কুঠারে রক্তের দাগ
বুয়ুকাদা, বড় দ্বীপ। মর্মর সাগরের মধ্যে মাথা তুলে রয়েছে, পুরনো ইস্তানবুলের ফেরিঘাট থেকে নৌকো ধরলে ঘণ্টা দুয়েক সময় তো লাগবেই এ-দ্বীপে পৌঁছতে। অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানজাদা, মন্ত্রী-সেনাপতি, বিশিষ্ট উদ্যোগপতি, মোটের ওপর রইস আদমিদের বড়-বড় প্রাসাদ রয়েছে এ-দ্বীপে। সেসব প্রাসাদের লাগোয়া বাগানে গাছভর্তি কমলালেবু, দূরে তাকালে সবুজ পাতা আর কমলা ফলের তাক লাগানো যুগলবন্দির মধ্যেই নীলের হাতছানি। ভূমধ্যসাগরীয় আকাশ আর মর্মর সাগরের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা এখানে অবিরাম। বাবু-বিবিরা সুযোগ পেলেই জুড়িগাড়িতে চড়ে বসে এক পাক চক্কর দিয়ে আসেন। মিনিট চল্লিশ থেকে একঘণ্টা লাগবে। রোলস রয়েস হোক কি স্টুডেবেকার, ক্যাডিলাক হোক বা ফোর্ড— কোনো চারচাকার-ই এখানে দেখা মিলবে না। এ-দ্বীপে এককালে ছিল ধনাঢ্য গ্রিকদের বসবাস, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সেসব সম্পত্তি চলে যেতে শুরু করেছে তুর্কিদের হাতে। আর সে-সময়ে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা প্রভূত সাহায্য পেয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে। সোভিয়েত এবং তুর্কি নেতাদের তখন গলায়-গলায় দোস্তি না হলেও ঘনিষ্ঠতা যথেষ্টই ছিল।
সেই ঘনিষ্ঠতার কারণেই কি বুয়ুকাদায় ইজ্জত পাশার ভেঙে পড়া প্রাসাদে এসে উঠেছেন রাশিয়ান নেতা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে-খুঁজতেই বাবু-বিবিদের জুড়িগাড়ি সফর শেষ হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ১৯২৯-এর ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই বুয়ুকাদা এবং ইস্তানবুলে এ-প্রশ্ন নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। রাশিয়ান মানুষটিকে অবশ্য পারতপক্ষে ইজ্জত পাশার প্রাসাদের বাইরে দেখা যায় না, শোনা যায় তিনি লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। শুধু কাকভোরে তিনি মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়েন দ্বীপের জেলেদের মাছ ধরা দেখতে। কী লেখেন সে-নিয়েও মানুষজন ওয়াকিবহাল নন। কখনও-সখনও দেখা যায় সে-বাড়িতে বিদেশি সাংবাদিকদের আনাগোনা চলছে।
ইজ্জত পাশার প্রাসাদের অধিবাসী মানুষটি যে আসলে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে নির্বাসিত, সে-খবর জানতেন না বহু বিশিষ্ট তুর্কিও। বলশেভিক আন্দোলনের সাফল্যের পর প্রায় দেড় দশক কেটে গেছে। ভ্লাদিমির লেনিনের উত্তরসূরি কে হতে পারতেন, সে-নিয়ে জল্পনা-কল্পনারও অবসান হয়েছে বহুদিন। জোসেফ স্টালিন এমন বজ্রমুষ্টিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন শাসন করে চলেছেন যে, লেনিনের মৃত্যুর পাঁচ বছরের মধ্যেই লেনিনের আদর্শগত রাস্তাটি ঠিক কী ছিল তা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ ভুলতে বসেছিলেন। সেখানে মস্কো থেকে হাজার মাইল দূরে ইস্তানবুল শহরে যেখানে কমিউনিজম এবং কমিউনিস্ট নিষিদ্ধ, মানুষ যে লিওন সেদভ নামক রাশিয়ান মানুষটিকে নিয়ে প্রায় কিছুই জানবেন না, তাতে আর সন্দেহ কী! লিওন সেদভ অবশ্য ছদ্মনাম, শুধুমাত্র তুর্কি গোয়েন্দা অফিসার এবং হাতে গোনা কিছু বিদেশি সাংবাদিক জানেন তাঁর আসল পরিচয়। তাঁরা এও জানেন, লেনিনের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্ণধার হওয়ার কথা ছিল এই মানুষটিরই। শিক্ষিত মানুষদের পলিটবুরো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে বসাতে গিয়ে যিনি ভরসা হারিয়েছিলেন নিম্নবর্গের, প্রথাগত শিক্ষাহীন মানুষের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের। জোসেফ স্টালিন সেখানেই বাজিমাত করে বেরিয়ে যান। ফলত বুয়ুকাদার ধ্বসে পড়া বাড়িটিতে সেই প্রবাদপ্রতিম নেতাকে বসে আত্মজীবনী লিখতে হচ্ছে। এবং শুধু আত্মজীবনীই নয়, তিনি লিখবেন রাশিয়ান বিপ্লবের ইতিহাসও। আর এর পাশাপাশিই নিয়তিও লিখছে আর এক করুণ ইতিহাস— সে-আখ্যান অবশ্য শুধুই পারিবারিক। স্টালিন ততদিনে জানিয়ে দিয়েছেন জীবদ্দশায় মানুষটির পরিবারের বাকি সদস্যরাও রাশিয়ায় ফিরতে পারবেন না। শুনে বিষম মানসিক অবসাদে আত্মহত্যা করেছেন তাঁর বড় মেয়ে। চার বছর আগে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মানুষটির ছোট মেয়ে যখন মারা যাচ্ছিলেন, পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এই বড় মেয়েই। বাবার অনুপস্থিতিতে সেই দুর্বিষহ সময়ের কথা আত্মহত্যার দিন অবধি তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
বুয়ুকাদায় যখন ট্র্যাজেডির ঘনঘটা, প্রায় সেই সময়েই স্পেনে তৈরি হচ্ছিল এক প্রবল রাজনৈতিক সংঘর্ষের প্রেক্ষিত। বামপন্থী কর্মী এবং শ্রমিকদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দলের কর্মী-সমর্থকদের বিরোধের মধ্যে দেখা যাচ্ছিল আসন্ন গৃহযুদ্ধের পূর্বাভাস। রামোন মারকাদের নামের স্প্যানিশ তরুণটি ফ্রান্স থেকে সদ্য মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হয়ে ফিরেছেন। অবশ্য ফ্রান্সে যাওয়ার বহু আগে থেকেই তাঁর কিউবান মা’র থেকে তিনি বামপন্থী আদর্শের কথা জেনেছেন, নিজের পড়াশোনার দরুন বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন বলশেভিক বিপ্লবের ইতিহাসে। রামোনের মা আবার ছিলেন স্টালিনের অন্ধ ভক্ত। এ হেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা না পেলে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে বামপন্থীদের জেতা মুশকিল, এরকম এক ধারণা ছিল রামোনের মা’র। তিরিশের দশকে স্পেনে স্টালিনিস্টদের সংখ্যা যে খুব বেশি ছিল, তা নয়। অধিকাংশ বামপন্থী নেতা এবং কর্মী মনেপ্রাণে মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী, এবং বিশ্বাস করতেন স্টালিনের নীতি নেহাতই একনায়কতান্ত্রিক। রামোনের মা সেখানে যথার্থই ব্যতিক্রম, এবং নিজের উদ্যোগেই তাঁর কমরেডদের মধ্যে স্টালিনিজমের প্রচার চালাতে পিছপা হননি। স্বাভাবিক ভাবেই স্পেনে উপস্থিত রাশিয়ান এজেন্টদের নজর রামোনের মা এবং তাঁর ছেলের ওপর পড়ে। স্টালিনের রাজনীতিতে দেশজ সহকর্মীদের আনুগত্য তাঁদের জীবনরক্ষার চাবিকাঠি। কিন্তু বিদেশিদের ক্ষেত্রে স্টালিন পুরস্কার দিতে কার্পণ্য করেননি। তাই স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ শুরু হতে-না-হতেই মা এবং ছেলেকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল মস্কোয়। মা’র হাতে তুলে দেওয়া হল লেনিন অর্ডার, সাহসিকতার শ্রেষ্ঠ সোভিয়েত সম্মাননা। আর ছেলে? তাকে নিয়ে যাওয়া হল গোয়েন্দা পুলিশের সদর দপ্তরে। অবশ্য গোয়েন্দাগিরি আর নজরদারি এক্ষেত্রে সমার্থক!
১৯৩৭ সালের শেষে রামোনকে আবার দেখা গেল ফ্রান্সে। কিন্তু স্বনামে নয়, সোভিয়েত এজেন্টদের তৈরি করে দেওয়া পাসপোর্টে তার নাম তখন জাক মরনার্ড। অনতিবিলম্বে জাককে দেখা গেল মার্কিনি তরুণী সিলভিয়া অ্যাগেলফের সান্নিধ্যে। সিলভিয়া তখন ফ্রান্সের বামপন্থীদের মধ্যে চেনা মুখ। যদিও সিলভিয়ার আদর্শগত আনুগত্যে স্টালিনের হক নেই, হক আছে স্টালিনের মুখ্য শত্রুর। হ্যাঁ প্রিয় পাঠক, আপনি ঠিকই ধরেছেন— সিলভিয়ার আনুগত্য লিওন সেদভের প্রতি। যদিও ততদিনে সেদভ ইস্তানবুল ত্যাগ করেছেন, ত্যাগ করেছেন তাঁর ছদ্মনামও। ইস্তানবুল ছেড়ে ফ্রান্স, নরওয়ে ঘুরে শেষমেশ আশ্রয় পেয়েছেন দূরের দেশ মেক্সিকোতে। রাশিয়ান এজেন্টদের শত চোখরাঙানিতেও মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ভয় পাননি, সাদরে বরণ করে নিয়েছেন লিওন সেদভ নয়, লিওন ট্রটস্কিকে। সেই ট্রটস্কি, যাকে রাশিয়ার রাজপরিবার চিহ্নিত করেছিল বলশেভিকদের মধ্যে নিষ্ঠুরতম নেতা হিসাবে, যাকে খোদ লেনিন দুষেছিলেন পার্টির মধ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার জন্য, যাকে স্টালিন মনে করতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক। কিন্তু স্টালিনের আগ্রাসী একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্য যে-সমস্ত বামপন্থী ছটফট করছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ট্রটস্কির মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন যোগ্য এক নেতাকে। যদিও সিলভিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী নিছক স্টালিন-বিরোধিতা নয়, ট্রটস্কির দেখানো বামপন্থার মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন রাজনৈতিক সার্থকতা। যে-পথ জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়নই বামপন্থা সাধনের একমাত্র পীঠস্থান হয়ে উঠতে পারে না, ‘মাস স্ট্রাগল’কে যথার্থ বিপ্লবের রূপ দেওয়ার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে রাজনৈতিক চেতনা।
রামোন মারকেদার ওরফে জাক মরনার্ড তাঁর নতুন অবতারে দেখা দিলেন ঘোর ট্রটস্কাইট হয়ে। যিনি সিলভিয়া অ্যাগেলফের কাছে ট্রটস্কিইজমের দীক্ষামন্ত্রে দীক্ষিত। এক বছর পর রামোন পাড়ি দিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সিলভিয়ার কাছে। এবারে তাঁর নাম ফ্র্যাঙ্ক জ্যাকসন। সিলভিয়াকে বলা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ খুব তাড়াতাড়িই ঘটতে চলছে, আমেরিকান কর্তৃপক্ষের সন্দেহ নিরসনের জন্য এই কানাডিয়ান পরিচয়টির নিতান্তই দরকার ছিল। সিলভিয়া ও ফ্র্যাঙ্ক মার্কিনি বামপন্থীদের মধ্যে ট্রটস্কির জনপ্রিয়তার কাজে নামলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ে আমেরিকার সন্দেহ তিরিশের দশক থেকেই তুঙ্গে। বামপন্থা নিয়ে ঘোরতর বিদ্বেষ, বামপন্থীদের খুঁটিনাটি কাজকারবার এফবিআইয়ের ফাইলে নথিবদ্ধ। সেখানে সিলভিয়া ও ফ্র্যাঙ্কের কাজ কতটা কঠিন ও বিপদজনক ছিল, সে-কথা আলাদা করে বলাটাই বাহুল্য। দু’বছর ধরে আমেরিকায় সে-কাজ চলল, মেক্সিকোয় ট্রটস্কির কাছে যে-খবর পৌঁছতে দেরি লাগেনি। তার এক বড় কারণ অবশ্য সিলভিয়ার বোন রুথ ছিলেন মেক্সিকোয় ট্রটস্কির ব্যক্তিগত সেক্রেটারিদের একজন।
চব্বিশে মে, ১৯৪০— ভোররাতের দিকে মেক্সিকোয় ট্রটস্কির বাড়ির নাইটগার্ডরা অবাক হয়ে দেখলেন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল একাধিক পুলিশি জিপ। কোনো বিপদবার্তা নিয়েই কি তাঁদের আগমন? ভাবতে-ভাবতেই প্রায় জনা কুড়ি পুলিশ নেমে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের হাতে মেশিনগান এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র। আধুনিক হলিউড সিনেমায় যেরকমটি দেখা যায়, ঠিক সেই ভঙ্গিতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে ট্রটস্কির বাড়ি কয়েকশো গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। মারা গেলেন কিছু দেহরক্ষী, বুলেট-বিধ্বস্ত বাড়ির বাসিন্দাদেরও একই হাল হয়েছে ভেবে আততায়ীরা বিদায় নিল। আশ্চর্যজনকভাবে ট্রটস্কি বেঁচে গেলেন, বেঁচে গেলেন পরিবারের বাকি সদস্যরাও। কয়েকদিনের মধ্যেই জানা গেল মেক্সিকান পুলিশ নয়, মস্কোর নির্দেশে পুলিশি উর্দি পরে এসেছিল রাশিয়ান এজেন্ট এবং মেক্সিকান ভাড়াটে খুনিরা।
ট্রটস্কির রাশিয়ায় ফেরা নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই ট্রটস্কি তাঁর লেখালেখির মাধ্যমে স্টালিনের অর্থনীতি এবং বিদেশনীতির প্রভূত সমালোচনা করছিলেন। স্টালিনের সঙ্গে তাঁর বিবাদ এক হিসাবে লেনিন বেঁচে থাকতেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু যে চরম সমালোচনা ট্রটস্কি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর শুরু করলেন, তা অভূতপূর্ব। তিনি জানালেন অশিক্ষিত, রুগ্ণস্বাস্থ্য শ্রমিকদের নিয়ে স্টালিন এক তাসের দেশ বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এবং সর্বোপরি কমিউনিজমকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সোভিয়েতপন্থী দেশগুলির কুক্ষিগত করে রেখে পশ্চিমি দেশগুলির কাছে ক্রমাগত জমি হারাচ্ছেন। ট্রটস্কিকে রাশিয়ার স্টালিনপন্থী বিদ্বজ্জনরা ফ্যাসিস্ট বলে ঘোষণা করলেন। তাঁকে বলা হল প্রতিবিপ্লবী, যিনি বিদেশে বসে রাশিয়ান বিপ্লবের ঐতিহ্যকে টুকরো-টুকরো করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ‘দ্য গ্রেট পার্জ’ খ্যাত স্টালিন, যিনি কথার সামান্য নড়চড়ে তাঁর ঘনিষ্ঠতম সহকর্মীর প্রাণ নিতেও পিছপা হন না, তিনি যে স্রেফ কাগুজে সমালোচনাতেই থেমে থাকবেন না তা বলা বাহুল্য। সারা পৃথিবী জানত ট্রটস্কি আদতেই ‘ডেড ম্যান ওয়াকিং’, কিন্তু মেক্সিকোর মতন দূর দেশে যেখানে স্টালিনের প্রভাব তুলনামূলক ভাবে কম, সেখানে এহেন অভিযান দেখে পশ্চিমে বেশ খানিকটা হইচই পড়ে গেল। নিউ ইয়র্কে বসে এ-খবর পেলেন সিলভিয়া এবং ফ্র্যাঙ্কও। সিলভিয়া তাঁর বোনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার পরিকল্পনা অনেকদিন ধরেই করছিলেন। ট্রটস্কির ওপর হামলার খবর শুনে আর দেরি না করে মেক্সিকো যাওয়া মনস্থির করলেন সিলভিয়া। বিশেষ উৎসাহ দিলেন ফ্র্যাঙ্ক জ্যাকসনও।
সিলভিয়া এবং ফ্র্যাঙ্কের কাজের খবর তো ট্রটস্কির কাছে ছিলই, তার সঙ্গে থাকলেন সিলভিয়ার বোন। ফলে মেক্সিকো পৌঁছে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সিলভিয়া ট্রটস্কি এবং তাঁর স্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। এবং সিলভিয়ার দৌলতে ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গেও বেশ ভালই আলাপ গড়ে উঠল ট্রটস্কির। তাকে হয়তো বন্ধুত্ব বলা যায় না কিন্তু তাত্ত্বিক আলোচনায় ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে সময় কাটাতে ট্রটস্কির আদৌ কোনো আপত্তি ছিল না। তাঁর ওপর হামলার আগে থেকেই স্টালিনকে নিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করছিলেন ট্রটস্কি। এই সময়েই ট্রটস্কি লিখছিলেন, বলশেভিক আন্দোলনের সময়ে স্টালিনের যা ভূমিকা তাকে নেহাত সুযোগসন্ধানী বললে অত্যুক্তি হয় না; মার্ক্সবাদের আদর্শগত ভিত্তিগুলি স্টালিন আদৌ বোঝেন কি না, সে-নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন ট্রটস্কি। যে-কারণে স্টালিনকে ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’ আখ্যা দেন তিনি। সম্ভবত স্টালিনকে নিয়েই ট্রটস্কি ও ফ্র্যাঙ্কের আলোচনা দীর্ঘায়িত হতে থাকে।
বিশে অগাস্ট, ট্রটস্কির ওপর মেশিনগান হামলার তিন মাসও হয়নি। রোদঝলমলে অপরাহ্নে ফ্র্যাঙ্ককে দেখা গেল রেনকোট পরে ট্রটস্কির বাড়িতে ঢুকছেন। অগাস্টের মেক্সিকোর জন্য বেশ অদ্ভুত পোশাকই বটে। ফ্র্যাঙ্ক চাইছেন ট্রটস্কির একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। রাজি হলেন ট্রটস্কি, ফ্র্যাঙ্ককে ডাকলেন নিজের স্টাডিতে। এর পর ঠিক কী হয়েছিল তা নিয়ে কিছু মতপার্থক্য আছে। কোনো গোয়েন্দা বলেন ট্রটস্কির পেছনে দাঁড়িয়ে ফ্র্যাঙ্ক যথাক্রমে বার করেছিলেন একটি রিভলভার, একটি ছোরা এবং একটি ছোট তুষার-কুঠার— যেরকমটি বয়স্কাউটের ছেলেরা ব্যবহার করত। কেউ বলেন তুষার-কুঠারটি যে ব্যবহার করবেন সেটা প্রথম থেকেই ঠিক ছিল, তাই একটিই মারণাস্ত্র বার করা হয়েছিল। ট্রটস্কির অজ্ঞাতসারেই, পিছন থেকে মাথায় পড়ল তুষার-কুঠারের বাড়ি। শোনা যায়, পরে দীর্ঘ জেরার সময়ে ফ্র্যাঙ্ক জানিয়েছিলেন, ট্রটস্কির মুখ থেকে দীর্ঘ আর্তনাদ শুনতে চেয়েছিলেন তিনি।
একুশে অগাস্ট স্টালিনকে আক্ষরিক অর্থেই বিরোধীশূন্য করে মারা গেলেন লিওন ট্রটস্কি। তার আগের দিন প্রহারে প্রায় অচৈতন্য ফ্র্যাঙ্ক জ্যাকসন ওরফে রামোন মারকেদারকে তুলে দেওয়া হয় মেক্সিকো পুলিশের আগে। প্রায় প্রথম থেকেই রামোন দাবি করতে থাকেন তিনি একজন ক্ষুব্ধ ট্রটস্কাইট মাত্র, ট্রটস্কির হাত থেকে ট্রটস্কিজমকে বাঁচাতেই এই হত্যাকাণ্ড। যেভাবে ট্রটস্কি শুধুমাত্র উদগ্র স্টালিন-বিরোধিতায় নিজের সমস্ত শক্তি সমর্পণ করেছিলেন, তাতে আর তাঁর ওপর ভরসা রাখা যাচ্ছিল না। মেক্সিকো পুলিশ শুরুতে সে-কথা বিশ্বাসও করে। এফবিআই আসরে না নামলে হয়তো রামোনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পূর্ণ যোগসূত্রটি জানাই যেত না। স্টালিনের আদেশে রাশিয়ান সিক্রেট সার্ভিস যে রামোনকে আততায়ী বানিয়েছিল, তার অকাট্য প্রমাণ পেতে দেরি হয়নি। জানা গেল মেশিনগান-হামলা এবং রামোন, এই দুটি প্ল্যানই ঠিক হয়েছিল একসঙ্গে। প্রথম হামলায় ট্রটস্কি বেঁচে যাওয়ায় রামোনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেক্সিকোতে পৌঁছতে হত। সিলভিয়ার সান্নিধ্য তাঁকে সেই সুযোগটি তৈরি করে দেয়।
কিন্তু রহস্য এখানেই শেষ নয়। মেক্সিকান গোয়েন্দারা তদন্তে নেমে দেখলেন এক বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়ে তৈরি হচ্ছে একাধিক ধোঁয়াশা। তিনি আর কেউ নন, সিলভিয়া অ্যাগেলফ। যিনি রামোন ধরা পড়ার পরে পরেই তাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় অস্থির হয়ে আত্মহত্যা করতে গেছিলেন। মেক্সিকান গোয়েন্দারা খোঁজ নিয়ে দেখলেন, একজন শিশু মনস্তত্ত্ববিদ হিসাবে সিলভিয়ার মাইনে ছিল মাসে একশো ডলারের কাছাকাছি। সংসার খরচ সামলে তিনি এই সামান্য টাকায় কীভাবে ঘন ঘন ইওরোপে যেতেন, সে-নিয়ে প্রশ্ন উঠল। আরও চর্চার পর প্রশ্ন উঠল, সিলভিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার কি কোনো যোগাযোগ আদৌ ছিল? বহু চাপাচাপিতে সিলভিয়া স্বীকার করলেন, তাঁর একাধিক আত্মীয় রাশিয়ায় থাকতেন। এও জানা গেল, তাঁর আরেক বোন হিল্ডা রাশিয়াতে গিয়ে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে এসেছেন। তদন্তে উঠে এল আরও এক গুরুত্বপূর্ণ খবর— নিউ ইয়র্কে থাকাকালীন রামোন সিলভিয়াকে তিন হাজার ডলার দিয়েছিলেন, যে-টাকা খরচ হয় তাঁদের মেক্সিকো ভ্রমণ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে।
মেক্সিকান গোয়েন্দারা সিলভিয়াকে জেলে পুরলেও চার মাসের মধ্যে সিলভিয়া মুক্তি পেয়ে যান। এফবিআই রিপোর্ট থেকে অনেক পরে জানা যাবে, সোভিয়েত সিক্রেট সার্ভিসের কাজকর্মের সুলুকসন্ধান জানার জন্যই তাঁকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নও চাইছিল না ট্রটস্কি হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনর্থক জলঘোলা হোক। উচ্চস্তরের গোপন বৈঠকে তাই ঠিক হয় ট্রটস্কি হত্যার যাবতীয় দায় চেপে বসবে শুধু এবং শুধুমাত্র রামোনেরই ওপর। আরও পরে সিক্রেট-সার্ভিস বিশেষজ্ঞরা দেখাবেন, রামোন প্রথম থেকে জানতেন না সিলভিয়া নিজেও একজন রাশিয়ান গুপ্তচর। ট্রটস্কি এতই গুরুত্বপূর্ণ শত্রু ছিলেন যে, সমস্ত রকম গোপনীয়তা রেখে চলতে হয়েছিল কেজিবিকে, তখনও অবশ্য কেজিবি কেজিবি হয়নি। পুরনো অবতারে তার নাম এন.কে.ভি.ডি.।
মেক্সিকোর জেলে দু-দশক কাটিয়ে রামোন ফিরে যান রাশিয়ায়। ততদিনে বদলে গেছে সোভিয়েত রাজনীতিপট। স্টালিনের পাপের থেকে যথাসম্ভব নিজেদের বাঁচাতে চাইছেন সোভিয়েত নেতারা। ফলে অর্ডার অফ লেনিন পেলেও রামোন থেকে গেলেন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এক বিদেশি কমিউনিস্ট হয়ে। নিউ ইয়র্কে সিলভিয়াও সারা জীবন কাটালেন এফবিআইয়ের নজরদারির মধ্যে। ‘দ্য গ্রেট পার্জ’, স্টালিনের ‘মহান’ শুদ্ধিকরণ যজ্ঞের দুই বিদেশি সহযোগী হয়তো জানতেও পারেননি, পাঁচশো থেকে সাতশো হাজার মানুষ মারা যাবেন প্রতিহিংসার আগুনে। এবং সেই লিস্টে সর্বপ্রধান নামটি লিও ট্রটস্কির।
আর ট্রটস্কির রক্তদাগওয়ালা কুঠারটি এখন দেখতে পাওয়া যাবে ওয়াশিংটন ডিসির ইন্টারন্যাশনাল স্পাই মিউজিয়মে। শোনা যায়, বহু হাজার বা মিলিয়ন ডলার দিয়ে সে-কুঠার সংগ্রহ করে আনা হয়েছে আমেরিকায়। ট্রটস্কির মৃত্যু, স্টালিনের সর্বগ্রাসী ক্রোধ নাকি এই মিলিয়ন ডলারের দ্রষ্টব্য। সর্ববৃহৎ ট্রাজেডি যে কোনটি, সে-প্রশ্নের উত্তর প্রিয় পাঠক আপনিই দিন!
ছবি সংগৃহীত