আলোর উৎসব
সবচেয়ে ভাল লাগত তারাবাজি। আজ অবশ্য জানি না, এই নামের সঙ্গে কতজন পরিচিত, বিশেষত আজকালকার কচিকাঁচারা। তখন এর দু’খানা নামই রমরমিয়ে চলত— তারাবাজি আর ফুলঝুরি। তারাবাজি নামটা আমার নিজের কেন যে একটু হলেও বেশি ভাল লাগত, তা আজ আর মনে নেই। কিন্তু মানতে হবে, ফুলঝুরি নামটিও বেশ। সরু লিকলিকে একখানা ধাতব ডাঁটি, লোহারই হবে, তার মাঝখান থেকে মাথা পর্যন্ত বারুদের বেশ একখানা প্রলেপ। মোমের দপদপে শিখার মধ্যে কিছুক্ষণ ধরে রাখলেই এক ঝটকায় তার যে জ্বলে ওঠা, আর যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে, তার ওই রোগাটে শরীর থেকে আলোর ছোট বড় ফুলকি ছিটকে বেরনো, এ-দৃশ্যের কোনও তুলনা ছিল না। কখনও মনে হত আগুনের ফুল, কখনও মনে হত ঝলমলে তারা। তাই দুটো নামই সার্থক— ফুলঝুরি আর তারাবাজি।
কালীপুজোর আগে আগে আমাদের ছোট্ট মধ্যবিত্ত পাড়াটা তলায় তলায় বেশ তেতে উঠত। এদিক-ওদিক অস্থায়ী টেবিল পেতে শুরু হত হরেক রকমের বাজি বিক্রি। কারও হয়তো বইয়ের দোকান, কেউ চালান মুদিখানা। কিন্তু কালীপুজোর দশ দিন আগে থেকে সকলের দোকানের বাইরেই বাজির ছোটখাটো সম্ভার। আর তখন বই হোক বা মুসুর ডাল, সবকিছুর চেয়ে বাজি বিক্রি হত বেশি। আমাদের, যাদের বাবা-মায়ের সামর্থ্য সীমিত, তাদের একটু অপেক্ষা করতে হত শেষ অবধি। হয়তো কালীপুজোর আগের দিন কিছু বাজি বাড়িতে এল, তাও গোনাগুনতি। কিন্তু আমরা এটা জানতাম, শেষমেশ কালীপুজোর সন্ধে থেকে বোঝাই যাবে না, কার বাড়ির বাজি কোনটা। কেননা আমরা খুদেরা আর বড়রা এক জায়গায় জড়ো হব, জড়ো হবে আমাদের যার যার বাড়ির বাজিও। তারপর যে যেমন পারো, পোড়াও। মিশে গেলে মালিকানা কোনও দিনই আলাদা করা যায় না। সে বাজিই হোক, আর মানুষ!
তা যা হোক, পাড়ায় দু’চারজন কাকা জ্যাঠা থাকতেনই, যাঁরা পাড়ায় হুট করে গজিয়ে ওঠা বাজির দোকানগুলোকে বিশেষ পাত্তা দিতে চাইতেন না। আমরা জানতাম, তাঁরা নুঙ্গি বলে কোনও একটা জায়গায় যাবেন, বা যাবেন চম্পাহাটি। সেখানে কত শস্তায় কত ভাল বাজি বিক্রি হয়, সে-গল্প আগেও বহুবার শুনেছি। তাঁদের কেনা তুবড়ি হয়তো আমাদের তুবড়িদের চেয়ে দু’ফুট বেশি ফুলকির ফোয়ারা ছোটায়, কিন্তু আমাদের বাবা-মা বা কাকা-জ্যাঠা কোনও দিনই নুঙ্গি বা চম্পাহাটি গিয়ে উঠতে পারেননি। বরং তাঁদের দৌলতে পাড়ার নানা দোকান একটু ঝলমলিয়ে উঠত ওই হিমেল মরসুমে।
পুজোর আগের দিন আমাদের টুকটাক বাজি কেনা শুরু হত। তাও সে একা-একা নয়। বাবা বা পাড়ার কোনও দাদার সঙ্গে বাজির দোকানে গিয়ে তবেই। সব মিলিয়ে বরাদ্দ হয়তো তিরিশ টাকা, তার মধ্যেই বেছেবুছে নিতে হবে। তবে বাজির ব্যাপারে আমরা বেশ একটা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিতাম। খবর থাকত, টুম্পা আর পুশকান এবার চরকি কিনেছে অনেক, দীপ আর রাজাদের তুবড়ির স্টক ভালই, ওদিকে পিন্টুদা ধানিপটকা আর রকেটের জোগান রেখেছে। অতএব ওসব বেশি না কিনলেও চলবে। আমি তাহলে এ-বছর কী কিনব? তারাবাজি কয়েক প্যাকেট তো নিতেই হবে, হাতখানেক লম্বা ফুলঝুরি, যেগুলোয় বড় বড় ফুলকি ছোটে, সেও কয়েকটা নিলে মন্দ হয় না। আর অবশ্যই নিতে হবে ইলেকট্রিক তার। হ্যাঁ, এই নামেই তার খ্যাতি ছিল তখন, এখন তো চারপাশে আর তেমন দেখি না তাকে। সরু লম্বা তার, তাকে গুটিয়ে ভাঁজ করে জুতোর ফিতের মতোই বেঁধে পেশ করা হত পাশাপাশি রেখে, ছোট ছোট বাক্সে। বাইরে লাল-নীল ডোরাকাটা কাগজের পোশাক, ভেতরে চকমকি বারুদ। খুলে নিলেই সে চারহাত লম্বা এক তার, গোড়ায় দেশলাই ধরলেই ঝকমক করে পুড়তে শুরু করবে। ওইটুকু তারের মধ্যে এত আলো কীভাবে পোরা থাকত, এই ভেবেই বিস্ময় হত। তা সেই বিস্ময় ঝালিয়ে নেওয়ার জন্যেই ইলেকট্রিক তার আমাকে কিনতেই হবে। আর হ্যাঁ, অবশ্যই রংমশাল। সেও ছিল আমার খুব প্রিয় এক বাজি। সোনালি রাংতায় তার শরীর মোড়া, মুখের কাছটায় গাঢ় নীল কাগজ দেওয়া। আগুনে ধরলে কী আশ্চর্য উজ্জ্বল এক সোনালি-গোলাপি আলো ছিটকে বেরোত, সেইসঙ্গে চারপাশ ঝাপসা করা ধোঁয়া। সুতরাং তাকেও রাখতে হবে টিমে। নইলে খেলা জমবে কী করে?
খেলার আগে অবশ্য প্রস্তুতি আছে অনেক। তার মধ্যে একখানা হল বাজি রোদে দেওয়া। বিশেষ করে তুবড়ি, চরকি, হাউই, এদের তো রোদে একটু দিতেই হত। তারপর বিকেল-বিকেল হাওয়া ঠান্ডা হওয়ার আগেই তাদের ছাদ থেকে নামিয়ে আনা। বাজি পোড়ানোর আগে আরেকখানা পর্ব থাকত, যেটা আমার খুব ভাল লাগত। সেটা হল, সব বাড়ির জানলায়, বারান্দায়, ছাদের আলসেয় মোমের আলো জ্বলে ওঠা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, যেন সারা পাড়া জরি আর চুমকি বসানো পোশাক পরেছে সন্ধেবেলায়। তখনও এত রকম টুনিআলোর চল হয়নি। ছোট, সরু, সাদা মোমগুলোই জ্বলে উঠত। বেশিক্ষণ তাদের আয়ু নয় জেনেও গোটা পাড়াকে মায়াময় করে তুলতে তারা পিছপা হত না।
সেইসব সন্ধেগুলোয় একটু তাড়াতাড়িই শীত পড়ত। অন্তত হিম তো পড়তই। তাই আমাদের গায়ে হালকা হাতকাটা সোয়েটার বা পাতলা একখানা চাদর কিছু বিস্ময়ের ছিল না। সেইসব চাপিয়ে অন্ধকার একটু জমে উঠলে শুরু হত বাজি পোড়ানো। আমরা ছোটরা দল বেঁধে থাকতাম ঠিকই, কিন্তু সে-দলের এক বা দুজন বয়স্ক লিডার থাকতেই হত। বাজির মতো ব্যাপার, আগুনের মতো দুরূহ বিষয়, ছোটদের তো একা ছাড়া যায় না! তাই কারও ছোটকাকা, কারও মেজদা, কারও পিসতুতো দিদি, এই গোছের কেউ না কেউ ঠিক জুটে যেত। যে ঠিক করত রকেটের বোতল কোন পাঁচিলে বসানো হবে বা তুবড়ি রাস্তার মাঝখানে রাখা হবে কি না। বাকি কোন অর্ডারে পুড়বে, মানে চরকির পর রংমশাল না ফুলঝুরি, সেটাও এই লিডাররাই ঠিক করত। এমনকী কখন ইন্টারভাল হবে— আমরা একটু যার-যার বাড়িতে গিয়ে জল খেয়ে আবার হাজির হব, সে-সিদ্ধান্তও তাদেরই। কিন্তু সেসব মেনে নিতে আমাদের কোনও অসুবিধে ছিল না। বরং সারাবছর নিভে থাকা একখানা ছোট্ট পাড়া যে এক সন্ধের জন্য এমন ঝলমলিয়ে উঠছে, আর তার সেজে ওঠায় আমরাও শামিল, এইটা ভেবেই আমাদের মন ভাল হয়ে যেত।
আজ আর সেরকম শীত পড়ে না এই সময়টায়। কিন্তু টের পাই, নিজের ভেতরটা অনেক বেশি ঠান্ডা হয়ে গেছে; সেখানে প্রায় সারা বছর শীত। তুন্দ্রা অঞ্চল। সেখানে স্লেজগাড়ি চলে বরফের উপর দিয়ে, একটু রোদ উঠলে চিকচিক করে ওঠে চারদিক, আর রাতের জমাট ঠান্ডায়, বহু দূরের গ্রহ থেকে, স্মৃতি থেকে, ছোটবেলা থেকে কেউ ফানুস উড়িয়ে দিলে, মনে হয় উল্কা…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র