। গুরুত্বপূর্ণ যাবতীয় সমস্ত কাজ দূরে সরিয়ে দিনরাত মানুষ কেবলই তাদের একান্ত ব্যক্তিগত টাইমলাইনে ডুবে থাকুক, ফেসবুকের মালিক মনেপ্রাণে তেমনটাই চান। একই কথা প্রযোজ্য প্ল্যাটফর্ম-পুঁজিবাদের অন্তর্গত সমস্ত প্রযুক্তি সংস্থার নিজস্ব আকাঙ্ক্ষার সাজানো বাগানে। আমাদের সময় যে যত বেশি ছিনিয়ে নিতে পারে, মুনাফা বাড়ানোর ইঁদুরদৌড়ে সে তত বেশি এগিয়ে। ইন্টারনেটে উপলব্ধ সমস্ত পরিষেবাই বিনা পয়সায় পাওয়া যায় এবং আসল খেলা এখানেই। কথায় আছে, ‘if you are not paying for the product, then you are the product.’।
সঠিক সময়ে সঠিক বিজ্ঞাপনটি যদি সঠিক মানুষটির সামনে তুলে ধরা যায় তবে বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত পণ্যটি বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সঠিক সময়ে, সঠিক মানুষটির মানসিক অবস্থা প্রায় নির্ভুলভাবে খুঁজে বার করার দায়িত্বে থাকে অ্যালগরিদম। অ্যালগরিদমটির দরকার কাঁচামাল। এই কাঁচামালই হল আমাদের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক বা খুব ব্যক্তিগত ফেসবুক পোস্ট, উল্লাস-বিষাদের ইন্সটা ছবি, উইকেন্ড ট্রিপের ইউটিউব ভিডিয়ো, ক্যাজুয়াল টুইট, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তুমুল তর্ক, অফিশিয়াল ই-মেল জাতীয় যাবতীয় তথ্য— বিনা পয়সায় যা আমরা প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে সরবরাহ করে থাকি। আমাদের মনোযোগ হস্তগত করে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে আটকে রাখার সে কারণেই এত মহার্ঘ আয়োজন। আমি এবং আমার মনোযোগই হল সবচেয়ে মূল্যবান প্রোডাক্ট। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত কম্পিউটার বিজ্ঞানী Jaron Lanier চমৎকার ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘ it’s the gradual, slight, imperceptible change in your own behaviour and perception that is the product.’
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর যুগে মানুষের চাহিদা বুঝে এখন আর পণ্য উৎপাদন করা হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আদপে অপ্রয়োজনীয় সব পণ্য উৎপাদন করা হয়, তারপর সেই পণ্যকে ঘিরেই নির্মাণ করা হয় মানুষের চাহিদা। সেই পণ্যের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কেবলমাত্র চাহিদা নির্মাণ করাই যথেষ্ট হয় না; সবচেয়ে কম সময়ে, সবচেয়ে কম খরচে, সর্বোচ্চ মুনাফা পেতে মানুষের চাহিদা, তার মনোভাব, আকাঙ্ক্ষা, তার ব্যক্তিত্বকে পর্যন্ত সামান্য হলেও বদলে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। এই বদলে দেওয়ার কাজটি করে ফেসবুক, গুগল, টুইটারের জিম্মায় থাকা বেতনভুক ডিজিটাল শ্রমিকদের তৈরি জটিল অ্যালগরিদম সমৃদ্ধ বিজনেস মডেল। একটি বিজ্ঞাপনকে সামনে আনার সঙ্গে সঙ্গেই পণ্যটির বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনাকে একশো ভাগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিজেদের বিজনেস মডেলগুলিকে আরও বেশি নিখুঁত করে চলেছে প্রযুক্তি সংস্থাগুলি। কারণ এখানেই যে সোনার খনি। বিলিয়ন ডলারের ব্যবসাকে ট্রিলিয়ন ডলার ব্যবসায় পৌঁছে দেওয়ার অনন্য চাবিকাঠি। এই ব্যবসা খনিজ তেল কিংবা অ্যান্টিবায়োটিককে ঘিরে নয়, আমাদের চোখের সামনে প্রত্যেক মুহূর্তেই বাণিজ্যিক লেনদেন ঘটে চলেছে আমাদের মনন, বিশ্ববীক্ষা, আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে অভূতপূর্ব এক বিশৃঙ্খলার সামনে দাঁড় করিয়ে। যেহেতু মানুষকে বাজি রেখেই এই ব্যবসা তাই এই কাজে দরকার হয় মানুষের যাবতীয় লেনদেনের পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিনাটি তথ্য। পাঁচশো তিরিশ কোটি মানুষের পর্বতপ্রমাণ তথ্যেই সেজে ওঠে কৃত্রিম বুদ্ধির সমস্ত অ্যালগরিদমগুলি। প্রত্যেক আলাদা মানসিক গঠনের মানুষেরই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করার আলাদা বিন্যাস রয়েছে।
অ্যালগরিদমের কাজই হল প্রত্যেকটি মানুষের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করার এই নকশাটিকে রপ্ত করা। কোন মানসিকতার মানুষ কোন ধরনের ছবি আপলোড করছে, কী ধরনের ভিডিয়ো রিলস দেখছে, কতক্ষণ ধরেই বা দেখছে, এই প্রাত্যহিক অনলাইন কর্মকাণ্ডের খুঁটিনাটি যা মানুষের বোধগম্যতার অনেকটাই বাইরে, তার সবই ধরা পড়ে যায় নজরদারির আওতায়। অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় যে ধরনের পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মানুষ অবসাদ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে, তা আহ্লাদে আটখানা হয়ে খুঁজে বেড়ানো পণ্যের থেকে চরিত্রগত ভাবে আলাদা হবেই। অতএব আমাকে টার্গেট করে, আমার মানসিক অবস্থা বুঝে, পণ্যটিকে আমার সামনে বিজ্ঞাপনে সাজিয়ে তোলা হলে পণ্যটির বিক্রির সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়। ব্যবসায় মুনাফা বাড়াতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন নতুন কিছু নয়। টেলিভিশনেও আমরা বিজ্ঞাপন দেখতাম কিন্তু টিভির পর্দায় যা দেখানো হত তা সকল দর্শকের কাছে ছিল একই রকম এবং তার চেয়েও বড় কথা, টেলিভিশনের কোনও নজরদারির চোখ ছিল না। নিউজ ফিডে অবিরাম বিশেষ ধরনের বিজ্ঞাপন দেখে ক্রমাগত আসক্ত হয়ে পড়ে, আচরণগত পরিবর্তনও আমার মধ্যে দেখা দিত না টেলিভিশনের দৌলতে। অ্যালগরিদম আমাদেরকে ক্রমাগত আসক্ত করে তোলে স্মার্টফোনে, নিজের এবং অপরের টাইমলাইনে, ইনস্টাগ্রামে, ডোপামিন-ঘন টিকটক ভিডিয়োতে। বিপুল পরিমাণ ডেটা এবং তথ্যকে হাতিয়ার করে প্রযুক্তি সংস্থাগুলি নিজেদের বিজনেস মডেলকে আরও বেশি বলিষ্ঠ করে তোলে যাতে সহজেই আমাদের আগামী পদক্ষেপগুলি আগেভাগেই বুঝে নেওয়া যায়। ভবিষ্যৎবাণীর এই খেলায় যার বিজনেস মডেল যত বেশি দক্ষ, ডিজিটাল দুনিয়ায় সেই হল বাদশা। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই হোক বা অপরকে নিজের পোস্টে ট্যাগ করে, লক্ষ্য কিন্তু স্মার্টফোনের স্ক্রিনে আমাদেরকে মজিয়ে রেখে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মুনাফা লুটে নেওয়া।
একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্নতা, সরকার আরোপিত পলিসি বা প্যান্ডেমিকের প্রভাব, যে কারণেই হোক, অনলাইন যোগাযোগ ছাড়া একুশ শতকের দুনিয়ায় প্রায় সকলেই অচল। অতএব ক্রমে আরও বেশি বাধ্যতামূলক এবং অপরিহার্য হয়ে ওঠা অনলাইন লেনদেনের প্রাত্যহিকতায় নিশ্চিত করে বলা যায়, অ্যালগরিদমের সুতোয়, প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাদের মুঠোয় আমাদের এই পুতুলনাচও হয়ে উঠছে একই সঙ্গে বাধ্যতামূলক এবং অপরিহার্য। অ্যালগরিদমকে ভিত্তি করে এই প্রযুক্তি মূলত আমাদেরকে প্ররোচিত করে। দীর্ঘদিনের প্ররোচনায় শরিক হয়ে আমাদের মধ্যে জন্ম নেয় নতুন প্রবৃত্তির। প্রাথমিক স্তরে বিচিত্র সব কৌতুহল নির্মাণ, তারপর কৌতুহলবশত শুরু হয় আমাদের অবিরাম স্ক্রোলিং। এই প্রক্রিয়ার বন্দিদশায় আমাদের মস্তিষ্কের গভীরতম অঞ্চলকে প্রোগ্রাম করে ফেলা হচ্ছে। আমরা নতজানু হয়ে পড়ছি আমাদের বদলে যাওয়া মস্তিষ্কের নতুন সব প্রবৃত্তির ম্যাজিকাল ক্ষমতায়। এই প্রবৃত্তি মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়, সহযোগিতামূলকও নয়— অমানবিক এবং সময়সাপেক্ষ হলেও আখেরে কিন্তু ধ্বংসাত্মক!
ফেসবুক-কেই যদি উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায়, উদ্ভাবনী কৌশলে এই প্রযুক্তি সংস্থার সত্যিই জুড়ি নেই। বন্ধুর করা একটি পোস্ট, অর্থহীন হোক বা অর্থনৈতিক, হাজারো পোস্টের ঘনঘটায় তা হারিয়ে যেতেই পারে। কিন্তু ট্যাগ করা কিংবা হালের @highlights, @followers, @everyone-এর নতুন চালে আমরা সকলেই মাত। নিজেরাই নিজেদের কান ধরে স্মার্টফোনে নিজেদেরকে মজিয়ে রাখতে অপরের মনোযোগকে আমরা নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে নিই। ট্যাগ, কিংবা অমুক ‘mentioned you’-কে আমরা পাত্তা না দিয়ে থাকতে পারি না। সাতসকালে আমার টাইমলাইনে আমি দেখতে পেলাম আমারই এক বন্ধুর উজ্জ্বল মুখ, ছবিতে সে আলাস্কায় স্কিইং করছে, কিংবা মিলিটারি পোশাকে আধুনিক বন্দুক হাতে আড়চোখে সে তাকিয়ে হিরোইক পোজে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপারটি হল, সৌন্দর্যের যে সংজ্ঞায় আমাদের মনন আক্রান্ত, তার সঙ্গে শতভাগ সাযুজ্য রেখেই আমার বন্ধু হয়ে উঠেছে শতগুণ সুন্দর। ঠিক তখনই আমার হাত নিশপিশ করে ওঠে। মাত্র একটা ক্লিকে আমিও হয়ে উঠতে পারি সিন্থেটিক দুনিয়ার রাজকন্যা বা রাজকুমার। সেই চেহারায় আমার চোখ-নাক-গাল-ঠোঁট থেকে সমস্ত খুঁত সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অ্যালগরিদমের জাদুতে আমাকে এখন সেলুলয়েডের হিরো বা হিরোইনের মতোই দেখায়।
তারপর অজস্র লাইক এবং কমেন্ট আমার ফেক ছবিটিকেই যেন বাস্তবায়িত করে তুলবে। ফেসবুকের দরকার বিশেষ কিছু ডেটা কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন অ্যাপটিকে সংস্থাটি পরীক্ষা করতে চায়। ঠিক কতটা উত্তেজক দেখায় ওই অ্যাপটির মধ্যে দিয়ে ফিল্টার করা আমাদের বাস্তব চেহারা। এই প্রক্রিয়ায় কেবলমাত্র সামাজিকভাবেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি না, আয়নায় নিজের চেহারা, নিজের বাস্তবিক অস্তিত্ব থেকেও দূরে সরে যেতে চাই। অপরের চোখে নিজেকে সুন্দর প্রতিষ্ঠা করার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় অ্যাপটি ক্রমশ ভাইরাল হয়ে ওঠে। একের পর এক মানুষ, সিংহভাগ মানুষ, কোনও ভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না আকর্ষণীয় সেই বন্ধুর ছবিটির নীচে সঠিক রঙে, সঠিক ফন্টে, সঠিক জায়গায় রাখা বাটনটি— ‘Tap to Play’। আমরা হয়ে উঠি আপাদমস্তক প্রোডাক্ট। বাস্তবে আবার নিজেদেরকে বিক্রি করি। অন্তর্যামী অ্যালগরিদম তখন মুচকি হাসে, ভার্চুয়ালি!
তথ্যঋণ:
১. https://www.axios.com/sean-parker-unloads-on-facebook-2508036343.html